Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

শিক্ষক দিবসে শিক্ষকদের কথা শুনছে কি কেউ

সকাল সন্ধ্যা এডিটোরিয়াল ডেস্ক
শিক্ষক দিবসে শিক্ষকদের কথা আমরা শুনতে পাচ্ছি কি

“শিক্ষকের কণ্ঠস্বর: শিক্ষায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকার”— প্রতিপাদ্য নিয়ে ৫ অক্টোবর বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালিত হচ্ছে। বিশ্ব শিক্ষক দিবসকে কেন্দ্র করে দেশের প্রবীণ-নবীন শিক্ষকদের কাছে সকাল সন্ধ্যা জানতে চেয়েছে দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক আর শিক্ষা নিয়ে তাদের ভাবনা ও প্রত্যাশার কথা। তাঁদের কাছে প্রশ্ন ছিল, ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের পর শিক্ষাঙ্গনগুলোতে শিক্ষক নিপীড়নের ঘটনা এবং এই বাস্তবতা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে, প্রশ্ন ছিল আজকের বাংলাদেশে কেমন শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক চান তারা আর বিশ্ব শিক্ষক দিবসে শিক্ষক হিসেবে তাঁদের প্রত্যাশা কী?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রতিহিংসাপরায়ণতা শিক্ষাঙ্গনেও দেখা দিয়েছে। শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করে পদত্যাগপত্র লিখিয়ে নেবার ঘটনা নেহায়েত কম ঘটছে না। দলবাজ ও দুর্নীতিবাজ বলে অভিযুক্ত হয়ে শিক্ষকরা কেবল যে পদত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন তা নয়, লাঞ্ছিতও হচ্ছেন। নারী শিক্ষকরাও অপমানের শিকার হচ্ছেন। এসবের পেছনে কেবল যে রাজনীতি আছে তা নয়, কোথাও কোথাও ব্যক্তিগত শত্রুতাও কাজ করছে। কোনও শিক্ষক যদি দলবাজি বা দুর্নীতি করে থাকেন, হতে পারে অভ্যুত্থানের বিরোধিতাও করেছেন কেউ কেউ, তবে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করবার বৈধ পথ-পদ্ধতি রয়েছে; শিক্ষার্থীরা যদি সে পথে না গিয়ে সহিংস পথ ধরে তবে তো তারা আর শিক্ষার্থী থাকে না, ভিন্ন কিছুতে পরিণত হয়। অপরদিকে একজন শিক্ষক যদি তাঁর নিজের শিক্ষার্থীদের দ্বারাই লাঞ্ছিত-অপমানিতই হন, তবে তাঁর জ্ঞান-বুদ্ধি যতোই থাকুক না কেন তিনি তো আর শিক্ষক থাকেন না, একেবারেই সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন। শিক্ষকরা কেবল পদমর্যাদার কারণেই শিক্ষক হন না, এমন কি শুধু নিজেদের জ্ঞানগরিমার জন্যও নয়; শিক্ষককে শিক্ষক হতে হলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সম্মান প্রাপ্তিরও প্রয়োজন হয়। ওই সম্মানের ভেতর শ্রদ্ধাবোধও থাকে।

একজন শিক্ষককে আক্রমণ করাটা কিন্তু কেবল ব্যক্তিকে লাঞ্ছিত করা নয়, গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকেই আক্রমণ করা। শিক্ষার মান প্রধানত নির্ভর করে শিক্ষকতার মানের ওপর, শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক যদি অনিরাপদ থাকেন তবে মেধাবানরা তো শিক্ষক হতে চাইবেন না। শিক্ষকরা এমনিতেই অন্যান্য পেশাজীবীদের তুলনায় বঞ্চিত, তদুপরি শ্রদ্ধা জিনিসটা যদি ক্ষয়প্রাপ্ত হয় তাহলে শিক্ষকতার এখন যে আকর্ষণটুকু আছে সেটুকুও আর অবশিষ্ট থাকবে না। আরও একটা ব্যাপার লক্ষ্য করবার মতো। শিক্ষক-লাঞ্ছনা কিন্তু কওমী মাদ্রাসা এবং ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে ঘটছে না। ঘটছে কেবল মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায়। ওই ধারা নানাভাবে বিপদগ্রস্ত। সেখানে কারিকুলাম, সিলেবাস, পাঠ্যপুস্তক ইত্যাদি নিয়ে বহু রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে যেগুলোর অধিকাংশই কোনও সুফল বয়ে আনে না; অনেকক্ষেত্রে বিপরীত ফলই পাওয়া যায়।

রাষ্ট্র-শাসকরা এনিয়ে তেমন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নন, কারণ তাঁদের সন্তানরা মূলধারায় পড়তে আসে না, ইংরেজি মাধ্যমই তাদের স্থির ও নিজস্ব ঠিকানা; আরেকটি ঠিকানাও ভেতরে ভেতরে থাকে, সেটা স্বদেশী নয়, বিদেশী বটে। আমরা অনেক কাল ধরে ঔপনিবেশিক শাসনাধীন ছিলাম, বঞ্চিত ছিলাম ক্ষমতা থেকে; তাই ক্ষমতা পেলেই আত্মহারা হয়ে পড়ি। অপব্যবহার শুরু করি ক্ষমতার। তাছাড়া ক্ষমতার নিজস্ব একটা স্বভাবও আছে। সেটা হলো প্রযুক্ত হওয়া। ক্ষমতা যদি প্রদর্শিত হতেই ব্যর্থ হলো তবে সে আবার ক্ষমতা কিসের? কোন জোরে? একবার রক্তের স্বাদ পেয়েছে যে বাঘ সে কি ওই স্বাদ ভুলতে পারে? শিক্ষাঙ্গনে ক্ষমতা প্রদর্শনের সঙ্গে আমাদের ক্ষমতা-বঞ্চনা এবং ক্ষমতার স্বভাব দু’টোই জড়িত রয়েছে।

শিক্ষককে তাঁর আত্মমর্যাদা নিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে সৌর্হাদ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। শিক্ষকের রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতেই পারে। সেটা তাঁর ব্যক্তিগত। তবে দলকানা হবার ফলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যকার সম্পর্ক যেন বৈরিতার সৃষ্টি না করে সেদিকে শিক্ষককে হতে হবে নিষ্ঠাবান এবং আদর্শ স্থানীয়।

শিক্ষকদের বেতন-ভাতার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অপরাপর প্রতিষ্ঠানের সমপরিমাণে না হলে তাঁদেরকে বিকল্প আয়ের পথানুসন্ধান করতে হয়। যেমন কোচিং সেন্টার, প্রাইভেট পড়ানো ইত্যাদি। বহুল প্রচারিত কথা যে পেশার জগতে শ্রেষ্ঠ পেশা হচ্ছে শিক্ষকতা। সেটা মান্য করা দরকার, রাষ্ট্রের যেমন, তেমনি শিক্ষকদেরও। মেধাবীরা যাতে শিক্ষকতার পেশায় আকৃষ্ট হয় সেই উদ্দীপনা সৃষ্টিতে রাষ্ট্রকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক

সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের উপর নিপীড়নের যে চিত্র এবং জোর করে পদত্যাগপত্র নেওয়ার যে প্রবণতা আমরা গণমাধ্যমে লক্ষ্য করেছি তা কোনভাবেই কাম্য নয়। শিক্ষকদের যদি কোনও স্খলন থেকে থাকে তবে তা নিরসনের জন্য যথাযথ প্রক্রিয়া আছে, যথাযথ কর্তৃপক্ষ আছে। কিন্তু শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষকদের হেনস্থা কোনওভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এ ধরনের দুঃখজনক ঘটনা আমাদের সকলের মাথা হেঁট করে দেয়। শিক্ষক সমাজকেও আজ চিন্তা করতে হবে যে কেন আমাদের শিক্ষার্থীরা এমন আচরণ করছে। শিক্ষকমণ্ডলী ছাত্রছাত্রীদের পথপ্রদর্শক। তাই শিক্ষকদেরই ভেবে দেখতে হবে যে ছাত্রছাত্রীরা কেন এমন অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে।

শিক্ষার আত্যন্তিক উদ্দেশ্য হলো, শিক্ষার্থীদের মাঝে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটানো। আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই স্বর্ণালী সময় আমাদের শিক্ষাজীবন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক হতে হবে মানবিকতা ও আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ একটি সুসম্পর্ক। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষককে শ্রদ্ধা করবে এবং একইসাথে শিক্ষকবৃন্দও ছাত্রছাত্রীদের শ্রদ্ধা করবেন। পারষ্পরিক এই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্ক যদি স্থাপন করা যায় তবে আমরা সত্যিকারভাবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশের সুষ্ঠু ভবিষ্যৎ নির্মাণের কারখানা হিসেবে দেখতে পাব। একজন আদর্শ শিক্ষকই প্রকৃত অর্থে জাতি, রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্মাতা। এটি আমরা যত দ্রুত উপলব্ধি করব সমাজের জন্য ততই মঙ্গল। একজন শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে প্রথামাফিক শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি তাঁর চাল-চলন, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-ব্যবহার, কর্তব্যপরায়ণতা, সময়ানুবর্তিতা, সর্বোপরি সৎ জীবনচর্চার এমন একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন যাতে শিক্ষকতা যে একটি মহান পেশা সেটি যেন সমাজে দৃশ্যমান হয়।

বিশ্ব শিক্ষক দিবসে আমি দেশের সকল শিক্ষকের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই। এই দিবস উদযাপনের উদ্দেশ্য হলো শিক্ষকের মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধির বিষয়ে আমরা যেন সচেতন থাকি। জ্ঞান অনুশীলনের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলার কোনও বিকল্প নেই। এটি যেন আমরা বিস্মৃত না হই। সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষক নিপীড়নের যে দুঃখজনক ঘটনা দেখা গেছে সেখান থেকে সংশোধনমূলক শিক্ষা নিয়ে শিক্ষক, অভিভাবকমন্ডলী, শিক্ষাপ্রশাসন সর্বোপরি সরকারের আরও জোরালো ভূমিকা আমরা প্রত্যাশা করি।

ড. মাহবুব উল্লাহ

ড. মাহবুব উল্লাহ

অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক

‘শিক্ষক নিপীড়ন’ হিসেবে যে শব্দবন্ধটি ব্যবহার করা হচ্ছে এটি এভাবে ব্যবহার করার সুযোগ নেই। ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা সারা বাংলাদেশে দেখলাম পুলিশরা থানা ছেড়ে পালিয়ে গেল, তারপর অনেক কর্মকর্তা কর্মরত অবস্থা থেকে চলে গেল। এই ঘটনাগুলো তো আমরা দেখেছি। প্রথমত, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেসব ঘটনা ঘটেছে, বিশেষ করে প্রধান শিক্ষক, প্রিন্সিপালদেরকে হেনস্থা করার ঘটনা, সেসব খুবই দুঃখজনক। কিন্তু একইসঙ্গে এটাও দেখতে হবে যে, এই শিক্ষকরা গত ১৬ বছর কী করেছেন এবং তাঁরা ফ্যাসিবাদের সহযোগী ছিলেন কি না। এইসব বিষয়গুলো পরিষ্কার হওয়া দরকার। দ্বিতীয়ত, আমরা জানি আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যায়না। এটা উচিৎ না। যেভাবে হেডমাস্টার, প্রিন্সিপাল বা অনেক শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে এটা আইনানুগ পদ্ধতি নয়। কিন্তু আমাদের এটাও বুঝতে হবে একটা বিশাল গণঅভ্যুত্থানের পর যে সময়টা আসে সেখানে সবকিছু খুব সাজানো-গোছানোভাবে চলে না। সে সময় মানুষের মধ্যে আবেগ, ক্ষোভ এগুলো খুব তীব্র থাকে। এসব কারণেই এমন ঘটনাগুলো ঘটেছে। তবে এগুলো না ঘটলেই ভালো হতো। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই ভালো হতো। তাছাড়া আমি কখনো দেখিনি বা শুনিনি যে দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাইস চ্যান্সেলর, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, ডিন, প্রভোস্ট এঁরা সবাই নিজ নিজ পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেন, দূরে সরে যান, পালিয়ে যান। এমন ঘটনা অতীতে কখনও ঘটেনি। আমার মনে হয়, দীর্ঘদিন ধরে ফ্যাসিবাদী শাসনের সহযোগী হিসেবে থাকার কারণে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের অপরাধী ভাবছেন এবং সেই লজ্জা থেকেই তারা চলে গিয়েছেন।

শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কন্নোয়নে বাইরের কেউ তো কিছু করতে পারবে না। শিক্ষককে এমন শিক্ষক হতে হবে যাতে তিনি সমাজে একজন আদর্শবান শিক্ষক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। আমরা জানি, ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকদের অনুসরণ করে থাকে, সেটা কেবল জ্ঞানচর্চায় নয়, জীবনচর্চাতেও। একজন শিক্ষক সৎ জীবনযাপন করলে এবং আদর্শবান হলে কোনও শিক্ষার্থী তাঁর সঙ্গে খারাপ আচরণ করবে এটা আমার মনে হয় না। আসলে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টা বেসিক্যালি শিক্ষকের ওপর বর্তায়, তারপর ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক ও বৃহত্তর সমাজের ওপর। কিন্তু আমরা তো দেখছি শিক্ষকরা নিজেরাই নানারকম রাজনীতি-দলাদলিতে জড়িয়ে সমাজে শিক্ষকের যে অবস্থান ও মর্যাদা ছিল সেটা হারাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলতে পারি, শুনেছি সেখানকার অনেক শিক্ষক এতটাই দলকানা হয়ে পড়েছিলেন যে এখন আর ছাত্ররা তাদের ক্লাসে যেতে চাননা।

বিশ্ব শিক্ষক দিবসে প্রত্যাশা তো অনেক। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষা বিষয়টাই খুবই অবহেলিত। দিন দিন শিক্ষার মান অবনত হচ্ছে, নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। অথচ, শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য ভালো কোনও পদক্ষেপ দৃশ্যমান হচ্ছে না। এটা অত্যন্ত দুঃখের একটা বিষয়। শিক্ষার মান, শিক্ষার পরিবেশ এসবের জন্য বিশাল সামাজিক পুনর্গঠন দরকার। এই পুনর্গঠনের জন্য সত্যিকারের সামাজিক সংগ্রাম প্রয়োজন। সর্বোপরি শিক্ষার জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শিক্ষকের বেতন, মর্যাদা যথাযথ হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কেবল ক্লাস-লেকচারের কেন্দ্র হলে চলবে না, সেখানে মানসম্মত গবেষণা করতে হবে এবং অবশ্যই শিক্ষক নিয়োগকে দলীয় ভোটার রিক্রুটের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে, যোগ্য প্রার্থীদেরই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। আজ শিক্ষাঙ্গনের যে দুর্গতি চলছে তার একটা বড় কারণ অযোগ্যদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া। প্রত্যাশা থাকবে আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলো এসব থেকে মুক্ত হবে।

আব্দুল হাসিব চৌধুরী

আব্দুল হাসিব চৌধুরী

প্রো-ভিসি, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও প্রতিষ্ঠান এই তিনের মধ্যেই টানাপোড়েন রয়েছে। কিন্তু মিডিয়ায় বেশি প্রচার পেয়েছে শিক্ষার্থীদের দ্বারা শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনা। সারাদেশে কয়েক লাখ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, লক্ষ লক্ষ শিক্ষক রয়েছেন। শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে অল্প কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে। কোনও শিক্ষক যদি অপরাধ করে থাকেন তার জন্য দ্রুত ও যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাহলে আর শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনা ঘটবে না।

শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর মধ্যে মিথস্ক্রিয়া শিক্ষার পরিবেশের সহায়ক হতে হবে। এই সম্পর্ক শিক্ষার্থীর শেখার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ লাভের অভিজ্ঞতার উপর অপরিসীম প্রভাব ফেলে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা— প্রত্যেক পর্যায়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক একই রকম থাকে না। আজকের বাংলাদেশে, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে আস্থা ও মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হোক এটাই আমি চাই। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ও স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, বৈশিষ্ট্য, অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস রয়েছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে আস্থা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাস্তবতার ভিত্তিতে যা যা করণীয় তা-ই করতে হবে। প্রথম কাজ হবে এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করা।

বিশ্ব শিক্ষক দিবসে প্রত্যাশা করি, বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে জিডিপির ন্যূনতম ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হবে এবং প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করা হবে।

সাঈদ ফেরদৌস

সাঈদ ফেরদৌস

অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে জোর করে পদত্যাগ করানোর যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেসব দুঃখজনক, অবশ্যই দুঃখজনক, কিন্তু প্রায় অবধারিতই ছিল বলে মনে হয়। দীর্ঘ সময় ধরে স্বৈরশাসন থাকার ফলে আমরা সবাই কমবেশি স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতায় আক্রান্ত হয়েছি, স্বৈরাচারী মানুষে পরিণত হয়েছি, স্বেচ্ছাচারী হয়েছি— কমবেশি শিক্ষক, শিক্ষার্থী সকলেই এবং উভয়ের মাঝে সম্পর্কেরও অবনতি ঘটেছে। তারই একটা প্রতিফলন আমরা এই জোর করে পদত্যাগ করানোর ঘটনাগুলোয় দেখলাম।

এখানে দুটো দিক আছে। একটা হলো, শিক্ষাঙ্গনে জবাবদিহি একেবারেই ছিলনা, নিচ থেকে শুরু করে একেবারে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্তই তা অনুপস্থিত ছিল। ফলে, শিক্ষকদের একাংশ এই জবাবদিহিহীনতার সুযোগ নিয়েছেন, অবশ্যই সব শিক্ষক নন। হয়ত এসব কারণেও কিছু শিক্ষকদের ওপর শিক্ষার্থীদের রাগ, ক্ষোভ ছিল। এই ক্ষোভ কতখানি হলে শিক্ষার্থীরা একজন শিক্ষককে জোর করে বসিয়ে শাদা কাগজে পদত্যাগের সই করিয়ে নেওয়া যায় সেটা ভাবতে হবে। এটা যে যথাযথ পদ্ধতি নয় সেটা ভাবারও হয়ত সময় ছিলনা। শিক্ষাঙ্গনে জবাবদিহিহীন একটা সংস্কৃতিতে যে বিপুল অনিয়ম, দুর্নীতি হয়েছে সেসবও শিক্ষার্থীদের ক্ষুব্ধ করে থাকতে পারে। আরেকটা দিক হলো, এখানে আরেক দল মানুষ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছেন। যে শিক্ষকরা ওই প্রধান শিক্ষকের পদে বসতে চান কিংবা উপাচার্যের পদে বসতে চান সেইসব শিক্ষকরা হয়ত ছাত্রছাত্রীদেরকে উসকে দিয়েছেন। যেসব ঘটনা ঘটেছে সবখানে যে লাঞ্ছনার শিকার হওয়া শিক্ষকরা সত্যিই দোষী ছিলেন বা অপরাধে যুক্ত ছিলেন এমন কিন্তু নয়। আমি শুনেছি, আওয়ামী আমলে গভর্নিং বডির সঙ্গে বিবাদ ছিল, তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে শিক্ষক আদালতে লড়ে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই শিক্ষককের বিরুদ্ধে ক্ষোভ মেটাতে এখন অন্য ব্যক্তিদের দাঁড় করিয়ে তাকে হেনস্থা করা হয়েছে। আমি বলতে চাচ্ছি, একটা সুযোগ সন্ধানী পক্ষ হয়ত এমন কিছু ঘটনার নেপথ্যে কাজ করে থাকতে পারে।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সব শিক্ষাঙ্গনে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে হবে, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় বা কোনও শিক্ষাঙ্গনে বা সমাজে প্রতিহিংসার রাজনীতি দেখতে চাই না। শিক্ষাঙ্গনের এমন প্রতিটি ঘটনা কেইস-বাই-কেইস একটা একটা করে তদন্ত করতে হবে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে সেগুলো খতিয়ে দেখতে হবে। তিনি দোষী হলে যথাযথ শাস্তি দিতে হবে আর দোষী না হলে যারা জোর করেছেন অন্যায় করেছেন তাদের বিরুদ্ধে উল্টো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

আজকের বাংলাদেশে আমরা কেমন শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক চাই। একটা গণঅভ্যুত্থান ঘটলে কী ঘটে সেটা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। আমাদের তাত্ত্বিক ধারণা ছিল কিন্তু এবার আমরা সেটার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এবার এমন একটা অভ্যুত্থান হয়েছে যার তুলনায় এখন আর নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানকে যেন অভ্যুত্থানই মনে হচ্ছে না। আরেকটা বিষয় হলো, এখন আমরা যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যা দেখছি, এমনকি অনেক ভাষা, যেগুলো হয়ত আমাদের রূঢ় মনে হচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এখনকার প্রতিবাদীরা, বিপ্লবীরা জেন-জি প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের ভাষা এইটা। এখন এই ভাষার সঙ্গে আমরা কিভাবে নেগোশিয়েট করব সেটা আমাদের ভাবতে হবে। ফলে এসব ভাবনা মাথায় রেখে আমাদেরকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের বিষয়টাও নতুন করে ভাবতে হবে। তবে, সবার আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং শিক্ষকতা থেকে শুরু করে প্রশাসন চালানো সবক্ষেত্রেই একটা নতুন পেশাদারিত্বের মনোভাব তৈরি করতে হবে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের পরষ্পরের প্রতি শ্রদ্ধা। এই পারষ্পরিক শ্রদ্ধাশীল একটা সম্পর্ক যেন শিক্ষাঙ্গনে তৈরি হয় সেজন্য দুই পক্ষকেই কাজ করতে হবে।

একটা সময়ে মনে করা হতো শিক্ষকতা কেবল একটি পেশা নয়, এটি একটা জীবনব্যবস্থা। শিক্ষক হয়ে উঠতে হয়। এই শিক্ষক হয়ে ওঠার বিষয়টা মন থেকেই আসতে হয়। তার মানে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি শুরু করলেই শিক্ষক হওয়া যায় না। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে একজন শিক্ষক হিসেবে আমার প্রত্যাশা থাকবে শিক্ষকতা পেশায় যেন তারাই আসেন যারা মন থেকে শিক্ষক হয়ে উঠতে চান। শিক্ষকতা পেশায়ও আর সব পেশার মতোই যোগ্যতা লাগে, ফলে যোগ্যতার সব মাপকাঠি পূরণ করেই যেন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। শিক্ষকরা যেন যথাযথ প্রশিক্ষণ পান সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের তবু কিছু প্রশিক্ষণ হয় কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণকে খুব বাঁকা চোখে দেখা হয়। এই মানসিকতা দূর করতে হবে। একজন ব্যক্তিকে শিক্ষক হিসেবে তৈরি করার জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক উদ্যোগগুলো নেওয়া দরকার সেসব নিশ্চিত করতে হবে।

শর্মি হোসেন

শর্মি হোসেন

শিক্ষক, ইংরেজি বিভাগ, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

গত সরকারের আমলে সকল পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রচুর দুর্নীতির অভিযোগ আছে। প্রতিষ্ঠানিকভাব উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সেসব অভিযোগ খতিয়ে দেখা উচিত। একইসঙ্গে গণঅভ্যুত্থানের সুযোগ নিয়ে কোনও মহল যেন মব-জাস্টিসের আদলে শিক্ষকদের নিপীড়ন করে পদত্যাগে বাধ্য করতে না পারে সেটা নিশ্চিত করাও প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। সকল শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মতামত প্রকাশের সুযোগ তৈরি করতে হবে ও সেগুলো আমলে নিয়েই নিরাপদ ও বাস্তবসম্মত কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা কার্যকর শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করে। এজন্য শিক্ষার্থী ভর্তি থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রদানের পদ্ধতি ও মূল্যায়ন সবই স্বচ্ছ হওয়া জরুরি।

অগাস্ট ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট ছিল একটি বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণ। একটি বৈচিত্র্যময় সমাজ যেখানে রাষ্ট্রের সকল নাগরিক স্ব-স্ব ক্ষেত্রে নির্বিঘ্নে অবদান রাখতে পারবে। আশাকরি আজকের শিক্ষার্থীরা লক্ষ্যচ্যুত না হয়ে সেই পথে এগিয়ে যাবে।

মুফতি সাঈদ আহমাদ

সিনিয়র শিক্ষক, জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়া, মোহাম্মদপুর, ঢাকা

ছাত্র গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সারাদেশে স্কুল কলেজ মাদ্রাসাগুলোতে যে সমস্ত শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে তাদের অনেকেই বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের সুবিধাভোগী সমর্থক ছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নানা অনিয়ম দলীয়করণ তাদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। তাই সরকার পতনের পর তাদের পদত্যাগের দাবি একটা স্বাভাবিক বিষয় ছিল। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সমাজকে আন্দোলনে অংশগ্রহণেও বাধা প্রদান করা হয়েছে। বিগত সরকার রাষ্ট্রের সমস্ত বিভাগের মতো ‌দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিল। ছাত্র সমাজের আন্দোলন শিক্ষকদের মোকাবেলায় ছিল না ছিল মূলত ফ্যাসিবাদের দোসরদের মোকাবেলায়। এতে প্রকৃত শিক্ষক ছাত্রদের সম্পর্কে টানাপোড়েন হবে না। এমনটাই আমি মনে করি।

আজকের বাংলাদেশে আমরা চাই শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে চমৎকার একটি বোঝাপড়া গড়ে উঠুক। শিক্ষকরা আদর্শবান হোক। এবং শিক্ষার্থীদেরকে আগামী দিনের আদর্শ নাগরিক হিসেবে তাঁরা গড়ে তোলার দায়িত্ব পালন করুক। এজন্য আমি মনে করি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈতিকতার শিক্ষাকে মজবুত করা উচিত। এর মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ সুন্দর হবে। শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষককে আদর্শবান দেখতে চায়, এটা তাদের ন্যায্য দাবি। এটাকে মূল্যায়ন করতে হবে।

বিশ্ব শিক্ষক দিবসে একজন শিক্ষক হিসেবে আমার প্রত্যাশা, আমরা শিক্ষক সমাজ যেন শিক্ষা প্রদানকে একটি মহান দায়িত্বের দৃষ্টিতে দেখি। শিক্ষকতার মহান পেশাকে যেন আমরা কেবল জীবিকা উপার্জনের পেশার দৃষ্টিতে না দেখি। আমাদের আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামীর বাংলাদেশ, আমাদের ভবিষ্যৎ। আমাদের উচিত তাদেরকে সময় দেওয়া। আজকের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে আর শিক্ষকতা কেবল একটা পেশায় পরিণত হয়েছে। আমরা আগামীর বাংলাদেশে এর পরিবর্তন দেখতে চাই।

মোঃ সালাহ উদ্দিন

মোঃ সালাহ উদ্দিন

প্রধান মুহাদ্দিস, মানিকগঞ্জ ইসলামিয়া কামিল মাদরাসা, মানিকগঞ্জ

ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী দিনগুলোতে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানকে টার্গেট করে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে, যা খুবই দুঃখজনক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছাত্রদের ব্যবহার করা হয়েছে। আমি একজন শিক্ষক হিসেবে অনাকাঙ্ক্ষিত এসব ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং তদন্তের মাধ্যমে এগুলোর যথাযথ মীমাংসার দাবি জানাচ্ছি। বর্তমানে ছাত্র ও শিক্ষকদের মাঝে সম্পর্কের টানাপোড়েন অনেকটাই কমে এসেছে। আশা করছি পরিস্থিতি আরও স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সুসম্পর্ক চিরন্তন। জীবনের সকল সম্পর্ক উঠানামা করে কিন্তু ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্ক আজীবন অটূট থাকে। মনে রাখতে হবে, সাহাবায়ে কেরাম সকলেই মহানবীর ছাত্র ছিলেন এবং তারা তাদের মহান শিক্ষক প্রিয় নবীকে নিজেদের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক নিঃস্বার্থ ও অকৃত্রিম হওয়া উচিৎ। বর্তমান সময়ে ছাত্র ও শিক্ষকদের মাঝে সম্পর্কোন্নয়নে সততা নৈতিকতা ও আদর্শিক দৃঢ়তা বাড়াতে এবং কাউন্সেলিং জোরদার করতে হবে।

বিশ্ব শিক্ষক দিবসে একজন শিক্ষক হিসেবে আমার প্রত্যাশা হলো, শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে এবং ছাত্রছাত্রীদেরকে আন্তরিকভাবে পাঠদানের পাশাপাশি নৈতিকতা শিক্ষা দিতে হবে। সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা হলো শিক্ষা ব্যবস্থাকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে এবং উৎপাদনমুখী ও কর্মমুখী শিক্ষা চালু করতে হবে। আদর্শ নাগরিক সৃষ্টির উপযোগী গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষা দিতে হবে। এমন শিক্ষাব্যবস্থা চাই যেন প্রতিটি শিক্ষার্থী যোগ্য ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে। একইসঙ্গে এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে, সিলেবাসে যেন এমন কোনও বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা না হয় যার মাধ্যমে ইসলামবিরোধী মনোভাব তৈরি হতে পারে।

কাব্য কৃত্তিকা

কাব্য কৃত্তিকা

গবেষণা সহযোগী ও প্রভাষক, জেনারেল এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট
ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ

বিপুল সংখ্যক শিক্ষকের দলীয় ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ এবং ফলাফলস্বরূপ পেশাগত দায়িত্ব আমলে না নিয়ে অগণতান্ত্রিক জবাবদিহিহীন নিপীড়নমূলক শিক্ষাঙ্গন নির্মাণে যেসকল শিক্ষক সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন তাদের অনেককেই আমরা অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের রোষানলে পড়তে দেখেছি। কিন্তু এ সকল ঘটনায় ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নব্য ক্ষমতায়িত হওয়া শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রকাশের যে আক্রমণাত্মক ভঙ্গি আমরা দেখি তা আমাদের নতুন করে ভয় পাইয়ে দেয়। যেনবা, ক্ষমতা বদলের মধ্য দিয়ে নতুন মুখগুলো পুরনো চর্চাই শুরু করলেন। শুধু স্বৈরাচারী রেজিমের সুবিধাভোগী শিক্ষকেরাই যে আক্রমণের শিকার হলেন বাস্তবতা এত সরল-ও নয়। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠনের লক্ষ্যে কারিকুলাম সংস্কারের যে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ শুরু হচ্ছিল সেখানে আমরা নতুন আরেকটি বাস্তবতা লক্ষ্য করলাম, জুলাই-আগস্ট ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে শিক্ষার্থীদের পক্ষে থাকা শিক্ষকদেরও আমরা বিবিধ আক্রমণের শিকার হতে দেখলাম। আক্রমণের ধরন আমাদের চিরচেনা সেই ট্যাগিং ও ট্যাগিং পরবর্তী লিঞ্চিং। এই পরিস্থিতি অবশ্যই উদ্বেগজনক এবং যে কোনও শিক্ষকের অনিরাপদ বোধ করবার জন্য যথেষ্ট। একটি নিরাপদ, দরদী, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক শিক্ষা কাঠামো ও গণতান্ত্রিক শিক্ষা পরিবেশ নির্মাণে উদ্যোগী হওয়া এই বাস্তবতা থেকে উত্তরণের জন্য সহায়ক হবে বলে আশা রাখি।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়েই জ্ঞান সঞ্চারিত এবং উৎপাদিত হয়, তাই বর্তমান বাংলাদেশে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আন্তঃসম্পর্ক পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ সম্পন্ন ও জ্ঞান আদান-প্রদানমূলক হবে সেই প্রত্যাশা রাখি। শিক্ষকের পেশাদারি দায়িত্ব সততার সাথে পালন করা ও পন্ডিতিভাব ব্যাতিরেকে শিক্ষার্থীদের সাথে যুক্ত হবার প্রচেষ্টায় নিজেকে লিপ্ত রাখা ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সহায়ক হবে। অপরদিকে, শিক্ষার্থীদের চিন্তাশীল হওয়া, প্রতিহিংসার মনোভাব থেকে বের হয়ে তথ্য যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া, আইনী উপায়ে ন্যায়বিচার চাওয়া ও সার্টিফিকেট প্রাপ্তির উদ্দেশ্য থেকে বের হয়ে এসে উৎসুক মন নিয়ে পড়াশোনা-গবেষণার সাথে যুক্ত থাকা নিঃসন্দেহে উভয়ের জন্যই প্রেরণাদায়ক হবে।

রাষ্ট্রকর্তৃক বাংলাদেশের শিক্ষকদের সঠিক মূল্যায়ন করা এখন সময়ের দাবি। বৈষম্যবিরোধী নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের অংশ হিসেবে সর্বস্তরের শিক্ষকদের জন্য অভিন্ন ও স্বতন্ত্র বেতনকাঠামো প্রণয়ন করা হোক। বিদ্যায়তনিক পরিসরে স্বাধীনভাবে পাঠদান ও গবেষণা করার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয় এমন সকল একাডেমিক স্বাধীনতা পরিপন্থী আইন-কানুন বাতিল করা হোক। মুক্তভাবে শিক্ষক তার পেশাগত দায়-দায়িত্ব পালন করতে পারে এমন পরিবেশ নির্মিত হোক বাংলাদেশে, বিশ্ব শিক্ষক দিবসে এটুকুই প্রত্যাশা রইল। শিক্ষকদের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।

তাহমিনা আফরোজ

তাহমিনা আফরোজ

সহকারী শিক্ষক, নেভি এ্যাংকরেজ স্কুল এন্ড কলেজ, খুলনা

সৌভাগ্য যে আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিপীড়নের মতো অপমানজনক ঘটনা ঘটেনি। আর যেসব প্রতিষ্ঠানে এমন ঘটনা ঘটেছে তা অবশ্যই অনুচিত কাজ। রাজনৈতিক মতাদর্শ যাই হোক, শিক্ষক শিক্ষকই। এহেন অপমান তাঁর প্রাপ্য নয়। প্রশাসনিক পদ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নেবে, শিক্ষার্থীরা নয়। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ জরুরি।

শিক্ষক শিক্ষার্থীর সম্পর্ক ভয়ের নয়, চাপিয়ে দেওয়ার‌ নয়, একে অপরকে বুঝবে এমন হওয়া উচিত। জেনারেশন গ্যাপ আছে, সেটা‌ দূর করতে হবে শিক্ষককে। শিক্ষার্থীর সময়ে নিজেকে দাঁড় করিয়ে তাদেরকে বুঝতে হবে, তখনই একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীকে যথাযথ গাইড করতে পারবেন। আমাদের সময়ে আমরা কী করেছি, কী ভেবেছি, সেটাই ঠিক আর এখন শিক্ষার্থীরা যা করছে সব ভুল এমন ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। শিক্ষার্থীকে স্পেস দিন, ক্লাসে ও ক্লাসের বাইরে প্রশ্ন করার অধিকার দিন, সময়ের দায়িত্ব ওরা ঠিক নিতে শিখে যাবে।

বিশ্ব শিক্ষক দিবসে, প্রত্যাশা তেমন কিছুই নেই। কারণ সম্মান শ্রদ্ধা চেয়ে পাওয়া যায় না। এই জাতি মানুষকে শ্রদ্ধা করতে শিখুক।