মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে আরও ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একইসঙ্গে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেছেন, যারা মানুষের ক্ষতি করবে তাদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত রাখবে এবং কাউকে রেহাই দেওয়া হবে না।
বৃহস্পতিবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে ১৪ দলীয় জোটের বৈঠকে তিনি একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “জ্বালাও-পোড়াও ও অগ্নিসংযোগ যেন কেউ না করতে পারে। এটা যারা করবে তাদের কোন ছাড় নেই। যতই মুরুব্বি ধরুক আর যাই করুক এদের আমরা ছাড়বোনা, এটা পরিষ্কার কথা। মানুষের ক্ষতি যারা করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত থাকবে।”
গ্রেনেড হামলাকারী, ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাকারবারি, দুর্নীতিবাজরা তার করে দেওয়া ডিজিটাল বাংলাদেশের সুযোগ নিয়ে বিদেশে বসে রোজই আন্দোলন, সরকার উৎখাতসহ নানারকম হুমকি ধমকি দিয়ে যাচ্ছে– একথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যতক্ষণ জনগণ আমাদের সাথে, আমি পরোয়া করিনা।”
তিনি বৈঠকে অংশগ্রহণকারী ১৪ দলীয় জোট নেতৃবৃন্দকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “এটা আমাদের সবসময় লক্ষ্য রাখতে ও বুঝতে হবে যে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি ছাড়া দেশের মানুষের কোনও কল্যাণ হবে না।
“এখানে আমাদের একটা জিনিস চিন্তা করতে হবে– আমরা যারা স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি, তারা সুসংগঠিত হয়ে জনগণের কাছে গিয়ে তাদের এই চেতনায় যুক্ত করতে আনতে হবে।”
ইতিহাস বিকৃতির চক্রান্ত মোকাবিলা করে তার সরকার ‘জয় বাংলা’ স্লোগান আবার ফিরিয়ে এনেছে– মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতার ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ সম্প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। তা এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিলে স্থান করে নিয়েছে। অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবেসের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে।
“বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে সেটাকে আর কেউ পিছিয়ে দিতে যেন না পারে। আর পারবেও না কারণ জনগণই আমাদের শক্তি,” বলেন তিনি।
বিএনপি বাংলাদেশে নির্বাচন করতে না দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল– এমন অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশে একটি বিমান ঘাঁটি করতে দেওয়ার প্রস্তাবও তার কাছে এসেছিল, তাহলে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং তার পুনর্নির্বাচিত হওয়ার ব্যবস্থা তারাই করবে। কিন্তু তখনও তিনি সেই নেতিবাচক উত্তরই দেন। যে ধরনের উত্তর ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে ভারতে বাংলাদেশের গ্যাস বিক্রির বিষয়ে আমেরিকার প্রস্তাবে তিনি দিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, “আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করে দেশ স্বাধীন করেছি। আমরা বিজয়ী জাতি। দেশের অংশ ভাড়া দিয়ে বা কারও হাতে তুলে দিয়ে আমি ক্ষমতায় যেতে চাই না। ক্ষমতার দরকার নেই। যদি জনগণ চায় ক্ষমতায় আসব, না হয় আসব না। আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মেয়ে।”
“এই কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য সবার জানা উচিত যে, তার যে যুদ্ধ সেটা ঘরে বাইরে সব জায়গায়,” বলেন শেখ হাসিনা।
চক্রান্ত এখনও চলছে– মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বে অব বেঙ্গলে একটা ঘাঁটি করবে। তার কারণ হচ্ছে বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগরে প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে। আর এই জায়গাটা নিয়ে কোনও রকম কারও দ্বন্দ্ব নাই। কাজেই এই জায়গাটির ওপরে সকলেরই নজর। সেটা আমি হতে দিচ্ছি না, সেটাও আমার একটা অপরাধ। যে কারণে আমাদের কিছু সমস্যায় সবসময় পড়তে হচ্ছে, পড়তে হবে আমি জানি।
“কিন্তু আমি এটাকে পাত্তা দেইনা, সোজাকথা। দেশের মানুষ আমার শক্তি। এই মানুষ যদি ঠিক থাকে, আমরা আছি। দেশটার যে উন্নতি হচ্ছে এটাও অনেকের পছন্দ নয়। এমনকি আমরা যে খাদ্য উৎপাদন করি, বড় এক দেশ বলে ফেলল– এত খাদ্য উৎপাদনের দরকার কি, আমাদের তো আছে আমরা দিতে পারি।”
তিনি বলেন, “জাতির পিতা যে বলেছিলেন তার মাটি ও মানুষ আছে তা দিয়ে স্বাধীনতার পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলবেন এবং সে পদক্ষেপও নিয়েছিলেন। সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমরা নিজেদের খাদ্য নিজেরাই উৎপাদন করব এবং এই দেশে কোনও মানুষ আর ভূমিহীন-গৃহহীন থাকবে না। সেভাবেই আমর দেশটাকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি, যেখানে বাধা দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা রয়েছে।”
কোভিড-১৯ পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং একে কেন্দ্র করে স্যাংশন ও পাল্টা স্যাংশনের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মূল্যস্ফীতি সমস্যাটা বড় আকারে দেখা দিয়েছে এবং কেবল বাংলাদেশ নয় পৃথবীর অনেক উন্নত দেশও এর ভুক্তভোগী।
তিনি সংবাদে প্রচারিত সাম্প্রতিক একটি অর্থনৈতিক রিপোর্টের বরাত দিয়ে বলেন, “আমরিকাতেও মূল্যস্ফীতি একটি বিরাট সমস্যা। অনেক দেশের রিজার্ভ কমে যাচ্ছে, আমাদেরও। কোভিড-১৯ এর সময় ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি বন্ধ এবং মানুষের চলাচল সীমিত থাকায় এবং বৈধ চ্যানেলে প্রবাসী রেমিট্যান্স আসায় দেশের রিজার্ভ বেড়েছিল। কিন্তু সবকিছু চালুর পর আবার ব্যয় বেড়েছে।
“খরচ হবেই, কিন্তু আমাদের যদি আপৎকালীন সময়ের জন্য খাদ্য মজুতটা থাকে তাহলে রিজার্ভ নিয়ে খুব একটা চিন্তার কোনও ব্যাপার নেই। যথেষ্ট উৎপাদন হচ্ছে, উৎপাদনে কোনও অভাব নেই। বোরো ধানও ভালো হয়েছে, হাওড়ে ধান কাটা প্রায় শেষ। সেভাবেই আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, দেশটা যেন সচল থাকে এবং এগিয়ে যেতে পারে।”
দেশে বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে নানারকম খেলা চলে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “আলুর কোল্ড স্টোরেজে ডিম নিয়ে রাখা হচ্ছে। এরকম নানা ঘটনা বাংলাদেশে ঘটছে।”
এ সময় তিনি দেশের প্রতি ইঞ্চি অনাবাদী জমিকে চাষের আওতায় আনার মাধ্যমে সার্বিক উৎপাদন বাড়ানোর জন্য দেশবাসীর প্রতি তার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, “এভাবে করতে পারলে আমাদের দেশে খাবারের কোনও অভাব হবে না, আমরা বাইরেও পাঠাতে পারব।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের অর্জনগুলো ধরে রেখে আমাদের আরও সামনের দিকে এগোতে হবে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশটাকে গড়ে তুলত হবে।”
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন এবং গণহত্যার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, তিনি যে ফোরামেই যাচ্ছেন এর প্রতিবাদ করছেন এবং যুদ্ধ বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন।
“আমাদের স্ট্যান্ডার্ডটা ঠিক থাকবে সবসময়। আমরা চাই না যে এ ধরনের ঘটনা ঘটুক। আমরা সবসময় সাধারণ ও নির্যাতিত মানুষের পাশে আছি। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ‘সকলের সঙ্গে বন্ধত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’– এটা ধরে রেখেছি যার কোনও ব্যত্যয় ঘটছে না,” বলেন তিনি।
এ সময় তিনি সম্প্রতি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুতে বাংলাদেশে শোক দিবস পালনের এবং মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী ১০ লাখেরও অধিক রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেন। বাসস।