পুঁজিবাজারের উন্নয়নে নিয়ন্ত্রক সংস্থার একগুচ্ছ উদ্যোগ নেওয়ার ঘোষণা এবং পতনের কারণ খুঁজতে কমিটি নামায় এই বাজারে দুই দিন ধরে চাঙ্গাভাব দেখা যাচ্ছে।
মঙ্গলবারের পর বুধবারও মূল্যসূচকের উল্লম্ফন দেখেছে দুই বাজার। লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে; বেড়েছে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারদরও।
অব্যাহত দরপতনে দেশের প্রধান বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে এসেছিল, যা ছিল চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
সেই ধারাবাহিকতায় চলতি সপ্তাহের প্রথম দুই দিন রবিবার ও সোমবারও বড় পতন হয় বাজারে। রবিবার ডিএসইএক্স প্রায় ১৫০ পয়েন্ট পড়েছিল। সোমবার ৬৭ পয়েন্ট কমে ৪ হাজার ৮৯৮ দশমিক ৫২ পয়েন্টে নেমে এসেছিল।
তৃতীয় কার্যদিবস মঙ্গলবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১১৮ দশমিক ৮০ পয়েন্ট বেড়ে ৫ হাজার পয়েন্টের উপরে ৫ হাজার ১৭ দশমিক ৩২ পয়েন্টে অবস্থান করে।
চতুর্থ দিন বুধবার আরও বড় লাফ দিয়েছে এই সূচক; বেড়েছে প্রায় ১৫০ পয়েন্ট। সূচক উঠেছে ৫ হাজার ১৬৫ পয়েন্টে। শতাংশ হিসাবে বেড়েছে প্রায় ৩ শতাংশ।
অপর বাজার চট্টগ্রাম স্টক একচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ৩৩০ দশমিক ২৭ পয়েন্ট বেড়ে ১৪ হাজার ৩৪৭ দশমিক ৭৭ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। শতাংশ হিসাবে বেড়েছে প্রায় আড়াই শতাংশ।
পুঁজিবাজারের উন্নয়নে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) একগুচ্ছ উদ্যোগ নেবে—চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের এই ঘোষণায় বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে জানিয়েছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর) এক সংবাদ সম্মেলনে খন্দকার রাশেদ মাকসুদ বলেন, “পুঁজিবাজারের উন্নয়নে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি নীতি সহায়তা দিতে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ব্যক্তিশ্রেণির সাধারণ বিনিয়োগকারী, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, উচ্চ সম্পদশালী বিনিয়োগ ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এসব সহায়তার আওতাভুক্ত হবেন।
“অর্থ উপদেষ্টা দেশে ফিরেছেন। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সমন্বিতভাবে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে নীতি সহায়তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যার মধ্যে কিছু থাকবে স্বল্প মেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য, আর কিছু বিষয় মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে।”
তিনি বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু কারণে পুঁজিবাজারে বড় দরপতন হয়েছে। এ অবস্থায় বাজারের উন্নয়নে তিনটি বিষয় মাথায় রেখে সরকারের সঙ্গে আলোচনা হবে। এগুলো হলো- বিনিয়োগকারীর সুবিধা, বাজার মধ্যস্থতাকারীদের সমস্যার সমাধান ও বাজারের গভীরতা বৃদ্ধি।
“বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে আগ্রহ বাড়াতে কর সুবিধা দেওয়া এবং ভালো কোম্পানিকে তালিকাভুক্তিতে আগ্রহী করতে কর প্রণোদনা বৃদ্ধি করা দরকার।”
অন্যদিকে গত রবিবার বড় দরপতনের পর পুঁজিবাজারে টানা দরপতনের কারণ অনুসন্ধানে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। তদন্ত কমিটি সোমবার (২৮ অক্টোবর) থেকে কাজ শুরু করেছে।
এই কমিটি গঠনও বাজার ঘুরে দাঁড়াতে ভূমিকা রেখেছে বলে জানান বিশ্লেষকরা।
বাজার বিশ্লেষক ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভী স্টক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাকিল রিজভী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “পতনের পর পতনে বাজারে আতঙ্ক বিরাজ করছিল। দুই দিনের বড় উত্থানে সেই আতঙ্ক কিছুটা কমেছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।”
“আর এই আস্থা ফেরাতে মঙ্গলবার আমরা ডিএসইর পক্ষ থেকে কিছু সুপারিশ করেছি। এগুলো বাস্তবায়ন হলে বাজার ভালোর দিকে যাবে।”
ডিএসইর বর্তমান পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, “পুঁজিবাজারকে দক্ষ, স্বচ্ছ ও অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বর্তমানে একটি দুর্লভ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এর জন্য দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত পরিবর্তন, অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত ও বিচারের সাথে সাথে বিনিয়োগকারী এবং মধ্যস্থতাকারীদের আস্থা অর্জনে বাজার সংশ্লিষ্ট সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
“আর এজন্য ডিএসই কিছু কাজ স্বল্পমেয়াদী করছে। যেখানে প্রধান চ্যালেঞ্জ শেয়ারবাজারের প্রতি আস্থা পুনরুদ্ধার করা। সেটির কয়েকটি ধাপ রয়েছে। একটি হলো—নীতিগত সহায়তা বৃদ্ধি করা, এজন্য আমরা এনবিআর-এর সাথে যোগাযোগ করে শেয়ারবাজারের স্বার্থে ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স, ডিভিডেন্ড ট্যাক্স, টার্নওভার ট্যাক্স হ্রাসসহ প্রাসঙ্গিক সমস্যাগুলো দূর করার চেষ্টা করছি।”
“আরেকটি হলো তারল্য সাপোর্ট। এজন্য আমাদের দেশীয় উৎসের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। ব্যাংক খাতের মত শেয়ারবাজারের জন্য সরকারের সহযোগিতা অত্যন্ত প্রয়োজন। বাজার মধ্যস্থতাকারীরা যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে একসাথে একটি প্লাটফর্ম হিসেবে যেতে পারি, তবে আমাদের পলিসিগত সুবিধা পাওয়া সহজ হবে,” বলেন শাকিল।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পুঁজিবাজারে ব্যাপক উত্থান শুরু হয়। মূল্যসূচকের পাশাপাশি লেনদেনও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। টানা চার কর্মদিবসে (৬, ৭, ৮ ও ১১ আগস্ট) প্রধান বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স প্রায় ৮০০ পয়েন্টের মতো বেড়েছিল।
১১ আগস্ট ডিএসইএক্স ৯১ পয়েন্টের বেশি বেড়ে ৬ হাজার পয়েন্ট ছাড়িয়ে ৬ হাজার ১৫ দশমিক ৯০ পয়েন্টে অবস্থান করছিল। লেনদেন ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
তবে ১২ ও ১৩ আগস্ট বাজার হোঁচট খায়; এই দুই দিনে ডিএসইএক্স প্রায় ১৫০ পয়েন্টের মতো পড়ে যায়; সূচক নেমে আসে ৫ হাজার ৮৬৭ দশমিক ৯৬ পয়েন্টে। লেনদেন নেমে আসে হাজার কোটি টাকায়।
এরই মধ্যে ১৩ আগস্ট অর্থনীতিবিদ পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজকে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
তার নিয়োগের খবরে ১৪ আগস্ট দুই বাজারেই সূচক বাড়ে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স বাড়ে ৮৪ দশমিক ৮১ পয়েন্ট। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক সূচক সিএএসপিআই বাড়ে ১৩২ দশমিক ৫৫ পয়েন্ট।
মাসরুর রিয়াজের নিয়োগের পরপরই বিতর্ক ওঠার প্রেক্ষাপটে তার নিয়োগ স্থগিত রাখে সরকার। এ খবরে ১৫ আগস্ট দুই বাজারেই সূচকের পতন দেখা যায়। ডিএসইএক্স ৪৮ দশমিক ৯৩ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৯০৩ দশমিক ৮৩ পয়েন্টে দাঁড়ায়।
এরই মধ্যে ১৬ আগস্ট পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানান মাসরুর রিয়াজ। পদত্যাগের কারণ জানিয়ে গণমাধ্যমে একটি বিবৃতিও দেন মাসরুর।
এমন পরিস্থিতিতে ১৮ আগস্ট দুই বাজারেই মূলসূচকের বড় পতন হয়েছে। ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১২৫ দশমিক ১৯ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৭৭৮ দশমিক ৬৩ পয়েন্টে নেমে আসে।
মাসরুর রিয়াজ রাজি না হওয়ায় ১৮ আগস্ট পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের জন্য খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে নিয়োগ দেয় সরকার।
কিন্তু পুঁজিবাজারে পতন থামেনি। দু-একদিন ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই সূচক পড়েছে দুই বাজারে। লেনদেনেও খরা নেমে আসে।
অনেক দিন পর মঙ্গল ও বুধবার—পরপর দুই দিন দুই বাজারেই উল্লম্ফন দেখা গেল।
বুধবারের বাজার পরিস্থিতি
মঙ্গলবার ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১৪৭ দশমিক ৫১ পয়েন্ট বেড়ে অবস্থান করছে ৫ হাজার ১৬৪ দশমিক ৮৩ পয়েন্টে। অন্য দুই সূচকের মধ্যে ডিএসই শরিয়া সূচক ২২ দশমিক ৫৫ পয়েন্ট বেড়ে ১ হাজার ১৩৬ দশমিক ২১ পয়েন্টে এবং ডিএস৩০ সূচক ৫৭ দশমিক ৫৮ পয়েন্ট বেড়ে ১ হাজার ৯১৫ দশমিক ৮৬ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
এদিন ডিএসইতে মোট ৩৯৭টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ৩৭৩টিরই দাম বেড়েছে। কমেছে মাত্র ১৫টির এবং অপরিবর্তিত ছিল ৯টির দর।
৫১৯ কোটি ৩১ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। মঙ্গলবার লেনদেনের অঙ্ক ছিল ৩৪৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
অপর বাজার চট্টগ্রাম স্টক একচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ৩৩০ দশমিক ২৭ পয়েন্ট বেড়ে ১৪ হাজার ৩৪৭ দশমিক ৭৭ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
অন্য সূচকগুলোর মধ্যে সিএসসিএক্স সূচক আগের দিনের চেয়ে ১৯৭ দশমিক ১১ পয়েন্ট বেড়ে অবস্থান করছে ৮ হাজার ৭২৫ পয়েন্টে। শরিয়া সূচক ১৬ দশমিক ৯০ পয়েন্ট বেড়ে ৯২০ পয়েন্টে এবং সিএসই ৩০ সূচক ৩৩৮ দশমিক ৫১ পয়েন্ট বেড়ে ১২ হাজার ৩০ পয়েন্টে অবস্থান করছে।
বুধবার সিএসইতে ২১৭ কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দাম বেড়েছে ১৭৯টির। কমেছে ২৮টির এবং অপরিবর্তিত আছে ১০টির।
৬ কোটি ৯০ লাখ টাকার শেয়ার হয়েছে। মঙ্গলবার লেনদেনের অঙ্ক ছিল ১০ কোটি ৮ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট।