আমরা, স্কুলের বন্ধুরা যখন আড্ডায় বসি, সে আড্ডার অনেকখানি জুড়ে থাকে আমাদের শিক্ষকদের স্মৃতি।
সব স্মৃতিই যে মধুর, ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই তেমন নয়। আমাদের গল্পের অনেকখানি জুড়ে আসলে থাকে জব্বার স্যার, আলী স্যার বা শামসুদ্দিন স্যারদের নানা রকম পাগলামোর গল্প। কিন্তু তাঁরা যত পাগলামিই করুন না কেন, এখনও একটা ব্যাপারে আমাদের মধ্যে কোনও দ্বিধা নেই, তাঁরা আমাদের শিক্ষক— তাঁদের চোখে চোখ রেখে কথা বলার দুঃসাহস কোনওদিন করা সম্ভব ছিল না। সেই ছোট্টবেলাতেই কাজী কাদের নেওয়াজের একটি কবিতা পড়িয়ে আমাদের মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, শিক্ষক মানেই শ্রদ্ধাভাজন, তাঁকে সেই শ্রদ্ধাটা দিতে হবে। তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ, ধর্মীয় দর্শন অথবা ব্যক্তিগত আচরণ আমাদের কাছে কোনওদিনই বিবেচ্য ছিল না।
পৃথিবীর সব দেশে হয়ত বিষয়টা ঠিক এ রকম নয়। পশ্চিমের অনেক দেশে শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীর আচরণ অনেকটা বন্ধুর মতো, আমাদের দেশের মতো শ্রদ্ধাবনত থাকার ব্যাপার নেই সেখানে। কিন্তু একটা বিষয় বিশ্বজনীন, তা হলো শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কের মধ্যে থাকতে হবে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতিফলন। শিখন ও শিক্ষণ প্রক্রিয়ার স্বার্থেই এটা জরুরি।
দুঃখের বিষয়, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে এই আস্থার সংকটটাই হয়ে উঠেছে প্রবল। দেশে একটা বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন এসেছে; ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ রকম একটা পরিবর্তনের পর রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটা পক্ষ চাপের মুখে থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে সংগঠিত এ আন্দোলনের সাফল্যের পর থেকে সেই রাজনীতিবিদদের বাদ দিলে বিস্ময়করভাবে সবচেয়ে চাপের মুখে আছেন শিক্ষকরা।
স্কুলের শিক্ষার্থীদের একটা দল অফিসকক্ষে ঢুকে পড়ে প্রধান শিক্ষককে বাধ্য করছেন পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে, কলেজের শিক্ষককে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে ধমক দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনকে তার অফিসেই অপমান করা হচ্ছে— এমন ছবি হর-হামেশাই চোখে পড়ছে।
সরকারের পক্ষ থেকে কেউ কেউ মিনমিনে কণ্ঠে বলছেন বটে, এ ধরনের মবোক্রেসি গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই মবোক্রেসিকে নিরুৎসাহিত করার মতো কোনও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বরং উল্টোটাই সত্যি, মিডিয়ায় অনেকেই ইনিয়ে বিনিয়ে এসব পদক্ষেপকে সমর্থন করছেন, এর শিকার হওয়া শিক্ষকদেরই দায় দেখছেন বেশি! আর প্রশাসনের পক্ষ থেকেও এমন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, যাতে করে এ ধরনের ঘটনাকে এক অর্থে উৎসাহিতই করা হচ্ছে।
শুধু আমার কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই তো শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে, বিধি অনুসরণের তোয়াক্কা না করে নির্বাহী আদেশে প্রায় অর্ধশত শিক্ষককে ক্লাস-পরীক্ষার মতো একাডেমিক কার্যক্রমসহ নানা দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে । এই শিক্ষকদের প্রায় সকলেই বিগত সরকারের সমর্থক ছিলেন, তবে সকলেই যে সেই সূত্রে লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, এমন নয়। নীরব সমর্থনের কারণেও শাস্তি পেতে হচ্ছে অনেককেই।
এ ধরনের ঘটনা শেষ পর্যন্ত কোন দিকে গড়ায়, তার খানিকটা আভাসও কিন্তু পাওয়া গেছে এরই মধ্যে। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পক্ষে এবং বিগত সরকারের বিপক্ষে অত্যন্ত সরব ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই এমন দুজন শিক্ষককে সরকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েও সেটা প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছে শিক্ষার্থীদেরই একটি দলের দাবির মুখে। নগর পুড়লে যে দেবালয়ও রক্ষা পায় না—চাপের মুখে বিরুদ্ধ মতকে শায়েস্তা করার পদ্ধতি সমর্থন করলে ভবিষ্যতে ভিন্ন মতের চাপে নিজেদেরও পিষ্ঠ হওয়ার পথ উন্মুক্ত করা হয়। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের অভিজ্ঞতা থেকে এই শিক্ষাটুকু অন্তত নেওয়া উচিৎ ছিল।
এ ধরনের ঘটনার জন্য খানিকটা দায় তো অবশ্যই নিতে হবে শিক্ষকদের। প্রধান দায়, শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীর সামনে সেই আস্থার জায়গাটা তৈরি করতে না পারার। তাঁরা সেটা পারেননি বলেই তাঁদেরই শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ সংঘবদ্ধ হয়ে উঠছেন তাঁদের বিপক্ষে। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক এমন সরলরৈখিক নয় বলেই মনে হয়।
ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে এই আস্থার সংকটটা একপাক্ষিক নয়, এখানে দায় দুপক্ষেরই আছে। শিক্ষকদের বিপক্ষে শিক্ষার্থীদের অভিযোগের যুক্তিটা অনেক ক্ষেত্রেই হচ্ছে এ রকম, অভিভাবক হিসেবে তাঁদের পাশে দাঁড়াননি শিক্ষকরা। এটা যদি তাঁদের অধিকার হয়ে থাকে, তাহলে মনে রাখা দরকার, প্রত্যেক অধিকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো দায়িত্ববোধ। ‘অভিভাবক’দের প্রতি সেই দায়িত্ববোধটুকু দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন তাঁরাও।
শুরুতে যে গল্প বলেছিলাম, সেই গল্পের শিক্ষকরাও যে সবাই খুব দায়িত্ববান ছিলেন, এমন নয়। কিন্তু আমাদের প্রজন্মের শিক্ষা অনুযায়ী আমরা শিক্ষকের দর্শন নিয়ে প্রশ্ন করতে শিখিনি, শিখেছি তাঁদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে।
এখন শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের যে সংকট সেখানে আসলে দুই পক্ষেরই দায় আছে। কিংবা, হয়ত আছে তৃতীয় কোনও পক্ষেরও, যারা চেয়েছেন এই সংকটটা তৈরি করতে। নইলে দুর্নীতিগ্রস্ত আমলা কিংবা ব্যবসায়ীদের রেখে শিক্ষকদেরই বা কেন টার্গেট করা হবে?
বিশ্বজুড়ে শিক্ষকদের প্রতি সম্মান দেখাতে ইউনেস্কোর উদ্যোগে এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে— ‘‘শিক্ষকের কণ্ঠস্বর: শিক্ষায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকার।’’
শ্রেণিকক্ষে ও তার বাইরে শিক্ষকদের কণ্ঠস্বরই পথ দেখাবে, এমন আশা যদি করতে হয়, তাহলে শিক্ষকদের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করার প্রক্রিয়াটি আগে বন্ধ করতে হবে যে কোনও মূল্যে।
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected]