দেশের সরকারি গুদামগুলোয় বর্তমানে ২০ লাখ মেট্রিক টনের বেশি খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে। তারপরেও বাজারে বাড়ছে চালের দাম।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বন্যার কারণে চালের দাম বেড়েছে। তবে কৃষি অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্যার অজুহাতে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ‘সিন্ডিকেট’ তৈরি করে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এদের বিরুদ্ধে দ্রুত যথাযথ ব্যবস্থা নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) প্রতিদিনের খুচরা বাজার দর প্রকাশ করে। সে অনুযায়ী, শনিবার ঢাকার বাজারগুলোয় প্রতি কেজি মোটা চাল ৫২-৫৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মাঝারি মানের চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকায়। আর সরু চালের মধ্যে নাজিরশাইল ও মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৬৪-৮০ টাকায়।
এক মাস আগেও প্রতিকেজি মোটা চালের দাম ছিল ৫০-৫৪ টাকা। সেসময় মাঝারি মানের চাল বিক্রি হয়েছিল ৫৪-৫৮ টাকায় এবং সরু চালের কেজি ছিল ৬০-৭৮ টাকা।
অর্থাৎ টিসিবির হিসাবেই, এক মাসের ব্যবধানে সরু চালের দাম বেড়েছে ৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ। মাঝারি মানের চালের দাম বেড়েছে ২ দশমিক ৬৮ শতাংশ, মোটা চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৩ শতাংশ।
অবশ্য শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট ও শেওড়াপাড়া বাজার ঘুরে দেখা গেছে, টিসিবির দামের চেয়েও ২-৩ টাকা বেশি দামে চাল বিক্রি হচ্ছে।
অন্যদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত বুধবার পর্যন্ত দেশের সরকারি গুদামগুলোয় সব মিলিয়ে ২০ লাখ ৬ মেট্রিক টন খাদ্য মজুত ছিল। এর মধ্যে চাল ১৪ লাখ ৮১ হাজার ৫১৬ টন, গম ৪ লাখ ৪৮ হাজার ৬৬০ টন ও ধান ১ লাখ ৭ হাজার ৪৩০ টন।
বর্তমান মজুতকে ‘সন্তোষজনক’ উল্লেখ করে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বোরো সংগ্রহ কার্যক্রম চলছে। গত ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সব মিলিয়ে ১৪ লাখ ৪৭ হাজার ১২২ টন খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২ লাখ ৯৬ হাজার ৯৩১ টন ধান, ১১ লাখ ২৯ হাজার ৩৭৪ টন সেদ্ধ চাল, ১ লাখ ২৪ হাজার ৭০৬ টন আতপ চাল এবং ৩৭ টন গম সংগ্রহ করা হয়েছে।
খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতি বছরই আমন ও বোরো ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শেষ হওয়ার পর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে সরকারের গুদামে খাদ্যের মজুত বাড়তে থাকে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সন্তোষজনক মজুত থাকে।
এরপর সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতায় বিভিন্ন কর্মসূচির অধীনে চাল-আটা বিতরণ ও বিক্রির কারণে এই মজুত কমতে থাকে।
মজুত বেশি কমে গেলে সরকার বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে শুরু করে।
গত কয়েক মৌসুম বোরো ও আমন ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় সরকারকে খাদ্য নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি জানিয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, গম আমদানি হলেও গত তিন বছর সরকারি-বেসরকারি কোনও পর্যায়েই চাল আমদানি করতে হয়নি।
খাদ্য কর্মকর্তারা মনে করেন, বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় আপৎকালীন সংকট মোকাবেলার জন্য সরকারের মজুত ১২ থেকে ১৩ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুত থাকলেই যথেষ্ট।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ঢাকা স্কুল অব ইকনোমিকসের পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম খান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “২০ লাখ টন খাদ্য মজুত মানেই যথেষ্ট মজুত। এত মজুত থাকার পরও বাজারে চালের দাম বাড়ার কোনও কারণ নেই। বন্যাকে অজুহাত করে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট গড়ে তুলে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ দেশে এখন ভিন্ন পেক্ষাপট। অন্তর্বর্তী সরকার দেশ চালাচ্ছে। সবাই ভয়-অতঙ্কের মধ্যে আছে। এর মধ্যে সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়ানো খুবই উদ্বেগের বিষয়।”
এই সিন্ডিকেট শক্ত হাতে দমন করতে হবে বলে মনে করেন তিনি। বলেন, “গত কয়েক বছর বাম্পার ফলন ও স্বস্তিদায়ক মজুত থাকলেও বাজারে চালের দাম কমেনি; উল্টো চলেছে। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও তেমনটা হবে-সেটা মেনে নেওয়া যায় না।”
বাংলাদেশে ১২ লাখ টন খাদ্য মজুত থাকলেই তা যথেষ্ট উল্লেখ করে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “সেখানে ২০ লাখ টনের বেশি মজুত আছে। গত আমন ও বোরো মৌসুমে উৎপাদন বেশি হওয়ায় মজুত বেড়েছে। এবার চালের কোনও অভাব নেই। বেসরকারি ও কৃষক পর্যায়েও যথেষ্ট মজুত রয়েছে। চাল আমদানিরও প্রয়োজন পড়বে না। তাই দাম বাড়ার কোনও কারণ নেই।”
মূল্যবৃদ্ধির পেছনে ব্যবসায়ীরা বন্যার কথা বললেও তারা মূলত আগের মতো কারসাজির চেষ্টা করছে, অভিযোগ এই কৃষি অর্থনীতিবিদের।
দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের কী করা উচিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, “খোলাবাজারে বিক্রি বাড়ানো উচিত। এখন কিছুটা ট্রাক সেল শুরু হলেও ওএমএস কার্যক্রম সেভাবে শুরু হয়নি। মজুত কেবল গুদামে রেখে দিলে বাজারে কোনও প্রভাব পড়বে না।”
তাই দ্রুত সরকারকে পদক্ষেপ নিতে নিতে পরামর্শ দিলেন তিনি। এছাড়া বাজারে নজরদারি বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “মূলত দুর্বল ব্যবস্থাপনায় চালের দাম বাড়ে।”
একই কথা বললেন বাংলাদেশ অটো রাইস মিলস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ বি এম খোরশেদ আলম খান।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বাজারে চালের দাম যেটা বেড়েছে, সেটা কিন্তু চালের ঘাটতি বা সংকটের কারণে নয়; কিছু বড় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। বন্যাকে অজুহাত হিসেবে নিয়েছে তারা। এদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে চালের দাম এমনিতেই কমে আসবে।”
নতুন সরকারের কাছে সিন্ডিকেটবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
মজুতের পরেও চালের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসমাইল হোসেন বলেন, “এ কথা ঠিক যে বন্যার কারণে ধানের উৎপাদন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে তা সামগ্রিকভাবে চালের চাহিদা মেটাতে কোনও সমস্যা তৈরি করবে না। কারণ, সরকারি গুদামে যথেষ্ট পরিমাণ চালের মজুত আছে।”
কারসাজি করে কেউ চালের দাম বাড়াচ্ছে কি না-সে ব্যাপারে কড়া নজরদারি করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। শিগগিরই জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের মানুষের দৈনিক গড়ে চাল গ্রহণের পরিমাণ ৩২৮ গ্রাম। যদি দেশের ১৭ কোটি মানুষের ১৫ কোটিও ভাত খায়, তাহলে প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার টন চাল প্রয়োজন হয়।
অক্টোবর পর্যন্ত অস্থিরতা
বাংলাদেশের চালের বাজারের এই অস্থিরতা অক্টোবর পর্যন্ত থাকবে বলে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
সংস্থাটির বাংলাদেশের দানাদার খাদ্যবিষয়ক ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্যায় আমন ও আউশ ধানেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আবার বিশ্ববাজারে চালের দাম দেশের বাজারের চেয়ে বেশি। ফলে আমদানির সম্ভাবনাও কম। সব মিলিয়ে আগামী অক্টোবর মাস পর্যন্ত চালের বাজারে অস্থিরতা থাকতে পারে। তবে নভেম্বরে আমন কাটার মৌসুম শুরু হলে চালের দাম কমতে পারে।
বাংলাদেশ গ্রেইন অ্যান্ড ফিড আপডেট, আগস্ট–২০২৪ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিষয়টিও উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, এ আন্দোলনের সময় মাসখানেক খাদ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। যার প্রভাব পড়ে চালের বাজারে।
তবে ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে আন্দোলনের প্রভাব পড়েনি বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
গত ৩০ আগস্ট প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বন্যায় ধানের ব্যাপক ক্ষতির কারণে এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে চালের উৎপাদন ৩ শতাংশ কমতে পারে। এই অর্থবছরে চালের উৎপাদন ৩ কোটি ৬৮ লাখ টন হতে পারে। ধান হয়েছে ১ কোটি ১৫ লাখ হেক্টর জমিতে, যা গত বছরের চেয়ে সাড়ে ৩ শতাংশ কম। বছরে মোট চালের চাহিদা ৩ কোটি ৭০ লাখ টনের বেশি।
দেশে সাধারণত আউশ, আমন ও বোরো—তিনটি মৌসুমে ধানের চাষ হয়। আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে আমন ধান রোপণ করা হয়। আর তা কাটা হয় নভেম্বর–ডিসেম্বরে। বর্ষা দেরিতে আসায় এবং আগস্টজুড়ে প্রবল বৃষ্টি হওয়ায় এবার আমনের চাষ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আমনের চারা দেরিতে রোপণ করা হলে মোট উৎপাদন কিছুটা কমতে পারে।
ইউএসডিএর প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী কয়েক মাস চালের দাম অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকবে। অক্টোবরে আমন ধান কাটা শুরু হলে দাম কমতে পারে। এ মুহূর্তে বিশ্ববাজারে দাম বেশি হওয়ায় বাংলাদেশের পক্ষে চাল আমদানি করা কঠিন হবে। তাছাড়া ভারতও চাল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা এখনও তুলে নেয়নি।
বোরো উৎপাদন ব্যাহতের শঙ্কা
ইউএসডিএর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বোরো ধান সাধারণত ডিসেম্বর–জানুয়ারি মাসে রোপণ করা হয়। আর এপ্রিল–মে মাসে তা কাটা হয়। বোরো মৌসুমে সবচেয়ে বেশি বিপদ আসে। খরা থেকে শুরু করে তাপপ্রবাহ, ঘূর্ণিঝড় ও পোকার আক্রমণ এ সময় বেশি হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে এ বছর ৩৯ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছে। এখান থেকে দুই কোটি পাঁচ লাখ টন চালের উৎপাদন হতে পারে।
আউশ মৌসুমে এবার ৯ লাখ হেক্টর জমিতে ২১ লাখ টন ধান হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে ১৮ দশমিক ২ শতাংশ কম।
আউশের ভরা মৌসুম ধরা হয় জুন–জুলাই মাসকে। আর সেই সময়টাতেও হয়েছে আকস্মিক বন্যা। আগস্টে ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লায় হঠাৎ বন্যার কারণে ধানের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর পাশাপাশি লক্ষ্মীপুর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
বাংলাদেশের উজানে ভারত থেকে আসা ঢলের কারণে মুহুরী, কহুয়া, সিলোনিয়া ও গোমতী নদীর তীরবর্তী এলাকায় বেশি ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিক মূল্যায়ন অনুযায়ী দুই লাখ হেক্টর জমির আমন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে ১০ আগস্টের মধ্যে ৬০ শতাংশ আমন ধান রোপণ করা হয়। এরপর বন্যা শুরু হয়ে যাওয়ায় চারা রোপণ ব্যাহত হয়েছে।