নির্বাচন চাইলেও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে সময় দেওয়ার কথা আগেই জানিয়েছিল বিএনপি; এখন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বললেন, অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকারকে ব্যর্থও হতে দেবে না তারা।
‘আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস’ উপলক্ষে মঙ্গলবার ঢাকার নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশে যুক্তরাজ্য থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য রাখেন তারেক, সেখানে তিনি এই সরকারের প্রতি দলীয় সমর্থন প্রকাশ করেন।
দেড় দশক বিএনপি বার বার ব্যর্থ হলেও ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এরপর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই মুক্তি পান বিএনপি চেয়ারপারসন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। তবে অসুস্থতার কারণে রাজনৈতিক কোনও কর্মসূচিতে আসেন না তিনি।
খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক বলেন, “অনেক রক্তের বিনিময়ে, লাখো কোটি জনতার গণঅভ্যুত্থানের ফসল এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকারের কোনও কোনও কার্যক্রম সকলের কাছে হয়ত সাফল্য হিসেবে বিবেচিত নাও হতে পারে, কিন্ত এই সরকারের ব্যর্থতা হবে আমাদের সকলের ব্যর্থতা। বাংলাদেশের পক্ষের গণতন্ত্রকামী জনগণের ব্যর্থতা। এটি আমাদের প্রত্যেকের মনে রাখতে হবে।
“অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সব কার্যক্রম মনঃপূত না হলেও তাদের ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। দেশ-বিদেশ থেকে নানা রকমের উসকানিতেও জনগণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ হতে দেবে না।”
“তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যাতে নিজেরাই নিজেদের ব্যর্থতার কারণ হয়ে না দাঁড়ায়, সে ব্যাপারে তাদেরও সতর্ক থাকতে হবে,” সরকারকে সতর্ক করে দেন তিনি।
বিশেষ পরিস্থিতিতে এই অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলেও এই সরকার কতদিন থাকবে, তা এখন অস্পষ্ট। সরকার এরই মধ্যে নানা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের লক্ষ্য ঠিক করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সংস্কারের পরই নির্বাচন হবে।
তারেক রহমান ২০২৩ সালে রাজনৈতিক সংস্কারে বিএনপির ৩১ দফা কর্মসূচির বিষয়াবলি তুলে ধরে বলেন, “এই ৩১ দফাই শেষ কথা নয়। বিএনপি মনে করে, রাষ্ট্র কিংবা রাজনীতি, সকল ক্ষেত্রেই সংস্কার কার্যক্রম একটি ধারাবাহিক এবং চলমান প্রক্রিয়া।
“সুতরাং রাষ্ট্র ও রাজনীতি সংস্কারে বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচির আরও প্রয়োজনীয় পরিবর্তন পরিমার্জনকেও বিএনপি স্বাগত জানায়।”
এই সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তিনি বলেন, “যেকোনও দেশেই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকার অবশ্যই জনগণের সরকার।
“তবে কোনও এক পর্যায়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জবাবদিহিতাও কিন্তু নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমেই নিশ্চিত করা হয়। সুতরাং, জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সংসদ এবং সরকার প্রতিষ্ঠাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সকল সংস্কার কার্যক্রমের প্রথম এবং প্রধান টার্গেটও হওয়া জরুরি।”
সরকারকে সময় দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তি দেখিয়ে তিনি বলেন, যেহেতু গত ১৫ বছর বাংলাদেশ ‘মাফিয়া চক্রের দখলে’ ছিল, তাই অর্থনীতি, বিচার বিভাগসহ সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
সরকারকে হুঁশিয়ার থাকার পরামর্শ দিয়ে তারেক বলেন, “মাফিয়া চক্রের প্রধান দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও তাদের চক্রটি প্রশাসনে এখনও সক্রিয়। তারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।”
দলের নেতা-কর্মীদের হুঁশিয়ার করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, “প্রতিটি রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর মনে রাখা প্রয়োজন, রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের আচার-আচরণেও গুণগত পরিবর্তন জরুরি।
“সুতরাং আমার আহ্বান, কোনও প্রলোভন কিংবা উসকানিতে বিভ্রান্ত না হয়ে জ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্র এবং সমাজের নেতৃত্ব দানের জন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখুন।”
“সংস্কার কার্যক্রমের পথ ধরে নির্বাচনী রোডম্যাপে উঠবে দেশ। সুতরাং আসুন- আমরা সবাই কাজের মাধ্যমে জনগণের বিশ্বাস-ভালোবাসা অর্জন করি। জনগণের সঙ্গে থাকি। জনগণকে সঙ্গে রাখি,” বলেন তারেক।
নির্দলীয় এই সরকারের সময়ে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের যে আলোচনা চলছে, তা নিয়েও কথা বলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত রহমান।
তিনি বলেন, “কেউ যদি মনে করেন, একটি উন্নত এবং নিরাপদ বাংলাদেশের জন্য আরও নতুন রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন রয়েছে, তাতেও দোষের কিছু নেই। কারণ শেষ পর্যন্ত জনগণই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে তারা কাকে সমর্থন জানাবে কিংবা কাকে সমর্থন দেবে না।
“একারণেই বিএনপি বারবার জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছে। বিএনপি মনে করে, একমাত্র অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই রাষ্ট্র-রাজনীতি এবং রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সঙ্গে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশীদারিত্ব তৈরি হয়।”
সরকার পতনের এক মাস পর রাজধানীতে বিএনপির এই সমাবেশে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ ও ঢাকা জেলা ছাড়াও আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মী যোগ দেয়।
মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে এই সমাবেশ সমন্বয় করেন এ জেড এম জাহিদ হোসেন ও যুগ্ম মহাসচিব হাবিবুন্নবী খান সোহেল। সঞ্চালনা করেন বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ও ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের দুই সদস্য সচিব আমিনুল হক ও তানভীর আহমেদ রবিন।
নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি
তারেক রহমান যখন ঢাকায় সমাবেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সংস্কারের জন্য সময় দেওয়ার কথা বলেন, সেদিনই চট্টগ্রামে এক সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানান।
নগরীর আলমাস মোড়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিএনপি আয়োজিত ‘গণতন্ত্রের শোভাযাত্রা’ পূর্ব সমাবেশে তিনি বলেন, “নির্বাচনমুখী যাবতীয় জরুরি সংস্কারের দায়িত্ব এ সরকারের আছে, বুঝলাম। কিন্তু সব সংস্কার বাস্তবায়নের দায়িত্ব একমাত্র নির্বাচিত সরকারের।
“সুতরাং নির্বাচিত সরকারের কোনও বিকল্প নেই। আপনারা সংবিধান সংশোধনের জন্য পরামর্শ নিতে পারেন, কিন্তু সেই সংবিধান সংশোধন করবে নির্বাচিত পরবর্তী পার্লামেন্ট।”
নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা এবং উপদেষ্টাবৃন্দদের আহ্বান জানাই, যতদ্রুত সম্ভব নির্বাচনমুখী সংস্কার সাধন করুন এবং গণতান্ত্রিক নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ আপনারা ঘোষণা করুন। তাহলে এদেশের মানুষ আশ্বস্ত হবে যে, বাংলাদেশ সত্যিই প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাবে।”
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহর সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব নাজিমুর রহমানের পরিচালনায় সমাবশে বক্তব্য দেন দলের কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আবুল খায়ের ভূঁইয়া, জয়নাল আবদিন ফারুক ও গোলাম আকবর খোন্দকার, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সমন্বয়কারী মাহবুবের রহমান শামীম, কেন্দ্রীয় সহ সম্পাদক মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সরওয়ার জামাল নিজাম এবং সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শাহাদাত হোসেন।
চট্টগ্রাম মহানগরী, জেলা, উপজেলা পর্যায় থেকেও বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মীরা সমাবেশে যোগ দেয়। এতে সংলগ্ন সড়কতগুলোতে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সমাবেশ শেষে শোভাযাত্রা বের হয়।