বাংলাদেশে বড় ঈদ জামাতের কথা উঠলে প্রথমেই আসে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার নাম। দীর্ঘদিন ধরে এর আয়োজকদের দাবি ছিল, তাদের জামাতই সবচেয়ে বড়। এখন আবার দিনাজপুরের গোর-ই-শহীদ ময়দানের আয়োজকরা দাবি করছেন, তাদেরটিই বড়।
আয়তন ও জনসমাগমের বিচারে দেশে বড় তো বটেই, পাশাপাশি দুটিরই ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। তাই দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে এই দুটি জামাতে অংশ নিতে।
ঈদ সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এ দুটি ঈদগাহের প্রস্তুতির খবর আলাদা করে প্রকাশ করে। সেখানে আলাদাভাবে দুটিকেই দেশের সবচেয়ে বড় ঈদগাহ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।
শোলাকিয়া ঈদগাহ বৃত্তান্ত
কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের পূর্ব প্রান্তে শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের অবস্থান। এই মাঠের ঐতিহাসিক গুরুত্বও কম নয়। ৬ দশমিক ৬১ একর আয়তনের এই ঈদগাহে এবার ১৯৭তম ঈদের জামাতের প্রস্তুতি চলছে।
প্রায় ২০০ বছর ধরে এই মাঠে ঈদের জামাতের আয়োজন করা হচ্ছে। ইতিহাস বলছে, ১৮২৮ সাল থেকে চলছে এই আয়োজন। শুরুতে সাহেববাড়ি হিসেবে পরিচিত স্থানীয় সৈয়দ আহম্মদ (র.) তার নিজের জমিতে ঈদ জামাতের আয়োজন করেছিলেন।
পরে ঈদগাহ মাঠের প্রসারে ভূমিকা রাখেন ঈশা খাঁর বংশধর স্থানীয় হয়বতনগরের দেওয়ান পরিবারের সদস্য দেওয়ান মান্নান দাদ খান। এই মাঠের প্রচারেও ছিল পরিবারটির ভূমিকা।
শোলাকিয়া নামটি কীভাবে এল, তারও আছে ইতিহাস। স্থানীয়রা বলেন, একসময় এই মাঠে সোয়া লাখ মুসল্লি একসঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করেছিলেন। সোয়া লাখ কথাটি মানুষের মুখে ফিরে সোয়া লাখিয়া ঈদগাহ হিসেবে পরিচিতি পায়। সেই নামেরই অপভ্রংশ শোলাকিয়া।
এই ঈদগাহের পরিচালনা পর্ষদ জানিয়েছে, মূল মাঠে ২৬৫টি কাতারে বৃহস্পতিবার ঈদুল ফিতরের জামাত হবে। প্রতি কাতারে ৬৫০ থেকে ৭০০ জন নামাজ আদায় করতে পারবেন।
এছাড়া মূল মাঠের চারপাশেও অনেকের নামাজ আদায়ের সুযোগ থাকবে। সে হিসেবে দুই লাখের বেশি মানুষ এই ঈদগাহে নামাজের সুযোগ পাবেন।
গোর-এ-শহীদ ময়দানের আদ্যোপান্ত
দিনাজপুর শহরের মাঝামাঝি এলাকায় অবস্থান গোর-এ-শহীদ ঈদগাহ মাঠের।
সঠিক ইতিহাস জানা না গেলেও স্থানীয়রা বলছেন ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হওয়ার পর থেকেই এই মাঠে ঈদ জামাতের আয়োজন করা হতো। তবে তা ছিল ছোট পরিসরে। কয়েক বছর আগেও এখানে বেশ ছোট পরিসরেই জামাতের আয়োজন করা হতো।
২০১৭ সালের পর পরিস্থিতি বদলে যায়। দুবছর ধরে এই ঈদগাহে মিনারের কাজ করে জেলা পরিষদ। এরপর সেখানে শুরু হয় বড় পরিসরে ঈদের নামাজের আয়োজন।
চার কোটি টাকা ব্যয়ে মাঠে মুঘল স্থাপত্যরীতিতে তৈরি করা হয় মিনার। যার মিম্বারের উচ্চতা ৫৫ ফুট, গম্বুজ রয়েছে ৫২টি। দুই প্রান্তের উঁচু মিনার দুটির উচ্চতা ৬০ ফুট।
২২ একর আয়তনের এই মাঠে একবারে ৬ লাখের বেশি মানুষ নামাজ আদায় করতে পারেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আয়তনের দিক থেকে এটি উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ঈদগাহ মাঠ।
গোর-এ-শহীদ নামের উৎস নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যেই দ্বিমত রয়েছে। কেউ বলেন, এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একটি সমাবেশ হয়েছিল। সেখান থেকেই কোনওভাবে এসেছে এই নাম।
আবার আরেকদল বলেন, ইসলাম প্রচারে এ অঞ্চলে আসা শাহ আমিরউদ্দিন ঘুরির (র.) মৃত্যুর পর তাকে মাঠের পাশেই সমাহিত করা হয়। সেখান থেকেই এসেছে গোর-এ-শহীদ নামটি। গোর অর্থ কবর।
আয়তনে-ইতিহাসে কে এগিয়ে
জমির আয়তন বিচার করলে নিঃসন্দেহে এগিয়ে দিনাজপুরের গোর-এ-শহীদ ঈদগাহ মাঠ। একসঙ্গে ছয় লাখ মানুষের নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা যে কোনও হিসাবেই বিপুল।
অন্যদিকে ইতিহাসের বিচারে এগিয়ে থাকবে শোলাকিয়া মাঠ। গোর-এ-শহীদে যেখানে ১৯৪৭ সালের পর শুরু হয়েছে ঈদের জামাত, সেখানে ১১৯ বছর পার করে এসেছে শোলাকিয়া মাঠ।
এতদিন শোলাকিয়ার আয়োজকরা বলে আসছিল, তাদের ঈদ জামাত দেশের বৃহত্তম। এদিকে দিনাজপুরের এমপি, সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম দাবি করছেন, গোর-ই শহীদের ঈদগাহ তো দেশে বটেই, এশিয়ায়ই বৃহত্তম।
দুই মাঠে এবারের আয়োজন
শোলাকিয়ায় এবার ঈদের প্রথম জামাত হবে সকাল ১০টায়। এতে ইমামতি করবেন ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা ফরীদ উদ্দিন মাসউদ। তার বিকল্প হিসেবে থাকবেন বড় বাজার মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা শোয়াইব আব্দুর রউফ।
শোলাকিয়া ঈদগাহ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ এবং পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ মাঠের প্রস্তুতি এরই মধ্যে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঈদের জামাত উপলক্ষে মাঠের ভেতর মুসল্লিদের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে, স্থাপন করা হয়েছে শৌচাগার। যে কোনও প্রয়োজনে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য মাঠে প্রস্তুত থাকবে মেডিকেল টিম, তৈরি থাকবে কিশোরগঞ্জের হাসপাতালগুলোও। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরাও সেদিন থাকবেন প্রস্তুত।
এরই মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে ওয়াচ টাওয়ার, বসানো হয়েছে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা। মাঠ ঘিরে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে থাকবেন পুলিশ, র্যাব, আনসারসহ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। মোতায়েন করা হবে পাঁচ ৫ প্লাটুন বিজিবি সদস্যর।
২০১৬ সালের ৭ জুলাই ঈদুল ফিতরের নামাজ চলাকালে শোলাকিয়া ঈদগাহের কাছে পুলিশের একটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা। তাতে দুই পুলিশ সদস্য নিহত ও চার জন আহত হন।
এর পর থেকে বাড়ানো হয় শোলাকিয়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সেই ধারাবাহিকতায় এবারও অন্য বছরের চেয়ে প্রায় দেড়গুণ বেশি নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। থাকবে আর্চওয়ে, মেটাল ডিটেক্টরও।
গোর-এ-শহীদ মাঠে এবার ঈদের প্রথম জামাত হবে সকাল ৯টায়, এতে ইমামতি করবেন মাওলানা শামশুল হক কাশেমী।
জেলা প্রশাসক শাকিল আহমেদ জানিয়েছেন, পুরো ঈদগাহ জুড়ে চার স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নিয়োজিত থাকবেন পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও আনসার সদস্যরা। থাকবেন স্বেচ্ছাসেবকরাও।
সকাল ৭টা থেকে মুসুল্লিরা মাঠে প্রবেশ করতে পারবেন। মোট ১৯টি গেইট ব্যবহার করে মেটাল ডিটেক্টরের তল্লাশি পার হয়ে কেবল জায়নামাজ ও ছাতা সঙ্গে নিয়ে প্রবেশ করতে পারবেন তারা। থাকবে ওয়াচ টাওয়ার ও ৩০টি সিসিটিভি ক্যামেরা। মাইক বসানো হবে ১১০টি।
এছাড়া ইমামকে সহযোগিতা করতে আশপাশের বিভিন্ন মসজিদ ও মাদ্রাসা থেকে পাঁচ শতাধিক মুক্কাবির নিয়োজিত থাকবেন।
মুসল্লিদের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে হেলথ ক্যাম্প, ২৫০টি ওযুখানা এবং সুপেয় পানির।
যাতায়াতে বিশেষ ব্যবস্থা
শোলাকিয়া এবং গোর-এ-শহীদ মাঠে ঈদের জামাতের জন্য বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
‘শোলাকিয়া এক্সপ্রেস’ নামে দুটি স্পেশাল ট্রেন চলবে ভৈরব-কিশোরগঞ্জ-ভৈরব এবং ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ পথে।
এর মধ্যে শোলাকিয়া এক্সপ্রেস-১ ভৈরব থেকে ছাড়বে সকাল ৬টায়, কিশোরগঞ্জ পৌঁছবে সকাল ৮টায়। আবার কিশোরগঞ্জ থেকে ছেড়ে যাবে দুপুর ১২টায়, ভৈরব পৌঁছাবে দুপুর ২টায়।
শোলাকিয়া এক্সপ্রেস-২ ময়মনসিংহ থেকে ছাড়বে সকাল পৌনে ৬টায়, কিশোরগঞ্জ পৌঁছাবে সকাল সাড়ে ৮টায়। এরপর মুসল্লিদের নিয়ে কিশোরগঞ্জ থেকে ছেড়ে যাবে দুপুর ১২টায়, ময়মনসিংহে পৌঁছবে বেলা ৩টায়।
ভৈরব ও কিশোরগঞ্জ রেলস্টেশনেও মোতায়েন থাকবেন র্যাব সদস্যরা।
দিনাজপুরের গোর-এ-শহীদ ঈদগাহে জামাতের জন্যও দুটি ঈদ স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
এদের মধ্যে একটি পার্বতীপুর থেকে দিনাজপুর যাবে, অন্যটি যাবে ঠাকুরগাঁও থেকে। নামাজ শেষে এই ট্রেনগুলোই মুসল্লিদের গন্তব্যে পৌঁছে দেবে।
[এই প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য জুগিয়েছেন সকাল সন্ধ্যার দিনাজপুর ও ময়মনসিংহের আঞ্চলিক প্রতিবেদক]