- ২০২৪ ইউরোতে স্পেন প্রতি ৯০ মিনিটে গড়ে ২৫টি ড্রিবল করেছে। ’৯৬ ইউরোর পর তারা গত ২৮ বছরে কোনও বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে এত ড্রিবল করেনি
- এবার ইউরোতে স্পেনের গড় বল পজেশন ৫৪.৪ শতাংশ। ২০০২ বিশ্বকাপের পর কোনও বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে এটা তাদের সর্বনিম্ন বল পজেশন
- ১৬ বছর ধরে প্রতি ম্যাচে ৫০ শতাংশের ওপরে বল পজেশন ধরে রাখার স্প্যানিশ রেকর্ড গুঁড়িয়ে গেছে ইউরোতে। ১৩৬ ম্যাচ পর এবার ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে তাদের বল পজেশন নেমেছে ৪৬.৭ শতাংশে
বল পজেশনের শেষ দুটো পরিসংখ্যানে চোখ রাখলে স্প্যানিশ ফুটবলে গেল গেল রব উঠার কথা। কারণ বল পায়ে পাসিং ফুটবলে স্পেনের অনুরাগ অনেকদিনের। এই ব্র্যান্ডের ফুটবল স্পেনকে দিয়েছেও দু-হাত ভরে। সুন্দর খেলা, শিরোপার শোভা সবই পেয়েছে তারা। কিন্তু কোনও বলা-কওয়া ছাড়াই এই স্প্যানিশ ফুটবল ঐতিহ্যে ইতি টেনে দিয়েছেন লুইস দে লা ফুয়েন্তে। এরপরও এই কোচকে কাঠগড়ায় তুলছে না কেউ। বরং তার ডিরেক্ট ও দ্রুতগতির ফুটবল স্টাইলকে কুর্নিশ জানাচ্ছে। খেলায় পাসের বদলে পেস বা গতি যোগ করে জায়ান্টদের হারিয়ে স্পেন পৌঁছে গেছে ইউরো ২০২৪ এর ফাইনালে। শিরোপা জিতলে তিকি-তাকার দেশে উড়বে ফুয়েন্তে ফুটবলের নতুন পতাকা। রচিত হবে নতুন এক ফুটবল বিপ্লবের গল্প।
সুফলা তিকি-তাকা’র বিদায়
ফুটবলের দুর্দান্ত টেকটিক্যাল বিপ্লবের নাম তিকি-তাকা, যার জন্ম বার্সেলোনার লা মাসিয়া একাডেমিতে। জন্মদাতা পেপ গার্দিওলা। তার হাতে ফুটবলের নব সৃষ্টি ও মোহনীয় রূপ দেখে রিয়াল মাদ্রিদের কিংবদন্তী হোর্হে ভালদানো ফুটবলের ‘স্টিভ জবস’ আখ্যা দিয়েছেন এই স্প্যানিশ ফুটবল কোচকে।
এটা মূলত পজেশনাল ফুটবল। এখানে ব্যাক্তিগত ড্রিবলের তেমন সুযোগ নেই। পুরো ৯০ মিনিট ‘ওয়ান টাচ পাসিং’ খেলে প্রতিপক্ষকে শেষ করে দেওয়ার ফুটবল টেকটিস দেখে ২০০৬ বিশ্বকাপে স্প্যানিশ ধারাভাষ্যকার আন্দ্রেস মোন্তেস বলে ওঠেন, “আমরা বল নিয়ে তিকি-তাকা, তিকি-তাকা খেলছি।” সেই থেকে পেপের এই ফুটবল দর্শনের নাম হয় তিকি-তাকা।
জাভি-ইনিয়েস্তাদের মতো এক ঝাঁক খেলোয়াড়দের পায়ে এই ফুটবল স্টাইল মাঠে রোমাঞ্চ ছড়িয়েছে। এটিকে আলিঙ্গন করে ছবির মতো ফুটবল খেলেছে একটি প্রজন্ম। আর সেটি স্পেন ফুটবল ইতিহাসের পাতায় ঢুকে গেছে তিনটি বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের শিরোপায়। ২০১০ সালে স্পেনের একমাত্র বিশ্বকাপ শিরোপা তিকি-তাকারই অবদান। এছাড়া ২০০৮ ও ২০০১২ সালে টানা দুটো ইউরো সাফল্যের মূলে আছে এই রোমাঞ্চকর পাসিং ফুটবল।
একটি প্রজন্মের পায়ে এই ব্র্যান্ডের খেলা খুলেছিল দারুনভাবে। কিন্তু পরের প্রজন্ম যেন সেটিকে আর বয়ে নিতে পারছে না। তাই দৃশ্যপটে আসে লুইস দে লা ফুয়েন্তের নতুন ব্র্যান্ড।
স্কালোনির শিক্ষক লা ফুয়েন্তের ডিরেক্ট ফুটবল
লুইস দে লা ফুয়েন্তের হাতে স্প্যানিশ ফুটবল এমন সুরভী ছড়াবে, সেটা অনেকে বিশ্বাস করেনি। ২০২২ বিশ্বকাপে যারা দ্বিতীয় রাউন্ডে মরক্কোর কাছে হেরে বিদায় নিয়েছিল সেই স্পেন এখন ইউরো ফুটবলের ফাইনালে ! এই দেখে অনেকে মানছেন, ফুয়েন্তের হাতে জাদুর কাঠি আছে।
আসল ব্যাপার হলো, স্পেনের এই দলের বেশিরভাগই তার পুরনো ছাত্র। রোদ্রি, মেরিনো, মার্কো অ্যাসেনসিও, উনাই সিমোন, ওলমোরা ভালভাবে চেনেন এই কোচকে। পরিচিত তার কোচিং স্টাইলের সঙ্গে। ৬১ বছর বয়সী এই কোচ স্পেনের যুব দলকে ট্রেনিং করিয়ে আসছেন ২০১৩ সাল থেকে। ২০১৯ সালে স্পেনকে উপহার দেন অনূর্ধ্ব-২১ ইউরো চ্যাম্পিয়িনশিপের শিরোপা।
তিনি শুধু ফুটবলারদের কোচ নন, ফুটবল কোচদেরও শিক্ষক। স্পেন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত ২০১৭ সালে কোচেস প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে অংশ নেওয়া আর্জেন্টাইন কোচ লিওনেল স্কালোনি বলছেন, “লুইস দে লা ফুয়েন্তে আমার শিক্ষক, তার অধীনে আমি কোচিং কোর্স করেছি। তিনি একজন চমৎকার মানুষ। অন্যের সামনে নিজেকে তুলে ধরা, তার কাজ এবং তার খেলোয়াড়রা যেভাবে মনপ্রাণ দিয়ে তাকে অনুসরন করে, এগুলো আমি উপভোগ করেছি।“
দে লা ফুয়েন্তে সবসময় তার খেলোয়াড়রা অন্ধের মতো অনুসরণ করেন। কারণ ফুটবলারদের অগাধ আস্থা অর্জন করেই কাজ করেন তিনি। লুইস এনরিকের অধীনে কাতার বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর ২০২২ সালে তার হাতে তুলে দেওয়া হয় স্পেনের দায়িত্ব। অথচ এর আগে যার লা লিগার দল চালানোরও অভিজ্ঞতা ছিল না, সেই লুই ফুয়েন্তেই কিনা তিকিতাকার ধারা বদলে নতুন স্টাইলে স্পেনকে খেলিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। এখন ইউরো শিরোপা থেকে মাত্র এক ম্যাচ দূরে দাঁড়িয়ে তার দল।
এই ইউরো অভিযানের সাফল্যের পেছনে দে লা ফুয়েন্তের নিজস্বতার কথাই বলেছেন স্পেনের মিডফিল্ডার রোদ্রি, “ফুটবল দর্শনে হয়তও বড় পরিবর্তন আসেনি তবে প্রত্যেক কোচের কিছু নিজস্বতা থাকে। ফুয়েন্তে ডিরেক্ট ফুটবল খেলাতে চান। পজেশন ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে শেষ করে দিতে চান। আমাদের খেলার পদ্ধতিটা বদলে দিয়েছেন তিনি।”
তিনি দীর্ঘ সময় ধরে পাস খেলে আক্রমণ যান না। ডিরেক্ট ফুটবল এবং গতি দিয়ে প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলে দেন। স্পেনের এই কোচের মুখেই শোনা গেছে গতির গল্প, “আমাদের কাছে লামিন ইয়ামাল, নিকো উইলিয়ামস, ফেরান তোরেস বা পেরেজের মতো তুমুল গতির খেলোয়াড় আছে। তাদের ব্যবহার না করার কোনো মানে হয় না।” ফুটবলারদর গতি দিয়েই চমকে দিয়েছেন লা ফুয়েন্তে।
পাসের জায়গা নিয়েছে পেস
স্পেনের তিকিতাকা বা পাসিং ফুটবলের সাফল্য অনেক। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বুঝি এর কার্যকারিতা কমছে। বলা ভাল, এর বিপক্ষে টিকে থাকার খেলা শিখে ফেলেছে দলগুলো। কাতার বিশ্বকাপেই মারাত্মকভাবে নিষ্ফলা হয়েছে বার্সেলোনার এই ফুটবল স্টাইল। গ্রুপে জাপানের বিপক্ষে বল পজেশনে বেশ এগিয়েছিল স্পেন। এমনকি ১০৫৮ টি পাস খেলেও তারা শেষমেষ ২-১ গোলে হারে। দ্বিতীয় রাউন্ডে মরক্কোর বিপক্ষে হয়েছে আরো করুণ দশা। ৭৭ শতাংশ বল পজেশন ও ১০১৯ টি পাস খেলেও ১২০ মিনিটে স্পেন লক্ষ্যে শট নিতে পেরেছিল মাত্র একটি। এরপর তো টাইব্রেকারে বিদায় নিতে হয়েছিল তাদের।
কাতার বিশ্বকাপের ভরাডুবির পর দলের হাল ধরেন লুইস দে লা ফিয়েন্তে এবং ইউরোতে স্পেন ফুটবলের চরিত্র বদলের বড় ঘটনা ঘটিয়ে দিয়েছেন। ঘটনা নাকি অঘটন ? বল পজেশনে স্পেনের যে সুবিশাল ধারা, তার ইতি ঘটেছে ক্রোয়েশিয়ার ম্যাচে। গত ১৬ বছর ধরে ৫০ শতাংশ বা তার ওপরে বল পজেশন রেখেই খেলেছে দুই বারের ইউরোজয়ীরা। সেই ধারা ১৩৬ ম্যাচে বজায় রাখার পর দলটি গ্রুপে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে পজেশন নামিয়ে আনে ৪৬.৭ শতাংশে। এ যেন তিকিতাকার বুকে বড় এক ঘা। কিন্তু সেই ম্যাচে স্পেন ৩-০ গোলে হারিয়েছে ক্রোয়েশিয়াকে। প্রমাণ হয়ে গেল, বল পজেশন ছাড়াও প্রচন্ড দাপটে জেতা যায়।
ইউরোতে স্পেনের প্রথম গোলটিই ঘোষণা দিয়েছিল তাদের ফুটবলের নতুন ধারার। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ৩ পাস ও ৬ টাচের মুভটি ৬ সেকেন্ডে গোলে রূপ দেন মোরাতা। অপ্রয়োজনে ‘স্কয়ার পাস’ নয়, বরং ডিরেক্ট ও দ্রুতগতির ফুটবল খেলতে শুরু করে তিনবারের ইউরো চ্যাম্পিয়নরা।
আসলে তাদের গতির সামনেই আত্মসমর্পন করছে প্রতিপক্ষ। বিশেষ করে লামিন ইয়ামাল ও নিকো উইলিয়ামস খুব দ্রুত গতির এবং ওয়ান-টু-ওয়ানে ভয়ংকর। দুই উইঙ্গারকে দিয়েই দ্রুত গতির ডিরেক্ট ফুটবলের নতুন প্রদর্শনী দেখাচ্ছে স্পেন। ইতালির বিপক্ষে ১-০ গোলে জয়ী ম্যাচে দু’জনের ১৭ টি ড্রিবলে আজ্জুরি রক্ষণ ভীষন চাপে পড়েছিল।
স্পেনের খেলার ধরণ নিয়ে লুইস দে লা ফুয়েন্তের ব্যাখ্যা এরকম, “আমরা বিভিন্নভাবে খেলার জন্য একটি দল তৈরি করছি। আমাদের প্রতিপক্ষরাও জানে, পজেশনাল, পজিশনাল আক্রমণ দিয়ে তাদেরকে আমরা আঘাত করতে পারি — যদি তারা সুযোগ দেয়, আমরা দ্রুত বেগে দৌড়াবো।“ ক্রোয়েশিয়া, ইতালিসহ কয়েকটি দলের বিপক্ষে দেখা গেছে স্পেন ফুটবলের সেই ‘পেস’।
আগের পাসিং ফুটবলের জায়গায় এখন পেস।