বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশেই ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন জুনাইদ আহমেদ পলক। যিনি ছিলেন শেখ হাসিনার সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের জুলাই-আগস্টে মানবতাবিরোধী অপরাধের এক মামলায় দেওয়া স্বীকারোক্তিতে পলক একথা জানিয়েছেন, এমনটাই দাবি চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলামের।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন তুঙ্গে, ঠিক তখন সারাদেশে কয়েক ধাপে বন্ধ রাখা হয় ইন্টারনেট পরিষেবা। প্রথমে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, এরপর বন্ধ হয়ে যায় ব্রডব্যান্ডও।
জুলাই-আগস্ট মাসে আন্দোলন চলাকালে বেশ কয়েকদফায় ইন্টারনেট বন্ধের কবলে পড়তে হয় দেশের মানুষকে। যার ফলে যোগাযোগ তো ব্যাহত হয়ই, ব্যবসা-বাণিজ্যতেও বিরূপ প্রভাব পড়ে।
সেসময় সরকারের পক্ষ থেকে ইন্টারনেট বন্ধের কারণ হিসেবে ডেটা সেন্টারে আগুন, সাবমেরিন কেবলের তার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা বলেছিলেন তৎকালীন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর কারাবন্দী সেই পলকই বললেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ইন্টারন্যানাল ইন্টারনেট গেইটওয়েসহ (আইআইজি) প্রোভাইডারদের ইন্টারনেট বন্ধ করতে বলা হয়।
বৃহস্পতিবার তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড বিশ্ববাসীর কাছ থেকে আড়াল করতেই ইন্টারনেট বন্ধের ওই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।
পলকের জবানবন্দির বক্তব্য তুলে ধরে তাজুল বলেন, “তিনি স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেছেন, নিজে স্বীকার করেছেন তদানিন্তন প্রধানমন্ত্রী এবং এই মামলাগুলোর প্রধান আসামি শেখ হাসিনার নির্দেশে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নির্দেশনা আসার পরই আইআইজি ইন্টারনেট গেটওয়েদের একটি হোটাসঅ্যাপ গ্রুপ খোলা হয়, সেই গ্রুপে সরাসরি নির্দেশ দেওয়া হয় দ্রুত ইন্টারনেট বন্ধ করতে। এবং তাদের এটা এনশিওর (নিশ্চিত) করতে বলা হয় অর্থাৎ বন্ধ করার পর জানাতে যে, ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছে।”
এই তথ্যগুলো বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়ার পর সেগুলো যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পলককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, “তিনি এটার সত্যায়ন করেছেন। সুতরাং ইন্টারনেট বন্ধের মাধ্যমে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যাকে গোটা দুনিয়া থেকে আড়াল করা হয়েছে। এটার ব্যপারে যে মিথ্যা অজুহাত দেওয়া হয়েছে, ক্যাবল লাইন পুড়ে গিয়েছিল, তা ছিল সর্বৈব মিথ্যা। প্রধান যে নিউক্লিয়াস শেখ হাসিনার নির্দেশে তার পরবর্তী কমান্ডার জুনাইদ আহমেদ পলকের পরবর্তী নির্দেশে ইন্টারনেট প্রোভাইডার যারা আছে, বিটিসিএল, বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলস (পিএলসি) চিঠি দিয়ে বলেছে যে, তারা কার কার নির্দেশে এটা বন্ধ করেছে।”
রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে বাধ্য করে তৎকালীন ক্ষমতাশালীরা বাংলাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ করেছিল মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এর মাধ্যমে এই গণহত্যাকে এক্সপেডাইট (দ্রুত সম্পন্ন করা) করেছে। এই তথ্যগুলো আমরা পেয়েছি। এইগুলোকে ফর্মুলেট করছি, এগুলো বিচারের উপযোগী করে আদালতে উপস্থাপন করব।”
মামুন-জিয়াউলদের তদন্ত ২ মাসে শেষ করার নির্দেশ
জুলাই-আগস্টের সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মামলায় বৃহস্পতিবার সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানসহ আট কর্মকর্তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছিল।
তাদের বিরুদ্ধে দুই মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে নির্দেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
আগামী ২০ ফেব্রুয়ারি তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেয়।
মামুন-জিয়াউল আহসান ছাড়া ট্রাইব্যুনালে হাজির করা অন্যান্য আসামি হলেন- ঢাকা জেলার সাবেক পুলিশ সুপার মো. আব্দুল্লাহ আল কাফি, মিরপুর ডিএমপির সাবেক ডিসি মো. জসিম উদ্দিন মোল্লা, ঢাকার সাবেক অতিরিক্ত সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহিদুর ইসলাম, গুলশান থানার সাবেক ওসি মাজহারুল হক, যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান এবং ঢাকা উত্তর ডিবির সাবেক পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন।
এ বিষয়ে পরে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, “আট আসামিকে হাজির করা হয়। তারা সবাই মোটাদাগে বিভিন্ন পদের পুলিশ অফিসার, সেনাবাহিনীর অফিসার। আমাদের দিক থেকে চারটি আবেদন ছিল। আব্দুল্লাহ আল মামুন, শহীদুল ইসলাম এবং আব্দুল্লাহ আল কাফীকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছিলাম। আগামী ২৬, ২৯ ও ৩০ ডিসেম্বর আলাদা আলাদাভাবে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।”
তবে এই জিজ্ঞাসাবাদ প্রক্রিয়াটা গতানুগতিক কোনও পুলিশ রিমান্ডের মত নয় জানিয়ে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, “সেখানে একটা স্বচ্ছ কাঁচের দেয়ালের পেছনে আমাদের তদন্তকারীরা কথা বলেন এবং কাঁচের দেয়ালের বাইরে বসে তাদের আইনজীবী সব দেখেন। সেখানে কোনও ভয়ভীতি প্রদর্শনের সুযোগ নেই। আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড (মান) মেইনটেইন (রক্ষা) করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।”
এক প্রশ্নের জবাবে তাজুল বলেন, “তদন্তকাজ কতদিনের মধ্যে শেষ করতে হবে, আইনে তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা নেই। এত বড় গ্র্যাভিটির একটা মামলা যথাযথভাবে তদন্ত করা, যথাযথ একটি প্রতিবেদন তৈরি করে জমা দেওয়ার জন্য অনেক সময় প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে ধাপে ধাপে আমরা কোর্টের কাছ থেকে সময় নিচ্ছি, যাতে আমাদের উন্নতিটা যথেষ্ট হয়েছে কিনা, তা আদালতকে দেখাতে পারি।”
এর আগে গত ২০ নভেম্বর এই আট আসামিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা ও নির্দেশদাতার অভিযোগ আনা হয়েছে।