Beta
বুধবার, ৩ জুলাই, ২০২৪
Beta
বুধবার, ৩ জুলাই, ২০২৪

সাপভীতি কাটাতে ‘স্নেক পার্ক’ গড়তে চান তিনি

সাপ বিশেষজ্ঞ আবু সাইদ
সাপ বিশেষজ্ঞ আবু সাইদ
Picture of কমল জোহা খান

কমল জোহা খান

“আমাদের দেশে শিশুদের অক্ষরজ্ঞান শুরু হয় ‘অ-তে অজগর ওই আসছে তেড়ে’ বাক্য দিয়ে। এমন বাক্য শিশুদের বর্ণ চেনা-জানার শেকড় শক্ত করে বটে। তবে তার কোমল মনে তৈরি হতে শুরু করে সাপের প্রতি নেতিবাচক, ভীতিকর ধারণা। সেটাই পরবর্তীতে তাকে উৎসাহিত করে সাপ হত্যার মতো নৃশংসতায়।”

এমনটাই মনে করেন সাপ বিশেষজ্ঞ আবু সাইদ। সাপ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন তিনি। প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে জাতীয়ভাবে অবদান রাখায় পেয়েছেন ‘বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন’ অ্যাওয়ার্ডও। তার মতে, সাপের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক করা প্রয়োজন। সেজন্য দেশে একটি স্নেক পার্ক বা সাপ পার্ক গড়ার পরিকল্পনা করছেন তিনি।

দেশে রাসেলস ভাইপার নিয়ে আলোচনা যখন তুঙ্গে, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসছে সাপ ধরা ও মারার খবর। তখন আবু সাইদ তার পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেন সকাল সন্ধ্যার সঙ্গে। জানান দেশে-বিদেশে থাকা আরও নানা ধরনের সাপের অজানা কথা।

সকাল সন্ধ্যা তার কাছে জানতে চায়, দেশে স্নেক পার্ক গড়ার প্রয়োজনীয়তা কী? জবাবে আবু সাইদ বলেন, “পুরো দক্ষিণ এশিয়াতেই নানা জাতের সাপ দেখতে পাওয়া যায়। বনজঙ্গল, ঝোপঝাড়, নদী অববাহিকায় বিচরণ করে তারা। অথচ আমাদের দেশে অনেকে সাপকে শত্রু মনে করে। দেখা মাত্র তাকে মারতে উদ্যত হয়।”

“সত্যি বলতে, সাপ নিজে আক্রান্ত না হলে কখনও অন্যকে আক্রমণ করে না।” একথার সঙ্গে আবু সাইদ যুক্ত করেন সাপের প্রয়োজনীয়তার কথাও। তিনি বলেন, “পরিবেশ ও ফসল রক্ষাতেও সাপের বিরাট ভূমিকা আছে। সাপের বিষ থেকে তৈরি করা হয় নানা ধরনের ওষুধ।”

স্নেক পার্ক গড়তে চান আবু সাইদ।

ইঁদুর, পোকামাকড় খেয়ে ফসল রক্ষা করে সাপ। ফলে সাপের সংখ্যা যদি কমে যায় তাহলে ইঁদুর বেড়ে যাবে। আর ইঁদুর বাড়লে প্লেগের মতো প্রাণঘাতী রোগ যে আবার ফিরে আসবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? এমন প্রশ্ন তোলেন আবু সাইদ। তিনি বলেন, “সাপ না থাকলে পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা পাবে না। সাপ যে মানুষকে শত্রু মনে করে না- এই ইতিবাচক ধারণা সবাইকে দেওয়া প্রয়োজন। তারই অংশ হিসেবে স্লেক পার্ক গড়া আমরা বহুদিনের স্বপ্ন।”

মহারাষ্ট্র, চেন্নাইসহ ভারতের ৩-৪ জায়গায়, ইন্দোনেশিয়া, চীন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামিতে গেলে ঘুরে দেখা যাবে স্নেক পার্ক। দেশে এখনও মানুষ ঠিক এই পরিকল্পনার সঙ্গে পরিচিত নয়। তবে স্নেক পার্ক গড়ে তোলা হলে তা মানুষ আর সাপের দূরত্ব কমাবে বলেই মনে করেন এই সাপ বিশেষজ্ঞ।

আবু সাইদ বলেন, “আমাদের দেশের চিড়িয়াখানায় সাপ শুধু খাঁচাবন্দী করেই রাখা হয়। ফলে সেখান থেকে সাধারণ মানুষ তেমন কোনও ধারণাই পান না। স্লেন পার্কের পরিকল্পনায় তাই মানুষের সঙ্গে সাপের সুসম্পর্ক তৈরির চেষ্টা থাকবে সর্বাগ্রে।”

বাংলাদেশে প্রায় ১১৯ প্রজাতির সাপের বিচরণ। এর মধ্যে ৩৫টি বিষধর প্রজাতির। বর্তমানে তুমুল আলোচনায় থাকা রাসেলস ভাইপারও তাদের একটি। এছাড়া রয়েছে ১৬টি সামুদ্রিক প্রজাতির সাপ। এই ১১৯ ধরনের সাপের মধ্যে প্রায়ই সহজে দেখা যায় ১০৭ ধরনের সাপ।

প্রাণিবিজ্ঞানী আবু সাইদ বলেন, “দেশে শতাধিক প্রজাতির সাপে বিচরণ থাকলেও ৮৪ প্রজাতিরই কোনও বিষ নেই। কিন্তু সে বিষয়ে ধারণা খুব কম মানুষেরই আছে। সাপের চরিত্র বা আচরণ সম্পর্কে ধারণা কম থাকায় সাপ দেখলেই আমরা বিষধর মনে করি, মারতে উদ্যত হই। রাসেলস ভাইপারকে মনে করে অজগর। আবার অন্য সাপকে রাসেলস ভাইপার মনে করেও মেরে ফেলা হয়।”

আবু সাইদের আশা স্নেক পার্কে গেলে মানুষ এদেশের সব সাপের স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে ধারণা পাবে। তাই আপাতত বেশ কিছু পরিকল্পনা ঘুরপাক খাচ্ছে আবু সাইদের ভাবনায়।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, স্নেক পার্কে প্রতিটি প্রজাতির সাপের জন্য আলাদা বড় বেষ্টনী করতে চান আবু সাইদ। খোলা জায়গায় গড়া এই বেষ্টনী থেকে সরাসরি সাপগুলো দেখা যাবে। কাঁচের ভেতর বিষধর ও নির্বিষ সব সাপই থাকবে।

এছাড়া সামুদ্রিক সাপগুলোর জন্য বিশেষ ব্যবস্থার পরিকল্পনাও রয়েছে। বিশেষ ব্যবস্থায় স্যালাইন ওয়াটার দিয়ে শেড করে সামুদ্রিক সাপ প্রদর্শনের ইচ্ছা আছে।

আর সাপ দর্শকদের জন্য থাকবে বড় গ্যালারি। ইচ্ছা হলে সেখান থেকে দেখা যাবে জ্যান্ত সাপ। জানানো হবে সাপের চরিত্র, জীবনধারণ পদ্ধতি, বিষ সংগ্রহের পদ্ধতিসহ আরও নানা তথ্য। পার্কে গেলে সাপের সঙ্গে ছবি তোলার সুযোগও থাকবে, তা সাহায্য করবে সাধারণ মানুষের সাপের ভয় কাটাতে।

শুধু সাপ প্রদর্শন নয়, সাপ সম্পর্কে গবেষণা ও শিক্ষাকেন্দ্র করারও ভাবনা রয়েছে আবু সাইদের। তিনি বলেন, স্নেক পার্কে একটি হারপেটোলজি ট্রেনিং অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটও করার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। এই ইনস্টিটিউটের ল্যাবে সাপ নিয়ে গবেষণা, পড়াশোনা, এমনকি এমফিল, পিএইচডিও করা যাবে।

শুধু জনসাধারণকে পরিচিত করানো নয়, আবু সাইদের ভাবনায় রয়েছে সাপের মতো প্রাণীদের স্বাভাবিক জীবনধারণ নিশ্চিত করার ভাবনাও। পরিকল্পনার অংশ থেকে তিনি জানান, প্রজাতি অনুযায়ী আলাদা করে কয়েক সেট সাপ রাখা হবে পার্কে। এক সেট সাপ নির্দিষ্ট সময় প্রদর্শন শেষে নতুন সেট শেডে রাখা হবে। পুরোনো সাপের সেটকে খাবার ও পরিচর্যা দেওয়া হবে। সাপ কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সময়ে খাদ্য গ্রহণ করে। প্রদর্শনের সময় কোনও সাপকে খাবার দেওয়া হবে না। সাপের সংখ্যা বেড়ে গেলে সেগুলো আবার প্রকৃতিতে অবমুক্ত করা হবে।

আবু সাইদের প্রাথমিক পরিকল্পনায় অনলাইনে টিকিট কেটে দর্শনার্থীদের স্নেক পার্কে আসতে হবে। তবে দর্শনার্থীর চাপে যেন সাপের মতো প্রাণীদের স্বাভাবিক জীবন বাধার মুখে না পড়ে, তাই প্রতিদিন নির্দিষ্ট সংখ্যক দর্শনার্থীর পার্কে ভ্রমণের সুযোগ পাবেন।

১১৯ প্রজাতির মধ্যে সাপের পার্কে ১০৭টি রাখার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে শুরুটা হবে ৪০-৫০ প্রজাতির সাপ দিয়ে। প্রাথমিকভাবে ঢাকা জেলার আশপাশে ৫ একর জায়গায় স্নেক পার্ক গড়তে চান তারা। তা না হলে কক্সবাজারে হতে পারে এই পার্ক। জায়গাটা ১০ একর হলে পার্ক আরও ভালো হবে। এরই মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে বেশ কয়েক জন বিনিয়োগকারীর সঙ্গে।

আবু সাঈদ বলেন, “এখনও সরকারের কাছে এ বিষয়ে প্রস্তাব দিইনি। জমি ও অর্থ দিয়ে সরকার সহযোগিতা করলে ভালোই হবে। তবে ব্যবস্থাপনা আমাদের হাতে থাকবে। আর্থিকভাবে লাভবান হলে তখন তা ভাগাভাগি করা হবে।”

যদিও আর্থিক লাভালাভের থেকে মানুষের সাপভীতি কাটানোই এই স্নেক পার্ক গড়ার মূল উদ্দেশ্য। প্রকৃতিপ্রেমী আবু সাইদ চান, প্রকৃতির মাঝে আপনমনে বেঁচে থাকার সুযোগ পাক সব প্রজাতির সাপ।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত