Beta
শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০২৪
Beta
শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০২৪

কলাম

যৌন হয়রানির ঘটনা কেন বারবার ঘটছে

চিররঞ্জন সরকার। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার।

মানুষ তার মানবিক গুণাবলি উন্নততর করার মধ্য দিয়ে দিন দিন সভ্য হয়। প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে। আমরা যেন উল্টো পথের যাত্রী। আমরা কে কার চেয়ে নিকৃষ্ট হতে পারি—

সেই সাধনাই যেন চলছে! বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের ঘটনাগুলো যেন সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে। কখনও সহপাঠী, কখনও শিক্ষকরা নিপীড়নকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। এতে করে নিরীহ ছাত্রীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ আত্মহননের পথও বেছে নিচ্ছে।

সমাজের এ এক কঠিন অসুখ। নারী শিক্ষার্থীরা যদি তাদের সহপাঠী ও শিক্ষকের কাছেও নিরাপদ না হয়, তা হলে এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কি হতে পারে? যৌন হয়রানির কোনও ঘটনা জানাজানি হলে, প্রতিবাদ-বিক্ষোভ কিছু কম হয় না। ব্যাপক সমালোচনা-নিন্দা-ঘৃণা, কঠোর আইন ইত্যাদির পরও দেশে যৌন হয়রানির ঘটনা থেমে নেই। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় তো ঘটছেই, বিশ্ববিদ্যালয়েও ঘটছে। প্রশ্ন হলো, যৌন হয়রানি বা ছাত্রী নিপীড়নের ঘটনা কেন বারবার ঘটছে? শুধু যৌন হয়রানিই নয়, ধর্ষণের ঘটনাও ঘটছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও আরও বিশ্ববিদ্যালয়ের পর আলোচনায় এখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা সম্প্রতি ফেইসবুকে তার এক সহপাঠী ও শিক্ষককে অভিযুক্ত করে আত্মহত্যা করেছে। এর আগে গত বছরের ১৪ নভেম্বর তিনি তৎকালীন প্রক্টরের কাছে সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে উত্যক্ত করা ও হয়রানির অভিযোগ জানিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে আম্মানের হয়রানি, হুমকির শিকার হচ্ছেন ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন জানিয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু তিনি কোনও প্রতিকার পাননি। সংশ্লিষ্টরা কেবল আশ্বাস আর সুপারিশ প্রদানের মাধ্যমেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেছে।

এর আগে গত বছরের ১৪ নভেম্বর তিনি তৎকালীন প্রক্টরের কাছে সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে উত্যক্ত করা ও হয়রানির অভিযোগ জানিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে আম্মানের হয়রানি, হুমকির শিকার হচ্ছেন ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন জানিয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু তিনি কোনও প্রতিকার পাননি। সংশ্লিষ্টরা কেবল আশ্বাস আর সুপারিশ প্রদানের মাধ্যমেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেছে।

আসলে যৌন হয়রানির অভিযোগগুলো ধামাচাপা দেওয়ার একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এর প্রকোপ চরম মাত্রায় পৌঁছেছে। পদ-পদবি-রাজনৈতিক পরিচিতির জোরের কারণে এইসব নরপশুদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এর জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক ব্যক্তিরা দায় এড়াতে পারেন না। যৌন হয়রানির ঘটনাগুলো কখনওই তাদের কাছে গুরুত্ব পায় না।

বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে যৌন হরানির অভিযোগ দাখিলের কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেই। আর যেসব প্রতিষ্ঠানে ‘যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ব্যবস্থাপনা’র জন্য কমিটি আছে, সেগুলোও ঠুঁটো জগন্নাথ। অভিযোগ এলে কমিটির সদস্যরা এগুলোকে ফাইলবন্দি করে রাখে। অথচ তারা যদি অভিযোগগুলো ফাইলবন্দি না করে উদ্যোগী হন, তদন্ত-সাপেক্ষে প্রতিটি অভিযোগের ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেন, তাহলে কিন্তু হয়রানিকারীরা কিছুটা হলেও নিজেদের আচরণ পরিবর্তনে বাধ্য হতেন। যৌন হয়রানির ঘটনাগুলো কমে যেত।

একেকটি যৌন হয়রানির ঘটনা সামনে আসে, আমরা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি। কেউ কেউ আশা রাখি, এমন হয়রানির ঘটনা আর দেখতে হবে না। আমরা আশা রাখি, এ বারের অভিজ্ঞতা হয়ত উন্নততর মানবিকতায় পৌঁছে দেবে এ সমাজকে। কিন্তু আবার হানা দেয় নিপীড়ক, আবার লজ্জিত করে মনুষ্যত্বকে। আমরা অনুভব করি, একটুও এগুতে পারিনি, কোনও উন্নততর মানবিকতায় পৌঁছাইনি।

বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় ২০০৯ সালে যৌন নির্যাতন প্রতিকার ও প্রতিরোধের বিষয়ে হাইকোর্ট একগুচ্ছ নির্দেশনা দেন। হাইকোর্টের এ নির্দেশনা আইনে রূপান্তর না হওয়া পর্যন্ত সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এ নির্দেশনাই আইন হিসেবে কাজ করবে বলে ঘোষিত হয় এবং সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রের জন্য এ নীতিমালা মেনে চলার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। কিন্তু বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র তা মানছে না এবং এই নির্দেশ মানা ও না মানার বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে কোনও নজরদারি নেই। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ‘যৌন নিপীড়ন অভিযোগ সেল’ গঠন করার বিষয়কে অগ্রাহ্য করেছে প্রশাসন।

যৌন হয়রানির মতো ঘটনা প্রতিকারে সচেতনতা ও জনমত তৈরির জন্য হাইকোর্টের নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছিল যে, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতি শিক্ষাবর্ষের প্রারম্ভে কাজ শুরুর আগে শিক্ষার্থীদের এবং সব কর্মক্ষেত্রে মাসিক ও ষাণ্মাসিক ওরিয়েন্টেশানের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এর পাশাপাশি সংবিধানে বর্ণিত লিঙ্গীয় সমতা ও যৌন নিপীড়ন সম্পর্কিত দিকনির্দেশনাটি বই আকারে প্রকাশ করতে হবে। কিন্তু এটা মেনে চলার ক্ষেত্রে কারও তেমন কোনও উৎসাহ নেই। আর এই উদাসীনতার সুযোগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যৌন নিপীড়নকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।

সমাজবিজ্ঞানে ‘সেক্সুয়াল ইন্টারঅ্যাকশন কম্পিটেন্সি’ বলে একটা ধারণা আছে। এই ধারণায় ঠিক যৌন আচরণ অর্থে নয়, বৃহত্তর অর্থে বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে সুস্থ আচরণের ক্ষমতাকে বোঝানো হয়। বলা হয়, যেভাবে অক্ষরজ্ঞান শিখতে হয়, কম্পিউটার শিখতে হয় সেভাবে, কোনও বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা-আচরণেরও একটা শিক্ষা আছে। সে শিক্ষা পরোক্ষভাবে পরিবার থেকে আসে, পঠনপাঠনের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া রুচিবোধ, নীতিবোধ থেকে আসে, আসে ধর্মবোধ থেকেও। অনেক ক্ষেত্রে এই বিষয়ের ওপর প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমেও তা অর্জন করার ব্যবস্থা করা হয়। যেসব পুরুষের কোনও সূত্র থেকেই সেই শিক্ষাটা আসে না, তারা পরিণত হয় প্রবৃত্তিসর্বস্ব, লিঙ্গসর্বস্ব এক একটা বেকুব জন্তুতে। আমাদের পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান থেকে এই শিক্ষা না পাওয়ার কারণে এখন এই বেকুব জন্তুদেরই বাড়বাড়ন্ত। আমরা এও লক্ষ করছি যে দেশের ভেতর একটা সাংস্কৃতিক মেরুকরণ চলছে কিছুকাল ধরে। মেয়েরা তাদের পোশাক, আচরণ ইত্যাদি দিয়ে পুরুষদের বর্বর আচরণে প্ররোচিত করে—এমন কুযুক্তি দেওয়ার মানুষও এ দেশে কম নেই। ফলে নারীর ওপর যৌন নিপীড়নকে একটা সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা দেওয়ার চেষ্টা আছে।

দু’য়েকটি সংবাদপত্রে ছাড়া গণমাধ্যমেও যৌন নিপীড়কদের খবর তেমন গুরুত্ব পায় না। নারীর অপমানকে, নিপীড়ন-নির্যাতনকে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আসলে ঢেকে রাখতে চায়, আড়াল করে রাখতে চায়। কারণ? তাহলে যে পুরুষের হিংস্র চেহারাটা বেরিয়ে আসবে। লাম্পট্য প্রকাশিত হয়ে পড়বে। আমরা যত বড় লম্পটই হই না কেন, লাম্পট্যকে ঢেকে রাখতে চাই। বরং চান্স পেলে নিজেদের লাম্পট্যের দায় নারীর স্বভাব, আচরণ, চরিত্র বা পোশাকের উপর চাপিয়ে নিজেকে সাধু প্রমাণ করতে চাই!

নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ এগুলো একেকটা ব্যাপকতর পুরুষতান্ত্রিক অসুস্থতার প্রকাশ। সেই অসুস্থতা, যার আরেক নাম পুরুষতান্ত্রিক বিকার, সেটা তো শ্রেণিধর্মজাতগোষ্ঠী সব ছাপিয়ে রমরমিয়ে বিরাজমান, সদরে অন্দরে বাজারে বাড়িতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।

তবে নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের ঘটনাগুলো নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হওয়া উচিত। অনেক গবেষণা, সমীক্ষা, অনেক তথ্যচিত্র, অনেক তর্কবিতর্ক হওয়া উচিত। তাতে অপরাধের উৎসভূমিতে নতুন আলো পড়বে, সমাজমানসের ব্যাধিগুলিকে আরও স্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত করা যাবে, যে ব্যাধির মূলে আঘাত করতে না পারলে অপরাধের নিরাময় সম্ভব নয়। সন্দেহ নেই, সমাজশুদ্ধির এই সব সৎ উদ্যোগ বা প্রচেষ্টায় পুরুষতন্ত্র ‘রে-রে’ করে তেড়ে আসবে, হরেক কিসিমের সমাজপতি নানা বুলি ও ধর্মের দোহাই দিয়ে অপরাধীকেই প্রশ্রয় দেবে, রাষ্ট্রও হয়ত রক্তচক্ষু দেখাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আটকাতে পারবে না। কারণ সমাজ দাঁড়িয়ে থাকে না, এমনকি বাংলাদেশের মতো ‘রক্ষণশীল’ সমাজও নয়।

দু’টো বিষয় নিশ্চিত করা হোক। প্রথমত, অপরাধীর বা অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হোক। দ্বিতীয়ত, গাফিলতি যদি থেকে থাকে অন্য কোনও পক্ষের, যথোপযুক্ত পদক্ষেপ হোক তার বিরুদ্ধেও। অভিযুক্তদের বিচার অত্যন্ত দ্রুত হওয়া জরুরি। অপরাধ প্রমাণিত হলে এমন সাজা হোক, যা ভবিষ্যতে যে কোনও অপরাধপ্রবণের বুকে আগাম আতঙ্ক জাগাবে।

মানুষ হতে হলে ‘মনুষ্যত্ব’কেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে, লাম্পট্যকে নয়। এটা মানবতার দায়। অপরাধীকে আড়াল করে সমাজ থেকে অপরাধ দূর করা যাবে না। অপরাধের কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। প্রতিকারের উপায়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে। এতে সমাজের, বা পুরুষের মাথা হেঁট হবে না। পুরুষতন্ত্রের মাথা হেঁট হতে পারে, আর তা হলেই মঙ্গল।

দু’টো বিষয় নিশ্চিত করা হোক। প্রথমত, অপরাধীর বা অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হোক। দ্বিতীয়ত, গাফিলতি যদি থেকে থাকে অন্য কোনও পক্ষের, যথোপযুক্ত পদক্ষেপ হোক তার বিরুদ্ধেও। অভিযুক্তদের বিচার অত্যন্ত দ্রুত হওয়া জরুরি। অপরাধ প্রমাণিত হলে এমন সাজা হোক, যা ভবিষ্যতে যে কোনও অপরাধপ্রবণের বুকে আগাম আতঙ্ক জাগাবে। এমন দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপের জন্য প্রশাসনকে বা সরকারকে বা আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে হয়ত বিশেষভাবে উদ্যোগী হতে হবে।

প্রয়োজনে তাই হোক। কিন্তু এই অন্যায়ের দৃষ্টান্তমূলক প্রতিকার সুনিশ্চিত করা হোক।

প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বা উপযুক্ত সতর্কতা থাকলে যে অপরাধ ঘটতে পারে না, সে কথাও মনে রাখা জরুরি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়ে আদৌ খুব যত্নবান? কয়টি প্রতিষ্ঠানে হাইকোর্টের নির্দেশনা মেনে যৌন নিপীড়ন অভিযোগ সেল গঠন করা হয়েছে? এই কমিটি কি কার্যকর? এই রকম অনেক প্রশ্ন কিন্তু উঠছে।

এই প্রশ্নগুলোর জবাব পাওয়ার বিষয়েও অত্যন্ত গুরুত্ব দিতে হবে। কর্তৃপক্ষ কতটা কর্তব্য পরায়ণ, তা এই প্রশ্নগুলোর জবাবেই স্পষ্ট বোঝা যাবে। গাফিলতির আঁচ যদি মেলে, ঔদাসীন্য যদি প্রমাণিত হয়, তা হলে যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

লেখক: লেখক ও কলামিস্ট।
ইমেইল: chiros234@gmail.com

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত