সিরিয়ার একনায়ক বাশার আল-আসাদের পতনের পর বিশ্ব তার প্যারাসুটের রং চিনেছে। তা হচ্ছে রাশিয়ার ত্রিবর্ণ পতাকা, যা এখন তার আশ্রয়স্থল।
আসাদের মস্কোতে পালিয়ে যাওয়া ক্রেমলিনের জন্য একটি মিত্র রাষ্ট্র হারানোর চেয়েও বেশি বেদনার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কারণ তার পতন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যপ্রাচ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে ভূমিকা রাখার আকাঙ্ক্ষায় বড় আঘাত হেনেছে। মেলে ধরেছে তার শাসনের ভঙ্গুরতার দিকটিও।
তাই পুতিনের বিরোধী পক্ষ ইতোমধ্যেই উল্লাসে মেতেছে।
রুশ বিরোধী কর্মী ইলিয়া ইয়াশিন এক্সে লিখেছেন, “পুতিনের আরেক একনায়ক সহযোগী কমল।”
পোস্টে তিনি আসাদের একটি পুড়তে থাকা ব্যানারের ছবি পোস্ট করেছেন।
ইউক্রেনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রি কুলেবা মন্তব্য করেছেন, “পুতিন ইউক্রেনের যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করতে আসাদকে ত্যাগ করেছেন। তার সম্পদ সীমিত এবং তিনি যতটা শক্তিশালী দেখান, আসলে ততটা নন।”
আসাদের প্রস্থানে ইতিহাসের কিছু মজার বিষয়ও সামনে আনছে ইউক্রেন যুদ্ধ পর্যবেক্ষণকারীরা।
আসাদ রাশিয়ায় গিয়ে ইউক্রেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের সঙ্গী হয়েছেন। ইয়ানুকোভিচ ২০১৪ সালে রাশিয়ায় পালিয়ে যান।
ইউক্রেনে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভ এবং রক্তক্ষয়ী দমনপীড়নের পর ইয়ানুকোভিচের শাসনের পতন ঘটে।
সিরিয়ার সাধারণ মানুষ এখন দামেস্কে দুর্ভেদ্য প্রেসিডেন্ট প্রাসাদেও এখন আবাধে ঘুরে দেখতে পারছে।
ঠিক যেমন ইউক্রেনীয়রা একসময় ইয়ানুকোভিচের দখলে থাকা বিলাসবহুল মেজিগিরিয়া এস্টেট পরিদর্শন করেছিল।
ইয়ানুকোভিচের পতনের পর মেজিগিরিয়াকে দুর্নীতির একটি জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়।
ইয়ানুকোভিচ তার ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকে ইউক্রেনে আর ফেরেননি; যদিও ২০২২ সালে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আক্রমণের পর দেশটির ২০ শতাংশের বেশি এলাকা কার্যত রাশিয়ার দখলে।
আসাদের সৈন্যদের কোনও প্রতিরোধ ছাড়াই দামেস্ক ছাড়তে দেখা যাচ্ছে। এর বিপরীতে, ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রাশিয়ার সৈন্যরা কিয়েভে পৌঁছানোর সময় দৃঢ়ভাবে অবস্থান ধরে রেখেছিলেন।
আসাদের সিরিয়া থেকে পালানো ইউক্রেনীয়দের জন্য পুতিনের প্রতীকী পরাজয়ে উল্লাস করার উপলক্ষের চেয়েও বেশি কিছু ছিল।
আসাদ শাসনের পতন ঘটেছে এমন সময় যখন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ফ্রান্সে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন।
সেই সফর ছিল নটরডেম ক্যাথেড্রালের পুনরুদ্ধার অনুষ্ঠান উপলক্ষে, যেখানে জেলেনস্কি দাঁড়ানো অভ্যর্থনা পান।
ট্রাম্পের পুনঃনির্বাচনে বিজয়ের ফলে কিয়েভের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন প্রত্যাহারের শঙ্কায় ইউক্রেন প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তবে আসাদের পতন পুতিনের অবস্থানকে দুর্বল করতে পারে, বিশেষত ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করার আলোচনার ক্ষেত্রে।
পুতিনের পারমাণবিক উত্তেজনা সৃষ্টিকারী সাম্প্রতিক হুমকি যদি ফাঁপা প্রমাণিত হয়, তবে এটি তার কৌশলগত অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
দামেস্কে বিদ্রোহী যোদ্ধারা অগ্রসর হওয়ার সময় ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পোস্টে ক্রেমলিনের সঙ্কুচিত কৌশলগত বিকল্পগুলোর প্রতি ইঙ্গিত দেন।
ট্রাম্প লিখেছেন, “রাশিয়া আর সিরিয়াকে রক্ষা করতে পারছে না। কারণ তারা ইউক্রেন সংকটে অনেকে বেশি জড়িয়ে পড়েছে এবং সেখানে ৬ লাখ সেনা হারিয়েছে।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, আসাদ শাসনের পতন পুতিনের জন্য একটি বাস্তব সামরিক পরাজয়ও বটে।
বিদ্রোহীদের অগ্রগতির পর একটি ভিডিওতে দেখা যায় যে, সিরিয়ার ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে তারতুস শহরে আসাদের স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে ফেলা হয়েছে। তারতুসে রাশিয়া স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকে একটি নৌঘাঁটি পরিচালনা করে আসছিল।
এছাড়া সিরিয়ার লাতাকিয়া প্রদেশের হেমেইমিমে অবস্থিত রুশ বিমানঘাঁটি মধ্যপ্রাচ্যে শক্তি প্রদর্শনের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
২০১৭ সালে হেমেইমিম পরিদর্শনকালে পুতিন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এই দুটি ঘাঁটি স্থায়ীভাবে পরিচালিত হবে। তিনি সতর্ক করেছিলেন, যদি ‘সন্ত্রাসীরা’— অর্থাৎ আসাদের বিরোধীরা— আবার মাথা তোলে, তবে তাদের ওপর নজিরবিহীন আঘাত হানা হবে।
প্রায় ১০ বছর আগে পুতিন সরাসরি সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করেন। তিনি আসাদের পরাজিত বাহিনীকে পুনর্গঠিত করার জন্য রুশ বিমান বাহিনী ও ভাড়াটে সৈন্য প্রেরণ করেন এবং ইরানের সঙ্গে মিলিতভাবে তাদের সহযোগিতা করেন। এই পদক্ষেপ তখন ফলপ্রসূ হয়েছিল।
পুতিনের সহায়তায় আসাদ শক্তি ফিরে পেয়েছিলেন। সিরিয়ার আরও ভূখণ্ড তার সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছিল এবং পুতিন নিজেকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে অপরিহার্য ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরেছিলেন।
২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল এবং ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদ উস্কে দেওয়ার কারণে জি-টোয়েন্টি সম্মেলনে একঘরে হওয়া পুতিন এক বছর পরই আবার আন্তর্জাতিক মনোযোগের কেন্দ্রে চলে আসেন। আসাদকে সমর্থন দিয়ে তিনি ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শূন্য থেকে নায়ক হয়ে উঠেছিলেন।
তবে এক দশক আগে আসাদকে দেওয়া পুতিনের সমর্থনের প্রতিশ্রুতি এখন শূন্য বলে মনে হচ্ছে। তা সত্ত্বেও পুতিনকে সম্ভাব্য আলোচক বা প্রতিপক্ষ হিসাবে বাতিল করে দেওয়াটা খুব তাড়াতাড়ি হবে।
পুতিনের একজন ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক তাতিয়ানা স্তানোভায়া এক্সে এক পোস্টে মন্তব্য করেন, আসাদের পরাজয় পুতিনকে ইউক্রেন নিয়ে আরও কঠোর অবস্থান নিতে উৎসাহিত করতে পারে।
তিনি বলেন, “পুতিন হয়ত অতিরিক্ত শর্ত তুলবেন এবং আলোচনায় সহজে সম্মতি দেবেন না। বরং তিনি জোর দিয়ে বলবেন যে এখন পশ্চিমা দেশগুলো এবং ইউক্রেনকেই তাদের অবস্থান বদলাতে হবে।”
এর আগে ট্রাম্প পুতিনকে ইউক্রেনে যুদ্ধ শেষ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
তাতিয়ানা বলেন, “আসাদের পতন পুতিনকেও ঝাঁকুনি দিয়েছে। এতে তিনি ইউক্রেন নিয়ে আর নমনীয় নাও হতে পারেন। ইউক্রেন যুদ্ধ কোনো না কোনোভাবে সিরিয়াকে হারানোর কারণ হয়েছে। এতে পুতিনের আপস না করার মনোভাব আরও দৃঢ় হবে।”
পুতিন দীর্ঘদিন ধরে নিজেকে পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে এক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সংঘাতে নিয়োজিত হিসাবে দেখে আসছেন। ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেছে।
আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার ঘটনা ইউক্রেন নিয়ে পুতিনের অবস্থান আরও কঠোর করতে পারে।
তথ্যসূত্র : সিএনএন