শফিক রেহমান প্রবীণ সাংবাদিক, জনপ্রিয় উপস্থাপক। রাজনীতি সংশ্লিষ্ট শফিক রেহমান বরাবরই তুমুল আলোচিত ও সমালোচিত; যদিও লন্ডন প্রবাসী শফিক রেহমান হাসতে হাসতে দাবি করলেন, ‘আমি তো রাজনীতি করি না’।
তবে সকাল সন্ধ্যার সঙ্গে কথোপকথনে শুধু ভালোবাসার কথাই বললেন না নব্বই ছুঁইছুঁই শফিক রেহমান, টেনে আনলেন অতীতের রাজনৈতিক প্রসঙ্গও। দেশ-বিদেশ মিলিয়ে এক জীবনে প্রায় নব্বই বসন্ত দেখে ফেলা শফিক রেহমানকে ভালোবাসার দিবসের আগেই নাগাল পাওয়া গেল।
রেসকোর্সে শফিক রেহমান
শফিক রেহমানের কাছে, বাংলাদেশ ভূখণ্ডের গোড়াপত্তন হয়েছিল ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে পূর্ব পাকিস্তান নামে।
“১৯৭০ এ আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর স্বাধীনতা আরও গুরুত্ব ও পরিচিতি পায়। কিন্তু ৪৭-এ স্বাধীনতা পেলেও পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ শোষণমুক্ত হতে পারেনি এবং আধুনিক সভ্যতার দিকে এগিয়ে যেতে পারেনি।”
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট নিয়ে শফিক রেহমানের বিশ্লেষণ- “এর দুটো কারণ ছিল। একটি– বৃটিশ শাসন, আরেকটি– পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ। এই শাসনের শোষণমুক্ত হবার জন্যই ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ।
“তারমানে ১৯৭১ এ শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল না। সেটা ছিল শোষণমুক্ত হবার মুক্তিযুদ্ধ। আর সেজন্যই পশ্চিমে ১৯৭১ এর যুদ্ধকে বলা হয় ওয়ার অব লিবারেশন অথবা মুক্তিযুদ্ধ; ওয়ার অব ইন্ডিপেনডেন্স বা স্বাধীনতা যুদ্ধ নয়।
“এর তাৎপর্য, ১৯৪৭ এ পাকিস্তান না হলে পূর্ব পাকিস্তান হতো না। ১৯৭১ এ পূর্ব পাকিস্তান না থাকলে বাংলাদেশ হতো না। অর্থাৎ ১৯৭১ পর্যন্ত সকল বাংলাদেশি স্বাধীন ছিল এবং পাকিস্তানেও বিশ্বাস করত। এবং শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং পাকিস্তানের মন্ত্রী হয়েছিলেন।”
৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ রেসকোর্সের মাঠে গিয়ে শুনেছিলেন শফিক রেহমান। রেসকোর্সের ময়দান তার বাড়ির খুব কাছেই ছিল।
সেদিন ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান ‘জিয়ে পাকিস্তান’ বলেছিলেন বলে এক সময় অনেক অপপ্রচার চলেছিল।
শফিক রেহমান সেসব অপপ্রচারে কান না দিয়ে নিজের কানে শোনা ওই ভাষণের কথা তুলে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “৭ই মার্চে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ আমি নিজে শুনেছি আমার স্ত্রীসহ রেসকোর্সে গিয়ে।
“তিনি ‘জয় বাংলা’ বলে ভাষণ শেষ করেছিলেন। তবে জনতার অনেকেই হয়তো সেই স্লোগানটি শোনেনি। শেখ মুজিব ‘জিয়ে পাকিস্তান’ বলেননি।”
১৯৭১ সালের ‘অর্ধেক সময়’ পর্যন্ত রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অ্যাকটিং জেনারেল ম্যানেজার এবং চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট এ দুই পদের দায়িত্বে ছিলেন শফিক রেহমান।
“এর ফলে জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ উভয় পাকিস্তানের বহু রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল।”
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম একজন সংগঠক ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী; যিনি পরে স্বাধীন বাংলাদেশে দুইবার মন্ত্রী হন। ইংল্যান্ডে তার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের হয়ে কাজ করেন শফিক রেহমান।
“আমি জুন মাসে সপরিবারে লন্ডনে চলে যাই। মুক্তিযু্দ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করিনি। এই সময় কিছু আমলা (পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতসহ) মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেন। তবে তাদের চাকরি ও নিয়মিত বেতন সম্পর্কে কোনো ঝুঁকি বা দুশ্চিন্তা ছিল না।”
শফিক রেহমান নিজে এসব ‘বেতন সুবিধাদি’ নিতে রাজি হননি বলে দাবি করেন সকাল সন্ধ্যাকে।
১৪ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখের নেপথ্যে
মুক্তিযুদ্ধের পরে শোষণমুক্ত বাংলাদেশে ফিরে আসাটা খুবই কঠিন ছিল।
“কারণ কোনও লন্ডন-ঢাকা ফ্লাইট ছিল না। ১৯৭২ এ আমি অনেক কষ্ট করে ১০ই ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় ফিরে আসি।”
ওই বছর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নববর্ষ উদযাপিত হয় ১৪ই এপ্রিল। ১৯৭২ সালের সেদিনটি ছিল শুক্রবার।
স্বাধীন বাংলাদেশ হওয়ার আগে প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট এরপর থেকেই পহেলা বৈশাখ পালন করে আসছিল। যদিও মুক্তিযুদ্ধের সময় এপ্রিলে বাংলা নববর্ষ বরণের আয়োজন হয়নি।
এরপর ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালন হওয়ার পেছনের ওই ঘটনাক্রম সকাল সন্ধ্যাকে জানালেন শফিক রেহমান।
দেশে ফিরে তিনি দেখলেন, ‘তখন পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বার্ষিক অনুষ্ঠান আসন্ন’।
“আমরা কয়েকজন সমমনা ব্যক্তি সংশয়ে পড়ে গেলাম। পহেলা বৈশাখ কোনদিন? গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা অনুযায়ী ১৪ই এপ্রিল নাকি ১৫ই এপ্রিল? এরফলে বড় বড় অনুষ্ঠানগুলো আয়োজন করা খুবই অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকল।”
হাতে লেখা পাঁজি থেকে প্রথম ছাপা অক্ষরে পঞ্জিকা এনেছিলেন দুর্গাচরণ গুপ্ত। ছাপাতেন কলেজ স্ট্রিটের গুপ্ত প্রেস থেকে। প্রাচীন গণনা পদ্ধতির গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকার বদলে পরে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ শুরু হলো বাংলাদেশের বর্ষবরণে। অন্তত চারশো বছর ধরে গোটা বিশ্বে অধিকাংশ দেশই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নির্ভর জীবনচর্চা করছে। শফিক রেহমান বললেন, “আমরা বাংলা একাডেমিকে অনুরোধ করলাম, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের মতো অনুসরণ করতে; তাতে তারিখে কোনো নড়চড় হবে না সারা বছর। তাই ১৯৭২ সাল থেকে ১৪ই এপ্রিল হলো পহেলা বৈশাখ।”
ভালোবাসার বিশেষ দিন
উইকিপিডিয়াতে শফিক রেহমানের পরিচিতি পর্বে লেখা আছে তাকে বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবসের ‘প্রচলক হিসেবে মনে করা হয়’।
এদিকে মানুষের মন থেকে ১৪ই ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস ভুলিয়ে দিতে শফিক রেহমান ভালোবাসা দিবসের আমদানি করেন, এমন ‘অপবাদ’ রয়েছে তার।
১৯৮৩ সালে এরশাদের শাসন চলছিল। তার শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে পুলিশের গুলিতে সড়কে আত্মাহুতি দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্র। কতজন মারা গেলেন সেই সংখ্যা নিয়ে এরশাদের সরকার লুকোচুরিও করেছিল। ওই তারিখটি ছিল ১৪ই ফেব্রুয়ারি; যা হয়ে ওঠে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস।
তবে এই দিবস পালনে সবার মনোযোগ সরাতেই পশ্চিমের ভ্যালেন্টাইন বাংলাদেশে এনেছেন এমন কোনো ‘গোপন বাসনা’ মিললো না শফিক রেহমানের কথায়।
উল্টো তিনি যে এরশাদের একজন কট্টর সমালোচক ছিলেন সেকথা মনে করিয়ে দিলেন সকাল সন্ধ্যাকে।
১৯৮৪ সালে সাপ্তাহিক যায়যায়দিন পত্রিকা চালু করেন তিনি। তখন এই পত্রিকার সম্পাদক শফিক রেহমানকে রাজনৈতিক কারণে বিদেশে চলে যেতে হয়।
ইংরেজদের শহরে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে প্রথম দেখলেন ও জানলেন শফিক রেহমান। এরপর ১৯৯৩ সালে দেশে এসে পশ্চিমের ভ্যালেন্টাইনস ডে থেকে করলেন দেশীয় ভালোবাসা দিবস।
পুরনো ওই ইতিহাস মনে করে তিনি বলেন, “১৯৯৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে আমি ভালোবাসা দিবসের প্রবর্তন করি, সাপ্তাহিক যায়যায়দিনের মাধ্যমে।
“শুধু ঘোষণা করলেই এই দিনটি প্রচার ও প্রসার লাভ করত না। প্রথমত, আমি ১৪ই ফেব্রুয়ারি যেটি পশ্চিমে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনস নামে পরিচিত এবং প্রেমিক-প্রেমিকা ও স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সীমাবদ্ধ সেটা করিনি।”
“আমি দেখতাম বাস, রিকশা, বেবি ট্যাক্সির পেছনে লেখা ‘মা’ অথবা ‘মায়ের দোয়ায় চলিলাম’। আমি বুঝলাম বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসার সম্পর্ক মা ও সন্তানের মধ্যে। তাই ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’র বদলে আমি ওই দিনের নাম দিলাম ভালোবাসা দিবস।”
ওই সময় যায়যায়দিন সম্পাদক শফিক রেহমান ‘ভালোবাসার দিন’ নিয়ে লেখা আহ্বান করেন।
“তারা জীবন থেকে নেওয়া হাজার হাজার কাহিনী আমাকে পাঠালো। আমি নিজেও লিখলাম। তার উপরে জানিয়ে দিলাম ভালোবাসা উদযাপন করতে অল্প পয়সা দরকার। একটি গোলাপ এবং একটি লজেন্স কিনে প্রিয়জনকে দিন। সবচেয়ে জরুরি ওইদিন সকাল বেলায় বাবা-মাকে এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়ান।”
১৯৯৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘ভালোবাসা সংখ্যা’ প্রকাশ করল শফিক রেহমানের যায়যায়দিন।
“এর সাথে আমি চা খাওয়ার মগ, বুক মার্ক, ল্যামিনেটেড ভালোবাসার কবিতা ইত্যাদি প্রকাশ করলাম।” “এই ভালোবাসার দিন চালু হবার পেছনে শুধু আমার একক সিদ্ধান্ত ও প্রচেষ্টা ছিল না – ছিল হাজার লেখক-লেখিকা ও পাঠক-পাঠিকা।”
ফুল চাষে আয়-রোজগার
এবার ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে হচ্ছে ২০ কোটি টাকার বাণিজ্য। গত কয়েক দশকে সারাদেশে বেড়েছে ফুল চাষী আর ব্যবসায়ী।
ফুলের রাজ্য হয়ে উঠেছে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালীর মাঠ। ভালোবাসার ফুলের পসরার নিয়ে একদিনের মৌসুমী বিক্রেতারাও ভালো রোজগার করেন রাজধানীর পাড়ায় পাড়ায়।
এই নতুন অর্থনীতির পথে ফুল বিছিয়েছিলেন হয়তো শফিক রেহমানই।
ভালোবাসা দিবস এভাবে ‘এতো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাবে’ সেকথা তার ‘কল্পনাতেও ছিল না’।
“আমি অবাক হয়েছিলাম পত্রিকা পড়ে। এক বছরে ভালোবাসার দিন শুধু যশোরেই ১২ কোটি টাকার গোলাপ ফুল বিক্রি হয়েছিল।”
“তাই আমি শাহবাগে যখনি ফুল কিনতে যেতাম তখনি তাবৎ দোকানদার আমাকে এসে জড়িয়ে ধরে ফুল উপহার দিয়ে বলত, “স্যার, আমরা তো শুধু ধানচাল চাষের কথাই জানতাম। ফুল চাষ করে যে আয় করা যায় আমরা জানতাম না।”
ভালোবাসা দিবস কি বাণিজ্যিক হয়ে গেল তাহলে?
শফিক রেহমানের অবশ্য তাতে কোনো আপত্তি নেই।
“ভালোবাসার দিন একটি বাণিজ্যিক দিনও বটে। এবং সেজন্য আমি খুশি। কারণ মানুষের আয় হচ্ছে।”
“অনেকেই হয়ত জানেন না, ইউরোপে অনেক ফুল আমদানি হয় চায়নার কুনমিং শহর থেকে। ঢাকা থেকে কুনমিং ফ্লাইট খুব বেশি দাম নয়। এবং সেখানে থাকাও যায় সস্তায়। যারা ফুল ভালোবাসেন তারা সেখানে যেতে পারেন। এটা হবে অপূর্ব অভিজ্ঞতা।”
ভালোবাসা দিবস ঠেকাবে কে?
শফিক রেহমানের চালু করা বলে অনেকের এই দিবস উদযাপনে সায় নেই এমন আভাস সকাল সন্ধ্যাকে দিলেন তিনি।
তার ভাষ্যে, “২০০৯ এর পরে ভালোবাসার দিনের প্রসার ঠেকানোর জন্য এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী ও দলীয় কর্মী পহেলা ফাল্গুন অর্থাৎ ১৩ই ফেব্রুয়ারিতে তারা খুব ঘটা সহকারে বসন্ত বরণ দিবস উদযাপন শুরু করল। এমনকি তারা আর্ট কলেজ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট) থেকে মিছিল শোভাযাত্রা বের করা শুরু করল। তারা বলল, ১৩ই ফেব্রুয়ারি পহেলা ফাল্গুনে বসন্ত বরণ উদযাপন করুন।”
ঘটনা আরেকটু বুঝতে শফিক রেহমান আবার গেলেন শাহবাগে।
“আমি সেই ফুলওয়ালাদের কাছে গেলাম। তারা বললো, স্যার ভালোই হয়েছে। আমরা ১৩ই ফেব্রুয়ারিতেও ফুল বিক্রি করছি এখন, ১৪ই ফেব্রুয়ারিতেও ফুল বিক্রি করছি। অর্থাৎ দুইদিন আমরা আয় করছি।”
“জেনে আমি খুব খুশি হলাম। কিন্তু তারা এটাও বলেছিল, তবে ১৩ই ফেব্রুয়ারিতে বেশি বিক্রি হয় না। জেনে আমি অনুমান করেছিলাম ১৩ই ফেব্রুয়ারি টিকবে না।”
সেই ‘অনুমান’ ২০২৪ সালে এসে ‘সত্যি হয়েছে’ বলে মনে করেন শফিক রেহমান।
১৪২৬ বঙ্গাব্দ থেকে সরকারিভাবে নতুন পঞ্জিকা অনুসরণ করা হচ্ছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২০১৯ সালে যে ছুটির তালিকা প্রকাশ করে, তাতে বাংলা বর্ষপঞ্জির নতুন তারিখগুলো উল্লেখ করা হয়।
এরপর থেকে পহেলা ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবসের তারিখ এক হয়ে যায়।
এই হালনাগাদ নিয়ে শফিক রেহমান বললেন, “অর্থাৎ পহেলা ফাল্গুন এখন হয়ে গেছে ১৪ই ফেব্রুয়ারি।
“আর তাই সরকারি ও দলীয় ভাবে চলবে এখন থেকে ১৪ই ফেব্রুয়ারি ভালোবাসার দিন নয়, বসন্তবরণ উৎসব দিন পালন করার প্রচেষ্টা।” “আমি এই প্রচেষ্টার শুভ কামনা করি। বসন্ত বরণ দিন ও ভালোবাসার দিন কখনই যেন সাংঘর্ষিক না হয়।”
খুলে গেল ভালোবাসার রাস্তা
ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় একটি গলির নাম লাভ রোড। এবারও এই নামের পেছনের মানুষটি শফিক রেহমান।
লাভ রোড নামের ধারণা অবশ্য তিনি পেয়েছিলেন চট্টগ্রামে।
“তখন আমি চট্টগ্রামের সবে প্রেমে পড়েছি। ডিসি হিল থেকে আসকার দীঘি পর্যন্ত লাভ লেইন আছে। ওখানে চট্টগ্রামে সবচেয়ে ভালো পান বিক্রি হতো। ওই পান খেতে অনেকেই লাভ লেইনে আসতো। এমনকি ঢাকার বিয়েতেও সেই দোকানের পান বিলি হতো।”
ওই সময় অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন সাদেক হোসেন খোকা। তার কাছেই লাভ রোডের প্রস্তাব রাখেন শফিক রেহমান।
“বিষয়টি আমি ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকাকে অনুরোধ করলাম। ঢাকায় যেন একটা লাভ রোড হয়।”
“তিনি দূরদর্শী ছিলেন। বললেন, আপনার অনুরোধে ঢাকার কোনো রাস্তার নাম যদি লাভ রোড হয় তাহলে পরবর্তী সরকার সেই রোডের নাম বদলে দিতে পারে। সেজন্য বীরশ্রেষ্ঠ ও বীর উত্তমদের নামে করতে হবে এবং একই সাথে লাভ রোডও করতে হবে।”
লাভ রোড এখনও বহাল রয়েছে।
তবে টেলিভিশনে ‘লাল গোলাপ’ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক এবং ‘মৌচাকে ঢিল’ সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক শফিক রেহমানের আরও একটি ইচ্ছে আছে – একটি লাভ পার্ক।
ভালোবাসা দিবসের তিন দশক পেরিয়ে
শফিক রেহমানের চোখে ভালোবাসার দিন আর যে কোনও দিবস থেকে আলাদা।
“এই জন্য যে এই দিনটির সঙ্গে কোনো সংঘর্ষ বা রক্তপাতের সম্পর্ক নেই। কোনো ধর্মের সংঘর্ষ নেই। বাংলাদেশে উদযাপিত প্রায় প্রতিদিনের উৎপত্তি রক্তের উপর ভিত্তি করে।”
“আবার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন দিনে ধর্মীয় উৎসব পালিত হয়। উদাহরণ খৃশ্চিয়ানদের কৃসমাস, মুসলিমদের দুটি ঈদ, হিন্দুদের বিভিন্ন পূজা। আবার বিভিন্ন দেশে নববর্ষ উদযাপিত হয় বিভিন্ন দিনে। যেমন বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ, ইরানে নওরোজ, পশ্চিমে নিউ ইয়ারস ডে।
“বিভিন্ন দিন পালনে বিভিন্ন দেশে এত ভিন্নতা আছে। কিন্তু ১৪ই ফেব্রুয়ারি ভালোবাসার দিন উদযাপন নিয়ে কোনো ভিন্নতা নেই।”
ভালোবাসা দিবসের ৩০ বছর পেরিয়ে গেছে তা মনে করে দিতেই চট করে একবার গুণে নিলেন শফিক রেহমান। মনে মনে তিনি হয়তো গর্ববোধ করলেন।
বাংলাদেশে এই দিবসের ইতিহাস গড়ে দেওয়া সেই মানুষটি তা ভেবেই হয়তো হেসে বললেন, “ভালোবাসার দিন তো এখন ভালোবাসার সপ্তাহে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ ৭ই ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪ই ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন নামে উদযাপিত হচ্ছে। যেমন একটি দিন চুমুর দিন, একটি দিন বিয়ের প্রস্তাবের দিন, একটি দিন শুধুই আলিঙ্গনের দিন।
“আমি চাই শুধু ভালোবাসা দিবস উদযাপিত হোক ধর্ম, বর্ণ, দেশ নির্বিশেষে। তবে বাংলাদেশে দল নির্বিশেষে নয়!”
যারা ভালোবাসেন আর যারা ভালোবাসার দিনটিকে ঠেকাতে চান তাদের সবার জন্যই এই দিবসের জনক শফিক রেহমান বলেন, “যারা ভালোবাসার দিনকে এখন উপেক্ষা করতে চাইছেন, তাদের অপরিণামদর্শিতা আছে, কিন্তু দূরদর্শিতা নেই।
“তারপরেও সর্বদলীয় ও বাংলাদেশের সর্বসাধারণকে আমি ভালোবাসার শুভেচ্ছা জানাই। এখন আমার বয়সে আমি তরুণ-তরুণীদের প্রতি বিশেষ অনুরোধ করছি তারা যে প্রবীণদের প্রতি মায়া-মমতা দেখান। এই দিনে তাদের অন্তত এক কাপ চা করে খাওয়ান।”
“এইদিন স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, নাতি-দাদি এদের মধ্যেই নয়; এই দিনটিতে প্রতিবেশিদের সাথে এমনকি ভাড়াটে এবং বাড়িওয়ালার সঙ্গেও সম্পর্ক হতে পারে।”
“পুলিশ এবং র্যাবের সাথে যদি জনগণের ভালোবাসার সম্পর্ক হয় তাহলে তো আরও ভালো। তাই ভালোবাসার দিন পালনের অনুরোধ জানালাম আমার পাঠকপাঠিকাদের। প্রতিশোধপরায়ণতা দূর হোক, পারস্পরিক ভালোবাসা থাকুক।”
(শফিক রেহমানের বক্তব্যে তার অনুসৃত বানানরীতি মানা হয়েছে)