টাকা লাগবে? সমস্যা কী? গৌরী সেন আছে না! এই গৌরী সেন কি কাল্পনিক চরিত্র, না বাস্তব চরিত্র— তার হদিস কেউ করে না, কিন্তু প্রবাদটি এই অঞ্চলে চালু আছে কালের পর কাল ধরে। বাংলায় গৌরী সেন নামে এক দানবীরের খোঁজ পাওয়া যায়; তিনি বাস্তবেই ছিলেন। ষোড়শ আর সপ্তদশ শতকে অঢেল অর্থ গরিব দুঃখীকে দান করে গেছেন তিনি। কিন্তু এই যুগে গৌরী সেন হবে কে? তাতেও সমস্যা নেই। টাকশাল আছে না? কিন্তু জটিল অর্থনীতির এই যুগে টাকা ছাপাতে অনেক হিসাব-কিতাব কষতে হয়। অবশ্য সেই হিসাব-কিতাব জলাঞ্জলি দিয়েই টাকা ছাপিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। লাটে ওঠা ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে টাকা ছাপাতে গিয়ে অর্থনীতির বেজেছে বারোটা! আবার সেই অর্থ যে পাচার হয়েছে, সেটাও এখন বেরিয়ে আসছে।
আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায়, তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও তারা কতটা স্বাধীন ছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন অবশ্য বরাবরই ছিল। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে দেদারছে ঋণ দিয়েছিল। দেওয়া হয়েছিল ব্যাংকগুলোকেও। নাজুক সেই ব্যাংকগুলোকে দেওয়া টাকা আবার এস আলম গ্রুপের হাতে পড়ে হাপিসও হয়েছিল। এভাবে টাকা ছাপলে মূল্যস্ফীতি বাড়ে, সেটা জানা কথা। মূল্যস্ফীতির অঙ্ক তা বলেও দিচ্ছে।
সরকারি হিসাবেই দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। আসলে যে কত, তা যারা বাজারে যান, তারা বুঝতেই পারছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারানোর আগেই থেকেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে। গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষকে বেশ ভুগতেই হচ্ছে। গত সেপ্টেম্বরের চেয়ে অক্টোবরে আরও বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। অক্টোবর মাসে তা হয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে ছিল ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ। জুলাই মাসে তো খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল, যা ছিল গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সব মিলিয়ে মূল্যস্ফীতির চাপে চিড়েচ্যাপ্টা এখন সাধারণ মানুষ।
এই মূল্যস্ফীতির বাড়-বাড়ন্তের আগে যখন টাকা ছাপানো হচ্ছিল, তখন আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, এর বিকল্প ছিল না। তখন এই টাকা ছাপানোর প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির পাশাপাশি প্রায় প্রতিদিনই কোনও না কোনও টেলিভিশনে টকশোতে উপস্থিত থাকতেন তিনি। আমি নিজেও তার সঙ্গে অনেক টকশোতে ছিলাম। গত ১৩ জুলাইও ইকনোমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) এক আলোচনায় আহসান মনসুর বলেছিলেন, টাকা ছাপিয়ে ‘অচল ব্যাংক’ টিকিয়ে রাখা হচ্ছে। ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোকে রক্ষার নামে টাকা ছাপানো অব্যাহত রাখা হলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। টাকা ছাপিয়ে ঋণ দিলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। তাই টাকা ছাপানো বন্ধ করতেই হবে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সব অঙ্গনে নেতৃত্বও বদলে যায় পুরোপুরি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর পান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব। গত ১৪ আগস্ট এই দায়িত্ব নেন তিনি। এরপর ২০ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দেন, অতীতের মতো টাকা ছাপিয়ে সরকারকে বা কোনও ব্যাংককে আর অর্থ দেওয়া হবে না। তিন সপ্তাহ আগে বাহবা চেয়ে বললেন, “টাকা না ছাপিয়েই তারল্য সংকটের সমাধান করেছি।”
কিন্তু এত হম্বিতম্বি এখন কই গেল? ডিগবাজি খেয়ে সেই রউফ তালুকদারের পথেই তো হাঁটছেন আহসান মনসুর। গত বৃহস্পতিবার জানালেন, অর্থ সংকটে ধুকতে থাকা ছয়টি ব্যাংককে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়েই সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ঘটা করে সংবাদ সম্মেলন করে নিজেই টাকা ছাপানোর এই খবর দিলেন তিনি। কেন সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেললেন— সেই প্রশ্নে তার উত্তর এল, “আমি আগে বলেছিলাম টাকা ছাপাব না। সেই বিষয় থেকে আমি সাময়িকভাবে সরে এসেছি, পুরোপুরি নয়। গ্রাহকের টাকা নিরাপদ রয়েছে। তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোতে ২২ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। তবে ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেওয়ার প্রক্রিয়াটিকে পুরোপুরি টাকা ছাপানো বলা যাবে না। এখানে এক হাতে বাজার থেকে টাকা তুলে অন্য হাতে ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হবে।”
সেই সংবাদ সম্মেলনে গভর্নরের ডান পাশে বসেছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু। ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি তিনি। ক্ষমতার পালাবদলের পর বেশ প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন মিন্টু। অনেকটা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মতো। যে ছয়টি ব্যাংককে নতুন টাকা ছাপিয়ে সহায়তা দেওয়া হয়েছে, তার একটি ন্যাশনাল ব্যাংক। এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান এখন মিন্টু। অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর তিনি এই ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, মূলত মিন্টুর চাপেই গভর্নর আহসান মনসুর তার অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। নতুন করে টাকা ছাপিয়ে ছয় ব্যাংককে দিয়েছেন। গভর্নরের সঙ্গে মিন্টু বেশ কয়েকটি বৈঠক করেন। বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনের আগেও বেশ কিছুক্ষণ আলাদা আলোচনা করেছিলেন তারা।
এখন বাজারে আবার টাকার চাপে মূল্যস্ফীতি কোথায় চড়ে, তা স্বাভাবিকভাবেই দুঃশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ তার আগে গত ৩ নভেম্বর বলেছিলেন, “আমরা নতুন করে কোনও টাকা ছাপাচ্ছি না, ফলে মূল্যস্ফীতিও আর বাড়বে না।” কিন্তু এখন যে টাকা ছাপানো শুরু হলো!
জুলাই অভ্যুত্থানে শুধু আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনের অবসানই ঘটনায়নি, পরিবর্তনের আশায়ও বুক বেঁধেছিল সাধারণ মানুষ। কিন্তু সেই পরিবর্তনের চাওয়ার সঙ্গে পাওয়ার হিসাবের ব্যবধান যেন ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। এক সময় গভর্নর রউফ তালুকদারকে যে সমালোচনায় বিদ্ধ করতেন আহসান মনসুর, এখন তিনি নিজেই সেই একই কাজ করছেন। নিরূপায় হয়ে, চাপে নাকি বাধ্য হয়ে, তা অবশ্য আহসান মনসুরই ভালো বলতে পারবেন।
তবে এখন তিনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, টকশোর বক্তৃতা গভর্নরের চেয়ারে বসে দেওয়া যায় না, স্ক্রিপ্ট বদলাতে হয়। আর মানুষ বলতেই পারে, ‘সেই তো নথ খসালি, তবে কেন লোক হাসালি’।
লেখক: সাংবাদিক।
ইমেইল: [email protected]