শ্রীলঙ্কায় আগাম পার্লামেন্ট নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে দেশটির প্রেসিডেন্ট অনুরা কুমারা দিসানায়েকের জোট ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি)।
প্রকাশিত ফল অনুযায়ী, এনপিপি জোট ১৫৯টি বা দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে বিজয়ী হয়েছে এবং মোট ভোটের ৬০ শতাংশের বেশি পেয়েছে তারা। সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে শ্রীলঙ্কার ২২৫ আসনের পার্লামেন্টে প্রয়োজন হয় ১১৩টি আসন।
গত সেপ্টেম্বরে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া দিসানায়েকে দুর্নীতি মোকাবিলা এবং দ্বীপদেশটির সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের পর স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা পূরণে পার্লামেন্টে তার সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা দরকার ছিল।
বিশ্লেষকরা ধারণা, নির্বাচনে এনপিপির দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে বিজয় তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষী সংস্কারের লক্ষ্য বাস্তবায়নের সুযোগ তৈরি করবে।
বিবিসি জানিয়েছে, নির্বাচনে এনপিপি জোটের নেতৃত্বে রয়েছে প্রেসিডেন্ট দিসানায়েকের দল জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জেভিপি) পার্টি, যে দলটির মাত্র তিনটি আসন ছিল আগের পার্লামেন্টে।
বৃহস্পতিবার ভোট দেওয়ার ৫৫ বছর বয়সী দিসানায়েকে সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন, যা শ্রীলঙ্কার জন্য একটি পরিবর্তনমূলক মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত হবে।”
বিগত পার্লামেন্টের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যই এবারের নির্বাচনে অংশ নেননি, যাদের বেশিরভাগই ক্ষমতাচ্যুত রাজাপাকসে সরকারের আমলে এমপি ছিলেন।
বামপন্থী অনুরা কুমারা দিসানায়েকে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরপরই নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জনসমর্থনের আশায় আগের পার্লামেন্ট ভেঙে দেন। এতে দেশটিকে আগাম পার্লামেন্ট নির্বাচন আয়োজনের পথে হাঁটতে হয়।
আগের পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া সময় দিসানায়েকে বলেছিলেন, “এমন একটি পার্লামেন্ট চালিয়ে যাওয়ার কোনও মানে হয় না, যা মানুষের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।”
শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টের ২২৫টি আসনের মধ্যে ১৯৬টিতে সরাসরি সদস্য নির্বাচিত হয়। বাকি আসনগুলোগুলোতে সদস্য বেছে নেওয়া হয় বিভিন্ন দলের প্রাপ্ত ভোটের হারের ভিত্তিতে, যা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব হিসাবে পরিচিত।
উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্য ও জ্বালানি ঘাটতি ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় একটি রাজনৈতিক সংকটের সূচনা করেছিল, যার কারণে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তার উত্তরসূরি রনিল বিক্রমসিংহে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছ থেকে তিন বিলিয়ন ডলারের ঋণ আনতে সক্ষম হলেও অনেক শ্রীলঙ্কান এখনও অর্থনৈতিকভাবে কষ্টে আছেন।
“আমরা এখনও সেই সমস্যাগুলোর মধ্যে আটকে আছি, যেগুলো আগেও ছিল। আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয়তা পূরণ করার জন্য এখনও আমরা কোনও ধরনের আর্থিক সহায়তা পাইনি,” বলে ২৬ বছর বয়সী পোশাক কর্মী মঞ্জুলা দেবী, যিনি কলম্বোর নিকটবর্তী কাটুনায়েকে মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চলে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন।
গত চার বছরে শ্রীলঙ্কায় দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বেড়ে মোট জনগোষ্ঠীর ২৫ দশমিক ৯ শতাংশে পৌঁছেছে। বিশ্ব ব্যাংক আভাস দিয়েছে, চলতি ২০২৪ সালে দেশটির অর্থনীতিতে মাত্র ২ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে।
প্রচলিত রাজনীতিবিদদের প্রতি অসন্তোষ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে বামপন্থী দিসানায়েককের বিজয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। তার দল বরাবরই জোরালো রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ এবং স্বল্পহারে করারোপের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে এসেছে এবং বামপন্থী অর্থনৈতিক নীতির পক্ষে কথা বলেছে।
সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ৫০ শতাংশের কম ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন দিসানায়েকে। তবে তার দল এনপিপি নেতৃত্বাধীন জোট পার্লামেন্ট নির্বাচনে সেই তুলনায় অনেক ভালো করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিরোধীদলগুলোর মধ্যে বিভক্তিও দিসানায়েকের জোটের সফলতার একটি কারণ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। কেননা ২০২২ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশটির অনেক রাজনৈতিক নেতা বা দল ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছে বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, জেভিপি নেতৃত্বাধীন জোটের প্রচার কার্যক্রম বিরোধীদের তুলনায় অনেক বেশি প্রাণবন্ত ছিল, যা নির্বাচনের ফলাফলে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।
তবে নির্বাচনে যারাই বিজয়ী হোক, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণের জন্য তারা ব্যাপক চাপের মুখে থাকবে।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি এখনও অনিশ্চয়তা কাটিয়ে উঠতে পারেনি এবং এখনও প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা সরবরাহের ওপরেই বেশি মনোযোগ দিতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণই হবে নতুন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।