প্রেসিডেন্টের পর এবার দক্ষিণ কোরিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টও অভিশংসিত হয়ে ক্ষমতা হারিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট উন সুক ইয়েলের অভিশংসনের মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যেই শুক্রবার (২৭ ডিসেম্বর) ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হান ডাক-সুও অভিশংসিত হলেন।
একই দিনে প্রেসিডেন্ট উন সুক ইয়েলের সামরিক আইন জারির বিষয়েও সাংবিধানিক আদালতে প্রথম শুনানি হচ্ছে। এই পরিস্থিতি দেশটির রাজনৈতিক সংকটকে আরও গভীর করছে।
প্রেসিডেন্ট ইয়েল গত ১৪ ডিসেম্বর অভিশংসিত হওয়ার পর থেকে হান ডাক-সু ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। একই সঙ্গে ২০২২ সালের মে মাস থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্বে রয়েছেন তিনি।
মোট ১৯২ জন সংসদ সদস্য তাকে অভিশংসনের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। এর জন্য প্রয়োজন ছিল ১৫১ ভোট। দক্ষিণ কোরিয়ার পার্লামেন্টের মোট সদস্য সংখ্যা ৩০০ জন।
হান দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটিয়ে ওঠার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। কিন্তু বিরোধীদের অভিযোগ, তিনি ইয়েলের অভিশংসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার দাবিকে উপেক্ষা করেছেন।
শুক্রবার ভোটগ্রহণের সময় সংসদে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলার দৃশ্য দেখা যায়। ভোটের আগে স্পিকার উ উন-শিক ঘোষণা করেন, হানের অভিশংসন বিল পাস করতে ১৫১ ভোটই যথেষ্ট।
এটি শুনে উন ও হানের শাসক দল পিপল পাওয়ার পার্টির (পিপিপি) শতাধিক আইনপ্রণে প্রতিবাদ জানান। কারণ একজন প্রেসিডেন্টকে অভিসংশনে ২০০ ভোটের প্রয়োজন হয়।
তবে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হান ডাক-সু একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী পদেও দায়িত্ব পালন করছেন। এজন্যই হয়তো তাকে অভিসংশনের জন্য ১৫১ ভোটকেই যথেষ্ট হিসাবে গণ্য করা হয়। কারণ প্রধানমন্ত্রীকে অভিসংশনে ১৫১ ভোটই যথেষ্ট।
এদিন স্পিকারের ঘোষণায় স্পষ্ট হয়, প্রেসিডেন্ট উনের অভিশংসনের জন্য প্রয়োজনীয় ২০০ ভোটের তুলনায় হানের ক্ষেত্রে শাসক দলের কোনো ভোট ছাড়াই বিল পাস সম্ভব।
ফলে শাসক দলের এমপিরা ভোটগ্রহণ কক্ষে জড়ো হয়ে ‘অবৈধ!’ এবং ‘ক্ষমতার অপব্যবহার!’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। তারা স্পিকারের পদত্যাগও দাবি করেন। বেশিরভাগ শাসক দলের এমপি ভোট বর্জন করেন।
বিরোধী দল বৃহস্পতিবার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হানের বিরুদ্ধেও অভিশংসন প্রস্তাব উত্থাপন করে। কারণ, তিনি পার্লামেন্ট মনোনীত তিনজন বিচারপতিকে এর আগে অভিসংশিত প্রেসিডেন্ট উন সুক ইয়েলের মামলার দায়িত্বে নিয়োগ দিতে বাধা দেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার সাংবিধানিক আদালত সাধারণত ৯ জন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত। প্রেসিডেন্ট উন সুক ইয়েলের অভিশংসন বহাল রাখতে অন্তত ৬ জন বিচারপতির সমর্থন প্রয়োজন।
কিন্তু বর্তমানে আদালতে মোট ছয়জন বিচারপতিই রয়েছেন। এর অর্থ, একজন বিচারপতি যদি অভিশংসনের বিপক্ষে ভোট দেন, তাহলে প্রেসিডেন্ট অপসারণ থেকে রক্ষা পাবেন।
বিরোধী দল আশা করেছিল, অতিরিক্ত তিনজন বিচারপতি নিয়োগ পেলে প্রেসিডেন্টের অভিশংসন বহাল রাখার সম্ভাবনা বাড়বে। প্রেসিডেন্ট উন সুক ইয়েলের বিষয়েও সাংবিধানিক আদালতে প্রথম শুনানি অনুষ্ঠিত হচ্ছে শুক্রবার।
প্রধানমন্ত্রী হানের পর এবার আইন অনুযায়ী অর্থমন্ত্রী চোই সাং-মক ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেবেন।
তবে, হানের অপসারণ দেশটির চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা এবং অনিশ্চয়তাকে আরও তীব্র করবে।
অর্থমন্ত্রীও হানকে অপসারণের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি সতর্ক করে বলেছিলেন, ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের অভিশংসন দেশের অর্থনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতাকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, “জাতীয় জরুরি অবস্থার মধ্যে অর্থনীতি ও জনগণের জীবিকা খুবই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আরেকজন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নেওয়ার ফলে যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হবে তা সামাল দেওয়া কঠিন হবে।”
শুক্রবার দক্ষিণ কোরিয়ার মুদ্রা ওন এর দাম যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের বিপরীতে গত ১৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছায়। এই অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার জন্য উভয় রাজনৈতিক দল একে অপরকে দোষারোপ করছে।
ভোটের পর এক বিবৃতিতে হান ডাক-সু জানান, তিনি আরও বিশৃঙ্খলা এড়াতে পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন। তবে তিনি তার অভিশংসনের বিষয়ে সাংবিধানিক আদালতের রায়ের অপেক্ষা করবেন। আদালতের এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সর্বোচ্চ ১৮০ দিন সময় রয়েছে।
ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের ভাগ্য নির্ধারণী এই ভোট সাংবিধানিক আদালত প্রেসিডেন্টের অভিশংসন বহাল রাখা বা তাকে স্থায়ীভাবে অপসারণ করার বিষয়ে প্রথম শুনানির দিনেই অনুষ্ঠিত হল।
কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে গভীর রাজনৈতিক সংকট
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট গত ৩ ডিসেম্বর হঠাৎ করেই সামরিক আইন জারি করলে দেশটি ১৯৮৭ সালের পর সবচেয়ে গুরুতর রাজনৈতিক সংকটের মুখে পড়ে।
প্রেসিডেন্টের এমন ঘোষণা দেশটির সবাইকে হতবাক করে দেয়। কারণ, দেশটি গত চার দশক ধরে নিজেকে একটি শক্তিশালী গণতন্ত্র হিসাবে গড়ে তুলেছে।
দেশটিতে নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদের অধিকার এবং নাগরিক স্বাধীনতার সুরক্ষা রয়েছে, যা রক্তাক্ত স্বৈরাচারী শাসনের দীর্ঘ ইতিহাস অতিক্রম করে অর্জিত হয়েছে।
প্রেসিডেন্টের সামরিক আইন জারির ঘোষণার দুই ঘণ্টার মধ্যেই সংসদ সদস্যরা জাতীয় পরিষদে একত্রিত হয়ে এই সিদ্ধান্ত বাতিল করেন।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ১৯০ জন সংসদ সদস্য সামরিক বাহিনী ও পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে প্রেসিডেন্ট ইয়েলের আদেশের বিরুদ্ধে ভোট দেন। ফলে ঘোষণার ছয় ঘণ্টার মধ্যেই ৪ ডিসেম্বর সকালে ইয়েল তার সামরিক আইন জারির ঘোষণা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন।
এরপর, প্রেসিডেন্টকে অপসারণে তার বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রক্রিয়াও শুরু হয়। নানা নাটকীয় ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে অবেশেষে গত ১৪ ডিসেম্বর পার্লামেন্ট প্রেসিডেন্ট ইয়েলকে তার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়।
৩০০ জন আইনপ্রণেতার মধ্যে ২০৪ জন প্রেসিডেন্টকে অভিশংসিত করার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্টকে অভিশংসনের প্রস্তাব পাস হতে ২০০ ভোট প্রয়োজন হয়। প্রস্তাবটি পাস করাতে ইয়েলের নেতৃত্বাধীন পিপল পাওয়ার পার্টির (পিপিপি) আটজন পার্লামেন্ট সদস্যকে পক্ষ পরিবর্তনের জন্য রাজি করায় বিরোধীরা।
তবে অভিশংসন বাস্তবায়নের জন্য সাংবিধানিক আদালতের রায় প্রয়োজন হয়। এই বিষয়েও শুক্রবার সাংবিধানিক আদালতে প্রথম শুনানি হচ্ছে।
অভিশংসন প্রস্তাব পাস হওয়ায় ইয়েল এখন সাময়িকভাবে বরখাস্ত অবস্থায় আছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার সাংবিধানিক আদালত পার্লামেন্টের ভোটের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে। ইয়েলের ভাগ্য নির্ধারণের জন্য আদালতের হাতে ১৪ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ১৮০ দিন সময় আছে।
ইয়েল এবং তার প্রশাসনের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধেও বিদ্রোহের অভিযোগে ফৌজদারি তদন্ত চলছে।
দক্ষিণ কোরিয়া গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন শুরু হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে তৎকালীন সামরিক শাসক দল একটি সাংবিধানিক সংশোধনী গ্রহণে বাধ্য হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে দেশটিতে সরাসরি জনগণের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শুরু হয়েছিল।
দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভিশংসনের ঘটনা নতুন নয়। নিজেকে একটি আধুনিক ও সফল গণতন্ত্র হিসেবে দেখা দেশটি এর আগেও একাধিকবার এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে।
দেশটির এর আগের ৭ জন প্রেসিডেন্টের মধ্যে ৪ জনই দুর্নীতির অভিযোগে অভিশংসিত বা কারাবন্দি হয়েছেন।
তথ্যসূত্র : বিবিসি, রয়টার্স, সিএনএন