নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নেতৃত্ব বদল, দুর্নীতি দমনে পদক্ষেপ ও বড় কিছু কোম্পানির পর্ষদ পুনর্গঠনের মতো ঘটনা পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বাড়িয়েছে উদ্বেগ। ব্যাংক খাতের আধিপত্যে লেনদেন কিছুটা বাড়লেও বেড়েছে শেয়ার বিক্রির চাপ, যে কারণে দেশের পুঁজিবাজারের মূল্যসূচক পড়েছে টানা পাঁচদিন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাজারে যে উল্লম্ফন দেখা দিয়েছিল তা আর নেই। মূল্যসূচকের টানা পতনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা ফিরে এসেছে।
সপ্তাহের চতুর্থ দিন বুধবার দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১০৮ দশমিক ৩৯ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৬০৬ দশমিক ৯৫ পয়েন্টে নেমে এসেছে। শতাংশ হিসাবে সূচক কমেছে প্রায় ২ শতাংশ।
অন্য বাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ২২৭ দশমিক ৬৯ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১৬ হাজার ২০২ দশমিক ৫১ পয়েন্টে। শতাংশ হিসাবে এই সূচক কমেছে ১ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫ হাজার ২২৯ পয়েন্ট নিয়ে সকাল ১০টায় শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৭ দশমিক ১৫ পয়েন্ট বেড়ে লেনদেন শেষ হয়; ডিএসইএক্স অবস্থান করছে ৫ হাজার ৪২৬ দশমিক ৪২ পয়েন্টে।
গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। পরের দিন ৬ আগস্ট ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স প্রায় ২০০ পয়েন্ট বেড়ে ৫ হাজার ৪২৬ দশমিক ৪২ পয়েন্টে ওঠে। পরের দিন ৭ আগাস্ট এই সূচক ১৯২ দশমিক ৩৬ পয়েন্ট বেড়ে ৫ হাজার ৬১৮ দশমিক ৭৯ পয়েন্টে দাঁড়ায়।
গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার দিন ডিএসইএক্স ৩০৬ পয়েন্ট বেড়ে ৫ হাজার ৯২৪ দশমিক ৮১ পয়েন্টে অবস্থান করে। শতাংশ হিসাবে এই সূচক বাড়ে ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ। ৪ বছর ৭ মাসের মধ্যে একদিনে এই সূচক সর্বোচ্চ বাড়ে ওই দিন।
গত ১১ আগস্ট ডিএসইএক্স ৬ হাজার পয়েন্ট ছাড়িয়ে ৬ হাজার ১৬ পয়েন্টে ওঠে; সূচক বাড়ে ৯১ পয়েন্ট। লেনদেন ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
এরপর হোঁচট খায় বাজার। ১২ ও ১৩ আগস্ট দুই দিনে ডিএসইএক্স প্রায় ১৫০ পয়েন্ট পড়ে যায়; সূচক নেমে আসে ৫ হাজার ৮৬৭ দশমিক ৯৬ পয়েন্টে। লেনদেন নেমে আসে হাজার কোটি টাকায়।
এরই মধ্যে (১৩ আগস্ট) অর্থনীতিবিদ পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজকে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
তার নিয়োগের খবরে ১৪ আগস্ট দুই বাজারেই সূচক বাড়ে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স বাড়ে ৮৪ দশমিক ৮১ পয়েন্ট। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক সূচক সিএএসপিআই বাড়ে ১৩২ দশমিক ৫৫ পয়েন্ট।
মাসরুর রিয়াজের নিয়োগের পরপরই বিতর্ক ওঠার প্রেক্ষাপটে তার নিয়োগ স্থগিত রাখে সরকার।
এ খবরে গত সপ্তাহের ১৫ আগস্ট দুই বাজারেই সূচকের পতন হয়। ডিএসইএক্স ৪৮ দশমিক ৯৩ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৯০৩ দশমিক ৮৩ পয়েন্টে নেমে আসে।
এরই মধ্যে ১৭ আগস্ট পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানান মাসরুর রিয়াজ। দায়িত্ব না নেওয়ার কারণ জানিয়ে গণমাধ্যমে একটি বিবৃতিও দেন মাসরুর।
এরই মধ্যে ১৮ আগস্ট ব্যাংকার খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। একই সঙ্গে মাসরুর রিয়াজের নিয়োগ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনটি বাতিল করা হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে ১৮ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া সপ্তাহের প্রথম দিন রবিবার দুই বাজারেই মূলসূচকের বড় পতন হয়। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১২৫ দশমিক ১৯ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৭৭৮ দশমিক ৬৩ পয়েন্টে নেমে এসেছে।
এর পরের তিন দিনে (১৯, ২০ ও ২১ আগস্ট) ডিএসইএক্স ১৭১ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৬০৬ দশমিক ৯৫ পয়েন্টে নেমে এসেছে।
সপ্তাহের চতুর্থ দিন বুধবার ডিএসইর অন্য দুই সূচকের মধ্যে ডিএসইএস ২৮ দশমিক ২৮ পয়েন্ট বা ২ দশমিক ৩০ শতাংশ কমে ১ হাজার ২০১ দশমিক ৪১ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। ডিএস-৩০ সূচক ৪৫ দশমিক ৬৩ পয়েন্ট বা ২ দশমিক ১৮ শতাংশ কমে ২ হাজার ৪৭ দশমিক ৬২ পয়েন্টে অবস্থান করছে।
লেনদেন হয়েছে ৫৩৬ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। আগের দিন মঙ্গলবার লেনদেনের অঙ্ক ছিল ৫১৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
বুধবার ডিএসইতে ৩৯৪টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ৩৭১টির দরই কমেছে। বেড়েছে মাত্র ১১টির। আর অপরিবর্তিত ছিল ১২টির দর।
এদিনের খাতওয়ারি লেনদেন পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ডিএসইর মোট লেদেনের মধ্যে ব্যাংক খাতের ৪১.৮ শতাংশ, ওষুধ ও রসায়ন খাত ১৯.১ শতাংশ এবং খাদ্য খাতের ছিল ১০ শতাংশ। অন্যদিকে টেলিকম, ভ্রমণ ও পেপার-প্যাকেজিং খাতে ৩ শতাংশ করে পতন হয়েছে।
অন্যদিকে বুধবার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ২২৭ দশমিক ৬৯ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১৬ হাজার ২০২ দশমিক ৫১ পয়েন্টে। শতাংশ হিসাবে এই সূচক কমেছে ১ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
লেনদেন হয়েছে ১৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা।
২০৩টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দাম বেড়েছে মাত্র ৮টির। কমেছে ১৮৭টির। আর অপরিবর্তিত ছিল ৮টির দর।
পুঁজিবাজারে টানা দরপতনের কারণ জানতে চাইলে শীর্ষস্থানীয় একটি ব্রোকারেজ হাউসের প্রধান নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর শেয়ারবাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনিয়ম–দুর্নীতি বিষয়ে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে, তাতে বড় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ কারণে অনেকে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ধীর চল নীতি গ্রহণ করছেন।
“তবে শেয়ারবাজারের অনিয়মের বিরুদ্ধে নেওয়া এসব পদক্ষেপ দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যতেও যাতে বাজারে কোনও ধরনের অনিয়ম না ঘটতে পারে, সেই ব্যবস্থা বর্তমান কমিশনকে নিতে হবে। বাজার কারসাজিমুক্ত থাকবে বা কারসাজি করলে কেউ ছাড় পাবে না—এই বার্তা যদি বিশ্বাসযোগ্যভাবে বাজারে যায়, তাহলে তা বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি করবে।”