ক্ষমতায় বসে প্রবল প্রতাপ নিয়ে থাকা আওয়ামী লীগ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গেছে উবে; দলটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরতে পারে কীভাবে, তা নিয়ে অনেক আলোচনাও হচ্ছে।
কিন্তু আওয়ামী লীগের ফেরার পথ আসলে রয়েছে কি- সেই প্রশ্নে ‘না’ই বলছেন তানজীম আহমদ, যিনি সোহেল তাজ নামেই বেশি পরিচিত।
আওয়ামী লীগের এক সময়ের সংসদ সদস্য, এই দলের সরকারে এক সময়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসা সোহেল তাজ বলেছেন, “যে দলের কোনও আত্মসমালোচনা নেই, অনুশোচনা নেই, অনুতাপ নেই, আত্মোপলব্ধি নাই- তাদের ফেরার পথ থাকে না।”
দৈনিক মানবজমিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একথা বলেন তিনি। মঙ্গলবার এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, স্বাধীনতার কাল পর্বে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে সোহেল তাজ।
বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহচর তাজউদ্দীন স্বাধীনতার বছর খানেক পরই মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন, দলের নির্বাহী দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তবে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাজউদ্দীনকে গ্রেপ্তারের পর কারাগারে অন্য তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে হত্যা করা হয়েছিল।
আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থাকে অনেকে পঁচাত্তর পরবর্তী অবস্থার সঙ্গে তুলনা করেন। তখন আওয়ামী লীগের হাল ধরতে এগিয়ে এসেছিলেন তাজউদ্দীনপত্নী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন। তার সভাপতিত্বে পুনরায় সক্রিয় হয়েছিল আওয়ামী লীগ।
পরে বঙ্গবন্ধুকন্যা নির্বাসন থেকে ফিরে দলের দায়িত্ব নেন; ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে তার নেতৃত্বে ক্ষমতায় ফিরেছিল আওয়ামী লীগ। ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়ার পর টানা চার বার সরকার গঠন করে।
তবে শেখ হাসিনার এই শাসনকালে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে ‘গণতন্ত্রহীন’ হয়ে পড়ছে বলে সমালোচনা উঠতে থাকে। প্রশ্নবিদ্ধ ভোট আয়োজন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব, আর দমন-পীড়ন চালিয়ে তার ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টাই সামনে আসছিল বার বার।
এরমধ্যে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারে নামা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে দমাতে চাইলে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। তাতে জনবিস্ফোরণে ঘটে সরকারের পতন। তিন সপ্তাহের আন্দোলনে টিকতে না পেরে গত ৫ আগস্ট ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন টানা ১৫ বছরের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তারপর আওয়ামী লীগে ছন্নছাড়া দশার মধ্যে সোহেল তাজ কি তার মায়ের মতো দলের দায়িত্ব কি নেবেন, সেই প্রশ্নও আসছে অনেকের মনে।
তবে তেমন কোনও ইঙ্গিত তো তিনি দিলেনই না, বরং জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার শত শত মানুষ মেরে ‘ক্রিমিনাল কাজ’ করেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তার ভাষায়, “এটা অনৈতিক কাজ হয়েছে। ক্রিমিনাল কাজ হয়েছে। এখানে জনগণ, নতুন প্রজন্মের ভেতরে কী চলছে, সেটা বোঝা হয়নি। মানুষ কী চায়, তাও ভেবে দেখা হয়নি।”
২০০৮ সালে দ্বিতীয়বার সংসদ সদস্য হওয়ার পর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব তাকে দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু কয়েকমাসের মধ্যে তিনি পদত্যাগ করেন। প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব ছাড়ার পাশাপাশি সংসদ সদস্যপদও ছাড়েন তিনি।
তখন তার আসন গাজীপুর-৪ (কাপাসিয়া) এ সংসদ সদস্য করা হয় তারই বোন সিমিন হোসেন রিমিকে। পরে রিমি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীতেও স্থান পান। ক্ষমতাচ্যুত সরকারেও মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন রিমি।
সোহেল তাজ পরিবারতন্ত্রের সমালোচনা করে বলেন, “জনগণ যদি পরিবারতন্ত্র চায়, তাহলে তারা সে অনুযায়ী কাজ করতে পারে। কিন্তু আমি পরিবারতন্ত্রে বিশ্বাস করি না। আমার একটা পরিচিতি আছে, সেটা ঠিক। কিন্তু সেটাকে তো আমি সরাতে পারব না।
“আমার যে মেধা, যোগ্যতা আছে, আমি যদি মনে করি, সেটা দিয়ে আমি কিছু করতে পারব, তাহলে সেটা একটা অপশন হতে পারে। কিন্তু আমি দাবি করব না, আমি তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে, এজন্য আমাকে নিতে হবে। এটা ঠিক নয়।”
প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পাঁচ মাসের মাথায় ২০০৯ সালের ৩১ মে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন সোহেল তাজ। এরপর ২০১২ সালের ২৩ এপ্রিল সংসদ সদস্যপদও ছাড়েন তিনি।
এরপর ২০১৩ সালে জীবননাশের হুমকি পাওয়ায় দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন বলেও সাক্ষাৎকারে জানান সোহেল তাজ।
পরে দেশে ফিরলেও রাজনীতি থেকে দূরেই রয়েছেন সোহেল তাজ। শরীর গঠনের দিকে তাকে বেশি মনোযোগী হতে দেখা গিয়েছিল।
বিডিআর বিদ্রোহের সময় কী ভূমিকা
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিডিআর বিদ্রোহের সময় পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পুনর্তদন্তের দাবি উঠেছে। তখন নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি বিডিআর কল্যাণ পরিষদও পুনঃতদন্তের দাবি জানিয়েছে।
সেই বিদ্রোহের সময় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন সোহেল তাজ। তাকে ওই ঘটনায় এখন জিজ্ঞাসাবাদের কথাও বলছেন কেউ কেউ।
মানবজমিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সোহেল তাজ বলেছেন, বিডিআর বিদ্রোহের সময় ব্যক্তিগত কাজে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে ছিলেন তিনি। তবে খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন পুলিশ প্রধান নূর মোহাম্মদকে তিনি ফোন করেছিলেন। ফোনে কথা হয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের সঙ্গেও।
সোহেল তাজ দাবি করেন, পুলিশ, র্যাব, আনসার দিয়ে তখন গোটা পিলখানা ঘেরাও করার পরামর্শ তিনি দিলেও তা শোনা হয়নি।
“এরকম সংকটে পুরো এলাকা ঘেরাও করতে হয়, যাতে ভেতরে যারা আছে তারা যেন বুঝতে পারে তাদের পালাবার কোনও পথ নেই। আর্মি আসার আগ পর্যন্ত এটাই করতে হবে।”
সাহারা খাতুন ও নুর মোহাম্মদকে ফোন করে সাড়া না পেয়ে শেখ হাসিনাকে ফোন করেন জানিয়ে সোহেল তাজ বলেন, “তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি আমেরিকায় বসে বসে বেশি বুইঝো না, আমি দেখতেছি।’ তখন আমার আর কিছু করার ছিল না।”
দেশে ফিরে আসার পর এবিষয়ে আর কোনও কাজ করার সুযোগও তাকে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন তখন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা সোহেল তাজ।
“আমি যা দেখলাম, তাতে অবাক হয়েছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিল বিডিআর। কিন্তু অলৌকিকভাবে সব কাজ হয়ে যাচ্ছে। আমি দেখতে পাচ্ছি না যে কী হচ্ছে। কো-অর্ডিনেটর করে দেওয়া হয়েছে কর্নেল ফারুক খানকে। তিনি তখন বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন। বাণিজ্যমন্ত্রীকে কেন এই ঘটনার কো-অর্ডিনেটর করতে হবে?
“তারপর থেকে সবকিছু অদৃশ্য হয়ে গেল। আমাদের হাতে আর কিছুই ছিল না। বিডিআরের ‘ব’ পর্যন্ত আমরা বলতাম না। কারণ আমাদের কাছে কেউ জানতেও চায়নি, বলেওনি। এভরিথিং ওয়াজ ডান বাই দ্য কো-অর্ডিনেটর। আমার কাছে সবই উদ্ভট লেগেছে। কিন্তু প্রমাণ তো নাই। প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের এটা একটা কারণ ছিল। বিডিআর বিদ্রোহের পরপরই আমি পদত্যাগ করি।”
গত ১৫ আগস্ট সোহেল তাজ তার এক ফেইসবুক পোস্টে লিখেছিলেন, “সত্য বলার সময় এসেছে। সত্যই হচ্ছে সবচেয়ে বড় শক্তি। পিলখানা হত্যাযজ্ঞের সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিৎ। একজন মানুষের সবচেয়ে বড় সম্বল হচ্ছে তার আত্মসম্মান আর মর্যাদা এবং সত্যই হচ্ছে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার আর ঢাল।
“আপনারা যারা জেনে না জেনে বা বুঝে না বুঝে কোনও প্রমাণ ছাড়াই আমাকে নিয়ে পিলখানা হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে জড়িত থাকার মিথ্যা অপপ্রচার করেছেন, তাদের উদ্দেশে বলব- এই কাজটা ঠিক না। আমিও বাংলাদেশের সব বিবেকবান মানুষের মতো হতভম্ব হয়েছিলাম, স্তম্ভিত হয়েছিলাম। আমিও মানসিকভাবে মর্মাহত হয়েছিলাম। আমিও সত্য জানতে চাই এবং সুষ্ঠু তদন্ত চাই। ভবিষ্যতে পুনঃতদন্ত হলে আমার অভিজ্ঞতা এবং পর্যবেক্ষণগুলো বলতে চাই।”