বহু বহু যুগ আগে গ্রিসের এথেন্স থেকে শুরু হয়েছিল প্রথম ভোটের ইতিহাস। মগজ ঝালিয়ে নিতে এই ইতিহাস ঘেঁটে পড়ে নেওয়া যায়। তবে বাংলাদেশের ভোটার হিসেবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে সেই ভোটগাঁথা মুখস্ত বলতে হবে না । তাই বলে ভোটের দিন একেবারে অপ্রস্তুত হয়ে থাকারও জো নেই।
শীতের হাওয়ার পালে এবার লেগেছে ভোটের হাওয়া। জাতীয় সংসদ নির্বাচন তাই গোটা দেশে ৭ জানুয়ারি থাকছে সাধারণ ছুটি। কারও কারও জীবনে জাতীয় নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ এসেছে একাধিক বার। আবার এবার অনেকেই প্রথম ভোটার হয়েছেন।
ভোটের সারাদিন আসলে উৎসবের দিনের মতই। এদিন পরিবারের ভোটার সদস্যরা এক সাথে ভোটকেন্দ্রে যান। এলাকায় ভোটকেন্দ্র হলে বন্ধুবান্ধবরা দল বেঁধে চলে আসেন।
ভোটের দিনটি তাই নাগরিক দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে পারিবারিক-সামাজিক মিলন মেলার দিনও।
ভোটারের প্রস্তুতি কেমন হবে?
এবার কোনো কেন্দ্রেই ইভিএমে ভোট হবে না। তাই নতুন এবং পুরনো ভোটার কাউকেই আর ইভিএমে ভোট দেওয়ার নিয়ম জেনে নিতে হবে না। তবে ভোটের তারিখের আগের রাতে অথবা ভোটের দিনে সকালে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নম্বর দেখে নিন।
ভোট দিতে এনআইডি সঙ্গে থাকা আবশ্যক নয়। তবে এনআইডি নম্বর, ভোটার নম্বর বা স্মার্ট কার্ড সঙ্গে থাকলে ভোটার তালিকা থেকে একজন ভোটারের নাম সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়।
এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের ৪২ হাজারেরও বেশি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ হবে। সাধারণত দেশের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতেই ভোট হয়ে থাকে।
নির্ধারিত ভোটকেন্দ্র কোনটি তা আগে থেকে জেনে নিলে ভোটের দিন থাকবেন নির্ঝঞ্ঝাট।
ভোটের দিন বাসা থেকে বার হওয়ার আগেই নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট http://www.ecs.gov.bd/page/gadgets-for-12th-national-parliament-election, অ্যাপ ও স্থানীয় নির্বাচন অফিস থেকে নিজের কেন্দ্রের বিবরণ জেনে রাখুন।
যারা এবার প্রথম ভোট দিচ্ছেন, তারা হাতে থাকা অল্প সময়ের মধ্যেই অনলাইনে খবর ও ভিডিও থেকে ব্যালটে ভোট দেওয়ার নিয়ম দেখে নিতে পারেন। তাছাড়া কেন্দ্রে কর্মকর্তার নির্দেশনাও মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে।
নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুসারে, ভোটকেন্দ্রে কোনো ধরনের দাহ্য পদার্থ, ম্যাচ, লাইটার কিংবা ধারালো বস্তুর মতো কিছুই সাথে নেওয়া যাবে না।
এমনকি মোবাইল ফোনও নিতে পারবেন না। যদি কারও সাথে ফোন থাকলে, তাহলে কেন্দ্রে থাকা অবস্থায় ফোন বন্ধ রাখতে হবে।
ভোটাররা তাই বড় ও ভারী কোনো ব্যাগ ছাড়াই ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেন। ভোটকেন্দ্রে লুকিয়ে ফোন চালু করে লাইভ করা ও সেলফি নিতে গেলে বিব্রতকর পরিস্থিতি হতে পারে। তাই অনুমতি না থাকলে কেন্দ্রের ভেতরে থাকাকালে এমন আচরণ করবেন না।
ভোট দিতে কখন যাবেন?
সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টার মধ্যে নির্ধারিত কেন্দ্রে যেতে হবে। ভোটকেন্দ্র যেতে কত সময় লাগবে বুঝে নিয়ে সেই মত রওনা করুন। কেন্দ্রে ভিড় থাকতে পারে, তাই হাতে সময় কিছু সময় রাখবেন, যেন ঘড়ি দেখতে গিয়ে মানসিক ভাবে অস্থির না হয়ে পড়েন।
ভোটের দিনের পোশাক
আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস বলছে, ৭ জানুয়ারি ’অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে’।
রোববার সকাল পর্যন্ত সারাদেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। এছাড়া রাত ও দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
যদি সকাল সকাল কেন্দ্রে যান, তাহলে বয়স্করা কুয়াশা ও বাতাসের ঠাণ্ডা থেকে সুরক্ষায় গলায় কলার দেওয়া সোয়েটার পরতে পারেন। তরুণ ভোটাররা ইউরোপীয় স্টাইলে গলায় চাদর বা মাফলার বেঁধে নিতে পারেন।
সকাল বা দুপুরে যখনই কেন্দ্রে যান, পোশাক পরবেন ঢিলেঢালা আরামদায়ক কাপড়ের । এদিন চারিদিক মুখর থাকবে মানুষের আনাগোনায়। এমন পরিবেশে তাই উৎসবের দিনের মতই রঙিন পোশাক বাছাই করুন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভোটকেন্দ্র হলে মাঠে হাঁটতে বা দাঁড়িয়ে থাকতে হতে পারে। তাছাড়া ভোটের দিন যান চলাচলে সীমাবদ্ধতা রয়েছে বলে হেঁটেও ভোটকেন্দ্রে যেতে হতে পারে।
তাই নারী ভোটাররা এদিন হিল জুতা এড়িয়ে চলুন। তরুণ থেকে বয়স্ক ভোটাররা বরং কেডস পরতে পারেন। ধুলো এড়াতে পা ঢাকা এবং পুরু তলার জুতা বাছাই করুন।
নেকাব পরে ভোটকেন্দ্রে গেলে, পোলিং এজেন্টের অনুরোধে নেকাব খুলে ভোটারের পরিচয় নিশ্চিত করতে হতে পারে। এই মানসিক প্রস্তুতি রেখে ভোট দিতে যান এবং কর্মকর্তাকে প্রয়োজনীয় দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করুন।
এই রবিবারের রূপসজ্জা
শীতকালে ত্বক একটুতেই শুষ্ক আর খসখসে হয়ে যায়। ভোটের দিন জনসমাগম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠে হাঁটাচলার কারণে ধুলোবালি উড়বেই চারদিকে। আবার দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত রোদে শুরুতে আরাম লাগলেও পরে মাথা ধরলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
এসব আগে থেকে ভেবে নিয়ে বাসা থেকে বার হওয়ার আগেই নিজেকে প্রস্তুত করে নিন। ত্বকে ভালো ময়েশ্চারাইজার, পছন্দের হারবাল তেল দিন। শীত হলেও মুখে, ঘাড়ে ও হাতে সানস্ক্রিন মেখে নিতে ভুলবেন না একদমই। প্রাইমার, ফাউন্ডেশন, কনসিলার যাই মুখে দিন, অবশ্যই এদিন ভারী মেকআপে সাজাবেন না নিজেকে।
গয়না বাছাই করতে একই পরামর্শ থাকছে আপনার জন্য। হালকা ও ছোট গয়না বেছে নিন। নুড লিপস্টিক, চোখে কাজল, ভ্রু যুগলের মাঝে ছোট টিপেই এদিন নারী ভোটারকে স্বতঃস্ফূর্ত দেখাবে।
সাজসজ্জা শুধু মেয়েদের জন্যই নয়। ছেলেরাও তাই ভোটের দিন মানসিক প্রস্তুতির সাথে সাথে নিজের ত্বকও প্রস্তুত করে নিন, যেন আপনাকে একদমই মলিন না লাগে।
ভোটের খানাদানা
ভোট দিতে দেরি হলেও হতে পারে। তাই না খেয়ে বাসা থেকে বার হওয়া বোকামি হবে। খেতে নিষেধ না হলে বয়স্করা ডিম, দুধ, ফল রাখবেন এদিন সকালের খাবার টেবিলে। কেন্দ্রে যাওয়ার আগে পেট ভাঙ্গে এমন কিছু খাবেন না। সকালে কমলার জুস, কফি খেতে পারেন। অন্য কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা না হলে স্যালাইন খেয়ে নিতে পারেন। এতে শরীর থাকবে আর্দ্র; বাইরে হাঁটা ও লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় দুর্বল বোধ করবেন না।
আর ভোট শেষে ফলাফল জানতে যদি রাত জাগতে চান, তাহলে টিভি পর্দার সামনে আড্ডা বন্ধু-পরিবার নিয়ে আড্ডায় শীতের ভাপা পিঠা, পেঁয়াজু, ফুচকা, চপ, সিঙ্গারা, গুড়-মুড়ি মাখা খেতে পারেন।
ভোটের চিন্তা বাড়াচ্ছে চাপ?
উৎসবের আমেজের মাঝেও ভোট নিয়ে সবখানেই নানা রকম ছক চলে। এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়তি উপস্থিতিতে অনেক ভোটার ঘাবড়ে যেতে পারেন। ভোট নিয়ে খবরাখবরে দখল, আটক, অগ্নিসংযোগ এমন অনেক ঘটনা বিচলিত করতে পারে। আবার ভোটের সময় পার হলে ফলাফল ঘোষণা শুনতে অনেকেই রাত জাগেন।
ভোটের দিনের আগের রাতে আগেভাগে ঘুমিয়ে যান। তাতে সকালে নিজেকে তরতাজা মনে হবে।
যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট রয়েছে ভোটের দিনে এসব ঘটনা প্রবাহ ও উত্তেজনা থেকে তারা অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন।
তাই প্রয়োজনে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগে বিপি মেপে নিন। ইনসুলিন নেওয়ার অভ্যাস থাকলে কেন্দ্রে যাওয়ার আগে বাসাতেই নিয়ে নিন। যাদের শ্বাসকষ্টের কারণে ইনহেলার নিতে হয়, তারাও ইনহেলার নিয়ে তবেই ভোটকেন্দ্রে যাবেন।
আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশন সচিব বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন মোবাইল অপারেটরের ইন্টারনেট ‘ফুল স্পিডে’ থাকবে। যদিও এর আগে অনেক ভোটের দিনেই মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক সমস্যা দেখা গেছে।
তাই ফোনে জরুরি কোনো যোগাযোগ ও অনলাইনভিত্তিক কাজ চেষ্টা করুন ভোটের দিনের আগে হাতে থাকা সময়ের মধ্যেই সেরে ফেলার।
ভোট সামাজিকতা
বন্ধু ও কাছে থাকা স্বজনরা একই ভোটকেন্দ্রের হলে সবাই মিলেই ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচন পাঁচ বছর পর পর আসে জীবনে। প্রতি পাঁচ বছরে জীবনে বহু অদল-বদল ঘটে যায়। তাই এই একটি দিন যখন চলে এসেছে, দিনটি ইতিবাচক আচরণের মধ্যে দিয়ে কাটান।