এটি শুধু একটি কলা না। মূলত এটি কলার গল্প।
নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটন শহরে নিলামকারী প্রতিষ্ঠান সোথবির নিলামে গত বুধবার সন্ধ্যায় একটি বিশেষ দৃশ্য চোখে পড়ে। সেখানে নিলামকারী সতর্ক করে বলেন, “মরিজিও ক্যাত্তেলানের এই ফলের শিল্পকর্ম যেন হাতছাড়া না হয়।”
হাতছাড়া হয়নি শিল্পকর্মটি। শেষ পর্যন্ত টেপ দিয়ে আটকানো ‘কমেডিয়ান’ নামের কলাটি নিলামে বিক্রি হয় অবিশ্বাস্য ৬ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলারে।
চীনা বংশোদ্ভূত আমেরিকান ক্রিপ্টো উদ্যোক্তা জাস্টিন সান ওই শিল্পকর্মটি কিনে নেন। তিনি মরিজিও ক্যাত্তেলানের ২০১৯ সালের সিরিজ শিল্পকর্ম “কমেডিয়ানকে” নিজের সংগ্রহশালায় যোগ করেন। গত কয়েক বছরে তিনি একটি জিয়াকোমেট্টি ভাস্কর্য, পিকাসোর একটি চিত্রকর্ম ও একটি মূল্যবান পেট রকের এনএফটিসহ বিভিন্ন শিল্পকর্ম সংগ্রহ করেছেন।
নিলামে ‘কমেডিয়ান’ বিক্রির পরই মূলত আলোচনার শুরু। মজার বিষয় শিল্পকর্মটি ক্রয় সংক্রান্ত চুক্তি হবে আগামী এক মাসের মধ্যে। আর ততদিনে কলাটি যাবে পচে।
এক সাক্ষাৎকারে জাস্টিন সান জানান, তিনি নিজের তৈরি ক্রিপ্টোকারেন্সি দিয়ে শিল্পকর্মটির মূল্য চুকাবেন। তবে সোথবি হয়ত শুধু বিটকয়েন বা ইথেরিয়ামের মতো ডিজিটাল পেমেন্টের মাধ্যমেই অর্থ নেবে।
এখন প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক, একজন ধুনকুবের পচনশীল একটি ফলের জন্য কেন মিলিয়ন ডলার খরচ করছেন?
জাস্টিনের বক্তব্য অনুসারে, তিনি বিশেষ শিল্প অভিজ্ঞতার অংশ হিসেবে কলাটি খেতে চান। তবে সম্ভবত তার এই চাওয়া পূরণ হবে না। সোথবির নিলামের সেই কলা রেফ্রিজারেটরে রাখলেও, সেটি হংকংয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে টিকে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম।
আসলে টেপ দিয়ে আটকানো কলাটি কেবল একটি ধারণা মাত্র। এটি মরিজিও ক্যাত্তেলান ২০১৯ সালে আর্ট বাসেল মিয়ামি বিচের জন্য তৈরি করেছিলেন। তখন এটি প্রায় দেড় লাখ ডলারে বিক্রি হয়েছিল। ক্যাত্তেলান তার ‘কমেডিয়ান’ শিল্পকর্মের তিনটি সংস্করণ করেছিলেন।
অর্থ পরিশোধের পর জাস্টিনকে সোথবি ১৪ পৃষ্ঠার একটি নির্দেশিকা দেবে। এর মধ্যে ছবিসহ কিছু নির্দেশনা থাকবে। ক্যাত্তেলান তার ‘কমেডিয়ান’ শিল্পকর্ম যাদের কাছেই বিক্রি করেছেন, তাদের প্রত্যেককে এমন নির্দেশনা দিয়েছেন। এদের মধ্যে সলোমান আর গুগেনহেইম জাদুঘরও রয়েছে। কয়েক বছর আগে জাদুঘরটি অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তির কাছ থেকে কমেডিয়ানের একটি সংস্করণ পায়।
কলাটি কীভাবে স্থাপন ও প্রদর্শন করতে হবে, পচে গেলে সেটি পরিবর্তন করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে নির্দেশিকায়। গুগেনহেইম জাদুঘরের প্রধান রক্ষণাবেক্ষণ কর্মকর্তা লেনা স্ট্রিঙ্গারি তখন বলেছিলেন, নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করা সহজ ছিল।
নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, কলাটি ৭ থেকে ১০ দিন পরপর পরিবর্তন করতে হবে। আর এটি মাটি থেকে প্রায় ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি উচ্চতায় রাখতে হবে। আর প্রতিবারই নতুন টেপ দিয়ে আটকাতে হবে।
ক্যাত্তেলান ইতোমধ্যেই কলাটি সোথবির কাছে বিক্রি করে টাকা পেয়েছেন। কি পরিমাণ টাকা তিনি পেয়েছেন, তা জানা যায়নি। এরপরই সোথবি কলাটি নিলামে তোলে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও ইতালির মতো দেশে শিল্পীরা পুনঃবিক্রয়ের ক্ষেত্রে একটি কমিশন পান। তবে যুক্তরাষ্ট্রে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। সেখানে কোম্পানিগুলোর এ ধরনের কোনও দায়িত্ব থাকে না।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিল্পীরা তাদের শিল্পকর্ম বিক্রয় সংক্রান্ত চুক্তিতে পুনঃবিক্রয়ের রয়্যালিটি যুক্ত করতে ব্লকচেইন সরঞ্জাম, যেমন এনএফটি বা নন-ফাঞ্জিবল টোকেন ব্যবহার করছে। এনএফটি বাজার অন্য অনেক প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করলেও সোথবি এখনও সেখানে আছে।
এনিয়ে ক্যাত্তেলান বলেন, “নিলামকারী প্রতিষ্ঠান ও সংগ্রাহকেরা মুনাফা করছে। অথচ যিনি শিল্পকর্ম তৈরি করে বাজারের চালিকা শক্তি দিচ্ছেন, তিনি বাইরে থাকছেন। এনএফটিগুলো প্রতিটি পুনঃবিক্রয়ের রয়্যালিটি দেয়। এটি খুবই অদ্ভুত যে, প্রচলিত শিল্প বাজারগুলো এখনও এমন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।”
জাস্টিনের মতে, “এটি কেবল একটি শিল্পকর্ম নয়। এটি একটি সাংস্কৃতিক ঘটনা, যা শিল্প, মিম ও ক্রিপ্টোকারেন্সি কমিউনিটির মধ্যে সেতু তৈরি করে। আমি বিশ্বাস করি, এই কাজটি ভবিষ্যতে আরও চিন্তা ও আলোচনার জন্ম দেবে এবং ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠবে।”
তবে সাধারণত শিল্প (আর্ট) বাজারে অংশগ্রহণ ধনীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক প্রভাব, আত্মতৃপ্তির অনুভূতি দেয়। বিভিন্ন শিল্পের সংগ্রহকারীরা প্রায়ই জাদুঘর ও প্রভাবশালী অলাভজনক গ্রুপগুলোর বোর্ডে জায়গা পায়। সেখানে তারা অন্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নেটওয়ার্কিং করতে পারে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রিপ্টোকারেন্সি ও অন্যান্য শিল্পক্ষেত্রের নব্য ধনীরা নিজেদের ও তাদের ব্যবসার প্রচারের জন্য শিল্পকর্ম কিনছেন। এমনকি যারা নিলামে জয়ী হননি, তারাও অনেক সময় প্রচারের জন্য নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করছেন।
‘কমেডিয়ান’ বিক্রির পরদিন সকালে দুই ক্রিপ্টো উদ্যোক্তা রায়ান জুরার ও কোজোমো ডি’মেডিচি তাদের মুখপাত্রের মাধ্যমে জানান, তারা জাস্টিনের কাছে শিল্পকর্মটি হারানোর পর পাঁচটি অন্য বিডার গ্রুপের সঙ্গে নিলামে অংশ নিয়েছিলেন।
যতদুর জানা গেছে, ক্যাত্তেলান কলাটি কেনেন ম্যানহাটনের আপার ওয়েস্ট সাইডে বাংলাদেশি এক ফল বিক্রেতার কাছ থেকে মাত্র ২৫ সেন্টের বিনিময়ে। বাংলাদেশি মুদ্রায় দাম হয় ৪২ টাকা। আপার ইস্ট সাইডে ওই একই কলার দাম ৩৫ সেন্ট।
বুধবার সন্ধ্যায় ওই বাংলাদেশি ফল বিক্রেতা জানান, তিনি জানতেন না যে, কয়েক হাতের দূরত্বে তার ডোল ব্র্যান্ডের কলাটি শিল্পকর্ম হয়ে ৬ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার মূল্যে দাঁড়াবে।
এক রাতেই কলটির দাম ১৮ মিলিয়ন গুণ বেড়ে গিয়েছিল।
৩৪ বছর বয়সী জাস্টিন সান হলেন ট্রন নামের একটি ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রতিষ্ঠাতা। গত বছর তাকে যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন অপর্যাপ্তভাবে নিবন্ধিত ক্রিপ্টো বিক্রির জন্য অভিযুক্ত করে। কমিশন জাস্টিনের ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রচারে আইনবহির্ভূতভাবে সহায়তার জন্য আটজন সেলিব্রিটিকে অভিযুক্ত করে। এদের মধ্যে অভিনেত্রী লিন্ডসে লোহানও ছিলেন।
জাস্টিন সান এই অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি আদালতে দাবি করেন, কমিশন ভুলভাবে তার বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করেছে।
চীনে জন্ম নেওয়া জাস্টিন একসময় গ্রেনাডার বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দূত ছিলেন। তিনি এখনও ট্রনের ওয়েবসাইটে ‘হিজ এক্সেলেন্সি’ উপাধি ব্যবহার করেন। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, পেনসিলভেনিয়া ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়ার পরই তিনি ক্রিপ্টো ব্যবসায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
বর্তমানে তিনি শিল্প পরামর্শক সিডনি ঝিয়ংয়ের সঙ্গে কাজ করছেন। ঝিয়ং ২০২১ সালে জাস্টিনকে ক্রিস্টির নিলামে ২০ মিলিয়ন ডলারের একটি পিকাসো চিত্রকর্ম ও সেই বছরই সোথবিতে ৭৮ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলারের একটি জিয়াকোমেট্টি ভাস্কর্য কিনতে সহায়তা করেন।
এছাড়া এই পরামর্শক ও উদ্যোক্তা একসঙ্গে এপিইএনএফটি নামে একটি ফাউন্ডেশনে কাজ করছেন। এটি ঐতিহ্যবাহী ও ডিজিটাল শিল্প জগতের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করতে কাজ করা শিল্পীদের আর্থিক সহায়তা দেয়।
শিল্পের সংজ্ঞা নির্ধারণে শতাব্দী ধরেই চলছে আলাপ আলোচনা। অনেকে বলছেন, এসব আলোচনার সূত্র ধরেই ক্যাত্তেলান কলা দিয়ে শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেন। একে ফরাসি শিল্পী মার্সেল দুশ্যাম্পের কাজ থেকে অনুপ্রাণিত বলেও মনে করেন অনেকে।
১৯১৭ সালে দুশ্যাম্প একটি ইউরিনাল উল্টে রেখে, এর ওপর ‘আর. মাট’ নাম লেখেন। এটি ছিল একটি কাল্পনিক নাম। তিনি ইউরিনালটিকে একটি শিল্পকর্ম হিসেবে দাবি করেন। আর এর নাম দেন ‘ফাউন্টেন’। দুশ্যাম্প আরও কিছু সাধারণ পণ্য যেমন মই, শাবল ও কোট হ্যাঙ্গারকে ‘রেডি-মেইডস’ শিল্পকর্ম হিসেবে ঘোষণা দেন।
ক্যাত্তেলান কলার মাধ্যমে সাধারণ ফলকেও শিল্পকর্ম হিসেবে স্বীকৃতির ক্ষেত্রে জনমত ও উচ্চস্তরের প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন। তবে তিনি আরেকটি বিষয়েও আলোকপাত করেন। সেটি হলো, যেকোনো কিছু, এমনকি একটি সাধারণ ফলও শিল্পকর্ম হিসেবে বাজারজাত ও ব্র্যান্ড করা যায়।
তথ্যসূত্র : নিউ ইয়র্ক টাইমস