Beta
বুধবার, ৩ জুলাই, ২০২৪
Beta
বুধবার, ৩ জুলাই, ২০২৪

সাক্ষাৎকার

আমরা আবার ঋণনির্ভর হয়ে পড়ছি

মোস্তাফিজুর রহমান

বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও অর্জনযোগ্য প্রবৃদ্ধিকে সামনে রেখে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব জাতীয় সংসদে তুলে ধরেছেন অর্থমন্ত্রী। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা চতুর্থ মেয়াদের প্রথম বাজেট হওয়ায় এর বিশেষ গুরুত্বও রয়েছে। এই বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত ওঠে এসেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও অর্থনীতিবিদদের দেওয়া প্রতিক্রিয়ায়। যদিও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে বাজেট ছাড়াও আরও কিছু বিষয়ে গুরুত্বের সঙ্গে নজর দেওয়া জরুরি। প্রস্তাবিত এই বাজেটে অর্থনীতির বিদ্যমান সংকটগুলো সমাধানে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তা জানতে অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমানের মুখোমুখি হয় সকাল সন্ধ্যা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করা এই অধ্যাপকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশফাকুর রহমান

আমরা আবার ঋণনির্ভর হয়ে পড়ছি

মোস্তাফিজুর রহমান

বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও অর্জনযোগ্য প্রবৃদ্ধিকে সামনে রেখে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব জাতীয় সংসদে তুলে ধরেছেন অর্থমন্ত্রী। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা চতুর্থ মেয়াদের প্রথম বাজেট হওয়ায় এর বিশেষ গুরুত্বও রয়েছে। এই বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত ওঠে এসেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও অর্থনীতিবিদদের দেওয়া প্রতিক্রিয়ায়। যদিও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে বাজেট ছাড়াও আরও কিছু বিষয়ে গুরুত্বের সঙ্গে নজর দেওয়া জরুরি। প্রস্তাবিত এই বাজেটে অর্থনীতির বিদ্যমান সংকটগুলো সমাধানে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তা জানতে অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমানের মুখোমুখি হয় সকাল সন্ধ্যা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করা এই অধ্যাপকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশফাকুর রহমান

সকাল সন্ধ্যা: অর্থমন্ত্রীর সদ্য দেওয়া বাজেট ২০২৪-২৫-এর শিরোনাম ছিল ‘টেকসই উন্নয়নের পরিক্রমায় স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রায়’। এ শিরোনামে থাকা শব্দ যুগল ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’কে একজন অর্থনীতিবিদ, বাজেট বিশেষজ্ঞ বা সচেতন নাগরিক হিসেবে চলমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের বিচারে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

মোস্তাফিজুর রহমান: দীর্ঘমেয়াদী প্রেক্ষাপট থেকে অবশ্যই আমরা একটা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ চাই। যেখানে ডিজিটালাইজেশনের সুবিধা, চতুর্থ বা পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের সুবিধা, যেখানে একটা আধুনিক উৎপাদনখাত থাকবে, শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে কৃষি— হবে একটি পরিবেশবান্ধব বাংলাদেশ।

এই যে একটা অভীপ্সা— আমার মনে হয় যে, এটার সঙ্গে দেশের সব নাগরিকই একাত্মবোধ করেন। কিন্তু এবারের যে বাজেট— একটা বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রণীত হয়েছে। এবারের বাজেটের বেশকিছু চ্যালেঞ্জ ছিল— যেটা আমাদের তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রয়োজনীয়তা ছিল।

একটা মধ্য-দীর্ঘমেয়াদী অভীপ্সা ঠিক আছে। কিন্তু সেই অভীপ্সার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে একটা বাজেট করাও প্রয়োজন। কিন্তু এবারের বাজেটটা ব্যতিক্রমী বাজেট হওয়া প্রয়োজন ছিল।

আমাদের অর্থনীতি এখন যে ধরনের চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে— এই প্রেক্ষিতে সেটি মোকাবেলা করার বাজেট দরকার ছিল।

আমাদের অর্থনীতির বড় একটি শক্তির জায়গা ছিল— সেটি হলো প্রবৃদ্ধি— সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা— নিম্ন মূল্যস্ফীতি, উচ্চ পর্যায়ের রিজার্ভ, ব্যালেন্স অব পেমেন্টে একটা স্বস্তিপূর্ণ অবস্থা, আমাদের মুদ্রার বিনিময় হারে একটা স্থিতিশীলতা— এই জায়গা থেকে গত দুই বছরে আমাদের অর্থনীতি সরে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে বেশ ‍কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে।

তাই এবারের বাজেটে প্রয়োজন ছিল ওই লক্ষ্যের যার মাধ্যমে কীভাবে অর্থনীতিকে আগের জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়। এরপর এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’র দিকে নিয়ে যাব। কিন্তু সেটা না করে এবার খুবই গতানুগতিক বাজেট দেওয়া হয়েছে— যেন এটাই স্বাভাবিক।

আমরা পূর্বে যে অবস্থার মধ্যে ছিলাম— এর সঙ্গে সামঞ্জস্যতা রেখেই একটা বাজেট দেওয়া হয়েছে। এতে আমাদের যে অভীপ্সা আছে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ নিয়ে সেটা অর্জন করাকে আমাদেরকে আরও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে।

আমাদের অর্থনীতির বড় একটি শক্তির জায়গা ছিল— সেটি হলো প্রবৃদ্ধি— সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা— নিম্ন মূল্যস্ফীতি, উচ্চ পর্যায়ের রিজার্ভ, ব্যালেন্স অব পেমেন্টে একটা স্বস্তিপূর্ণ অবস্থা, আমাদের মুদ্রার বিনিময় হারে একটা স্থিতিশীলতা— এই জায়গা থেকে গত দুই বছরে আমাদের অর্থনীতি সরে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে বেশ ‍কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে।

সকাল সন্ধ্যা: এবার বাংলাদেশের ঋণ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাই আপনার কাছে। ঋণ পরিশোধ নিয়ে বাংলাদেশ সংকটে রয়েছে বিভিন্নভাবে আলোচিত হয়েছে। এবারের বাজেটে সেটির প্রতিফলন কীভাবে দেখা গিয়েছে?

মোস্তাফিজুর রহমান: আমাদের দেশে ঋণের পরিপ্রেক্ষিতে যে সমস্যা হয়েছে, সেটি বাজেটীয় কাঠামোর মধ্যে যে দুর্বলতা আছে তা নিয়েই আমরা এই বাজেটটি করেছি। এটিরও একটি প্রতিফলন এই ঋণের বিষয়টির মধ্যে আছে।

আমরা বাজেটে প্রাক্কলন করেছি যে, ৯.৭ শতাংশ (রাজস্ব আয় পাঁচ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা) জিডিপি’র (মোট দেশজ উৎপাদন) সমপরিমাণ নিয়ে যাব আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎসকে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এটি ছিল ৮.৩ শতাংশ। ২০২৩-২৪-এ সংশোধন করে এটি করা হয়েছে ৯.৩ শতাংশ। এখন এটি আমরা ৯.৭ শতাংশে নিয়ে যাব।

বোঝাই যাচ্ছে যে, এখানে আইএমএফ’র একটা প্রচ্ছন্ন চাপ আছে। এর কারণ প্রকৃত যে আয়টি হবে সেটা এনবিআর’র সংশোধিত লক্ষ্য থেকেও কম। আমাদের ধারণা, প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো কম আদায় হবে। এটাকে আমি বিবেচনায় নিয়ে ৯.৭ শতাংশে নিয়ে যেতে চাই তাহলে প্রায় ২৫ শতাংশের মতো এনবিআর’র অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ বাড়াতে হবে। এই লক্ষ্যমাত্রাটা এই বছর অর্জন সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।

এটা হলো একটা দিক। দ্বিতীয় যেটা হলো এই ৯.৭ শতাংশ যদি আমরা আদায় করতে পারি, তাহলেও এটা আমাদের দক্ষিণ এশিয়ায় এবং উন্নয়নশীল দেশের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায় জিডিপি’র অনুপাতে আমরা অনেক পিছিয়ে থাকব।

এটার কারণে আমরা এখন আবার ঋণ নির্ভর হয়ে পড়ছি। আমাদের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির পুরোটাই হয় অভ্যন্তরীণ না হয় বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। আমরা যদি দেখি, রাজস্ব ব্যয়ের দ্বিতীয় প্রধান ব্যয়ের খাত আমাদের ঋণের সুদ পরিশোধ।  

সকাল সন্ধ্যা: এবারের বাজেটে আমরা দেখছি যে, সুদ এবং শিক্ষা-প্রযুক্তিতে প্রায় সমপরিমাণ টাকা ব্যয় করবে সরকার। ধারণা করি, বিষয়টি একদমই কাকতালীয়। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতির এই বিশেষ অবস্থায় টেকসই উন্নয়নের প্রতি যে আকাঙ্ক্ষা সেটা কোনওভাবে ব্যাহত হবে কিনা? শিক্ষা-প্রযুক্তিতে ব্যয়কে যদি আমরা এগিয়ে যাওয়ার ভিত্তি সূচক হিসেবে ধরে নিই…

মোস্তাফিজুর রহমান: বাংলাদেশের সরকারের ৭৯ বিলিয়ন ডলারের মতো বৈদেশিক ঋণ আছে। ব্যক্তিখাত যোগ করলে সেটা দাঁড়ায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। জিডিপি’র হার হিসেবে সেটা ২২-২৩ শতাংশ। হার হিসেবে এটা বড় নয়।

সমস্যা কিন্তু এই জায়গায় নয়। একটা হলো, আমরা ক্রমান্বয়ে ঋণ নির্ভর হয়ে পড়ছি। যেহেতু আমরা অভ্যন্তরীণ উৎস হতে সম্পদ আহরণ করতে পারছি না। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১৫-২০২০) অভ্যন্তরীণ সম্পদ ২০২০ সালেই জিডিপি’র ১৪ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য আমাদের ছিল। আর এখন ২০২৪ সালে এসে বলছি, ৯.৭ শতাংশ আমাদের লক্ষ্যমাত্রা।

কাজেই আমরা যেটা লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করি সেটারতো কোনটাই বাস্তবায়ন করতে পারছি না। এছাড়া বাস্তবায়ন করতে যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া দরকার সেগুলোর অনেকগুলোই আমরা নিচ্ছি না— সংস্কারও করছি না।

এখন এই ঋণ পরিষেবা আমাদের পরিশোধ করতে হয় বিদেশি মুদ্রায়। আমাদের রিজার্ভ এখন অনেক কম। আমাদের যখন ৪৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ ছিল— তখন আড়াই বিলিয়ন ডলার ছিল আমাদের বৈদেশিক ঋণের ব্যয়ভার। যেটাকে আমরা পাবলিকলি গ্যারান্টেড ঋণ বলি। এখন আমাদের রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে। আগামী দুই-তিন বছরে আমাদের সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

তাহলে তুলনামূলকভাবে বোঝাই যাচ্ছে, জিডিপি’র শতকরা হার হিসেবে কম হতে পারে— কিন্তু দায়ভার হিসেবে— আমাদের রিজার্ভের পরিমাণের সঙ্গে এর তুলনা করি— আমাদের রাজস্ব আয়ের সঙ্গে ঋণ পরিষেবা তুলনা করি— তাহলেতো এটা অনেক বাড়ছে। দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় হলো, অনেক ক্ষেত্রে এই ঋণগুলো আমরা সময়মতো ব্যবহার করতে পারছি না— সাশ্রয়ীভাবে ব্যবহার করতে পারছি না— সুশাসনের স্বার্থে ব্যয় করতে পারছি না।

মোস্তাফিজুর রহমান: অবশ্যই। কিন্তু আমার যদি রাজস্ব আয় কম হয়, আমার আয়ের বড় একটা অংশ যদি ঋণ পরিষেবায় চলে যায়— তখন শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো বা সামাজিক সুরক্ষার মতো যে খাতগুলো আছে সেখানে বেশি টাকা সংকুলান করা মুশকিল হয়ে যায়।

এর ফলে দেখা যাচ্ছে, প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। ইআরডি’র কাছে এই বিষয়ে হিসাব আছে, কোনও প্রকল্পে গড়ে আমাদের ৫০ শতাংশের মতো সময় বেশি লাগে। ফলে ব্যয়ও ওই অনুপাতে বাড়ে।

আমরা ক্রমান্বয়ে ঋণ নির্ভর হয়ে পড়ছি। যেহেতু আমরা অভ্যন্তরীণ উৎস হতে সম্পদ আহরণ করতে পারছি না। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১৫-২০২০) অভ্যন্তরীণ সম্পদ ২০২০ সালেই জিডিপি’র ১৪ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য আমাদের ছিল। আর এখন ২০২৪ সালে এসে বলছি, ৯.৭ শতাংশ আমাদের লক্ষ্যমাত্রা। কাজেই আমরা যেটা লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করি সেটারতো কোনটাই বাস্তবায়ন করতে পারছি না। এছাড়া বাস্তবায়ন করতে যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া দরকার সেগুলোর অনেকগুলোই আমরা নিচ্ছি না— সংস্কারও করছি না।

সকাল সন্ধ্যা: কিন্তু টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে শিক্ষাতো একটি বড় উপাদান…

মোস্তাফিজুর রহমান: এ কারণে বছরে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় জিডিপি’র এক শতাংশেরও কম। সেটাও আমরা ব্যয় করতে পারি না। বাংলাদেশে ‘আউট অব পকেট’ খরচ দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি। ৭০ শতাংশের বেশি নিজের অর্থ খরচ করতে হয়। যেহেতু স্বাস্থ্যখাতে সরকারি অনেক সুবিধা পাওয়া যায় না।

শিক্ষাখাতে আমাদের যে ব্যয় হওয়ার কথা সেটা আড়াই শতাংশেরও কম। যেটা আমাদের মতো দেশে চার-ছয় শতাংশে নিয়ে যাওয়া উচিত।

যেসব দেশ এক সময় আমাদের পর্যায়ে ছিল তারা কিন্তু শিক্ষাখাতে ব্যয় থেকে তাদের এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। এখনও আমরা যথেষ্ট সম্পদ আহরণ করতে না পারায় সম্পদ ব্যয় করতে গিয়ে নানান সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি।

শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সামাজিক সুরক্ষার মতো খাতে আমাদের যে ব্যয় করার কথা সেটা আমরা করতে পারছি না। দ্বিতীয়ত যেটুকুই ব্যয় করছি সেখানেও নানান ধরনের অদক্ষতা আমরা দেখছি। শিক্ষাখাতের বেশির ভাগ অংশ পরিচালনে ব্যয় হচ্ছে। আমাদের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় যে বিনিয়োগ করা দরকার সেটা আমরা করতে পারছি না।

অথচ এটা এমন একটা সময় এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। বাজারনির্ভর সক্ষমতা ও প্রতিযোগিতায় আমাদের অংশগ্রহণ করতে হবে।

সকাল সন্ধ্যা: আপনি বললেন যে, শিক্ষাখাতেও পরিচালনে বেশ ব্যয় হচ্ছে। এবারের বাজেটে আমরা দেখছি যে, জনপ্রশাসনে ব্যয়ের হার সবচেয়ে বেশি। এর কারণ কী?

মোস্তাফিজুর রহমান: জনপ্রশাসনে ব্যয় বৃদ্ধি সবচেয়ে বড় উল্লম্ফন হয়েছে বেতন-ভাতা-বিভিন্ন সুবিধার কারণে। জনপ্রশাসন যদি দক্ষভাবে সরকারি পরিষেবাগুলো দেয় তাহলে সেটা থেকে সবাই উপকৃত হবে।

কিন্তু আমরা অনেক সময় দেখছি, একদিকে জনপ্রশাসনের ব্যয় বাড়ছে কিন্তু যে দক্ষতাটা আমাদের বৃদ্ধি হওয়ার কথা— বড় বড় প্রকল্পগুলো সময়মতো শেষ করা, সাশ্রয়ী হওয়া— সেগুলো ঠিক মতো হচ্ছে না। ফ্যামিলি কার্ড বিতরণ করতে গিয়ে যে অব্যবস্থাপনা দেখা গেল সেটা থেকে এটি বোঝা যায়।

আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে জনপ্রশাসনের দরকার আছে। এ খাতে সরকারের মোট ব্যয়ের ১৪ শতাংশ। বাকি ব্যয়তো প্রাইভেট সেক্টর থেকে হচ্ছে। আমরা দেখছি যে, হাসপাতাল ভবন আছে, যন্ত্রপাতি আছে। কিন্তু পরিচালনার লোক নেই। কিংবা শিক্ষাখাতে একই চিত্র দেখছি।

সকাল সন্ধ্যা: সাধারণভাবে দেখলে দেখা যায়, প্রতিবছর বাজেট ঘোষণার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে খরচ বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার বদ্ধ পরিকর। তারপরওতো জীবনযাপন ব্যয় বাড়বে। তাহলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পুরো প্রক্রিয়াটি কতটা সফলভাবে সম্ভব হবে?

মোস্তাফিজুর রহমান: এখানেইতো এবারের বাজেটের সঙ্গে বর্তমানের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার যে পদক্ষেপ— এর যে অসামঞ্জস্যতা— এটাইতো আমাদের মূল সমালোচনা। যে কয়টি পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট কমানো হয়েছে— এক কথায় সেটা হলো খুবই কম।

নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের সঙ্গে ভ্যাটের সমন্বয় করতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে আইএমএফ’র একটা প্রচ্ছন্ন চাপ থাকতে পারে। এ বিষয়ে ২০১২ সালের ভ্যাট আইন অনুসরণ করা হয়েছে। ফলে ভ্যাট বেড়েছে। তার মানে হলো পণ্য-সেবার মূল্য বাড়বে। নির্বাচিতভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক কমিয়ে মূল্য কম রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।

এর সুবিধা আমদানিকারকরা পেলেও ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত আসে না। ফলে বাজার ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা শুধু রাজস্বের ওপরেই নির্ভর করে না। আমদানি শুল্ক কমালেই যে পণ্যের মূল্য কমে যাবে সেটি নয়। বাজার ব্যবস্থাপনা ও সরবরাহ ব্যবস্থায় নজরদারি বাড়াতে হবে। না হলে এটা ভোক্তাদের ঘাড়েই এসে পড়বে।

একদিকে জনপ্রশাসনের ব্যয় বাড়ছে কিন্তু যে দক্ষতাটা আমাদের বৃদ্ধি হওয়ার কথা— বড় বড় প্রকল্পগুলো সময়মতো শেষ করা, সাশ্রয়ী হওয়া— সেগুলো ঠিক মতো হচ্ছে না। ফ্যামিলি কার্ড বিতরণ করতে গিয়ে যে অব্যবস্থাপনা দেখা গেল সেটা থেকে এটি বোঝা যায়।

সকাল সন্ধ্যা: এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার প্রচেষ্টার সুবিধা কি আমরা পাব না?

মোস্তাফিজুর রহমান: যদিও চেষ্টা করা হয়েছে মুদ্রানীতি সংকোচমূলক করতে। বাজেটের আকার বড় না করে মূল্যস্ফীতি বাড়তে না দেওয়া। না হলে টাকার সরবরাহ বেড়ে গিয়ে মুল্যস্ফীতিকে উসকে দিত। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিছুটা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। শুল্ক, বাজার ব্যবস্থাপনা সেখানে কিন্তু বড় ধরনের উদ্যোগ দেখা যায়নি।

আরেকটি বিষয় হলো, আয়কর কাঠামোতে কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া নিম্ন আয়ের মানুষের সামাজিক সুরক্ষার কাঠামোর মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু বিস্তৃতভাবে হয়নি।

সকাল সন্ধ্যা: বাজেটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। নৈতিকতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই প্রস্তাব বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য প্রাসঙ্গিক?

মোস্তাফিজুর রহমান: এখানে দুইটি বিষয় আছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেই কিন্তু আছে— দুর্বৃত্তায়ন, অর্থপাচারকারী, ঋণখেলাপি, করখেলাপি তাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। কালো টাকা সাদা করার প্রস্তাব এই ইশতেহারের সরাসরি বিরুদ্ধে।

এছাড়া আগে যারা এই সুযোগ পেত, অবৈধভাবে সম্পদ গড়তো তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আইনপ্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থা নিতে পারত। এবার কিন্তু তাদের আলাদা করে নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে। কোনও সংস্থা তাকে কোনও প্রশ্ন করতে পারবে না।

এটা সংবিধান বিরোধী। এটা নৈতিকতাপন্থী নয়। এর মধ্যে দিয়ে যারা ৩০ শতাংশ হারে কর দিচ্ছে তাদের কি বার্তা দেওয়া হচ্ছে? বিষয়টি যদি এমন হতো, ১৫ শতাংশ হারে কর দিয়ে ৭.৫ শতাংশ হারে জরিমানা দিয়ে যদি এককালীন এই সুবিধা দেওয়া হলে তাহলেও না হয় হতো। কিন্তু এটার ফলেও যে সবটাকা সাদা হয়ে যাবে তা নয়।

আগেও এমন উদ্যোগে যে খুব সাফল্য পাওয়া গিয়েছিল তা নয়। বরং সৎ করদাতাকে নিরুসাহিত করবে— কর না দেওয়ার সুযোগ তৈরি করবে।

এটা সংবিধান বিরোধী। এটা নৈতিকতাপন্থী নয়। এর মধ্যে দিয়ে যারা ৩০ শতাংশ হারে কর দিচ্ছে তাদের কি বার্তা দেওয়া হচ্ছে? বিষয়টি যদি এমন হতো, ১৫ শতাংশ হারে কর দিয়ে ৭.৫ শতাংশ হারে জরিমানা দিয়ে যদি এককালীন এই সুবিধা দেওয়া হলে তাহলেও না হয় হতো। কিন্তু এটার ফলেও যে সবটাকা সাদা হয়ে যাবে তা নয়।

সকাল সন্ধ্যা: বাংলাদেশ তথ্য ও প্রযুক্তিখাত উৎসাহিত করতে কিছু কিছু ব্যবসায় কর সুবিধা দেওয়া হয়েছে এই বাজেটে। রাজস্ব আহরণ বাড়াতে বিনিয়োগ ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ একটি কার্যকর উপায়। বাজেটে কর সুবিধা দিয়ে এই সুযোগ কতটা তৈরি হয়েছে?

মোস্তাফিজুর রহমান: বাংলাদেশের বিনিয়োগ ও ব্যবসার পরিবেশ কী হবে সেটা হয়তো বাজেটে নেই। কিন্তু কর কাঠামোর সুবিধা কীভাবে পাওয়া যাবে সেটি বিবেচনা করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই সবকিছুই পরিবেশের ওপর নির্ভর করবে। এখনও যেমন ১০০ ইকোনোমিক জোনগুলো কার্যকর করে তোলা যায়নি।

সকাল সন্ধ্যা: গত ১৫ বছরে এই সরকারের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশকে শতভাগ বিদ্যুতের আওতায় আনার চেষ্টা করা হয়েছে। বেশ কিছু বড় প্রকল্প চলমান। বেশ কিছু প্রকল্পের সুবিধা আমরা পেতে শুরু করেছি। তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যত ভাবনা বাজেটে কতটা ইঙ্গিতপূর্ণভাবে আছে?

মোস্তাফিজুর রহমান: বাংলাদেশের অর্থনীতি পরবর্তী পর্যায় উন্নীত হওয়ার জন্য এসব উদ্যোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা মনে করি, এগুলো খুব ইতিবাচকভাবে ভূমিকা রাখবে। এটা নিয়ে সমালোচনা হতে পারে, এটি অতি অর্থায়ন করা হয়েছে কিনা। সময়মতো শেষ করতে না পারায় টাকা বেশি লেগেছে। এটা থেকে যে অভ্যন্তরীণ আয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে সেটা ঠিকমতো আসছে কিনা।

তবে এসব প্রকল্পের মধ্য দিয়ে সম্ভাবনা তৈরি করেছে। পদ্মা সেতুর মধ্য দিয়ে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমাদের শেষ ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করেছি। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক অবস্থা তৈরি করতে হবে। যার মধ্য দিয়ে জিডিপি বৃদ্ধি পাবে।

এবারের বাজেটেও বিনিয়োগকে প্রণোদিত করার বিষয়ে প্রাক্কলন করা হয়েছে প্রাইভেট ক্রেডিট আপটেক করবে ৯ শতাংশ। আমার এখন সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি করা হয়েছে। সুদের হার ৯ শতাংশের জায়গায় এখন ১৪-১৫ শতাংশ। ফলে বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে এগুলো কিছুটা সংকুচিত। এ জন্য আমাদের সময় লাগবে।

আমি যদি এখনকার চ্যালেঞ্জগুলোকে অস্বীকার করি— সঠিক সিদ্ধান্তগুলো না নিই তাহলে পরবর্তী যে অর্জন, সেগুলো তখন আরও প্রলম্বিত হয়ে যাবে। সুতরাং বাস্তবতা স্বীকার করে আমাদের উচিত হবে, এখনকার যে অর্থনৈতিক অবস্থা আছে সেটাকে একটু শান্ত করা— একটা নতুন ভারসাম্যে নেওয়া।

সকাল সন্ধ্যা: সংকোচনমূলক অর্থনীতির কারণে আমাদের আকাঙক্ষার লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়ার গতিটি ধীর হবে। কিন্তু এ অবস্থা মোকাবেলা করার সক্ষমতা কতটা আমাদের আছে?

মোস্তাফিজুর রহমান: বাংলাদেশের অর্থনীতির একটা অন্তর্নিহিত শক্তি আছে। আমরা কিন্তু একটি শক্তিমত্তা অর্জন করেছি। গত ১৫ বছর সময়কাল ধরলে দেখতে পাই, ২০১৫ সালে আমরা নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। ২০২৬ সালে আমরা এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাব। এখানে সরকারেরও ভূমিকা আছে, সেখানে ব্যক্তিখাতেরও ভূমিকা আছে।

কিন্তু গত দুই বছরে অর্থনীতি যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, এখন ফায়ার-ফাইটিং না করে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করাই এখন আমাদের মূল দায়িত্ব। সেখান থেকে আমাদের যখন একটা নতুন ভারসাম্য হবে তখন আমাদের যে মধ্যমেয়াদী আকাঙক্ষা আছে সেই দিকে অগ্রসর হবো।

কিন্তু আমি যদি এখনকার চ্যালেঞ্জগুলোকে অস্বীকার করি— সঠিক সিদ্ধান্তগুলো না নিই তাহলে পরবর্তী যে অর্জন, সেগুলো তখন আরও প্রলম্বিত হয়ে যাবে। সুতরাং বাস্তবতা স্বীকার করে আমাদের উচিত হবে, এখনকার যে অর্থনৈতিক অবস্থা আছে সেটাকে একটু শান্ত করা— একটা নতুন ভারসাম্যে নেওয়া।

সকাল সন্ধ্যা: এ জন্য আমাদের কী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে?

মোস্তাফিজুর রহমান: প্রবৃদ্ধিকে কিছুটা ছাড় দেওয়া। মূল্যস্ফীতিকে কীভাবে আমরা কমিয়ে আনতে পারি তাতে জোর দেওয়া। সুশাসনের দিকে জোর দেওয়া। সরাসরি কর সংগ্রহ না করে, ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে কীভাবে আমরা আরও বেশি কর সংগ্রহ করতে পারি সেই বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া— নিজস্ব সম্পদ আরও আহরণ করতে পারি।

যার অর্থ হচ্ছে, জোর দিয়ে আমাদের একটা ভারসাম্যে আসতে হবে। যার মধ্য দিয়ে বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক লক্ষ্যকে ঠিকমতো পরিচালিত করতে পারব।

সকাল সন্ধ্যা: এমন অবস্থার জন্য নিশ্চয়ই সবাইকে আমাদের দরকার। সরকার কি সেই দ্বার আমাদের জন্য উন্মুক্ত রেখেছে?

মোস্তাফিজুর রহমান: আমরা আশা করব। আমাদের বাজেট হলো, আমাদের মোট জাতীয় আয়ের ১৪ শতাংশ। বাকি ৮৬ শতাংশ বাংলাদেশের অন্যান্য খাত থেকে আসে। সরকারের কাজটা হলো তাদের কাজটাকে সহজ করে দেওয়া। তাই পুরো একটি দেশের ধারণা নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

সকাল সন্ধ্যা: আপনাকে ধন্যবাদ।

মোস্তাফিজুর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত