সিলেটের শাহী ঈদগাহে এই অঞ্চলের প্রধান ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়। সেই কারণে এখন এটি পরিচিত হলেও এটি সিলেটের একটি প্রাচীন নিদর্শন। মুঘল আমলে নির্মিত এই ঈদগাহ জড়িয়ে আছে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গেও।
ইতিহাসের বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, মুঘল ফৌজদার ফরহাদ খাঁ সপ্তদশ শতকে ঈদগাহটি নির্মাণ করেছিলেন। তখন মুঘল সম্রাট ছিলেন আওরঙ্গজেব।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, এই ঈদগাহ থেকেই ব্রিটিশের বিরুদ্ধে অবিভক্ত ভারতবর্ষে প্রথম দিককার বিদ্রোহের সূচনা হয়। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ১৭৮২ সালে এই ঈদগাহে শহীদ হন দুই ভাই। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহেরও ৭৫ বছর আগের ঘটনা এটি।
মহাত্মা গান্ধী থেকে শুরু করে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের মতো প্রখ্যাত নেতারা এই ময়দানে বক্তব্য দিয়েছেন। অতীতে সিলেটের বড় বড় সমাবেশের স্থানও ছিল এটি।
নির্মাণশৈলী
সিলেট নগরীর মধ্যভাগে ছোট্ট টিলার উপর কারুকার্য খচিত এই ঈদগাহ। কারুকার্যখচিত ২২টি বড় সিঁড়ি পেরিয়ে টিলায় উঠতে হয়। টিলার ওপরে রয়েছে কারুকার্য করা ১৫টি গম্বুজ। ঈদগাহের সামনে রয়েছে ওজুর জন্য বিশাল পুকুর। প্রায় দেড় লাখ মানুষ এখানে একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারে।
ঈদগাহের প্রাচীর সীমানার চারদিকে রয়েছে ছোট-বড় ১০টি ফটক। সামনের দিকের তিনটি ফটকে মুঘল আমলের স্থাপত্যের ছাপ স্পষ্ট।
পুকুরে স্থাপন করা আছে কৃত্রিম ফোয়ারা। ঈদগাহের ভেতরের ফলক অনুযায়ী, ২০০৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান পুকুরের চারদিকে ঘাট নির্মাণের ভিত্তি স্থাপন করেন। আরেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১০ সালের ২৯ অক্টোবর ঈদগাহে বিদ্যুতায়ন, সংস্কার ও চারদিকে ফুটপাত নির্মাণ করেন। তিনি ২০১৫ সালে ১৮০ ফুট উচ্চতার মিনারও তৈরি করেন, যা ঐতিহাসিক এই ঈদগাহের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে বহুগুণ।
ঈদের দিন ছাড়াও অন্য দিনগুলোতে প্রচুর মানুষ পাহাড়, টিলা আর বৃক্ষরাজির মধ্যে থাকা এই ঈদগাহ ঘুরতে আসেন।
ঈদগাহের উত্তরে শাহী ঈদগাহ মসজিদ, পাশে সুউচ্চ টিলার ওপর বন কর্মকর্তার বাংলো, দক্ষিণে বাংলাদেশ টেলিভিশনের উপ-কেন্দ্র, পূর্ব দিকে হযরত শাহজালালের (র.) অন্যতম সফরসঙ্গী শাহ মিরারজীর (র.) মাজার।
এবার ঈদুল ফিতরের নামাজের জন্য সিেলট সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নতুন করে রং দেওয়া হয়েছে। ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়েছে ঈদগাহ। করা হয়েছে আলোকসজ্জাও।
লেখক ও গবেষক ড. মোস্তাক আহমাদ দীন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, এটি সিলেটের এক প্রাচীন স্থাপত্য ও অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে
এক সময় মহররমের শোককে কেন্দ্র করে প্রতি বছর ১০ মহররম লাঠি খেলা অনুষ্ঠিত হতো এই ঈদগাহে। সেখানে জমায়েত হতেন হাজার হাজার মানুষ।
এই ময়দান থেকে ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দের মহররম মাসে স্থানীয় দুই ধর্মীয় নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ হাদী ও তার ভাই মাহাদী তাদের অনুসারীসহ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। মহররমের মিছিল করে তারা এই ময়দানে আসেন এবং পরিকল্পনা ছিল হঠাৎ করে ব্রিটিশদের উপর আক্রমন করবেন।
কিন্তু তৎকালীন সিলেটের কালেক্টর রবার্ট লিন্ডসে গুপ্তচরের মাধ্যমে আগের দিনই বিষয়টি জেনে ফেলেন। লিন্ডসে সেদিন তার বাহিনীসহ এই ময়দানে এসে তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। কিন্তু দুই ভাই ও তাদের অনুসারীগণ অস্বীকার করেন। ফলে গুলি চালায় ব্রিটিশ বাহিনী। তাতে নিহত হন হাদী ও মাহাদী।
নগরীর কুমারপাড়া সংলগ্ন ঝরনার পাড়ের সৈয়দ হাদি এলাকায় হাদা মিয়া এবং সৈয়দ মাহাদী এলাকায় মাদা মিয়া নামে পরিচিত ছিলেন। তাদের এই বিদ্রোহ ‘হাদা মিয়া-মাদা মিয়ার বিদ্রোহ’ নামে খ্যাত।
সিলেটের এক সময়ের বাম রাজনীতিক ও লেখক রফিকুর রহমান লজু এই ইতিহাস নিয়ে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ১৭৮২ সালে সিলেটের রেসিডেন্ট কালেক্টর ছিলেন রবার্ট লিন্ডসে। তিনি আধিপত্য বিস্তার ও সম্পদ লুণ্ঠনে মরিয়া ছিলেন। তার অত্যাচারে সবাই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। ক্ষোভ দেখা দেয় স্থানীয়দের মধ্যে। পুঞ্জীভূত এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে মহররমের দিন।
“ওইদিন স্থানীয় মুসলমানরা ঈদগাহে জড়ো হয়ে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করেন। তাদের প্রধান টার্গেটও ছিলেন লিন্ডসে। তবে বিদ্রোহ পরিচালনার জন্য তাদের পূর্বপ্রস্তুতি বা পরিকল্পনা ছিল না। অসংগঠিত ও বিচ্ছিন্নভাবে শুধু স্থানীয় শক্তির ওপর নির্ভর করে তারা বিদ্রোহে নেমে পড়েন। ফলে উন্নত অস্ত্রধারী ও সুসংগঠিত শক্তিশালী ব্রিটিশ বাহিনীর সামনে বিদ্রোহীরা বেশি সময় টিকতে পারেননি।”
রফিকুর রহমান জানান, ভারত ছাড়ার পর স্কটল্যান্ডে স্থায়ী হয়েছিলেন রবার্ট লিন্ডসে। ১৮৪০ সালে প্রকাশিত হয় তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ An Anecdotes of an Indian life বইয়ে সিলেটের বিদ্রোহের কথা উল্লেখ আছে।
লিন্ডসের আত্মজীবনীর সিলেট পর্ব- ‘সিলেটে আমার বারো বছর’ নামে অনুবাদ করেন লেখক ও সাংবাদিক আব্দুল হামিদ মানিক। তাতে দেখা যায়, লিন্ডসে ওই বিদ্রোহকে ‘মহররমের দাঙ্গা’ ও ‘হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
তবে রফিকুর রহমান বলেন, “ঘটনাটি তা ছিল না। এটা ছিল ইংরেজ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সিলেটবাসীর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। সমাজের একেবারে সাধারণ স্তর থেকে উঠে আসা মানুষজন এই বিদ্রোহে অংশ নেন, যার নেতৃত্বে ছিলেন হাদা মিয়া ও মাদা মিয়া।”
সিলেটের মদন মোহন কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, লেখক-গবেষক ড. আবুল ফতেহ ফাত্তাহ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, মূলত মোহাম্মদ হাদী ও তার ভাই মাহদী উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে প্রথম শহীদ।
তিনি আরও জানান, শাহী ঈদগাহের পাশে নয়াসড়ক মাদ্রাসার ঠিক পূর্বদিকে এবং ক্রিশ্চিয়ান গির্জার পশ্চিমপাশে তাদের দুই ভাইয়ের কবর রয়েছে।
কবর দুটি সংরক্ষণে প্রশাসনিক কোনও কোনও উদ্যোগ না থাকায় হতাশা প্রকাশ করে ড. আবুল ফতেহ বলেন, ইতিহাস সংরক্ষণের প্রয়োজনে এ দুটি কবর সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।
শাহী ঈদগাহ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বটি সিলেট সিটি করপোরেশনের।
মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মুঘল ঐতিহ্যের এই স্মারক স্থাপনাটি সিলেটের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ। কেবল ঈদের জামাত আয়োজন নয়, এই ঈদগাহের ইতিহাস সংরক্ষণেও সিটি করপোরেশন উদ্যোগ গ্রহণ করবে।”