এ বছরের শেষ নাগাদ বিশ্বে মিউজিক স্ট্রিমিং প্লাটফর্মগুলোর ব্যবসা দাঁড়াবে সাড়ে ২৯ হাজার কোটি ডলারের কাছাকাছি। প্রতিবছর প্রায় পৌনে ৫ শতাংশ হারে এই ইন্ডাস্ট্রির বাজার বাড়ছে। সেই হিসেবে ২০২৭ সাল নাগাদ এ ইন্ডাস্ট্রির বাজার দাঁড়াবে প্রায় ৩৪ হাজার কোটি ডলার।
নতুন বছরে অনলাইনভিত্তিক ডেটা সেবাদানকারী স্ট্যাটিস্টা এসব তথ্য জানাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি আরও জানায়, বাংলাদেশে ২০২৪ সালে মিউজিক স্ট্রিমিং ইন্ডাস্ট্রির বাজার দাঁড়াবে প্রায় ৫০০ কোটি টাকায়। আরও বড় বিষয় হলো, ২০২৪ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক বাজারের চেয়ে বাংলাদেশের বাজার বাড়বে ৮ শতাংশেরও বেশি হারে। অর্থাৎ বাংলাদেশের বাজার বাড়বে সাড়ে ১২ শতাংশ হারে।
স্ট্যাটিস্টা বলছে, ২০২৭ সাল নাগাদ বাংলাদেশে মিউজিক স্ট্রিমিং এর ব্যবহারকারী দাঁড়াবে ৯০ লাখে।
আরও মজার ব্যাপার হলো, আগামী ৩ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশে যে ৫ শতাংশ হারে ব্যবসা বাড়ার পূর্বাভাস দিয়েছে স্ট্যাটিস্টা তার বেশিরভাগই দেশিয় সংস্কৃতি বা মিউজিকের ক্ষেত্রে বাড়বে।
পরিসংখ্যান বলছে, স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো নতুন গান শোনা, শেয়ার এবং ডাউনলোডের জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে উঠছে। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে অনেক লাইভ শো, ট্যুর এবং কনসার্ট যখন বাতিল হয়ে যায়, তখন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির জন্য লাইফ সাপোর্ট হিসেবে কাজ করে। লকডাউনের সেই বন্দি সময়ে মিউজিক স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম সংগীতশিল্পীদের অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকতেও সহায়তা করেছিল।
তবে অনেক শিল্পীর মতে, স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোর খুব কম অর্থ দেয়। তারপরও এ-কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, যে মহামারী ছড়িয়ে পড়ার পরের সময়ে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির চরিত্রে নিয়ে আসে এক বিশেষ পরিবর্তন। যেকোনও সময়ের তুলনায় সংগীতের যেকোনও জনরাকে আরও ট্রেন্ডি করে তুলছে এই মাধ্যম। একই সঙ্গে করে তুলছে সাশ্রয়ী।
কিন্তু প্রশ্নটি হলো, সমগ্র মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিকে এই স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম কিভাবে প্রভাবিত করছে?
গান: আরও কাস্টমাইজড হয়ে উঠছে
সংগীতশিল্পীরা স্বভাবতই তাদের ভক্তদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকে। আবার মিউজিক স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোও শিল্পীর ধরন, জনরা এবং অপরাপর বৈচিত্র্য অনুযায়ী শ্রোতাদের গান নির্বাচন করার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেয়। ফলে, শ্রোতারা কোনরকম শর্ত ছাড়াই, তারা যা শুনতে চায় তা-ই শুনতে পারে। এমনকি শ্রোতারা এখানে তাদের মর্জি মাফিক কাস্টমাইজড প্লেলিস্ট তৈরি করতে পারে, ভিন্ন ভিন্ন প্লেলিস্ট খুঁজে বের করতে পারে এবং অন্যদের সাথে প্লেলিস্ট শেয়ার করতে পারে। পছন্দমতো তারা এমন এমন ট্র্যাক দিয়ে প্লেলিস্ট বানাতে পারে যেগুলো আবার গাড়ি চালানোর বা ব্যায়াম করার সময় শোনার উপযোগী। পাশাপাশি ভিন্ন ভিন্ন কাজের সাথে মানিয়ে যায়। এমন গান পছন্দ মতো বাজিয়ে শোনার সুযোগ-ও এতে আছে।
অন্যদিকে সংগীত শিল্পীরাও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে তাদের অ্যালবাম রিলিজ করে শ্রোতার নানা ধরনের চাহিদার ব্যাপারে ধারণা পেতে পারে।
গানের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ছোট
স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের গানগুলোর কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হলো গানের দৈর্ঘ্য ক্রমশ ছোট হয়ে আসা। এইসব প্ল্যাটফর্মে গান রিলিজ করে শিল্পীরা যেহেতু একটা গোটা অ্যালবাম কিংবা কনসার্টের টিকেট এর দামের চেয়েও কম মূল্য পান, সেহেতু তারা সচেতনভাবেই ছোট দৈর্ঘ্যের গান প্রকাশ করেন। একটা সময় ছিল যখন বড় গানের দৈর্ঘ্য ছিল গড়ে চার মিনিট করে। কিন্তু স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে, বিশেষত নতুন প্রকাশিত গানগুলোর দিকে যদি তাকাই তবে দেখবো, গানের গড় দৈর্ঘ্য বর্তমানে মাত্র আড়াই থেকে তিন মিনিটে এসে দাঁড়িয়েছে।
সংগীত শিল্পীরাও কম্পোজিশনের খুব বেশি তেলেসমাতি না দেখিয়ে তাদের ট্র্যাকগুলোকে আরও সরল করে তোলার ক্ষেত্রে দক্ষ হয়ে উঠেছেন। পাশাপাশি পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে সংগীতশিল্পীরা জেনে যাচ্ছেন তাদের শ্রোতারা আদতে কী শুনতে চায়। ফলে গানের “অতিরিক্ত” মেদ বাদ দিয়ে, শ্রোতার রুচি মাথায় রেখে শিল্পীরা সৃষ্টি করছেন আপাত “ছিপ ছিপে” সব ট্র্যাক।
মিউজিক কোলাবরেশন: এক নতুন মাত্রা
স্ট্রিমিং প্লাটফর্মে গান রিলিজ দেওয়া খুব স্বাধীন এবং সহজসাধ্য বিষয় হওয়ায় সংগীত আরও বেশি প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠেছে। ফলে, প্রতিযোগীতা এবং একই সাথে ট্রেন্ডে এগিয়ে থাকার জন্য শিল্পীরা অতীতের তুলনায় আরও নিয়মিতভাবে নতুন গান রিলিজ করার প্রয়োজন অনুভব করছেন।
এই সময়ের একটি সাধারণ প্রবণতা হলো শিল্পীদের কোলাবোরেশন। সংগীত শিল্পীরা নতুন শ্রোতাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য ভিন্ন ভিন্ন শিল্পী এবং কম্পোজারদের সঙ্গে মিলে গান প্রকাশ করছেন, যা সংগীতকে করে তুলছে আরও বৈচিত্র্যময়। উপরন্তু, এইসব কোলাবোরেশনের মধ্য দিয়ে শিল্পীদের ভেতর সহযোগিতামূলক মনোভাব ও তাদের নিজস্ব নেটয়ার্ক গড়ে উঠছে।
আরও আরও সুযোগ
স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো শিল্পীদের যেমন আপ টু ডেট থাকতে সাহায্য করছে, তেমনি তাদের ভিন্ন ভিন্ন আয়ের দুয়ার খুলে দিয়ে সামগ্রিকভাবে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিকে আরও ব্যবসায় সফল করে তুলতে সহায়তা করছে। উদাহরণস্বরূপ, সংগীতশিল্পীদের মধ্যে যারা লেসন দেন তারা সাম্প্রতিক ট্রেন্ড, জনরা ইত্যাদির সাথে আপ টু ডেট থাকার পাশাপাশি আসন্ন ইভেন্ট সম্পর্কে অবগত থাকছেন। যা তাদের পেশাগত কাজে সহায়তা করছে।
সিমোনা পি. একজন অনলাইন মিউজিক টিচার। যিনি নিউয়র্ক শহরের আশেপাশেই পিয়ানো শেখান। তিনি বলছেন – মিউজিক স্ট্রিমিং তাকে অন্যান্য সংগীতশিল্পীদের সাথে যোগাযোগের সুযোগ করে দিয়েছে। এর মাধ্যমে সেইসব শিল্পীদের সাথে তার যোগাযোগের সুযোগ ঘটছে যাদের সঙ্গে আগ্রহের জায়গায় তিনি ঐক্য বোধ করেন। অন্যদিকে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে তিনি তার পিয়ানো ক্লাস, ওয়ার্কশপ ইত্যাদি বিষয়ে নিজের আইডিয়া ঝালিয়ে নিতে পারেন যা তাকে যেমন বিকশিত করছে তেমনি তার আয়ের পথ সৃষ্টিতেও সহায়তা করছে।
সংগীত হয়ে উঠছে বৈচিত্র্যময়
ইন্টারনেট গান শোনার প্রধান উৎস হয়ে উঠার আগ পর্যন্ত শিল্পীরা মূলত রেকর্ডিং লেবেল এর উপর নির্ভর করে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাতেন। কিন্তু বর্তমানে মিউজিক স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম থাকায়, নানান জনরা এবং বৈচিত্রের সাথে শিল্পীদের মিথষ্ক্রিয়া ঘটে। ফলে শিল্পীরা হয়ে উঠছেন পূর্বের যে কোন সময়ের তুলনায় বহুমুখী, এবং একাধিক ঘরানা এবং শৈলীর সমন্বয়ে সংগীতকে করে তুলছেন বৈচিত্রময়।
উদাহরণস্বরূপ শিল্পী লিল নাস এক্স-এর ‘ওল্ড টাউন রোড’ গানটির কথা বলা যায়। ২০১৯ সালে গানটি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড সুপার ডুপার হিট হয়। গানটির বৈশিষ্ট্য হলো, এই গানটি শুধুমাত্র একটি মিউজিক্যাল ট্র্যাকেই কান্ট্রি মিউজিক, হিপ হপ এবং আরএন্ডবির দারুণ সম্মিলন ঘটিয়েছে। যা কিনা ভিন্ন ভিন্ন জনরার সকল শ্রোতাদের কাছেই আবেদন তৈরি করতে পেরেছে। আমরা অনুমান করতে পারি যে, ভবিষ্যতে একাধিক জনরার সমন্বয় ঘটানো গানগুলোই শিল্পীদের সাধারণ চর্চার জায়গা হয়ে উঠবে।
কমে আসছে পাইরেসি
মিউজিক স্ট্রিমিংয়ের একটি চমৎকার সুবিধা হল এটা পাইরেসি কমাতে সাহায্য করছে। বিশেষত, ২১ শতকের শুরুতে ন্যাপস্টার সফটওয়্যারের উত্থান ঘটলে এটা সংগীতশিল্পীদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। ন্যাপ্সটার এর কারণে শ্রোতারা অ্যালবাম বা রেকর্ড কেনার পরিমাণ আশংকাজনক হারে কমিয়ে দেয় ফলে শিল্পীরা হারায় বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থ।
কিন্তু মিউজিক স্ট্রিমিং এর কারণে পাইরেসির হার যথেষ্ট কমে গেছে। স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো কিছু নির্দিষ্ট মাত্রায় তাদের পরিষেবা বিনামূল্যে ব্যবহার করতে দিলেও, বিনামূল্যে পুরো ফিচার ব্যবহারের অনুমতি দিচ্ছেনা। প্ল্যাটফর্মগুলোর পরিষেবা পুরোটা ব্যবহার করতে হলে শ্রোতাদের অর্থ গুনতে হচ্ছে। আর এই সংস্কৃতি চালু হবার ফলে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি আবারও তার স্বাভাবিক বিকাশের পথে এগুচ্ছে।
কোনদিকে যাবে মিউজিক স্ট্রিমিং?
মিউজিক স্ট্রিমিং এর মাধ্যমে শ্রোতারা নতুন সংগীত শিল্পী আবিষ্কার করতে পারছেন সহজেই। শিল্পীরাও পাচ্ছেন এক্সপোজার। অথচ অতীতে কোন লেবেলের সাথে চুক্তিবদ্ধ না হলে শিল্পীরা এক্সপোজার পেতেন না।
এখন প্রশ্ন হলো, কোনদিকে যাচ্ছে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি? এ- কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, মিউজিক স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের ব্যাপ্তি সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পেতে থাকবে। একই সাথে শ্রোতাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং নতুন শিল্পী আবিষ্কারের অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে দু’পক্ষকেই করবে উপকৃত। যদিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের আর্থিক দিকটি আজও বেশ বিতর্কিত।
অনুমান করা যায়, স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের কথা মাথায় রেখে সংগীত শিল্পীরা, ক্রমশ আরও বেশি করে সংক্ষিপ্ত লিরিকে কাজ করবেন এবং শ্রোতা ধরে রাখতে গানের শুরুতেই কোরাস পার্ট নিয়ে আসবেন।
স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো রেকর্ডিং লেবেলের একচ্ছত্র আধিপত্যের যুগের অবসান ঘটিয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে একটি সমতাবস্থা নিয়ে এসেছে। যদিও প্ল্যাটফর্মগুলোর ডিস্ট্রিবিউশনের ধরন এমন যে, তাতে রয়্যালিটি বেশ কমই থাকে। তারপরও, বিশেষ করে নতুন শিল্পীদের নিজেকে তুলে ধরার ভালো জায়গা এই স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো। মোদ্দা কথা, মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি, শিল্পী এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের জন্যই এক আশির্বাদ মিউজিক স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম।
তথ্যসূত্র: স্ট্যাটিস্টা ও ‘মিডিয়াম’ প্রকাশিত মারিয়ানা তামেরার প্রবন্ধ