Beta
সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪
Beta
সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪

শ্রদ্ধাঞ্জলি

যে স্বপ্ন অপূর্ণ রেখে শফী আহমেদের বিদায়

শফী আহমেদ। প্রতিকৃতির গ্রাফিক্স: সকাল সন্ধ্যা ক্রিয়েটিভ টিম।

১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগেই আমরা শফী আহমেদের নাম জানতাম। তখন তিনি জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করে তাঁকে সরাসরি দেখা। ক্যাম্পাসভিত্তিক সাংবাদিকতা শুরু করার পর চেনাজানা।

ছাত্রনেতা হিসেবে শফী আহমেদকে নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত ছিল। এসব গল্প ডালপালা মেলে তাঁকে পরিণত করেছিল মিথে। তার সবই যে সত্য ছিল এমন নয়। আবার অনেক গল্প মিথ্যেও ছিল না। এর কারণ তাঁর অসম্ভব প্রভাববিস্তারকারী ক্ষমতা এবং সকলের জন্য ভালোবাসা। সেটা হোক নিজ সংগঠনে কিংবা অন্য ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব পর্যায়ে অথবা সাধারণের মধ্যে। নিজের সাংগঠনিক দক্ষতা এবং ডালপালা মেলা গল্পের মিথে তিনি এক বিশেষ চরিত্র ছিলেন। আসলে তিনি ছাত্ররাজনীতির এক নায়ক ছিলেন তখন।

অথচ শফী আহমেদকে দেখে তাঁর ক্ষমতা সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা পাওয়া সম্ভব ছিল না। ছোটখাট গড়নের একজন মানুষ। খুব উচ্চকণ্ঠও নন। কাপড়চোপড়ে খুব সাদামাটা। অথচ একই জেলায় বাড়ি হওয়ার কারণে তার অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের কথা জানা ছিল। তার মধ্যে কখনো সেটার প্রকাশ ছিল না। তবে, শফী আহমেদের কর্মীদের জানা ছিল যে পিতৃপ্রদত্ত অর্থে তিনি শুধু নিজেকেই চালান না, কর্মীদের অনেককেও।

বলা হতো, রাজনীতির অংক খুব ভালো বুঝতেন শফী আহমেদ। আসলে তখন রাজনীতি ছিল, তাই তিনি রাজনীতির সমীকরণ মেলাতে পারতেন। এখন সেই রাজনীতি হারিয়ে গেছে বলে একমাত্র রাজনীতির প্রতিই বিশ্বস্ত ও আস্থাবান শফী আহমেদ তথাকথিত রাজনীতির সমীকরণ থেকে ছিটকে পড়েছিলেন।

বলা হতো, রাজনীতির অংক খুব ভালো বুঝতেন শফী আহমেদ। আসলে তখন রাজনীতি ছিল, তাই তিনি রাজনীতির সমীকরণ মেলাতে পারতেন। এখন সেই রাজনীতি হারিয়ে গেছে বলে একমাত্র রাজনীতির প্রতিই বিশ্বস্ত ও আস্থাবান শফী আহমেদ তথাকথিত রাজনীতির সমীকরণ থেকে ছিটকে পড়েছিলেন।

শফী আহমেদ এবং তাঁর প্রজন্মের ছাত্ররাজনীতির সবচেয়ে বড় সাফল্য নব্বইয়ের ছাত্রগণঅভ্যুত্থান। সেই গণঅভ্যুত্থানে সামনের সারিতে যে ক’জন ছিলেন তাদের অন্যতম শফী আহমেদ। তবে, সকল ছাত্র সংগঠনকে এক রেখে, জাতীয় রাজনীতির নানা হিসাব মোকাবিলা করে এরশাদকে উচ্ছেদ করে দেওয়া খুব সহজ ছিল না। তখনকার ছাত্র নেতৃত্ব সেটা পেরেছিলেন। এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন শফী আহমেদ।

নব্বই সালের ১০ অক্টোবর জেহাদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সকল ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে যে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গড়ে উঠেছিল, ওই দিন সন্ধ্যাতেই সেটা ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে কেন্দ্র করে ভেস্তে যেতে বসেছিল। আবার বাংলাদেশ-জিন্দাবাদওলাদের অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে একাধিকবার ঐক্য ভাঙতে বসেছিল সেসময়। কিছুট জোড়াতালি দিয়ে হলেও শফী আহমেদ এবং অন্যরা সেটা ধরে রাখতে পেরেছিলেন। প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব পর্যায়ে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা এবং প্রভাবিত করতে পারার ক্ষমতা সেটা সম্ভব করেছিল।

যে কোনো আন্দোলনে পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত উত্তরণ ঘটে। জেনারেল এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও তাই। বিরাশি সালে এরশাদ ক্ষমতা দখল করার পরই সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। নব্বই সালের শেষদিকে এসে তা পরিণতির দিকে এগোতে থাকে। এরশাদকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করা আন্দোলনে গুণগত একটি উত্তরণ ঘটেছিল ১৭ নভেম্বর। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ডাকে ওইদিন মন্ত্রীপাড়া ঘেরাও কর্মসূচি এরশাদের ক্ষমতার তখতে তাউশ কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নীতি-নির্ধারণী বৈঠকে মন্ত্রীপাড়া ঘেরাওয়ের এমন অভিনব এবং কার্যকর কর্মসূচির প্রস্তাব করেছিলেন শফী আহমেদ। একদিকে রক্তপাতের আশঙ্কা এবং অন্যদিকে সফল না হলে আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ার শঙ্কা থেকে এরকম একটা কর্মসূচি নিয়ে কেউ কেউ পিছিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন। ইতিহাস সাক্ষী শিক্ষার্থীদের প্রবল অংশগ্রহণে ওই এক কর্মসূচি এরশাদের অবস্থাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যে তাকে সরিয়ে দিতে আর একটা মাত্র ধাক্কা দরকার ছিল।

সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নীতি-নির্ধারণী বৈঠকে মন্ত্রীপাড়া ঘেরাওয়ের এমন অভিনব এবং কার্যকর কর্মসূচির প্রস্তাব করেছিলেন শফী আহমেদ। একদিকে রক্তপাতের আশঙ্কা এবং অন্যদিকে সফল না হলে আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ার শঙ্কা থেকে এরকম একটা কর্মসূচি নিয়ে কেউ কেউ পিছিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন। ইতিহাস সাক্ষী শিক্ষার্থীদের প্রবল অংশগ্রহণে ওই এক কর্মসূচি এরশাদের অবস্থাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যে তাকে সরিয়ে দিতে আর একটা মাত্র ধাক্কা দরকার ছিল।

মন্ত্রীপাড়া ঘেরাও কর্মসূচি দেখে এরশাদ এবং তার গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এটা বুঝে গিয়েছিল যে, এ আন্দোলন বানচাল করতে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ভেতর থেকে ছুরি মারতে হবে। সেজন্য আন্দোলনে থাকা জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের একটি অংশকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেদিন তাদের হটিয়ে দিয়ে ছাত্রদলের মূলধারাকে সাহস এবং সমর্থন দিয়ে আন্দোলনে ধরে রাখতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন শফী আহমেদ।

এরশাদের পক্ষে যাওয়া ছাত্রদলের ছোট ওই অংশ রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় ক্যাম্পাসের কিছুটা দখলে নিতে পারলেও ২৭ নভেম্বর জাসদ এবং বিএমএ নেতা ডা. শামসুল আলম খান মিলন শহীদ হওয়ার পর প্রবল প্রতিরোধে এরশাদের বাহিনী ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। জরুরি অবস্থা ঘোষণা হলে আন্দোলন প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে সপ্তাখানেকের মধ্যে পদত্যাগের ঘোষণা দিতে বাধ্য হন এরশাদ।

এভাবে এরশাদের চূড়ান্ত পতন আসলে শুরু হয়েছিল ১৭ নভেম্বর মন্ত্রীপাড়া ঘেরাও কর্মসূচির মাধ্যমে যে কর্মসূচির প্রস্তাবক ছিলেন সেসময়ের ছাত্রনেতা শফী আহমেদ।

শফী আহমেদরা তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা শুরু হয়। তবে, যে চেতনাকে ধারণ করে ৯০’র ছাত্রগণঅভ্যুত্থান, সেটা কি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়েছে? না, সেটা হয়নি। বরং গণতন্ত্রের সময় ধনিক-বণিক-আমলাদের কাছে আগের চেয়েও বেশি বাকশোবন্দী হয়ে পড়েছে আমাদের রাজনীতি। না হলে শফী আহমেদের মতো সাবেক ছাত্রনেতাদের রাজনীতির শীর্ষে না যেতে পারার কথা না।

শফী আহমেদরা তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা শুরু হয়। তবে, যে চেতনাকে ধারণ করে ৯০’র ছাত্রগণঅভ্যুত্থান, সেটা কি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়েছে? না, সেটা হয়নি। বরং গণতন্ত্রের সময় ধনিক-বণিক-আমলাদের কাছে আগের চেয়েও বেশি বাকশোবন্দী হয়ে পড়েছে আমাদের রাজনীতি। না হলে শফী আহমেদের মতো সাবেক ছাত্রনেতাদের রাজনীতির শীর্ষে না যেতে পারার কথা না।

একথা বলতেই হবে যে, শফী আহমেদ বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ুর চেয়েও ১০ বছর আগে চলে গেছেন ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক স্বপ্ন অপূর্ণ রেখে। তাঁর যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সাংগঠনিক দক্ষতা এবং বিপুল জনসমর্থন; তাতে পরিণত বয়সে তাঁকে আমাদের জাতীয় সংসদেই দেখার কথা ছিল। কিন্তু, রাজনীতির এক ধরনের দুর্বৃত্তায়নের কারণে সেটা হয়নি। সেই ব্যক্তিগত স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার চেয়েও শফী আহমেদদের যন্ত্রণা আরো বেশি ছিল অন্য জায়গায়। সেটা ৯০’র যে ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে তাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেই লক্ষ্য অর্জন না হওয়া।

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক। হেড অফ ডিজিটাল, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
ইমেইল: znewaz@gmail.com

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত