সকাল সন্ধ্যা: নতুন শিক্ষাক্রম ২০২৩ সাল থেকে চালু হয়েছে। নতুন এই কারিকুলামের সঙ্গে আগের কারিকুলামের কোনও মিল নেই। একদম নতুন এক কারিকুলামের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা অভ্যস্ত হচ্ছে। ২০২৪-এ এসে এক বছর শেষে এ বিষয়ে আপনাদের মূল্যায়ন সম্পর্কে জানতে চাই।
এম তারিক আহসান: আমাদের এবারের শিক্ষাক্রমের পরিবর্তনটাকে আমরা ‘রূপান্তর’ বলছি। কারণ হলো আমাদের শিখন প্রক্রিয়া, শিখন উপকরণ, শিখন পরিবেশ, মূল্যায়ন প্রক্রিয়া এবং এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সবকিছুর মধ্যে নতুনত্ব আনা হয়েছে। সার্বিকভাবে আমরা বলব যে, সবচেয়ে ভালো এবং দ্রুত এটার সঙ্গে যারা অভিযোজন করেছে তারা হলো শিক্ষার্থীরা। এরপরে শিক্ষকরা। এ জায়গাটিতে এখনও যারা পুরো মানসিকভাবে তৈরি হননি তারা হলেন অভিভাবকরা। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সময়ের সঙ্গে কার্যক্রমগুলোতে সংশ্লিষ্ট হয়ে এ শিক্ষাক্রমের সঙ্গে অভিযোজন করে ফেলছেন। তবে অভিভাবকদের পর্যায়ে আরও বেশি যোগাযোগের মাধ্যমে ধারণাগুলো পরিবর্তনের জায়গায় আমাদের আরও একটু কাজ করতে হবে।
সকাল সন্ধ্যা: নতুন এ শিক্ষাক্রম প্রণয়নে আপনারা কোনও দেশের কোনও সুনির্দিষ্ট মডেল অনুসরণ করেছেন কি? করলে কেন করেছেন?
এম তারিক আহসান: নতুন এ শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করতে গিয়ে আমরা সুনির্দিষ্ট কোনও মডেল অনুসরণ করিনি। আমরা ১০২টি দেশের শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা করেছি। পাশাপাশি আমাদেরও যে শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের ধারাবহিকতা, এটিকেও পর্যালোচনা করেছি। কোন কোন সময়ে পরিবর্তন হয়েছে, কেন হয়েছে? পরিবর্তনগুলো কী কী, বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী ছিল— এসবও আমরা পর্যালোচনা করেছি।
আমরা এটি করে যেটি দেখতে পেয়েছি— আমাদের এই মুখস্থ নির্ভর, পরীক্ষা নির্ভর শিক্ষককেন্দ্রিক এবং কনটেন্ট নির্ভর যে শিক্ষা প্রক্রিয়াটি সেটি কিন্তু চালু হয়েছে ব্রিটিশ-কলোনিয়াল সময়ে। এর আগে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল অনেকটা কমিউনিটি বেইজড মডেল। যেটাকে আমরা পাঠশালা-টোল-মক্তব বলি। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যারা শিক্ষক বা গুরু ছিলেন— তারাই কিন্তু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে কারিকুলাম কী হবে, কতদিন ধরে কে পড়ালেখা করবে, প্রক্রিয়াটা কী হবে তা নির্ধারণ করতেন।
কিন্তু এ শিখন প্রক্রিয়াটি অনেকটাই অভিজ্ঞতানির্ভর। কোনও লিখিত পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল না, কোনও সনদেরও বালাই ছিল না ওই সময়ে। সেই প্রক্রিয়া থেকেই বের হয়ে মানুষ যে বাংলা তৈরি করেছিল সেটা কিন্তু সারাবিশ্বের প্রেক্ষাপটে খুব ‘সমৃদ্ধ বাংলা’ হিসেবে পরিচিত ছিল। আমরা যে পণ্যগুলো প্রস্তুত করতাম— আমাদের কৃষি পণ্য, মসলা, সূক্ষ্ম তুলা (ফাইন কটন), মসলিন— এগুলো কিন্তু আমরা রপ্তানি করতাম। সেই শিক্ষা ব্যবস্থা থেকেই কিন্তু আমরা আর্য ভট্ট বা ব্রহ্ম গুপ্তর মতো গণিতবিদ-জ্যোর্তিবিদকে পেয়েছি। তারা কিন্তু এই চারপাশের পরিবেশকে অন্বেষণ-অনুসন্ধান করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেই এ অবদানগুলো রেখেছিলেন। এই পরিবেশেই এই শিক্ষায় একদিনে যেমন সৃষ্টিশীল মানুষ তৈরি হয়েছে, আবার কর্মক্ষম-উৎপাদনশীল মানুষও তৈরি হয়েছে। যে পেশাগুলোও তৈরি হয়েছে সেগুলো কিন্তু এই দেশের সামর্থকে কাজে লাগিয়ে প্রেক্ষাপট-প্রসঙ্গ ধরেই তৈরি হয়েছে। এমনভাবেই এগুলো তৈরি হয়েছে যা সারাবিশ্বে সমাদৃত হয়েছে।
ওই সময় গোটা বিশ্বের ১৫ ভাগ অর্থনৈতিক কার্যক্রম হতো এই বাংলা থেকে। আরেকটা ছিল মূল্যবোধের জায়গাটি। এখন আমরা বলি, আমাদের শিক্ষা থেকে এটি হারিয়ে গেছে, সমাজ থেকে লোপ পেয়ে যাচ্ছে। তখন মূল্যবোধের যে চর্চাটি ছিল সেটি সমাজভিত্তিক ছিল। এটি যেমন শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করত। একইভাবে শিক্ষাব্যবস্থা এটিকে ধারণ করে ভবিষ্যত প্রজন্মকে সেই মূল্যবোধের চর্চা করাটা শিখাতো। শিক্ষকের যে সামাজিক অবস্থান ছিল সেটি আমরাও নতুন এই শিক্ষাক্রম প্রণয়নের আগে পর্যালোচনায় দেখেছি। কমিউনিটি বেইজড শিক্ষা মডেলের মধ্যে এমন অনেক উপাদান ছিল, এগুলোকে যদি আবার আমরা ফেরত আনতে পারি তাহলে আমরা আবার সমৃদ্ধ বাংলা গড়ে তুলতে পারব।
দ্বিতীয় পর্যালোচনায় ১০২টি দেশের শিক্ষাক্রম মূল্যায়ন করতে গিয়ে দেখেছি যে, এর মধ্যে ৫১টি দেশ তাদের শিক্ষাক্রমকে রূপান্তর করা শুরু করে দিয়েছে। এছাড়া ১০২টি দেশের বাইরে থাকা ৭৫টি দেশ রূপান্তর করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য হলো, চর্তুথ শিল্প বিপ্লবের ফলে আমাদের জীবন ব্যবস্থায় বড় ধরনের যে পরিবর্তন আসছে সেটার ফলে আমাদের পেশাগুলো পরির্তন হয়ে যাচ্ছে তার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো। এখন কাজ এত বেশি মেশিন বেইজড হবে, এত বেশি রোবোটিকসের ব্যবহার হবে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এমনভাবে আমাদের পেশাগুলোকে নিয়ে নিবে— যার ফলে মানুষকে এমনভাবে তৈরি হতে হবে যে দক্ষতাগুলো ও যোগ্যতাগুলো রোবোটের নেই, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নেই সেগুলো অর্জন করা। এটিও আবার বেশিদিন স্থায়ী হবে না। খুব দ্রুতই এগুলোরও পরিবর্তন ঘটবে। তাই এর সঙ্গে অভিযোজনের সক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ লাগবে। আর পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে এই চাহিদাগুলো তৈরি হয়ে যাবে। পরীক্ষা নির্ভর-মুখস্থ নির্ভর ব্যবস্থা দিয়ে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।
এই প্রেক্ষিতে আমরা দেখেছি যে, একদিকে আমাদের প্রাচীন বাংলার কমিউনিটি বেইজ লার্নিংটা দরকার, আবার চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যে চাহিদা— সারাবিশ্ব যেভাবে রূপান্তরিত যোগ্যতার দিকে যাচ্ছে সেটিরও সম্পৃক্ততা দরকার। এসব মিলিয়ে আমাদের প্রেক্ষাপটে আমাদের বাস্তবতায় এ শিক্ষাক্রম মডেলটি তৈরি করা হয়েছে।
সকাল-সন্ধ্যা: নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সঙ্গে আপনি যুক্ত ছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছেন, নতুন এ শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতমুখী ও অভিযোজনে সক্ষম দক্ষ ও সৃষ্টিশীল হতে ভূমিকা রাখবে। ভবিষ্যতে কীভাবে ভূমিকা রাখবে সেই সম্পর্কে আপনি বিস্তারিত বললেন। শিক্ষাক্রমের কোন বিষয়গুলো কীভাবে এই ভূমিকা রাখবে?
এম তারিক আহসান: আমরা এখন যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম তৈরি করেছি। যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম মানে হলো— শিক্ষার্থীর অর্জিত জ্ঞান শুধু সে মুখস্থ করে অর্জন করবে না— জ্ঞানকে বুঝবে। এই জ্ঞানকে অনুধাবন করে, সে তার জীবনের সমস্যার সমাধানে সঙ্গে মিলানোর চেষ্টা করবে। সেটিকে প্রয়োগ করে দেখবে, সেটা কতটা কার্যকর। এর ফলে কী পরিবর্তন আসল সেটিও যাচাই-বাছাই করবে। এর ফলে সে একদিকে জ্ঞানকে প্রয়োগের দক্ষতায় নিয়ে যাচ্ছে, আরেক দিকে নিজের ও সমাজের সমস্যার সমাধানে যাচ্ছে তখন তার মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির জায়গায় পরিবর্তন আসবে, যেটি আগে ছিল না। সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে সে সৃজনশীল সমাধানও আনার চেষ্টা করবে। যা নতুন আবিষ্কারের পথ দেখাবে। আগে পুরোটাই ছিল মুখস্থ নির্ভর। আমরা দেশপ্রেম-সততা এগুলোও মুখস্থ করে শিখিয়েছি। আমাদের সাইকেল চালানো বা সাঁতার কাটা শেখানো দরকার সেটাও আমরা বইয়ের মধ্যে সুন্দর করে লিখে দিয়েছি— বইয়ে লিখে ট্রাফিক আইনের নিয়মগুলো শিখিয়ে দিয়েছি। বাস্তব জীবনে যেগুলো মানা হয় না। রাস্তায় নামলে সে এক নিয়মে চলে, আর পরীক্ষায় পাস করার জন্য মুখস্থ করে তার এমন কিছু শিখতে হবে যা সে বাস্তবে চর্চা করে না। এখন সেই গ্যাপগুলোকে পূরণ করে শিক্ষার্থীরা এমন ধরনের যোগ্যতাগুলো অর্জন করবে যেটি সে প্রয়োগ করে নিজের জীবন ও সমাজে পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে।
সকাল সন্ধ্যা: এই সমাজ তো আর্থিকসহ নানা শ্রেণির কারণে বিভক্ত— তৈরি হয়েছে বৈষম্য। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এ বিষয়গুলো আপনারা বিবেচনায় নিয়েছেন?
এম তারিক আহসান: আমাদের যেমন শহর-গ্রামের একটা বড় বৈষম্য রয়েছে। আমাদের অর্থনৈতিক বৈষম্যের একটা ক্ষেত্র রয়েছে। আমাদের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ রয়েছে। এই সবকিছুকে বিবেচনায় নিয়েই এই শিক্ষাক্রমটি তৈরি করা হয়েছে। আগে শিক্ষাক্ষেত্রে শহর-গ্রামের বিরাট বৈষম্য ছিল— শিক্ষা অনেক ব্যয়বহুল একটা মডেলে পরিণত হয়েছিল। প্রাথমিক শিক্ষা বলা হয় অবৈতনিক। কিন্তু একজন শিক্ষার্থীকে যে পরিমাণ শিক্ষা খরচ বহন করতে হচ্ছে, যেমন— নানারকম ব্যয় বহন করতে হচ্ছে, পাশাপাশি কোচিং, গাইড বই প্রভৃতির খরচও বহন করতে হচ্ছে। গবেষণা বলে, অবৈতনিক বলা হলেও প্রাথমিক শিক্ষায় গড়ে অভিভাবকের মাসে চার-পাঁচ হাজার টাকা খরচ হচ্ছিল।
এই বৈষম্যগুলোর ফলেই কিন্তু শহরের স্কুলের মানকে আমরা একভাবে যাচাই করেছি। আর প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলগুলো আমরা যাচাই করেছি আরেকভাবে। প্রচলিত শিক্ষাক্রমে ভালো স্কুল-খারাপ স্কুলের যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতা নির্ধারণ করা হয় ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে। এই জায়গাগুলোর রূপান্তর ঘটাতেই আমরা এই শিক্ষাক্রম তৈরি করেছি। আমরা চিন্তা করেছি, একজন শিক্ষার্থীর শিখন কখনোই অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে বা ভৌগোলিক বৈষম্যের কারণে যেন বাধাগ্রস্ত না হয়। গ্রামের শিক্ষার্থীরা যে পরিবেশে আছে, সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েই তার শিখন পদ্ধতিকে ডিজাইন করা যায়, সেগুলোকে বিবেচনায় এনে শিক্ষক এগুলোর সন্নিবেশ ঘটাতে পারেন, তাহলে সেই স্কুলটি আর মানহীন স্কুল হিসেবে পরিচিত হবে না। আগে যেটি সবার জন্য একই পদ্ধতিতে পরিচালিত হতো, যেমন— আগে সমুদ্র তীরবর্তী স্কুলকে যা করতে হতো, উত্তরাঞ্চলের স্কুলকেও তাই একইভাবে করতে হতো। কিন্তু স্কুল দুটি ভৌগলিক অবস্থানের কারণে তাদের চাহিদা ও পরিবেশ একরকম নয়।
ধরা যাক, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ের কাছে থাকা এক স্কুলে শিক্ষার্থীকে ট্রাফিক সমস্যার সমাধানের কথা বলা হবে না। কিন্তু বাস্তবে তার ওইখানে ওই সমস্যা নেই। তার প্রেক্ষাপটে ম্যালেরিয়া একটা সমস্যা। আমরা চেয়েছি, শিক্ষার্থী তার নিজের চারপাশের এসব সমস্যা নিয়ে জানুক ও ভাবুক এবং সমাধান বের করার চেষ্টা করুক। একইভাবে ঢাকা শহরের কোনও স্কুলে শহরের ট্রাফিক সমস্যা নিয়ে জানবে। এগুলো নিয়ে ভেবে সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজবে। এর মধ্য দিয়ে বৈষম্য কমে আসবে— আমরা এ শিক্ষাক্রম নিয়ে পাইলট প্রকল্প করতে গিয়ে দেখেছি ২০২২ সালে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক স্কুল, তাদের মান অনেক বৃদ্ধি ঘটেছে। গ্রামের একটি স্কুল কৃষিশিক্ষার জন্য একজন কৃষককে ক্লাস নিয়ে আসছে। এভাবে অংশীজনের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এখন এ শিক্ষাক্রমের মধ্য দিয়ে গ্যাপগুলো পূরণ হওয়া শুরু হয়েছে। ফলে বৈষম্য কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মানুষের শ্রেণিগত যে বৈচিত্র্য তা পাঠ্যবইয়ে রাখা হয়েছে। একটা উদাহরণ আমি দিতে পারি, বগুড়ায় একটি ঘটনা ঘটেছিল আমাদের জীবন-জীবিকা বইয়ের অধ্যায়কে কেন্দ্র করে। সেখানে শিক্ষার্থীদেরকে স্কুল ঘর পরিষ্কার করতে হবে বলে বিচারক ও তার সন্তানের কাছ থেকে বাধা এসেছিল। একটি বৈষম্যমূলক পরিবেশ তারা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। ফলে স্কুল শিক্ষক, অভিভাবক, এলাকাবাসী প্রতিবাদ জানিয়েছিল। এ কারণে ওই বিচারকের বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তাকে ওএসডি করেছিল সরকার। এটি একটি উদাহরণ যা প্রমাণ করে একটি বইয়ের ছোট্ট একটি বিষয় শিখতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা নেতিবাচক চিন্তা থেকে বেরিয়ে সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। শিক্ষা যে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনে তার উদাহরণ কিন্তু আমরা এখনই দেখতে পাচ্ছি।
সকাল সন্ধ্যা: নতুন এ শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নে প্রযুক্তির ব্যবহার আছে। শহর-গ্রাম বা স্কুল ভেদে সবার প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা সমান নয়। এ ব্যবধান কমাতে আপনারা কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন?
এম তারিক আহসান: আমরা আশা করছি খুব শিগগিরই প্রযুক্তির এ বৈষম্য কেটে যাবে। কারণ আমরা জানি যে, এটুআই এবং মাউশি বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিচ্ছে। যেগুলোর মাধ্যমে সারা দেশের সব বিদ্যালয়ে ডিভাইস দেওয়া, ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করা হবে। তাদের লক্ষ্য ২০২৫-২০২৬ এর মধ্যে ইন্টারনেট সংযোগ ও ডিভাইস দেওয়া। এ সময়কালের মধ্য দিয়ে যেসব শিক্ষার্থী যাবে তাদের আমরা তিনটি ভাগে ভাগ করেছি— হাই টেক, লো টেক ও নো টেক। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা চক্রকে এমনভাবে সাজিয়েছি, আমাদের ডিভাইসের স্বল্পতা এবং ইন্টারনেট সংযোগে সুবিধা না থাকে তাহলে যেন কোনও বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিখন কার্যক্রম যেন বাধাগ্রস্ত না হয়। যেমন— শিক্ষাক্রমে ই-মেইল কীভাবে করে তা শিখতে হবে। যার স্কুলে এসব বিষয় প্রযুক্তির সাহায্যে শেখার সুযোগ নেই তার জন্য পুরো ই-মেইল শেখার পদ্ধতি যেন ছবি দেখে শিখতে হাতে-কলমে শিখতে পারে সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরো প্রক্রিয়াটি ম্যানুয়ালি করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে যখন প্রযুক্তি সবার কাছে পৌঁছবে তখন ই-মেইল করার কাজটি অপরিচিত লাগবে না।
সকাল-সন্ধ্যা: নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হচ্ছে, নবম-দশম শ্রেণিতে আগের মতো বিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের বিভাজন না থাকা নিয়ে। এ নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
এম তারিক আহসান: বিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের বিভাজন করা হয়েছিল ১৯৫৯ সালে শরীফ কমিশন রিপোর্টের মাধ্যমে। তার আগে কিন্তু একমুখী শিক্ষাই ছিল। ওই সময় যে দেশগুলো একমুখী শিক্ষায় ছিল তারা এখন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে বলেন, সামাজিক উন্নয়ন বলেন— সবগুলো মাপকাঠিতে তারা এগিয়ে গেছে। আমরা ওই সময় বিভাজনটা তৈরি করেছিলাম। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও আমরা সেটির পরিবর্তন আনতে পারিনি। বরং আমরা যেটা দেখেছি, বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার ঘটার বদলে সংকুচিত হয়ে এসেছে দিন দিন। আমাদের মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১৯ ভাগ বিজ্ঞান বিভাগ নেয়। বাকির যায় ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগে। এদের মধ্যে শতকরা ৫০ ভাগ উচ্চ মাধ্যমিকে পড়তে গিয়ে আর বিজ্ঞান নেয় না— ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিকে চলে যায়। এই যে নবম-দশম শ্রেণিতে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী বিজ্ঞান পড়ে না। বিজ্ঞান পড়া মানে শুধুমাত্র বিজ্ঞানী হওয়া বা বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট পেশাগ্রহণ করা নয়। বিজ্ঞান মনস্ক চিন্তা করা এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে কোনও একটা সমস্যার সমাধান করতে পারা এবং জীবনের সমস্যাগুলোকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা। যে বিষয়েই আমি পড়ালেখা করি না কেন— এমন গুণ কিন্তু আমাদের প্রয়োজন। সেই জায়গায় আমাদের একটা বড় ঘাটতি তৈরি হয়ে গেছে। এ বিভাজন বা ঘাটতির আরও কিছু নেতিবাচক প্রভাব আছে। একটা হলো— ল্যাবরেটরিকেন্দ্রিক বিজ্ঞান শিক্ষার একটি সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। যার ফলে বিদ্যালয়গুলোতে ল্যাব আছে, সে বিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞান পড়ানো হয় বাকি বিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞান পড়ানো হয় না। গ্রামের স্কুলগুলো এ কারণে বিজ্ঞান শিক্ষায় পিছিয়ে আছে। আরেকটি হলো— নারী-পুরুষের একটা বৈষম্য তৈরি হয়েছে। ছেলেরা বিজ্ঞানে যাবে, আর মেয়েরা মানবিক-বাণিজ্য শিক্ষায় যাবে। এছাড়া ভালো শিক্ষার্থী ও খারাপ শিক্ষার্থীর একটা ধারণা তৈরি হয়ে গেছে। এরকম বৈষম্যগুলো সৃষ্টি হয়েছে আমাদের সমাজে।
এর ফলে একদিকে আমাদের শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ বিজ্ঞানমনস্ক হচ্ছে না। ফলে জীবনে সমস্যা সমাধানে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াগুলো অনুসরণ করে না। বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে যেটি হয়— একজন শিক্ষার্থী মানবিকে পড়লেও এ চিন্তাটা থাকলে সমস্যার সমাধান সহজ হয়, যৌক্তিক হয়। যেমন— যাতায়াত সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা ‘উবার’ বা ‘পাঠাও’ ব্যবহার করি। যারা এটার আবিষ্কার করেছেন তারা এটার পেটেন্ট করেছেন। পেটেন্টের যে আবেদন সেটি যদি আমরা দেখি, প্রথম ১০টি দেশের মধ্যে এমন চার-পাঁচটি দেশ রয়েছে যাদের জনসংখ্যা আশি লাখ থেকে সোয়া কোটির মধ্যে। নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, ফিনল্যান্ড— এই পাঁচটি দেশেরই কিন্তু জনসংখ্যা এরকম। এত কম জনসংখ্যা নিয়ে পেটেন্ট আবেদনে তারা প্রথম দশটি বা পনেরোটি দেশের মধ্যে থাকে। আমরা ১৮ কোটি মানুষ। আমরা কিন্তু ১০০ তালিকারও নিচে আছি। কেন হচ্ছে? কারণ ওই বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তার মানুষটা তৈরি হচ্ছে না। আরেকদিকে বিজ্ঞানীও তৈরি হচ্ছে না তেমনভাবে। বৈষম্যও থেকে যাওয়ায় আমাদের সাক্ষরতার হার, ডিজিটাল লিটারেসির জায়গাগুলো, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট গোলের লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে পারছি না। বিজ্ঞান শিক্ষা উন্মুক্ত না করার জন্য আমরা এসব ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছি। এ জন্যই আমরা এ বিষয়টি আবার যুক্ত করতে চাইছি।
সকাল-সন্ধ্যা: অভিযোগ রয়েছে, এ কারিকুলামে শিক্ষাগ্রহণের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা গণিত-বিজ্ঞান শিক্ষা থেকে ব্যাপকভাবে বঞ্চিত হবে। আবার যারা নবম শ্রেণিতে গণিত-বিজ্ঞান শিখতে আগ্রহী নয় তাদেরও ‘জোর’ করে পড়তে হবে। এ বিষয়ে আপনার মত কী?
এম তারিক আহসান: বিজ্ঞান শিক্ষা সংকুচিত হয়ে গেল কিনা— একটি হলো শিক্ষাক্রমের দৃষ্টিকোণ বোঝা, অন্যটি হলো ধারণা থেকে বোঝার বিষয় রয়েছে। শিক্ষাক্রমের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমার কনটেন্ট কাভারেজ কমে গেল কি না, আমার শিখন ঘণ্টা কমে গেল কি না, এসব কমে গেলে বুঝতে হবে সেই বিষয়টি সংকুচিত হয়ে গেছে। নতুন শিক্ষাক্রমে কনটেন্ট কাভারেজ কমেনি, বরং বেড়েছে এবং ইন্টার-ডিসিপ্লিনারি হয়েছে। আরেকটি হলো, বিজ্ঞান শিক্ষার কনসেপ্ট শুধু বিজ্ঞান শিক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি জীবন-জীবিকা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, সামাজিক বিজ্ঞানের মধ্যেও যুক্ত হয়েছে। ফলে এটার ক্ষেত্র আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। আর ইন্টার-ডিসিপ্লিনারি হওয়ায় নানাভাবে ঘটনা ও বিষয় বোঝার জন্য বিশেষায়িত জ্ঞান চর্চার সুযোগ আগের থেকে অনেক বেড়েছে। পুরানো শিক্ষাক্রমে এ সুযোগ ছিল না। অষ্টম শ্রেণিতে এসে একজন শিক্ষার্থীর সেই বোধ ও অভিজ্ঞতা হয় না যার ফলে সে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে সে কোনটি পেশা হিসেবে গ্রহণ করবে। আগের শিক্ষাক্রমে আমরা সেটি চাপিয়ে দিয়েছিলাম।
সকাল সন্ধ্যা: বিজ্ঞান শিক্ষায় ‘অনুসন্ধান বই’র সঙ্গে ‘অনুশীলন বই’ বইয়ের সামঞ্জস্য নেই। এ বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ জানতে চাই।
এম তারিক আহসান: এখানে এমনভাবে বিষয়গুলো সাজানো হয়েছে একজন শিক্ষার্থী কাজ করতে গিয়ে নানাভাবে তথ্য খুঁজবে— অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। এসব বিষয়ে যদি কোনও সমস্যা থাকত তাহলে শিক্ষার্থীরাই আগে বিষয়টি নজরে আনত।
সকাল সন্ধ্যা: নবম-দশম শ্রেণিতে সব শিক্ষার্থীকেই কেন পেশাগত দক্ষতা অর্জনের জন্য কৃষি-শিল্প-কারিগরি বিষয়ের একটি পড়তে হবে? এজন্য তো দেশে আলাদা কারিগরি বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয় আছে। মাধ্যমিক স্তরে পেশাগত দক্ষতার শিক্ষা নিয়ে আসায় কি মৌলিক জ্ঞানার্জনের ভিত্তি তৈরির সুযোগ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে না?
এম তারিক আহসান: আসলে বেশ কতগুলো কারণে এসব বিষয়কে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে এ শিক্ষাক্রমে। আসলে আমাদের ৭০ ভাগ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। যারা পরবর্তী সময়ে অদক্ষ জনগোষ্ঠী হিসেবে বিদেশে কাজ করে দেশে অর্থ পাঠিয়ে আমাদের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এ জনশক্তিকে আমরা যদি শিগগিরই দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারি তাহলে তারা আমাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে। সেই সাপেক্ষে, আমাদের ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা কিছু ভকেশনাল স্কিল অর্জন করবে আশেপাশের পরিবেশ থেকে।
এরপর নবম-দশম শ্রেণিতে একটি অকুপেশন পছন্দ করবে। এটি কিন্তু প্রথাগত দক্ষতাভিত্তিক অকুপেশন শিক্ষা নয়। এটি হলো প্রয়োগমুখী শিক্ষা। এ শিক্ষাটি এমন তার জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের এটি কাজে লাগবে। ফলে সবাই যে দক্ষতাভিত্তিক পেশা গ্রহণ করবে বিষয়টি কিন্তু তাও নয়। বড় সংখ্যক একদল শিক্ষার্থী হয়তো দক্ষতাভিত্তিক পেশায় যাবে যারা ঝরে পড়ত। আরেক দল যারা উচ্চশিক্ষার জন্য বা মৌলিক গবেষণার জন্য তৈরি হবে, তারাও যদি জীবনের নানা সমস্যা সমধানের জন্য দক্ষতাভিত্তিক অকুপেশনাল শিক্ষাগ্রহণ করে এটি তার ভবিষ্যতের কাজগুলোতে লাগবে। যেমন— কম্পিউটার প্রোগামিং, কোডিং— এগুলো কিন্তু তারা খুব মেকানিক্যালি শিখবে না। এর মাধ্যমে তারা যে বিশেষ বিষয়ে শিক্ষার্জন করবে তার প্রায়োগিক দিকটি জানতে এসব শিক্ষা ভূমিকা রাখবে। এ শিক্ষার মাধ্যমে জীবনের নানা সমস্যার সমাধানের পথও বের করবে। এছাড়া কোনও কিছু আবিষ্কার করতে, উদ্ভাবন করতে কোনদিকটি নজর দেওয়া দরকার সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত গ্রহণ এ শিক্ষা ভূমিকা রাখবে। যা তত্ত্ব ও মুখস্থ নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় অনুপস্থিত ছিল। তাই নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে আবিষ্কার করতে, উদ্ভাবন করতে, জীবনের সমস্যার সমাধানে ভূমিকা রাখবে নিঃসন্দেহে। এর ফলে যেমন দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠবে, আবার তাত্ত্বিক জ্ঞানে অবদান রাখতে পারবে।
সকাল সন্ধ্যা: মাতৃভাষায় শিক্ষা ও বিদেশি ভাষায় শিক্ষা এ শিক্ষাক্রমে কতটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে নতুন এ শিক্ষাক্রমে?
এম তারিক আহসান: নতুন শিক্ষাক্রমে ভাষা শিক্ষাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেটিকে আমরা বলছি কমিউনিকেটিভ ল্যাংগুয়েজ। আমরা জানি যে, একজন শিক্ষার্থী স্কুলে ভর্তি হতে আসে তখন সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে। এ ভাষা শিখতে সে কোনও স্কুলে যায়নি, গাইড বই পড়েনি, কোচিং করেনি— অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের মধ্য দিয়ে সে এটা অর্জন করেছে। অথচ ১২ বছর স্কুলিংয়ের পর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়ার পর আমাদের এই শিক্ষার্থীকে দুই বছর ইংরেজি শিখাতে হচ্ছে। আমরা মোট ১৪ বছরেও এই শিক্ষার্থীকে ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী করে তুলতে পারি না। কারণ আমরা কমিউনিকেটিভ ল্যাংগুয়েজকে অনুসরণ না করে এত বেশি গ্রামাটিক্যাল নিয়মকে এত বেশি চর্চা করেছি, যার ফলে একজন শিক্ষার্থীর মাথায় শুধু নিয়ম ঘুরতে থাকে। কিন্তু সে ভাষাটায় দক্ষ হতে পারে না। আসলে একজন শিক্ষার্থী ভাষা শিখবে প্রয়োগ করতে গিয়ে। আমরা এই শিক্ষাক্রমে সেটি যুক্ত করেছি। আমাদের দেশের মার্কেটের বৈশিষ্ট্যকে লক্ষ্য করে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলগুলো গড়ে উঠেছে। অথচ ইংরেজি ভাষানির্ভর দেশের শিক্ষার্থীদের এভাবে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে না। কাজেই আমাদের এ বিষয়ে জানা দরকার— সচেতন হওয়া দরকার।
সকাল-সন্ধ্যা: নতুন শিক্ষাক্রমে প্রথাগত পাস-ফেল থাকছে না। তাহলে কি যোগ্য না হলেও শিক্ষার্থীরা পরের শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হবে? কেউ কেউ বলছেন সারা বছর ধরে ধারাবাহিক মূল্যায়নের নামে শিক্ষকদের হাতে বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যার অপব্যবহার হতে পারে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যেই মূল্যায়ন-পদ্ধতির জন্য বানানো ‘নৈপুণ্য’ অ্যাপে পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাহলে কি মূল্যায়ন পদ্ধতিতে ক্রটি রয়েছে?
এম তারিক আহসান: পাস-ফেল থাকছে না— এ কথাটি ঠিক নয়। যারা শিখন প্রক্রিয়া নিয়মিত থাকবে না এবং তিনটি বিষয় যথেষ্ট পারর্দশিতা দেখাতে পারবে না তাহলে সে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে পারবে না। এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, সারাবছর ধরে একজন শিক্ষার্থীর প্রতিদিনকার যে মূল্যায়ন হচ্ছে এবং এ পদ্ধতিতে একটি ন্যায্যতা আনতে আমরা শিখনকালীন মূল্যায়ন প্রর্বতন করেছি। এর মাধ্যমে আমরা একজন শিক্ষার্থীর সামগ্রিক মূল্যায়নটি দেখতে পাব। তৃতীয় বিষয়টি হলো, আগের যে পদ্ধতিটি প্রচলিত ছিল সেখানে শিক্ষকের জবাবাদিহিতার জায়গাটি নির্ণয় করা যেত না। এতে করে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতো— আমার নোটটি পড়তে হবে, আমার মতো করে লিখতে হবে, আমার কাছে কোচিং করতে হবে। এখন শিক্ষক একা কিন্তু মূল্যায়ন করছেন না। পুরো শিখন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নানা মানুষের কাছ থেকে শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন নিতে হচ্ছে। ‘নৈপুণ্য’ অ্যাপের ফলে শিক্ষক যে মূল্যায়নটি করছেন সেটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে যাচাই করা হবে। এর ফলে শিক্ষক ঠিকমতো যাচাই করছেন কি না সেটি সম্পর্কে আমরা অবগত হতে পারব। এ অ্যাপের মাধ্যমে সারা বছর শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কার্যক্রমকে ট্র্যাক করতে পারবে। এভাবে একটি ডিজিটাইজড অ্যাসেসমেন্ট সিস্টেম ডিজাইন হওয়ায় পুরো শিখন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে ও স্বচ্ছ মূল্যায়ন করতে সাহায্য করবে।
সকাল-সন্ধ্যা: স্কুলের পর্ব শেষ করে শিক্ষার্থীরা যখন উচ্চমাধ্যমিকের জন্য কলেজে ভর্তি হবে তখন তাদের যোগ্যতার বিচার কীভাবে হবে? বলা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়েও শিক্ষার্থীরা সংকটে পড়তে পারে। কেউ বলছেন বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বিশেষায়িত শিক্ষার পর্যাপ্ত ভিত্তি এই শিক্ষাক্রম তৈরি করতে পারবে না।
এম তারিক আহসান: নবম-দশম শ্রেণি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ পর্যন্ত আমাদের এ সময়কালের শিক্ষাক্রমকে আগে কখনো সুনির্দিষ্টভাবে সাজানো হয়নি। এ পর্যায়টি আমরা বিশ্লেষণের চেষ্টা করছি যার মধ্যদিয়ে একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের এ পর্বে কোনও পৌনঃপুনিকতা যেন না থাকে— তাকে যেন কোনও ঝাঁকুনি খেতে না হয়। এখন কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পদ্ধতি একজন শিক্ষার্থীর জন্য অনেক সহজ হবে বলে আমরা মনে করি। আমরা বিশ্লেষণ করে দেখেছি, নবম-দশম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে। উচ্চমাধ্যমিকেও পরীক্ষাগুলো হবে ভবিষ্যতে যে বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে চায় সেটি অনুসরণ করে। আরেকটি হচ্ছে রাষ্ট্রীয়ভাবে তৈরি করা কিছু পদ্ধতি, যেমন— স্যাট, টোফেল, জিআরই। আমরা আমাদের উচ্চশিক্ষায় ভর্তি প্রক্রিয়ায় একটি আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সঙ্গে কাজ করছি। অচিরেই শিক্ষার্থীরা দেশে-বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এর সুফল ভোগ করতে পারবে।
সকাল-সন্ধ্যা: শ্রেণিকক্ষে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতের বিচারে আমাদের দেশে শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের ব্যাপক ঘাটতি আছে। তাহলে এমন শিখন ও মূল্যায়ন পদ্ধতি কীভাবে সফল হবে? এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকরা কতটা বাস্তবসম্মত ভূমিকা রাখতে পারবে?
এম তারিক আহসান: তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি, প্রায় দুই হাজার স্কুলে ক্লাসে ৭০-৮০ জন শিক্ষার্থী আছে। শহরে এসব বেশিরভাগ বিদ্যালয়গুলো অবস্থান। বাকি বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষককের বিপরীতে ৫০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এগুলো সুস্থ চর্চা নয়। আগের বা প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় একজন শিক্ষক সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ জন শিক্ষার্থীর প্রতি যথাযথ নজর দিতে পারত। কিন্তু এখন আমাদের যে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থায় দেখতে পেলাম, একজন শিক্ষক অন্তত ৫০ থেকে ৬০ জন শিক্ষার্থীকে নজরে রাখতে পারছেন। এছাড়া গ্রুপভিত্তিক শিক্ষার কারণে সব ধরনের শিক্ষার্থী এতে যুক্ত হতে পারছে। এখন মাউশি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কোনও ক্লাসে ৫৫ জনের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করা যাবে না। এছাড়া সব স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারে সেটিও লক্ষ্য করা হবে। ফলে স্কুলগুলোও শিক্ষাক্রমের বিষয়ে সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে। এবার আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, শিক্ষকদের সামাজিক-আর্থিক মর্যাদা বৃদ্ধিতে কাজ করা। আমাদের প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকের যে ভূমিকা ছিল সেটি ফিরিয়ে আনতে চাইছি। শিক্ষকের ক্ষমতায়নের প্রতিফলন দেখা যাবে এ শিক্ষাক্রমে।
সকাল-সন্ধ্যা: শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকের ভূমিকা মুখ্য হলেও এই শিক্ষাক্রম অনুসারে পাঠদানের জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিষয়ে কোনও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। নানা প্রতিবেদন বলছে, দেশের বেশিরভাগ স্কুলের শিক্ষকরা প্রথম বছরে বুঝতেই পারেননি কীভাবে পড়াতে হবে।
এম তারিক আহসান: আমরা এটি নিয়ে কাজ করছি। শিক্ষককে নানাভাবে সুবিধা দেওয়ার জন্য আমরা নানারকম উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। শিক্ষক প্রশিক্ষণ ছাড়াও শিক্ষাক্রমকে সে সঠিকভাবে প্রয়োগ করে নিজের ভূমিকা রাখতে পারবে সেটি আমাদের লক্ষ্য। দ্রুতই এ অবস্থার পরিবর্তিত রূপ আমরা দেখব।
সকাল-সন্ধ্যা: বলা হচ্ছে, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হলে কোচিং, প্রাইভেট বা নোট-গাইড বইয়ের সুযোগ থাকবে না। তাহলে কি সত্যিই কোচিং-গাইডের নির্ভরতা থেকে শিক্ষার্থীদের মুক্তি মিলবে?
এম তারিক আহসান: আমাদের নতুন শিক্ষাক্রম দক্ষতা-যোগ্যতা অর্জন করাতে চায়। মুখস্থ এখন মূল বিষয় নয়। কাউকে যদি মুখস্থ না করিয়ে দক্ষতা-যোগ্যতার উন্নয়ন করানো হয় সেটি কিন্তু খুব বড় একটি বিষয়। কারও কোনও ক্ষতির কারণ হবে না। যারা আইইএলটিস, টোফেলের প্রশিক্ষণ দেয়, যা তারা পড়ায়, তারা জানে যে, এসব প্রশিক্ষণ কোনও কাজে লাগবে না। বরং তারা এসব পরীক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যা কাজে লাগবে সেগুলো শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করে। তেমনি আমাদের কোচিং-গাইড বুক ব্যবসায়ীদের ভাবার সময় এসেছে। তারা আগের শিক্ষাব্যবস্থার চাহিদা পূরণে যা করত তা এখন আর লাগবে না। বরং তাদের শিক্ষার্থীর দক্ষতা-যোগ্যতা উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে হবে।
সকাল-সন্ধ্যা: অনেকে বলছেন, এ কারিকুলামের কারণে ধীরে ধীরে সন্তানদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে ভর্তি করতে আগ্রহী হবে অভিভাবকরা। এমন মন্তব্য বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
এম তারিক আহসান: নতুন এ শিক্ষাক্রমের কারণে বাংলা ও ইংরেজি মিডিয়ামের শিক্ষার্থীদের আগের মতো কোনও কমিউনিকেশন গ্যাপ থাকবে না। ইংরেজি ভাষাভাষী দেশগুলোতে শিক্ষাদানের পদ্ধতি আর আমাদের ইংরেজি মিডিয়ামের শিক্ষাদানের পদ্ধতি এক নয়— এটা আমি আগেও বলেছি। আমরা এখনো মুখস্থ নির্ভর ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে এখনো শিক্ষার্থীদের পাঠাবো— এমন অযৈক্তিক সিদ্ধান্ত থেকে বের হয়ে আসার সময় আমাদের এসেছে।
সকাল-সন্ধ্যা: নতুন শিক্ষাক্রমের কারণে শিক্ষার্থীদের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়েছে বলে অভিভাবকদের অভিযোগ। তাদের আন্দোলনের মুখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘মূল্যায়ন পদ্ধতি ও কারিকুলাম সংক্রান্ত সমন্বয় কমিটি’ গঠন করেছে। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এর মধ্য দিয়ে আমরা কতটা যথাযথ শিক্ষাক্রম আশা করতে পারি?
এম তারিক আহসান: প্রথমেই বলতে চাই, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ‘মূল্যায়ন পদ্ধতি ও কারিকুলাম সংক্রান্ত সমন্বয় কমিটি’ আন্দোলনের কারণে হয়নি। আমাদের নতুন শিক্ষাক্রমের চাহিদার কারণে ও বাস্তবায়ন করতে নানা পক্ষ ও প্রতিষ্ঠান-সংস্থা সমন্বয় করতে এ কমিটি করা হয়েছে। নতুন এ শিক্ষাক্রমের কারণে তাদের কাজের ধরনও পরিবর্তন হওয়ার ফলে বিষয়টি নিয়ে একসঙ্গে কাজ করা দরকার।
সকাল সন্ধ্যা: আপনাকে ধন্যবাদ।
এম তারিক আহসান: আপনাকেও ধন্যবাদ।