সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের নাটকীয় পতনে দীর্ঘ ৫০ বছরের পারিবারিক শাসনের ঘটেছে অবসান। সিরিয় সরকারের আকস্মিক পতন ব্যাপকভাবে ঝাঁকুনি দিয়েছে বিশ্ব চলচ্চিত্রে। এই ঘটনায় দেশত্যাগী ঘরছাড়া সিরিয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতারা আশায় বুক বাঁধছেন। তবে ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কাও আছে তাদের মনে।
আসাদের পতনে নির্মাতারা খুশি সন্দেহ নেই। তবে অনেকেই মনে করছেন, যে ইসলামপন্থী নেতা আবু মোহাম্মদ আল জোলানির নেতৃত্বে স্বৈরশাসকের উৎখাত ঘটেছে, তিনি দেশকে আরও অরাজকতার মধ্যে নিয়ে যেতে পারেন। যদিও পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।
আমস্টারডামের ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডকুমেন্টারি ফিল্ম ফেস্টিভেল-এর আর্টিস্টিক ডিরেক্টর অরওয়া নিরাবিয়া অনুভূতি জানাতে গিয়ে বলেছেন, “সেই শৈশব থেকে এমন কিছুর স্বপ্ন দেখে বড় হয়েছি। আজ স্বপ্ন সত্যি হলো।”
তিনি বলেন, “এতো এতো মানুষের জীবনদান সত্যিই খুব বেদনাদায়ক। কত মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারালো। এতো যন্ত্রণা আমাদের প্রাপ্য ছিল কিনা কে জানে।”
সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৩ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধে সিরিয়ায় প্রায় ৫ লাখেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আর দেশ ত্যাগ করেছে লক্ষ লক্ষ মানুষ।
লস অ্যাঞ্জেলেস এ অবস্থানরত সিরিয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক এবং প্রযোজক সাম কাদি তার স্বস্তি প্রকাশ করে বলেন “এতোদিন ধরে চলা ভয়, আতঙ্ক, সংগ্রাম, রক্তপাত আর ধ্বংসের শেষ হলো।”
আলোচিত অ্যানিমেশন ফিল্ম ‘ল্যামাস পয়েমস’ এর প্রযোজক সাম কাদি। অস্কারের সংক্ষিপ্ত বাছাই তালিকায় নাম ওঠায় ফিল্মটি আলোচনায় এসেছিল। সিরিয়ান এক শরণার্থী মেয়েকে ঘিরে ‘ল্যামাস পয়েমস’ এর গল্প গড়ে ওঠে।
চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং অধিকার কর্মী হাসান আক্কাদ বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। ২০১৫ সালে সিরিয়া ত্যাগ করে যুক্তরাজ্য যাওয়ার সময়, নিজের যাত্রা ভিডিও করে রাখেন তিনি। যা পরে বাফটা (BAFTA) জয়ী ডকুমেন্টারি ‘এক্সোডাস: আওয়ার জার্নি টু ইউরোপ’- এ ব্যবহৃত হয়েছিল।
আসাদের পতনে উচ্ছাস প্রকাশ করে হাসান বলেন, “শেষ কবে এতো খুশি হয়েছিলাম জানি না। আসাদ শেষ পর্যন্ত উৎখাত হয়েছে। তার পতন হয়েছে।”
আরবের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র বিতরণ এবং বিপণন সংস্থা ম্যাড সল্যুশনস এর সিইও আলা কারকুটি আসাদের পতনকে শুধু উচ্ছ্বাস প্রকাশের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখতে আগ্রহী নন। তিনি বরং ভিন্ন একটি দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করছেন।
তিনি বলেন, “ আমার কাছে মূল বিষয় হলো ‘এতো অস্ত্রের মালিক কারা?’। অস্ত্র তো ফ্রি নয়। ফলে আসাদের উৎখাতের পেছনে অন্য কোন শক্তি নিশ্চয়ই আছে।”
পাশাপাশি তিনি ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা, এবং ইরান, রাশিয়া এবং লেবাননের হিজবুল্লার ওপর ভরসা করতে না পেরে আসাদের রাশিয়া পালিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গটিও নিয়ে আসেন।
সিনেমাটগ্রাফার এবং ডকুমেন্টারি নির্মাতা হাসান কাট্টান একই সঙ্গে খুশি এবং ভীত।
শঙ্কা লুকোতে না পেরে হাসান বললেন, “সিরিয়ার আসলে কী হবে এটি একটি কঠিন প্রশ্ন। সত্যি বলতে আমরা আসলে ভীত। যারা স্বাধীনতা এবং বিপ্লবে বিশ্বাসে তাদের সবার কাছেই এটি একটি বড় প্রশ্ন।”
তিনি আরও বলেন, “এটা ছিল আমাদের প্রথম (আসাদের পতন) মিশন। এবার আমাদের স্বাধীন সিরিয়া পুনর্গঠন করতে হবে। আমাদের মানুষের মাঝে একতা ও তাদের মধ্যে মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু আমি ভবিষ্যত নিয়ে ভয় পাচ্ছি। এই ভয় কেবল শুধু ইসলামিক গোষ্ঠীগুলোর উত্থানের জন্য নয়, বরং রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল এর কারণেও।”
অস্কার বিজয়ী ডকুমেন্টারি নির্মাতা অরল্যান্ডো ভন এন্সিডেল আসাদের পতনে তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “আশাকরি এইবার সিরীয়রা তাদের ভবিষ্যত নির্মাণের স্বাধীনতা পাবে।”
একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের সম্ভাবনা, আদর্শভাবে গণতন্ত্রের দিকে, সম্পর্কে অরল্যান্ডো ভন এন্সিডেল উল্লেখ করেছেন যে ‘স্পষ্টতই সামনে রাস্তা অনিশ্চিত’। তবে তিনি আরও যোগ করেন, “সিরিয়রা এমন কিছু সাহসী, যথাযথ এবং নীতিবান মানুষ যারা আমি কখনও দেখেছি।” এবং তিনি আশাবাদী যে তারা ‘আসাদের শাসনের এই অন্ধকার সময়ের পৃষ্ঠা ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হবে’।
তিনি বলেন, “সামনের দিন অনিশ্চিত। তবে আমার চলার পথে এমন কিছু সিরিয়ানদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে যারা দুর্দান্ত সাহসী এবং নীতিবান। আমি আশাবাদী যে তারা এই অন্ধকার সময় ঘুচিয়ে দিতে পারবে।”
সংবাদ মাধ্যম ‘ভ্যারাইটি’র সঙ্গে আলাপকালে সিরিয়ার চলচ্চিত্র নির্মাতারা সিরিয়া পুনর্গঠনের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেছেন, দেশ পুনর্গঠনে টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তারা ভূমিকা রাখবেন।
আলা কারকুটি জানান, গত ১৩ বছরে সিরিয়া চলচ্চিত্র নির্মাতা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি আশা করছেন আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার সঙ্গে সঙ্গে, সিনেমায় সেন্সরশিপও বিলীন হয়ে যাবে।
তাই তিনি বলেন, “যুদ্ধ শেষ, চলুন (সিরিয়ায়) ফিরে যাই”।
কারকুটি আরও জানান, গৃহযুদ্ধের আগে, সিরিয়া ছিল মধ্যপ্রাচ্যের টেলিভিশন প্রোডাকশনের ‘পাওয়ার-হাউজ’। অরওয়া নিরাবিয়া তাই সিরিয়ার পুনর্গঠনে কারও অপেক্ষায় না থেকে দায়িত্ব পালনের দিকেই ইঙ্গিত করলেন।