ব্যাংক ও জ্বালানি খাত দেশের অর্থনীতির ফুসফুস, যা এখন রোগাক্রান্ত; তবে প্রস্তাবিত বাজেটে তা সারতে কোনও বার্তা নেই বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি এও বলেন, সরকারের কাছে এখন সাধারণ মানুষের গুরুত্ব নেই, গুরুত্ব প্রভাবশালীদের।
সোমবার ঢাকার মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টার ইনে ‘জাতীয় বাজেট ২০২৪-২৫ ও বিরাজমান পরিস্থিতি, অসুবিধাগ্রস্ত মানুষের প্রাপ্তি’ শীর্ষক এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এমন অভিমত ব্যক্ত করেন ড. দেবপ্রিয়।
মিডিয়া ব্রিফিং আয়োজন করে বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তির সম্মিলিত উদ্যোগ বাংলাদেশে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, যার আহ্বায়ক এই অর্থনীতিবিদ।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “ক্ষমতা এবং তা বাস্তবায়নে যে রাজনীতি হচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে আমার পিছিয়ে পড়া মানুষের পক্ষে যাচ্ছে না। বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু সেগুলো মানুষের জন্য হচ্ছে না, হচ্ছে কিছু ব্যক্তির জন্য। ব্যাংক এবং জ্বালানি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল আমাদের জন্য এবার। একদম শরীরের ফুসফুসের মতো। কিন্তু এগুলো মেরামতের কোনও কথা কিন্তু বাজেটে নেই।
“ব্যক্তি প্রভাব বাড়াতেই এগুলো মেরামতে মনোযোগ নেই সরকারের। কারণ, তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে সাধারণ মানুষ নয়, গুরুত্বপূর্ণ সেই প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। তারা ঠিক করছে কী করতে হবে, আর কী করা যাবে না। সাধারণ মানুষের ভালো খারাপ উপেক্ষিতই থেকেই যাচ্ছে।”
ড. দেবপ্রিয় বলেন, “এখন যেই বাজেট দেওয়া হলো, তাও কি বাস্তবায়িত হবে—এটাই তো প্রশ্ন। যতটুকু আছে তাও যদি বাস্তবায়ন করতে হয়, তাহলে জবাবদিহিতা এবং সুশাসনের বিকল্প নেই। জবাবদিহিতা নিশ্চিতে আইনে পরিবর্তন আসতে পারে।”
প্রেস ব্রিফিংয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, “আয়করে কোথায় ছাড় আছে, সেটা বাজেটে বলা হয়েছে। বড়ভাবে ছাড় কমানো হয়েছে পরোক্ষ করে। গার্মেন্টস, জ্বালানি, মাইক্রো ক্রেডিটের মতো প্রত্যক্ষ করের ছাড়ের ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, আগামীতে কী করা হবে- এই বিষয়েও দিকনির্দেশনা নাই। আয়করের ছাড়ের ব্যপারে কোনও পদক্ষেপও নেই।”
কালো টাকা সাদা করার বিষয়টি নিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে উল্লেখ করে তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, “বলা হয়েছে ১৫ শতাংশ নগদ অর্থ দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করা যাবে। কিন্তু গুলশান এলাকায় ফ্ল্যাট কিনলে ২.৩৮ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে আপনি বের হয়ে যেতে পারবেন। পুরো বৈধ হবে, একইসঙ্গে দেখা যাচ্ছে ১৫ শতাংশ নয় ২-৩ শতাংশ দিয়ে আপনি বের হয়ে যেতে পারবেন। একইসঙ্গে সম্পূর্ণরূপে ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছে। কাউকে কেউ কোনও প্রশ্ন করতে পারবে না। এটা মানা যায় না।
“বাজেটে অর্থনৈতিক অবস্থা পুনঃরুদ্ধারের কথা বলা হয়েছে। আমরা খুবই আশাবাদী। এর থেকে চমৎকার স্বপ্ন আর হয় না। কিন্তু এটা বাস্তবায়নে কোনও দিকনির্দেশনা নেই। ঘুর্ণিঝড় রেমালে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। যে কারণে আমরা অর্থনৈতিক সংকটে পড়লাম, সেটা ভালোভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা বলে বের হয়ে যাওয়া হয়েছে। ব্যাংকিং সেক্টর, সুশাসন নিয়ে আলোচনা নাই। বাজারে অনিয়ম, অর্থপাচার রোধে কী হবে, দায় দেনার ক্রাইসিস চিহ্নিত করা হয়নি।”
সামষ্ঠিক অর্থনীতিতে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠিকে প্রাধান্য দেওয়ার আহ্বান জানান তৌফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, “নিম্ন আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ খাদ্য অনিরাপত্তায় ভুগছে। তাদেরকে আমাদের সুরক্ষা দিতে হবে। সরকার বলছে এবছর নাগাদ মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে নেমে আসবে, যদি এমটি হয় তাহলে চমৎকার বিষয় হবে। তবে আমাদের কৃষিখাতে বরাদ্দ কমে গেছে। ফুড সাবসিডি কমে গেছে।
“বড় আকারে আমরা ঋণের পরিস্থিতিতে পড়েছি, সেটা স্বীকার করা হয়নি। গত অর্থবছর বিদেশি ঋণ শোধ করার জন্য আমাদের রাজস্ব যথেষ্ট ছিল না। আমরা প্রায় সাড়ে ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ করে পরিশোধ করেছি।”
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করছিলেন ড. দেবপ্রিয়। এর মধ্যেই তিনি কিছু বিষয়েও তার অভিমত তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “বর্তমান সরকারের ইশতেহারের সঙ্গে বাজেটে অন্তত পাঁচটি ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যত্যয় রয়েছে। গত ৭ জানুয়ারিতে যে নির্বাচন হয়েছে, তাতে বর্তমান শাসকদল (আওয়ামী লীগ) যে ইশতেহার দিয়েছে, প্রস্তাবিত বাজেটে তারা তাদের নিজেদের ইশতেহারের প্রতি বিশ্বস্ত থাকেনি। প্রস্তাবিত বাজেটে নির্বাচনী ইশতেহারের বড় ধরনের বরখেলাপ করা হয়েছে। সরকারের যে প্রেক্ষিত পরিকল্পনা আছে, তার সঙ্গে কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটের নীতি এবং বরাদ্দের মিল নেই।”
দেবপ্রিয় এ কথা বলেই ইফতেখারুজ্জামানকে বক্তব্য দেওয়ার আমন্ত্রণ জানান। তবে এসময় তিনি এও বলেন, “এবার এই বে-নজির বাজেট নিয়ে কথা বলবেন ইফতেখারুজ্জামান ভাই।”
দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান প্রস্তাবিত বাজেটের কড়া সমালোচনা করেন।
তিনি বলেন, “এবারের বাজেট উচ্চাভিলাষী, ফাঁকা বুলির বাজেট। এটাকে আপনি শুভঙ্করের ফাঁকিও বলতে পারেন। এই বাজেটে পিছিয়ে পড়া মানুষ আরও পিছিয়ে পড়বে। ছোট ব্যবসায়ীরা হোস্টাইল হবে। এই বাজেট সামনের দিনে ধনী-গরিব বৈষম্য আরও বাড়িয়ে দেবে। দুর্নীতির মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেবে এবারের বাজেট।”
কালো টাকা সাদা করার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “(সাবেক) র্যাবের প্রধান, পুলিশের প্রধান, বিভিন্ন লোকের বিরুদ্ধে বেশ লম্ফ-ঝম্ফ করে তদন্তের ব্যবস্থা হচ্ছে। কিন্তু ওরা ১৫ শতাংশ কর দিয়ে দিলেই আর তাদের ব্যাপারে কেউ কোনও কথা বলতে পারবে না। তারা পরিস্কার হয়ে যাবে। এবার তো নিয়ম করে দেওয়া হলো কেউ এ বিষয়ে প্রশ্নও করতে পারবে না।
“আমি আমার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ক্ষমা চাই। আমি আর এখন নতুন প্রজন্মকে বলতে পারব না তোমরা সৎ থাকো, ন্যায়ের পথে আয় কর, কোনও দুর্নীতিতে জরাবে না। কিন্তু এই কথাগুলো বলার অধিকার রাষ্ট্র আমার থেকে কেড়ে নিয়েছে। এখন যে কেউ দেখবে এই দেশে সৎ থাকলে ক্ষতি বেশি, কিন্তু দুর্নীতিবাজ হলে আয়ও বেশি, লাভ বেশি।”
গণস্বাক্ষর অভিযানের ডেপুটি ডিরেক্টর ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেকটা তৈলাক্ত বাঁশের অংক করার মতো। আমরা ছোট বেলায় একটা অংক করেছিলাম- একটি তৈলাক্ত বাঁশে বানর বেয়ে উপরে উঠছে। প্রথম ১ মিনিটে কিছুটা ওঠে, পরের ১ মিনিটে কিছুটি নেমে যায়। এভাবে ২০ মিটার বাঁশটি বেয়ে উঠতে কত সময় লাগবে বানরটির? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও একই অবস্থায় আছে। এক বাজেটে আগায়, পরের বাজেটে আবার কমে।”
এবার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১.৬ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ করা হয়েছে, যা ২০১৬ সালের পর সর্বনিম্ন—এ তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, “স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়া কীভাবে হবে? বিনিয়োগ না বাড়ালে তা কীভাবে হবে? আপনার স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করতে হলে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও শিক্ষা উপকরণে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এটি না হলে আমাদের শিক্ষা গুণগত শিক্ষা হয়ে উঠবে না।”
মিডিয়া ব্রিফিংয়ে ‘আদিবাসীদের বাজেট’ প্রসঙ্গ তোলেন লেখক ও আন্দোলনকর্মী ইলিরা দেওয়ান। তিনি বলেন, “সামাজিক সুরক্ষা খাতের বরাদ্দ আসলে পাহাড়ের লোক পায় কি না, আমি জানি না। আমাদের ওইখানে জুম চাষ হয় তিন মাস। এরপর অনেক মানুষ কাজই পায় না। তখন খাদ্য সংকটও দেখা দেয়। কিন্তু সেখানকার মানুষ সরকারের এসব বরাদ্দের ছিটাফোঁটাও পায় না।
“স্মার্ট শিক্ষা ব্যবস্থার কথা হচ্ছে, কিন্তু এখনও পাহাড়ে প্রায় ৩-৪ কিলোমিটার হেটে স্কুল যেতে হয় বাচ্চাদের। স্কুলে আবার পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। অন্যদিকে ইন্টারনেট সংযোগ খুবই দুর্বল। সেখানে জুমে ক্লাস করা বা এখনকার শিক্ষা ব্যবস্থা টিকে থাকাই কষ্টসাধ্য হচ্ছে পাহাড়ের শিক্ষার্থীদের জন্য। এটি নিয়েও কিন্তু বাজেটে কোনও আলোচনা হলো না।”
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাশরুর রিয়াজ বলেন, “ব্যাংকিং গভর্নেন্স নিয়ে কোনও কথা এবারের বাজেটে বলা হয়নি। লুট হওয়া টাকা কীভাবে ফেরত আসবে? শুধু ১৫ শতাংশ ঘোষণা করলেই কি এটা আসবে? প্রায় বাজেটেই তো এসব বলা হয়, কিন্তু কত টাকা আসে? আসে না তো। কিন্তু বাজেটে এই লুট হওয়া টাকা উদ্ধার করার জন্য কোনও প্রকল্প বা প্রোগ্রামের বরাদ্দ কিন্তু দেখা যায়নি।
“এমনিতেই ছোট ব্যবসায়ীরা খারাপ আছে। বড় ব্যবসায়ীরা ছোট ব্যবসায়ীদের ক্রাউড আউট করে ফেলে। সেখানে সরকার ঘাটতি মেটাতে একটা বড় অংশ ব্যাংক থেকে লোন নেবে। তাহলে এই ছোট ব্যবসায়ীরা কোথায় যাবে? এভাবে আসলে এই দেশের অর্থনীতি আরও নিচের দিকে যাবে।”