বেশ কিছুদিন স্থির থাকার পর আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে ডলারের বাজার। ‘ক্রলিং পেগ’ ব্যবস্থায় আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ১২০ টাকা নির্ধারিত থাকলেও কোনও কোনও ব্যাংক ১২৩ টাকা দরে পর্যন্ত ডলার বিক্রি করছে। কিছু ব্যাংক ১২৫ টাকা ৫০ পয়সায় রেমিটেন্স সংগ্রহ করছে। খোলাবাজারে ডলারের দর উঠেছে ১২৬ টাকা ৪০ পয়সা পর্যন্ত।
এ পরিস্থিতিতে টাকা-ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি তুলে নিয়ে ‘নিলাম পদ্ধতি’ চালু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়ে একটি সার্কুলার জারি করা হবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা।
বুধবার বিকালে সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। সে কারণেই ডলারের দর বেড়েছে। রমজান মাসকে সামনে রেখে পণ্য আমদানি বাড়ছে। এতে ডলারের ডলারের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে।
“সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে টাকা-ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের জন্য নতুন মেকানিজম চালু করা হবে। বৃহস্পতিবার সার্কুলার জারি করে এ বিষয়ে বিষদ জানানো হবে।”
তাহলে কি নিলাম পদ্ধতি চালু করা হবে- এ প্রশ্নে হুসনে আরা শিখা বলেন, “সেটা বলা যাবে না। একটা দিন অপেক্ষা করেন, জানতে পারবেন।”
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ডলার বেচাকেনায় ক্রলিং পেগ ব্যবস্থা তুলে নিয়ে নিলাম পদ্ধতি চালু করা হবে।
কীভাবে নিলাম পদ্ধতি পরিচালিত হবে- এ প্রশ্নে ওই কর্মকর্তা বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক নিলাম ডাকবে। সেই নিলামে সর্বনিম্ন যে দর হবে, সেই দামে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ডলার কিনবে। আবার সর্বোচ্চ যে দর উঠবে, সেই দরে ডলার বিক্রি করবে।”
বাংলাদেশে এর আগে কখনই এই পদ্ধতিতে ডলার কেনাবেচা হয়নি বলে জানান তিনি।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণের জন্য বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ বাড়াচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ডলার কিনছে। এর প্রভাবে বেশ কিছুদিন স্থিতিশীল থাকা ডলারের দর বাড়ছে।
বুধবার বেসরকারি সিটি ব্যাংক ১২৩ টাকায় নগদ ডলার বিক্রি করেছে; কিনেছে ১২১ টাকা ৫০ পয়সায়। মঙ্গলবার ব্যাংকটি ১২০ টাকায় ডলার বিক্রি করেছিল; কিনেছিল ১১৯ টাকা ৫০ পয়সায়।
ইস্টার্ন ব্যাংক বুধবার ১২০ টাকা ৫০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করেছে। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ও জনতা ব্যাংক বুধবার ১২০ টাকা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে বলে তাদের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করেছে।
জানা গেছে, বেসরকারি একটি ব্যাংক গত ১৫ ডিসেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের লুলু ইন্টারন্যাশনাল এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ১২৫ টাকা ৫০ পয়সা দরে ডলার কিনেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বেশিরভাগ এক্সচেঞ্জ হাউসের দর ছিল এ রকমই। অন্য দেশের এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো এখন ডলার কিনছে ১২৪ টাকায়।
আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রেও নির্ধারিত দামের চেয়ে ৩-৪ টাকা বেশি নিচ্ছে ব্যাংকগুলো।
বুধবার খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ১২৬ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ১২৬ টাকা ৪০ পয়সায় ডলার বিক্রি হয়েছে। কেনা হয়েছে ১২৫ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ১২৫ টাকা ৮০ পয়সায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানী ঢাকার মতিঝিলের একটি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বাজারে ডলারের প্রচুর চাহিদা। কিন্তু সরবরাহ নেই। সে কারণেই এখন প্রতিদিনই দাম বাড়ছে।”
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সহিংস পরিস্থিতির মধ্যেও খোলাবাজারে ডলারের দাম বেড়ে গিয়েছিল। গত ৩১ জুলাই হঠাৎ করেই কার্ব মার্কেটে ডলারের দর ১২৪ টাকায় ওঠে। পরে তা কমে ১২০ থেকে ১২১ টাকার মধ্যে নামে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বাজার থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেনার পাশাপাশি রমজান সামনে রেখে আমদানি বৃদ্ধিও ডলারের দর বৃদ্ধির একটি কারণ। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে ডলারের বাড়তি দর মূল্যস্ফীতির ওপর আরও চাপ তৈরি করবে।
আইএমএফের শর্ত মেনে চলতি ডিসেম্বর শেষে নিট রিজার্ভ ১৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ থেকে উদ্বৃত্ত ডলার কেনা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৭ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার) আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। এক সপ্তাহ আগে ১১ ডিসেম্বর ছিল ১৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।
এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর গত ১১ নভেম্বর রিজার্ভ ১৮ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল।
বৈদেশিক মুদ্রার মোট সঞ্চিতি থেকে সব ধরনের দায়দেনা বাদ দেওয়ার পর যা থাকে সেটাই হচ্ছে নিট রিজার্ভ। বাংলাদেশের পেক্ষাপটে ‘গ্রস’ হিসাবের রিজার্ভের চেয়ে নিট রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলারের মতো কম হয়ে থাকে। আর বিপিএম-৬ হিসাবের চেয়ে কম থাকে ৫ বিলিয়ন ডলারের মতো।
সে হিসাবে বাংলাদেশের প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৪ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার।
রমজান সামনে রেখে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে এলসি খোলায় উৎসাহিত করা হচ্ছে। তবে দেশের মূল্যস্ফীতি দীর্ঘদিন ধরে দুই অঙ্কের ঘরে রয়েছে। এ সময় ডলারের দর আরও বাড়লে মূল্যস্ফীতিতে চাপ বাড়তে পারে। যে কারণে ডলারের দরে খুব একটা ওঠানামা হোক, তা চায় না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তবে ডলার দরে ওঠানামা না থাকায় প্রশ্ন তুলেছে আইএমএফ। যে কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বেচাকেনায় নিলাম পদ্ধতি চালু করতে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ।
বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রমজানকে সামনে রেখে এখন বড় অনেক এলসি হচ্ছে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইছে আগের বকেয়া যেন না থাকে। এসব কারণে ডলারের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে।”
“এর বাইরে এখন বড় এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো প্রবাসীদের সব ডলার কিনে ফেলছে। তারা বাড়তি দর চাইলেও অনেক ক্ষেত্রে কিছু করার থাকছে না। আগে ছোট ছোট এক্সচেঞ্জ হাউসের সঙ্গে দর কষাকষি করা সহজ ছিল। চাহিদা বাড়ার কারণেই ডলারের দর বাড়ছে,” বলেন তিনি।
আইএমএফের ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণের চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের আগে বিভিন্ন শর্তের অগ্রগতি পর্যালোচনায় একটি প্রতিনিধি দল এখন ঢাকা সফর করছে। বুধবার এই দলের বৈঠক শেষ হচ্ছে।
জানা গেছে, সংস্থাটির প্রতিনিধিরা দীর্ঘদিন ডলারের দর ১২০ টাকায় স্থিতিশীল থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ডলার দর আরও কীভাবে বাজারভিত্তিক করা যায়, সে পরামর্শ দিয়েছেন তারা। তারা এমন একটি ব্যবস্থা চাইছেন যেন ডলারের দর ওঠানামা করে।
অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স বৃদ্ধির কারণে এখন ডলারের দর স্থিতিশীল আছে। এরপরও আরও বাজারভিত্তিক করার জন্য নতুন পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। আইএমএফের পরামর্শেই ডলার বেচাকেনায় নিলাম পদ্ধতি চালু করা হচ্ছে বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
আইএমএফের পরামর্শেই বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৮ মে ডলারের দর নির্ধারণের নতুন পদ্ধতি ‘ক্রলিং পেগ’ চালু করে। এর মাধ্যমে এক লাফে প্রতি ডলারে ৭ টাকা বাড়িয়ে মধ্যবর্তী দর ঘোষণা করা হয় ১১৭ টাকা। এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় ডলারের দর নির্ধারিত ছিল ১১০ টাকা।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০ আগস্ট বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে তারল্য বাড়ানোর উদ্যোগের অংশ হিসেবে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের দাম ১২০ টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারবে বলে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
আমদানি ব্যয় কমায় ও রেমিটেন্স বাড়ায় ২০২১ সালের আগস্টে বাড়তে বাড়তে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তখন ‘গ্রস’ ও প্রকৃত হিসাবের রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করত না বাংলাদেশ ব্যাংক।