Beta
বুধবার, ১ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
বুধবার, ১ জানুয়ারি, ২০২৫

ফার্স্ট লেডিকে নিয়ে বিপাকে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইযুন সুক ইয়োল ও তার স্ত্রী কিম কেওন-হি ২০২৩ সালের ১২ ডিসেম্বর নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে। ছবি : রয়টার্স।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইযুন সুক ইয়োল ও তার স্ত্রী কিম কেওন-হি ২০২৩ সালের ১২ ডিসেম্বর নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে। ছবি : রয়টার্স।
[publishpress_authors_box]

ঠিক যেন কোরিয়ান ড্রামা সিরিয়াল। দৃশ্যে টান টান উত্তেজনা। ফার্স্ট লেডি দামি উপহার নিচ্ছেন এক যাজকের কাছ থেকে। গোপনে ধারণ করা ভিডিওতে যে যাজককে দেখা যায় তিনি উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার আবার একীভূত হোক, সেটা চান।

কিন্তু এটি টিভি সিরিয়ালের কোনও দৃশ্য নয়, দক্ষিণ কোরিয়ার বাস্তব ঘটনা। এটি রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বড় কেলেঙ্কারি হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ নিয়ে বিপাকে পড়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার রক্ষণশীল শাসকদল পিপল পাওয়ার পার্টি (পিপিপি)।

চটেছেন পিপিপির রাজনীতিকরাও। কারণ, আগামী ১০ এপ্রিল দক্ষিণ কোরিয়ায় জাতীয় নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হবে। সময় বাকি আছে দুই মাসের সামান্য বেশি। এই ঘটনা দলের প্রতি ভোটারদের আস্থা সংকট তৈরি হতে পারে।

এরই মধ্যে দেশটির মিডিয়ায় সমালোচনার বন্যা বইছে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়ুন সুক-ইয়োলের স্ত্রী কিম কেওন-হির বিরুদ্ধে। এক বছরেরও বেশি সময় আগে ফার্স্ট লেডিকে ফরাসি ব্র্যান্ড ডিওরের দামি একটি হ্যান্ডব্যাগ উপহার দিয়েছিলেন কোরিয়ান-আমেরিকান যাজক চোই জায়ে-ইয়ং, যিনি দুই কোরিয়ার একীভূতকরণের পক্ষে প্রচারণা চালান।

কমিউনিস্ট উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে চোইয়ের ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্ততার ইতিহাস রয়েছে। তিনি বেশ কয়েকবার দেশটিতে ভ্রমণও করেছেন। তখন পিয়ংইয়ংয়ের রাষ্ট্রীয় গীর্জাগুলোতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানও পরিচালনা করেন তিনি।

চোই বলেন, দুই কোরিয়া এক বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার বর্তমান প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলার জন্যই তিনি ফার্স্ট লেডি কিম কেওন হির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তার সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। এর ফলস্বরুপ ২০২২ সালে তারা একবার মুখোমুখি বৈঠকও করেন। এর কয়েকমাস আগেই কিমের স্বামী প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন।

চোইয়ের দাবি, ওই বৈঠকে তিনি কিমকে একবার ফোনে কারও সঙ্গে স্পর্শকাতর রাষ্ট্রীয় বিষয় নিয়ে কথা বলতে শোনেন। ওই কথপোকথনের ধরন দেখে শঙ্কিত হয়েই তিনি তাদের পরবর্তী বৈঠকের দৃশ্য গোপনে ভিডিও রেকর্ড করার সিদ্ধান্ত নেন। এর জন্য তিনি হাত ঘড়ির মধ্যে লুকানো একটি স্পাই ক্যামেরা ব্যবহার করেন।

দক্ষিণ কোরিয়ায় ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ কোনও ছেলেখেলা নয়। সাবেক রক্ষণশীল প্রেসিডেন্ট পার্ক গিউন-হেকেও দুর্নীতির জন্য অভিশংসনের মুখে পড়ার পর কারাবরণ করতে হয়েছিল।

কিমের সঙ্গে দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের সময় যাজক চোই তাকে ৩০ লাখ ওন (২,২৪০ ডলার) মূল্যের একটি ডিওর হ্যান্ড ব্যাগ উপহার দেন। চোইকে সেই ব্যাগ ও গোপন ক্যামেরা কিনে দিয়েছিল দেশটির বামপন্থী সংবাদ মাধ্যম ভয়েস অব সিউল। সংবাদ মাধ্যমটি ইযুন সরকারের কঠোর বিরোধিতার জন্য পরিচিত।

২০২২ সালের নভেম্বরের শেষদিকে ভয়েস অব সিউল তাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভিডিওটি প্রকাশ করে। ভিডিওতে দেখা যায়, ফার্স্ট লেডি কিম যাজক চোইয়ের সঙ্গে কথা বলছেন। এ সময় চোই কিমকে বলেন, তিনি তার জন্য একটি উপহার এনেছেন। তখন কিম বলেন, “আপনি কেন এমন জিনিস কিনলেন? দয়া করে এত দামি জিনিস কিনবেন না।”

তবে ভিডিওতে কিমকে ব্যাগটি নিজের হাতে নিতে দেখা যায়নি। অবশ্য ব্যাগটি তার সামনে টেবিলেই রাখা ছিল।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় চোই বলেন, দুর্নীতি সম্পর্কে জনগণের জানার অধিকারবোধ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই তিনি এই কাজ করেন। তার দাবি, তিনি কিমকে বৈঠকের আগেই জানিয়েছিলেন যে, তিনি তার জন্য ব্যাগটি নিয়ে আসছেন। কিন্তু কিম তাকে মানা করেননি বা পরেও ব্যাগটি ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করেননি।

তবে কোরিয়া হেরাল্ড জানিয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কার্যালয় ব্যাগটি গ্রহণের কথা নিশ্চিত করেছে এবং বলেছে যে, এটি সরকারের সম্পত্তি হিসেবে গণ্য ও সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

এই ঘটনার সম্ভাব্য আইনি প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে তা স্পষ্ট নয়। দেশটির দুর্নীতিবিরোধী আইনে কোনও সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রীর একবারে ১০ লাখ ওন (৭৪৮ ডলার) এবং বছরে ৩০ লাখ ওনের বেশি মূল্যের উপহার গ্রহণ নিষিদ্ধ। আর সেই উপহার অবশ্যই সেই সরকারি কর্মকর্তার দায়িত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে হবে।

তবে, যাজক চোইয়ের বিরুদ্ধেও চক্রান্তের অভিযোগ উঠেছে। প্রেসিডেন্ট ইযুন সুক-ইয়োলের সমর্থকরা বলছেন, নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য চোই এই নাটক সাজিয়েছেন।

দক্ষিণ কোরিয়ার দুর্নীতি দমন সংস্থা জানিয়েছে, তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। তবে আজ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট অফিস থেকে এ ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি।

দক্ষিণ কোরিয়ার ফার্স্টলেডি কিম কেওন-হিকে ঘিরে বিতর্ক এটিই প্রথম নয়। এর আগে তার বিরুদ্ধে পিএইচডি গবেষণায় অন্যের লেখা চুরি, সিভিতে ভুয়া তথ্য দেওয়া এবং পুঁজিবাজারে দর জালিয়াতির মতো একাধিক অভিযোগ উঠেছে।

স্ত্রীর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়ুন সুক-ইয়োলকেও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে। এ বছরের জানুয়ারির শুরুতে তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে পুঁজিবাজারে দর নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ তদন্তের জন্য সংসদে একটি বিল আনা হলে তাতে ভেটো দেন ইযুন।

আগামী এপ্রিলে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধান দুই রাজনৈতিক দল নিজেদের পক্ষে সমর্থন বাড়ানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। দুটি দলের কোনোটির প্রতিই জনগণের আর খুব বেশি আস্থা নেই। উভয় দলই অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার লড়াইয়ে জর্জরিত। এমন পরিস্থিতিতে ফার্স্ট লেডির দামি হ্যান্ডব্যাগ উপহার কেলেঙ্কারি দেশটির অজনপ্রিয় প্রেসিডেন্টের জন্য মরার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে উঠতে পারে।

স্থানীয় একটি নিউজ চ্যানেলের প্রকাশিত জরিপে দেখা গেছে, ৬৯ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, স্ত্রীকে ঘিরে বিতর্কের বিষয়ে ইযুনকে জবাব দিতে হবে। ডিসেম্বরের আরেকটি জরিপে দেখা গেছ, ৫৩ শতাংশ উত্তরদাতা বিশ্বাস করেন, কিম ঠিক কাজ করেননি। আর মাত্র ২৭ শতাংশ বলেছেন, তাকে ফাঁদে ফেলার জন্যই হয়তো এই কাজ করেছেন যাজক চোই জায়ে-ইয়ং।

দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষক রি জং-হুন বলেছেন, “এটি একটি রাজনৈতিক বোমা। কিম কেওন হিকে ঘিরে বিতর্কগুলো আরও বড় হবে।”

এমনকি প্রেসিডেন্ট ইযুন সুক ইয়োল নিজ দলের ভেতরেও সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন। দলের অনেকে তার স্ত্রীর চলন-বলনকে ফরাসি বিপ্লবের সময় ফ্রান্সের কুখ্যাত রানী মারি আঁতোয়ানেতের ভোগবিলাসের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

প্রধান বিরোধী দল ডেমোক্রেটিক পার্টিও প্রেসিডেন্ট ইযুন সুক ইয়োল ও তার দলকে আক্রমণ করার জন্য বিষয়টি হাতে তুলে নিয়েছে।

বিরোধী নেতা হং ইক-পিও বলেছেন, “প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ও ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে এটিকে উপেক্ষা করা এবং শুধু ক্ষমা চাইলেই পার পেয়ে পাওয়া যাবে—এমন মনোভাব হাস্যকর।” বিরোধীরা বহুদিন ধরেই ফার্স্ট লেডির বিরুদ্ধে পুঁজিবাজারে দর নিয়ে কারসাজির অভিযোগ করে আসছে।

গত বছর সিউল সরকার একটি এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প বাতিল করে দেয় এই অভিযোগে যে, এর ফলে ফার্স্ট লেডি কিমের পরিবার আর্থিকভাবে লাভবান হবে। ওই প্রকল্পের জন্য কিমের পরিবারের মালিকানাধীন জমির দাম বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত