গত বছরও ডিসেম্বর মাসজুড়ে শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনের শিরোনাম ছিল ‘বিজয়ের উৎসব’। স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল বিজয়ের মাসটিকে শিল্পকলার এমন উৎসব ছিল আগের বছরগুলোতেও।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এবার সেই উৎসবের নাম শিল্পকলা একাডেমি দিয়েছে ‘ডিসেম্বরের উৎসব’, যা চোখে পড়েছে অনেকেরই।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স ফেইসবুকে লিখেছেন- “বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি! ডিসেম্বর উৎসব কি জিনিস রে ভাই?? ডিসেম্বরের বিজয় উৎসব কোথায় গেল???”
এই নাম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শিল্পকলা একাডেমি কী ইঙ্গিত দিচ্ছে, তা বুঝতে চাইছেন বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি খান আসাদুজ্জামান মাসুম।
তিনি লিখেছেন, “বিজয় দিবসের উৎসব না লিখে, ডিসেম্বরের উৎসব লেখার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কি মেসেজ দিলেন সেটা বোঝার চেষ্টা করছি ….”
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এসে ‘জয় বাংলা’ জাতীয় স্লোগান থেকে বাদ পড়া, ৭ মার্চ জাতীয় দিবসের তালিকা থেকে বাদ পড়ার ধারাবাহিকতা থেকেই শিল্পকলা একাডেমির এই প্রয়াস বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
কবি-সাংবাদিক রথ রাফি ফেইসবুকে লিখেছেন, “শিল্পকলা কি জামিল আহমেদের নেতৃত্বে ‘রাজাকারকলা’ ফলাতে শুরু করেছে? বিজয়ের মাসের উৎসব কী করে ডিসেম্বরের উৎসব হয়? ডিসেম্বর তো একটা সাধারণ মাস মাত্র। এতে বাংলাদেশের বিশেষ কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
“বাংলাদেশ এ মাসটিকে চেনে ‘বিজয়ের মাস’ হিসেবে, তাই না? ‘বিজয়’ শব্দটি নিয়ে আপত্তি থাকতে পারে একমাত্র জামায়াতের, আর কারও নয়। এটা সবারই জানা। তাদের প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে জামিল আহমেদ কি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করাই বাদ দিয়ে দিয়েছেন?”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সরকারের সব পর্যায়ে যে পরিবর্তনের ঢেউ লাগে, তাতে শিল্পকলা একাডেমির নেতৃত্বও বদলে যায়।
আওয়ামী লীগের প্রায় পুরোটা সময় শিল্পকলার মহাপরিচালক বা ডিজির দায়িত্বে থেকে নানা কর্মকাণ্ডে সমালোচিত লিয়াকত আলী লাকীকে বিদায় নিতে হয়, সেই দায়িত্বে আসেন আরেক নাট্যব্যক্তিত্ব সৈয়দ জামিল আহমেদ।
তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই বিক্ষোভের মুখে একটি নাটক প্রদর্শনী বন্ধ করে দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন। এখন বিজয় দিবস ঘিয়ে আয়োজন নিয়েও পড়লেন নতুন বিতর্কে।
পরিবর্তনের যে যুক্তি দেখাচ্ছেন সৈয়দ জামিল
বিজয় দিবস ঘিরে মাসব্যাপী আয়োজনের নাম পরিবর্তনের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ বলছেন, ‘বিজয়ের মাস’ শব্দটি আওয়ামী লীগ তার রাজনীতির পুঁজি হিসাবে ব্যবহার করে আসছিল, তা থেকে এই উৎসবকে মুক্তি দিতে চাইছেন তারা।
আয়োজনের নাম পরিবর্তনের কারণ সকাল সন্ধ্যার পক্ষ থেক জানতে চাওয়া হলে তিনি শুরুতেই পাল্টা প্রশ্নে বলেন, “বিজয়ের মাস কবে থেকে শুরু হলো?
“আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তর সালে শুনিনি বিজয়ের মাস। শুনবোই না, কারণ পাকিস্তান ছিল। বাহাত্তর সালে শুনিনি বিজয়ের মাস। আপনি একটু খতিয়ে দেখুন তো কবে থেকে আসল বিজয়ের মাস?”
এরপর তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ এই ‘বিজয়ের মাস’টাকে মুক্তিযুদ্ধকে পুঁজি করে তার মতো করে ব্যবহার করেছে।
“তার আর কোনও পুঁজি ছিল না। এক ছিল শেখ মুজিব, আরেকটা মুক্তিযুদ্ধ। এ দুটোকে পুঁজি করে তার গৎবাঁধা যে ন্যারেটিভ তৈরি করেছিল, একরৈখিক একটা ন্যারেটিভ তৈরি করেছিল। যার অর্থ হচ্ছে-আওয়ামী লীগ একমাত্র দল যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে। যেখানে বামপন্থী সকল দলের কথা উহ্য। তাজউদ্দীন আহমেদ, যিনি মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করেছিলেন, তার কথাটা উহ্য হয়ে গিয়েছিল একেবারেই। তার মানে আওয়ামী লীগ সমান-সমান শেখ মুজিব সমান সমান মুক্তিযুদ্ধ। এর বাইরে দাঁড়িয়ে চিন্তা করেন আপনারা।”
বছরের ১২টি মাসই বাংলাদেশকে উৎসবমুখর দেখতে চাওয়ার কথা জানিয়ে সেই পথে এগোনোর কথা বললেন সৈয়দ জামিল।
“ডিসেম্বর মাসটাকে উৎসবমুখর বাংলাদেশ দেখতে চাই, জানুয়ারি মাসটাকে উৎসবমুখর বাংলাদেশ দেখতে চাই, ফেব্রুয়ারি মাসেও আমরা উৎসবমুখর বাংলাদেশ দেখতে চাই। সেখানটায় কী বলব তখন? আরেকটা নাম দিতে হবে তখন আমাকে? মার্চ মাসে কি নাম দেব? এপ্রিল মাসে কি নাম দেব? এজন্য আমাদের যতদিন টাকা আছে, অর্থটা ফুরিয়ে না যাবে, প্রতিটা মাসে, সারা বাংলাদেশ উৎসবমুখর বাংলাদেশে পরিণত করতে চাই।”
আয়োজনের মধ্য দিয়ে শিল্পীদের অভাব ঘোচানোর প্রয়াস চালানোর কথাও বললেন শিল্পকলার মহাপরিচালক।
তিনি বলেন, “আপনারা দেখবেন, ঢাকা শহরের পাশাপাশি আমরা জেলাগুলোতে গেছি। এগুলো কেউ খেয়াল করেন না-গ্রামে আমাদের শিল্পীরা বড় অভাবে আছেন। এ কথাগুলো কেউ বলেন না।
“আমরা যখন প্রোগ্রামগুলো গ্রামে গ্রামে নিয়ে যাচ্ছি, সেখানে যখন ওই এলাকার গ্রামের মানুষগুলো আসছেন, আমি নিজে গিয়েছিলাম নাটোরে, সে কথাগুলো আপনারা কেউ বলবেন না। আমি তার আগে গিয়েছিলাম চট্টগ্রামে, তার আগে গিয়েছিলাম সিলেটে, তার আগে গিয়েছিলাম বিরিশিরিতে। সে কথাগুলো কেউ বলবেন না।”
বিতর্ক চান, চান প্রশংসাও
নিজে বিতর্কে থাকতে পছন্দ করেন বলেই মন্তব্য করেছেন শিল্পকলার দায়িত্ব নিয়েই বিতর্কে পড়া সৈয়দ জামিল আহমেদ।
তিনি বলেন, “আমি বিতর্কের মাঝে থাকতে পছন্দ করি। যে মানুষটা বিতর্কের মাঝে নাই, সে প্রচলিত গৎবাঁধা পথে চলে। নবীজির কথা দেখবেন, তিনি যখন নতুন ধর্ম প্রবর্তন করেছিলেন, তখন তিনি বিতর্কিত হয়েছিলেন, শ্রী চৈতন্য একইভাবে বিতর্কিত হয়েছিলেন, বাধা এসেছিল, পক্ষে বিপক্ষে শক্তি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
“শেখ মুজিব যখন বাংলাদেশে কথা বলা শুরু করেছিলেন বা স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা শুরু করলেন, তারও বিপক্ষে লোক দাঁড়িয়েছিল। আমার কথা হচ্ছে নতুন কথা আসলে, নতুন চিন্তা আসলে পক্ষে বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। যতদিন আমার মতন এরকম বিতর্কিত বিষয় হবে, আমি উজ্জীবিত অনুভব করব, আমি বেঁচে আছি, আমি জীবন্ত কারণ আমার পথটা নতুন।”
সমালোচনা পছন্দ করলেও সমালোচকদের কাছে কাজের প্রশংসাও আশা করেন সৈয়দ জামিল।
তিনি বলেন, “আমরা বলছি আদিবাসী। আমরা কিন্তু ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী বলছি না। শেখ হাসিনার সময় থেকে ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠি বলা শুরু হয়েছে। আমরা বলছি আদিবাসী। এই কথায় তো আপনারা বলছেন না ‘বাহ’!
“আমার মনে হয়, মানুষ বসে থাকে কোথায় ঝাঁপ দিয়ে ধরা যায়। আপনারা একটু খোলাচোখে দেখেন, একটু খোলা মনে চিন্তা করেন, আমরা বিজয়ের উৎসব করছি, মাত্র চারুকলায় গিয়ে আসলাম, সেখানে মাসব্যাপী পারফর্ম্যান্স আর্ট, ইনস্টলেশানের কাজ হচ্ছে।”
“সেখানে আমাদের মূল বিষয়টা হচ্ছে উৎসবমুখর বাংলাদেশ, গণমুখী শিল্পকর্ম এবং প্রশ্ন উত্থাপন করা। আমরা চাই, শিল্পীরা প্রশ্ন উত্থাপন করুক। আমরা চাইব, সারাবছরব্যাপী এরকম উৎসব করতে। তাই, বারবার না পেঁচিয়ে আমরা অন্য যে কাজ করছি, তাতে আমাদের বাহ বলেন না। তারপর বলেন অন্যকথা,” বলেন তিনি।
এবারের আয়োজনে থাকছে কী
‘ডিসেম্বরের উৎসব ২০২৪’ শিরোনামে শিল্পকলার মাসব্যাপী আয়োজন শুরু হয়েছে গত ৫ তারিখে, সিলেটে কাওয়ালী সন্ধ্যার মধ্যদিয়ে। এরপর গাজীপুর ও নেত্রকোনায় ছিল আয়োজন।
১৬ ডিসেম্বর ও ১৩ ডিসেম্বর নােটারে অনুষ্ঠিত হয় কাওয়ালী সন্ধ্যা ও সাধুমেলা। ১২ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় ‘নতুন বাংলাদেশ, পথ কোথায়?’ শীর্ষক ‘বাহাস’।
এর মধ্যে ঢাকায় ৭-১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে যন্ত্রসঙ্গীত উৎসব। ৮-১০ ডিসেম্বর ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স, ৮-১২ ডিসেম্বর চলে নকশীকাঁথা তৈরি কর্মশালা। ৯ ডিসেম্বর শুরু হওয়া আলোকচিত্র প্রদর্শনী চলবে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে ঢাকায় থাকছে পোস্টার, আলোকচিত্র, কার্টুন প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
১৭ থেকে ২৩ ডিসেম্বর যাত্রা উৎসব চলবে বরগুনা, খুলনায়। ১৭ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জে হবে সাধুমেলা। ১৮-২০ ডিসেম্বর ২০টি জেলা শহরে হবে ভ্রাম্যমাণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
২০ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে হবে নাট্য প্রদর্শনী এবং ৬৪ জেলায় নাট্য কর্মশালা। একই দিন ঠাকুরগাঁওয়ে হবে ভাওয়াইয়া গানের অনুষ্ঠান। সেদিন ঢাকায়ও হবে জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে নাটক।
২১ ডিসেম্বর ঢাকায় শুরু হবে ভাস্কর্য প্রদর্শনী। সেদিন সুনামগঞ্জে হবে লোক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ২৬ ডিসেম্বর থাকছে ‘নতুন বাংলাদেশ : পথ কোথায়?’ শীর্ষক বাহাস।
২৮ ডিসেম্বর ঢাকায় থাকছে পোস্টারে জুলাই অভ্যুত্থান প্রদর্শনী। ওই দিন বান্দরবানে হবে লোক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
২৮ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চার দিন ঢাকায় আয়োজন থাকবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের স্মরণ এবং স্বৈরাচার পতনের পর ‘নতুন বাংলাদেশের রূপরেখা তুলে ধরে বিজয় অনুষ্ঠানমালা’।
২৯ ডিসেম্বর ঢাকায় ওয়েব জার্নাল প্রকাশ হবে। ৩০ ও ৩১ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারে হবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নিয়ে আর্ট ক্যাম্প।