দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে প্রবল চাপে এখন টিউলিপ সিদ্দিক; অভিযোগের তীর এখন কিয়ার স্টারমারের দিকেও ছুটছে। এতদিন ধরে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর পাশেই ছিলেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু আর কতদিন?
এতদিন বিরোধী দলের পক্ষ থেকে সিটি মিনিস্টার টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগের দাবি তোলা হচ্ছিল। এখন ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির নেতাদেরও এনিয়ে মুখ খুলতে হচ্ছে। তাতে এমপি টিউলিপের মন্ত্রী হিসাবে টিকে থাকাটা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশে অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপ (৪২) টানা চতুর্থবার এমপি হওয়ার পর গত জুন মাসে লেবার পার্টির নেতা স্টারমারের মন্ত্রিসভায় স্থান পান। তাকে বানানো হয় সিটি মিনিস্টার, আর্থিক খাতের দুর্নীতি দমনের দায়িত্বও তার ওপরই বর্তায়।
টিউলিপ মন্ত্রী হওয়ার দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন তার খালা, বাংলাদেশে টানা চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসা শেখ হাসিনা।
এরপর টিউলিপের বিরুদ্ধে বাড়ি সংক্রান্ত দুর্নীতির একের পর এক অভিযোগ উঠতে থাকে, সেগুলোর সঙ্গে তার খালা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার খবরও আসতে থাকে যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্রগুলোতে।
দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার আসা টিউলিপ চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত নিজেকে তদন্তের মুখে সঁপে দিয়েছেন। যুক্তরাজ্যের সরকারকে দায়িত্বশীল রাখার দায়িত্ব যার ওপর, সেই লরি ম্যাগনেস এখন টিউলিপকে নিয়ে তদন্ত করছেন।
টিউলিপ কোনোভাবে যুক্তরাজ্যের মন্ত্রিপরিষদের নীতিমালা লঙ্ঘন করেছেন কি না, তার স্থাবর সম্পত্তি এবং সেসবের সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোনও যোগসূত্র আছে কি না, তা খতিয়ে দেখবেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ম্যাগনাস।
টিউলিপের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ ওঠে একটি বাড়ির ভাড়ার তথ্য গোপনের। এরপর সেন্ট্রাল লন্ডনে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ফ্ল্যাট নেওয়ার অভিযোগ সামনে আসে, যে ব্যবসায়ী আবার তার খালা শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের সমর্থক। এরপর অন্যের মালিকানায় থাকা একটি বিলাসবহুল বাড়িতে বিনা ভাড়ায় বসবাসের অভিযোগও ওঠে তার বিরুদ্ধে। ওই ব্যবসায়ীও শেখ হাসিনা বাংলাদেশে সিআইপি ঘোষণা করে ভিআইপির মর্যাদা দিয়েছিলেন।
এরপর তার বোন আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীরও হ্যাম্পস্টেডের একটি ফ্ল্যাট মুফতে পাওয়ার অভিযোগ ওঠে। ওই ফ্ল্যাটটিরও আগের মালিক ছিলেন শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ এক আইনজীবী।
এর মধ্যে বাংলাদেশের রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের ৪০০ কোটি পাউন্ড আত্মসাতে জড়িত থাকার অভিযোগও ওঠে টিউলিপের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশে দুদকে অভিযোগ জমা হওয়ার পর তা ফলাও করে ছাপা হয় যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্রগুলোতে। চুক্তি সইয়ের দিন পশ্চিমাদের চক্ষুশূল রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে টিউলিপের ছবিও আসে।
শুরু থেকেই টিউলিপের পক্ষেই বলে আসছেন প্রধানমন্ত্রী স্টারমার। লন্ডনে টিউলিপ যে হ্যাম্পস্টেড ও হাইগেট আসনের এমপি, তার পাশের আসনটিরই এমপি স্টারমার। দুজনের বন্ধুত্বও দীর্ঘদিনের, যা উভয়ই খোলাখুলিভাবেই প্রকাশ করে আসছেন।
দুর্নীতির অভিযোগের মুখে থাকা টিউলিপের পক্ষে থাকা স্টারমারের বিরুদ্ধেও এখন লেখালেখি হচ্ছে যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্রগুলোতে। ডেইলি মেইল দুদিন আগেই এক ‘এক্সক্লুসিভ’ প্রতিবেদন প্রকাশ করে, সেখানে টিউলিপের সূত্রে স্টারমারের শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়।
লেবার পার্টি থেকে ২০১৬ সালে প্রথম এমপি হওয়ার পর স্টারমারের বাংলাদেশ সফর, শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত, যুক্তরাজ্যে তার নির্বাচনী প্রচারে আওয়ামী লীগের প্রবাসী নেতাদের অংশগ্রহণের বিবরণ দেওয়া হয় সেই প্রতিবেদনে।
দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর থেকে রক্ষণশীল দলের পক্ষ থেকে টিউলিপের পদত্যাগের দাবি জানানো হচ্ছিল। যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে দিয়েও তার বিষয়ে তদন্তের আহ্বান জানান টোরি পার্টির সুসান হল।
দুর্নীতি দমন যার দায়িত্ব, তার দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “এই কেলেঙ্কারি প্রধানমন্ত্রীর বিচার সম্পর্কে আরও গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করে এবং এটি দেখায় যে তিনি ও তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহযোগীরা সরকার পরিচালনার জন্য উপযুক্ত নন।”
রক্ষণশীল দলের নেতা কেমি বেডেনক শনিবারই বলেন, টিউলিপ সিদ্দিককে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ করতে হবে।
তার সেই কথাটি স্কাই নিউজের কাছে তুলে ধরেন ছায়া চ্যান্সেলর মেল স্ট্রাইড। তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী এখনও যে তাকে (টিইলিপ) সরাচ্ছেন না, তা ঠিক হচ্ছে না।”
বিরোধীদের এমন দাবির পর বিজ্ঞানমন্ত্রী পিটার কাইল স্কাই নিউজকে বলেন, তদন্ত চলছে, তা শেষ হোক। যদি টিউলিপের বিরুদ্ধে সরকারি নিয়ম ভঙ্গের অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তবে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
তাকে নিয়ে তদন্তের জন্য টিউলিপ নিজেই ম্যাগনাসকে চিঠি দেন। সেখানে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেই তিনি লেখেন, “গত কয়েক সপ্তাহে আমাকে নিয়ে অনেক খবর হয়েছে, তার বেশিরভাগই ঠিক নয়। আমি জানি আমি কোনও অন্যায় করিনি। তবে আমি সবার সন্দেহ দূর করতে চাই, স্বাধীনভাবে এর তদন্ত হোক।”
এতদিন টিউলিপের পক্ষেই বলে আসছিলেন স্টারমার; কিন্তু দিনকে দিন চাপ যেভাবে বাড়ছে, সেই সঙ্গে টিউলিপের কেলেঙ্কারিতে তার নামও জড়িয়ে যাচ্ছে, তাতে স্টারমারকে এখন নতুন করে ভাবতে হবে বলে যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্রগুলোর বিশ্লেষণে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।