পেশাগত জীবন আমাদের ব্যক্তিগত সময়ের অনেকটাই দখল করে রাখে। ফলে জীবনের চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপারে অনেক সময় চিন্তার সুযোগই ঘটেনা। অনেক সময় নিজের দিকে ফিরে তাকাতে হয়। প্রশ্ন করতে হয়, যা করছি, তা ভালোবাসছি তো? নাকি কাজের স্ট্রেস সামলাতেই ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে জীবনের সমস্ত সম্ভাবনা।
আত্ম উপলব্ধি আত্ম-উন্নয়নের প্রথম ধাপ। কিন্তু সেই সুযোগই বা কয়জনের ঘটে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েই তো কত কত আব্দার রক্ষা করি আমরা। তা হোক পেশাগত কি ব্যক্তিগত, দুই পরিসরেই। অথচ নিজের জীবনের কোন বিষয়গুলো, নিজের জন্য সবচেয়ে জরুরি, তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র মালিক আমরা নিজেরাই।
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এবং লেখক ড. জুলি স্মিথ গার্ডিয়ানে লিখেছেন স্ট্রেস সামলানো, জীবনের সীমা নির্ধারণ এবং সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে। তার আলোকে জেনে নিই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়-
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কী?
একটি কাগজে নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ চাওয়াগুলো লিখে ফেলুন। যেমন স্বাস্থ্য, ক্যারিয়ারের অগ্রগতি, পিতামাতার সান্নিধ্য, ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, সামাজিক জীবন। এবার প্রতিটির জন্য আলাদা আলাদা ছক করে প্রতিটি ঘরে লিখে রাখুন আপনার অগ্রগতি।
কোন বিষয়টিকে কতটা গুরুত্ব দিতে পারছেন তা রেট করুন ১০ এর মধ্যে। প্রতিটির জন্য কতটা সময় বের করতে পারছেন, তার ওপর ভিত্তি করে সাজান নিজের জীবন যাপন। রেটিং দেখে বুঝে নিন কোন বিষয়টি কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে, বা আদৌ গুরুত্ব পাচ্ছে কিনা আপনার কাছে। কোন একটা লক্ষ্য থেকে দূরে সরে গেলে, মনোযোগ দিন ওই বিষয়টির ওপর। আর এই প্রক্রিয়ায় জীবনের লক্ষ্য অর্জনে ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব বলে মনে করেন অনেক মনোবিদ। তবে জীবনের ভারসাম্য কোন নিখুঁত ব্যাপার নয়। তাই নিখুত হবার চাপ মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে।
স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট
মানুষ স্ট্রেসকে ব্যক্তিগত দুর্বলতা হিসেবে দেখে। কিন্তু আসলে কি তাই?
স্ট্রেস আসলে কেবলই একটি তথ্য। এর মানে হলো, আপনার শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা কেমন, সে ব্যাপারে আপনার মস্তিষ্ক আপনাকে সচেতন করতে চাইছে। হতে পারে, অফিসে আপনার ডেস্কে একজন কর্মী অনুপস্থিত। ফলে বাড়তি কাজ বাড়ি গিয়ে করতে হচ্ছে। যদি আমরা স্ট্রেসকে আমাদের শারিরীক এবং মানসিক অবস্থার তথ্য হিসেবে বিবেচনা করতে পারি, এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারি, তবেই নিজের যথাযথ মূল্যায়ন সম্ভব হবে।
স্ট্রেসকে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মতো ভাবুন।] ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে বারবার টাকা তুলে যদি কোন জমাই রাখা না হয়, তবে শিগগিরই আপনি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়বেন।
আমাদের শরীর স্ট্রেস মোকাবিলা করার জন্য তৈরি, তবে শর্ত হলো, বিনিময়ে তাকে কিছু দিতে হয়। স্ট্রেসের বিপরীতে শরীর ও মন যদি পর্যাপ্ত বিশ্রাম না পায়, তবে মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হতে থাকে। আর এ সময় কর্মক্ষেত্রে নিজের সেরাটা দেওয়া যায়না। ফলে আপনার পাশাপাশি, কাজের সঙ্গে যুক্ত অন্যরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
শরীর যখন ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে যায়, তখন দরকার কাজ থেকে ছুটি। কিছুদিনের বিরতি শরীর ও মনকে, কর্মক্ষেত্রে সেরাটা দেওয়ার জন্য তৈরি করতে পারে।
যখন ‘না’ বলতে হবে তখন কী ‘হ্যাঁ’ বলছেন?
নিজের হয়ে কথা বলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। চাপে পড়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে আমরা ‘হ্যাঁ’ বলে ফেলি। কর্ম এবং ব্যক্তিজীবন, উভয় ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটে। কিন্তু কর্মক্ষেত্র ও ব্যক্তিজীবন, এই দুই ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখতে হলে, সময় মতো ‘না’ বলা শিখতে হবে। নাহলে, ব্যক্তিগত ও পেশাগত সম্পর্কে সীমারেখা টানা কঠিন হয়ে পড়বে।
সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, কেউ কোন কাজ করার অনুরোধ করলে দ্রুত সিদ্ধান্তে না যাওয়া। এ ক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতিটি হলো, ‘আমি আপনাকে পরে জানাচ্ছি’ অথবা ‘আমাকে একটু ভাবার সময় দিন’ জাতীয় উত্তর দেওয়া। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমরা অন্যের হতাশা কিংবা রাগ অভিমানের কথাটি অতি বিবেচনায় নিয়ে ফেলি। অথচ, সময় মতো ‘না’ বলার অভ্যাস রপ্ত হলে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ যেমন বাড়ে, আত্মবিশ্বাসও বাড়ে। আর কমানো যায় স্ট্রেস। তবে কেন কাজটি করতে পারছেন না তা গুছিয়ে বলতে পারাটাও ভারসাম্য ধরে রাখে।
নিজের যা আছে তার যথাযথ ব্যবহার
মানুষ হিসেবে আমরা প্রত্যেকেই অমিত সম্ভাবনার। পৃথিবীতে টিকে থাকার আমাদের একমাত্র কারণ হলো, একে অপরকে সাহায্য করার প্রবণতা। তবে বর্তমান সমাজ ক্রমশ আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। আমাদের দিচ্ছে ‘একলা চলার’ পরামর্শ। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আমাদের যৌথতাই আমাদের ভবিষ্যৎ।
তাই যার যেটুকু আছে, তাই দিয়ে নিজের এবং অপরকে ভালো রাখার চেষ্টা আমাদের সামগ্রিকভাবে সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত করবে। ফলে, নিজের যে কোন বিষয়ের ন্যূনতম দক্ষতার ওপরও আস্থা হারালে চলবে না।