Beta
মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২৫

রিকশার ব্যাটারি অবৈধ হলে এত কারখানা কীভাবে

অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করে দিলে বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন চালকরা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করে দিলে বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন চালকরা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
[publishpress_authors_box]

ব্যাটারিচালিত রিকশা কি অনুমোদিত? সরকারের তরফে বিভিন্ন সময় বলা হয়েছে, অনুমোদিত নয়। তবে ব্যাটারিচালিত এই রিকশা চলছে দেশের সবখানেই। সেই সঙ্গে গড়ে উঠেছে এই রিকশা ও ব্যাটারি তৈরির কারখানা। আমদানিও হচ্ছে রিকশার ব্যাটারি, মটরসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ। অনুমোদিত হলে কীভাবে বছরের পর বছর আমদানি হচ্ছে? কারা আমদানি করছে? আমদানি ও নিয়ন্ত্রক সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কেন এ বিষয়ে মুখ খুলছেন না- সে প্রশ্নও উঠেছে।

ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে রাজপথে চালকদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে সকাল সন্ধ্যা।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০০৭ সালে চীন থেকে শুরু হয় এসব জিনিসপত্র আমদানি। ধীরে ধীরে বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে প্রায় একশ কারখানা। এর মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ কারখানাই পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে চীনের বিনিয়োগে চলছে। রিকশার জন্য এখন আর ব্যাটারি আমদানি করা হয় না। সব ব্যাটারিই বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে চীনা সরঞ্জাম দিয়ে।

রিকশার ব্যাটারি দেশে তৈরি হলেও মটরসহ বাকি সব যন্ত্রাংশই আসছে চীন থেকে। বাংলাদেশি আমদানিকারকদের পাশাপাশি চীনা কোম্পানি এসব যন্ত্রাংশ আনছে।

ঢাকার কমলাপুরে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়াম মার্কেটের এক ব্যাটারির দোকান। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

এই খাতে শুধু কারখানাকেন্দ্রিক বিনিয়োগের পরিমাণ হাজার কোটি টাকার বেশি বলে ধারণা খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতাদের। তারা বলছেন, এছাড়া রয়েছে গ্যারেজ, ওয়ার্কশপ ও বিক্রির দোকান। সব কিছু মিলিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ‘কয়েক হাজার কোটি’ টাকা।

সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো বলছে, ব্যাটারিচালিত রিকশা অনুমোদিত, নাকি অনুমোদিত না- এ নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা থাকায় এই কারখানাগুলো যখন হয় তখন কোনও বাধা দেওয়া হয়নি।

২০০৭ থেকে শুরু

ঢাকার কমলাপুরে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়াম মার্কেটই মূলত ঢাকার ব্যাটারিচালিত রিকশা বাজার হিসেবে পরিচিত। সেখানকার সব দোকানেই রিকশার ব্যাটারি, মটর ও বডি পাওয়া যায়।

ব্যাটারিচালিক রিকশার চালকদের আন্দোলন চলাকালে সকাল সন্ধ্যার এই প্রতিবেদক মার্কেটটি ঘুরে দেখেছে, কথা বলেছে সেখানকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে।

তাদের একজন আয়ান ট্রেড সেন্টারের মালিক মো. খোরশেদ আলম, যিনি প্রায় ১৫ বছর ধরে আছেন এই ব্যবসায়।

বাংলাদেশে ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যবসা কত টাকার, তা নিয়ে কোনও পরিসংখ্যানই নেই। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

বাংলাদেশে কীভাবে এই রিকশার যন্ত্রাংশ আসা শুরু, কীভাবে এই ব্যবসা এতো বড় হলো সে সম্পর্কে খোরশেদ আলম বলেন, “২০০৭ সালে প্রথম এই ব্যাটারি, মটর আসা শুরু। কিছুদিনের মধ্যেই এই রিকশা জনপ্রিয় হয়ে গেল। জনপ্রিয়তা এত বাড়ল যে বছরখানেকের মধ্যে প্রায় ১০০ জনের মতো আমদানিকারক তৈরি হয়ে গেল।”

খোরশেদ আলম নিজেও ব্যাটারি ও মটর আমদানি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ‘বিভিন্ন জায়গায় ঘুষ দেওয়ার ঝামেলা থেকে বাঁচতে’ আর আমদানি করেননি বলে জানান।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশে এই ব্যাটারি এমন জনপ্রিয় হলো যে চাইনিজরাও বুঝল ব্যাপক ব্যবসা হবে। তাই তারাও সরাসরি তাদের জিনিস বিক্রি করা শুরু করল। আমি তখন ঘুষ দেওয়ার বিভিন্ন ঝামেলা এড়ানোর জন্য তাদের থেকে জিনিস নেওয়া শুরু করলাম।

“বাজারের চাহিদা টের পেয়েছিল চীনা ব্যবসায়ীরা। তাদের উদ্যোগেই প্রথম বাংলাদেশে গড়ে ওঠে ব্যাটারির কারখানা। ২০১৩ সালে এশিয়া ব্যাটারি লিমেটেড নামে কারখানা তৈরি হয়, যার মালিকানা ছিল চীনা ব্যবসায়ীদের। এরপর একে একে গড়ে উঠতে শুরু করে কারখানাগুলো।”

ব্যবসার ৮০ শতাংশই চীনের

বাংলাদেশে ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যবসা কত টাকার, তা নিয়ে কোনও পরিসংখ্যানই নেই। ব্যবসায়ীদের ধারণা, প্রত্যেক বছর এ খাতে হাজার কোটি টাকার উপর ব্যবসা হয়। এই ব্যবসার প্রায় পুরোটাই চীনের নিয়ন্ত্রণে।

সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশে এই রিকশার পুরো ব্যবসায় চীনের অংশীদারত্ব ৮০ ভাগের উপরে। আর দেশে প্রত্যেক বছর যে পরিমাণ ব্যাটারি তৈরি হয়, তার ৯০ শতাংশই হয় চীনা কোম্পানিগুলোর কারখানায়।

বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোর মধ্যে নাভানা, সাইফ পাওয়ারটেকের রয়েছে ব্যাটারি তৈরির কারখানা। অন্য কোনও দেশীয় প্রতিষ্ঠান ব্যাটারি বানালেও উল্লেখযোগ্য না। কিছু কোম্পানি বাংলাদেশ-চীন যৌথ বিনিয়োগে চলছে। এদের মধ্যে বেঙ্গল বি লিমিটেডই বেশি ব্যবসা করছে।

ঢাকার কমলাপুরে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়াম মার্কেটের আরেক দোকান। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

সরাসরি চীনা বিনিয়োগে গড়ে উঠেছে সবচেয়ে বেশি কারখানা। এগুলোর মধ্যে জিয়াংজু স্টোরেজ ব্যাটারি কোম্পানি লিমিটেড, এশিয়া ব্যাটারি লিমিটেড, টং রুইডা ইন্ড্রাস্ট্রি লিমিটেড, ডং আও, লেকি পাওয়ার, হনইয়ং, এক্সশিং শুন উল্লেখযোগ্য। সবচেয়ে বড় কারখানা জিয়াংজুর। এই কারখানা থেকেই বাংলাদেশের চাহিদার ৫০ শতাংশ ব্যাটারি সরবরাহ করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কারখানা মালিক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের এই ব্যবসায় পুরোটাই চীননির্ভর। হয় আমরা তাদের কাছ থেকে আমদানি করছি। তা না হলে ওরা বানাচ্ছে, আমরা বিক্রি করছি। বাংলাদেশের কারখানাগুলো এখানে খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই।”

ব্যাটারিচালিক রিকশার বৈধতা নিয়ে ‘একপ্রকার ধোঁয়াশা’ থাকলেও কেন তারা এসব কারখানা দিলেন সেই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আমরা তো শুরু করিনি। শুরু করেছে বিদেশিরা। তারা যখন অনুমতি পেল, তখন আমরা কেন করতে পারব না? আমরা তো সব নিয়ম মেনেই কারখানা দিয়েছি। সব ধরনের ছাড়পত্র আমাদের আছে।”

রিকশার বৈধতা নিয়ে যে ধোঁয়াশা রয়েছে সে সম্পর্কে ওই ব্যবসায়ী বলেন, “আমরা যখন কারখানা দিই, তখন জানতাম যে খুব কম সময়ের মধ্যে এসব যানবাহনকে একটি নিয়মের মধ্যে আনা হবে। কিন্তু এত বছরেও তা হয়নি। আপনি আর কত বছর এরকম পায়ে চলা রিকশা চালাবেন। এই ধোঁয়াশা বন্ধ করা প্রয়োজন। এখানে অনেক মানুষের বিনিয়োগ রয়েছে। এর ক্ষতি হলে বাংলাদেশেরই ক্ষতি হবে।”

সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশে এই রিকশার পুরো ব্যবসায় চীনের অংশীদারত্ব ৮০ ভাগের উপরে।

সুষ্ঠু নীতিমালা শুধু এই যানবাহনের ক্ষেত্রে না, কারখানার ক্ষেত্রেও করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “পুরো ব্যবসা চীনের নিয়ন্ত্রণে। তারা চাইলেই দাম কমিয়ে দেয়। তাদের সঙ্গে আমরা দামে পারি না। আমাদের ক্ষতি হয়। সরকার একটা নীতিমালার মধ্যে আনলে ব্যাটারির দাম কত হতে পারে- তা নিয়ে ধারণা থাকলে কেউ আর দাম নিয়ে কারসাজি করতে পারবে না।”

কারখানাগুলো বৈধতা পেল কীভাবে

কোনও কারখানা করতে গেলেই বেশ কিছু সনদ লাগে। এর মধ্যে রয়েছে সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান অধিদপ্তরের শ্রম ছাড়পত্র। এসব সনদ আর ব্যাংক লেনদেনের হিসাব পরিষ্কার থাকলে শুরু করা যায় কারখানা।

এসব নিয়ম দেশি বিনিয়োগের জন্য। বিদেশি বিনিয়োগ হলে আরও কিছু ধাপ পার হতে হয়। বিদেশি বিনিয়োগ আসতে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) ছাড়পত্র লাগে। তারও আগে বাংলাদেশে কোম্পানি তালিকায় জয়েন্ট স্টক কোম্পানি হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে হয়।

এসব ব্যাটারি যানবাহনে ব্যবহার করার বিষয়ে সরকার কোনও নীতিমালা না করলেও কীভাবে এসব কারখানা বৈধতা পেল তা জানতে সকাল সন্ধ্যা কথা বলেছে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে।

এ প্রসঙ্গে শিল্প মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. আব্দুল ওয়াহেদ বলেন, “দেখেন- কে এখানে কারখানা করবে, কী করবে না- তা আমাদের শিল্প মন্ত্রণালয়ের দেখার কথা না। বিদেশি বিনিয়োগে হলে তো সেটা দেখার দায়িত্ব বিডার। আমরা বিভিন্ন রকমের ছাড়পত্রের তালিকা দিয়ে রাখি, সেগুলো পূরণ করতে পারলে যে কেউ কারখানা দিতে পারবে। এসব ছাড়পত্রে শুধু শিল্প মন্ত্রণালয়ের না, আরও মন্ত্রণালয়ের বিষয়ও রয়েছে।”

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিডার আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শাহ মোহাম্মদ মাহবুব বলেন, “এসব ব্যাটারি বৈধ, কি বৈধ না- এই নিয়ে একটা ধোঁয়াশা রয়েছে। এই কারণেই তারা হয়ত এই সুযোগ পেয়েছে।”

অটোরিকশা চালকরা সড়ক অবরোধ করলে তাদের সরিয়ে দেয় পুলিশ। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

নীতিমালা দাবি

ব্যাটারিচালিত রিকশা ও রিকশার ব্যবসার জন্য নীতিমালার দাবি জানিয়েছে চালকদের সংগঠনগুলো, যার আওতায় নিবন্ধনও থাকবে।

এ বিষয়ে রিকশা ভ্যান ইজিবাইক শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম নাদিম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কারখানা তো গরিব রিকশাচালকরা দেয় নাই। ব্যাটারিও তো তারা বানায় নাই, বা বিক্রিও করে নাই। সরকার বড় বড় ব্যবসায়ীদের এগুলো করার পারমিশন দিছে। এখন মার্কেটে এই ব্যাটারি আসার পর আমি লাগায়ে ব্যবহার করছি। এটা কি আমার দোষ?”

তিনি বলেন, “যেহেতু এটা বাজারজাত হইছে। রিকশাচালকরা কিস্তিতে টাকা নিয়ে এসব কিনেছে। এখন বন্ধ করে দেওয়া তো কোনোভাবেই উচিত নয়। এটা বৈধ, নাকি অবৈধ- এই টানাপোড়নে খুশি হচ্ছে চাঁদাবাজ এবং পুলিশরা। মাসে শত কোটি টাকার দুর্নীতির সুযোগ পাচ্ছে।

“আমরা চাঁদাবাজদের কেন টাকা দিব? বিআরটিএ যদি একটা নীতিমালা করে, সেটার অধীনে আমাদের লাইসেন্স দিবে। রিকশাচালকরা সরকারকে মাসিক বা বার্ষিক চুক্তিতে টাকা দিবে। এতে সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়বে।”

সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা, ভ্যানসহ এই ধরনের থ্রি হুইলার চলাচল বন্ধে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) গত ১৮ মে (শনিবার) জারি করা বিজ্ঞপ্তির ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই ঢাকার সড়কে রবিবার (১৯ মে) শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। প্রতিবাদে রাজধানীর কোথাও সড়ক অবরোধ করেন এসব বাহনের চালকরা।

চালকদের বিক্ষোভ ও সমালোচনার মুখে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সরকার। নিম্ন আয়ের মানুষের কথা চিন্তা করে ঢাকায় এই অটোরিকশা চালু রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা আসার পর এখন পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন বলে জানিয়েছেন সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের বিআরটিএ অধিশাখার উপ সচিব মো. মনিরুল আলম।

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আদেশে ঢাকা শহরে এসব রিকশা চলছে। আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছি। তাতো এখন বলা যাবে না। কিন্তু আপনাকে বলতে পারি, আমরা সকল অংশীদারদের সঙ্গে বসার উদ্যোগ নিচ্ছি। একটু সময় লাগলেও আমরা নীতিমালা ঠিক করব।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত