Beta
শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

‘সংসারই চলছে না, সঞ্চয় কীভাবে’

ss-Savings-Scheme-180524
[publishpress_authors_box]

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) সব মিলিয়ে ৩০ হাজার ১০৯ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এই ছয় মাসে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ করা হয়েছে ৩২ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা।

অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে সঞ্চয়পত্রের নিট বা প্রকৃত বিক্রির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা ঋণাত্মক (-)। গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের একই সময়ে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা ঋণাত্মক (-)।

এর মানে হচ্ছে, চলতি অর্থ বছরের প্রথমার্ধে যতো টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে তার চেয়ে ২ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা বেশি আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করেছে সরকার।

এই অর্থ সরকারের কোষাগার থেকে অথবা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করা হয়েছে।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর বৃহস্পতিবার সঞ্চয়পত্র বিক্রির হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সুদের হার হ্রাস ও নানা কড়াকড়ির কারণে গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বেশ কমে গিয়েছিল; বিক্রির চেয়ে সুদ-আসল পরিশোধে ৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা বেশি চলে গিয়েছিল।

অর্থাৎ গত অর্থ বছরে প্রথম ছয় মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বা প্রকৃত বিক্রির পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা ঋণাত্মক (-)।

আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল গ্রাহকদের পরিশোধের পর যেটা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বা প্রকৃত বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়।

এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।

এ হিসাবে চলতি অর্থ বছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে কোনও ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ নিতে পারেনি। উল্টো ২ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা কোষাগার থেকে গ্রাহকদের সুদ-আসল বাবদ দিতে হয়েছে।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে দেশের প্রধান কর আদায়কারী সংস্থা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৮ হাজার কোটি টাকা। অর্থ বছর শেষে ঘাটতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা নিয়ে চিন্তিত সরকার।

২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট দিয়েছিল বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকার। এর মধ্যে ঘাটতি ধরা আছে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।

এই ঘাটতি পূরণে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা টাকা ঋণ বা ধার করার লক্ষ্য ধরা আছে।

সঞ্চয়পত্র বিক্রি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বিক্রির চাপ কমাতে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। একই সঙ্গে এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করা হয়।

ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করার শর্ত আরোপসহ আরও কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তারপরও বাড়তে থাকে বিক্রি।

২০২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার।

গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের প্রথমার্ধে বিক্রি হয়েছিল ৪১ হাজার ২৯০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। তার মানে চলতি অর্থ বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেছে ১ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা বা প্রায় ২৭ শতাংশ।

দেশের সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি অর্থ জমা রাখেন ব্যাংকে। তারপর নিরাপত্তা ও অধিক মুনাফার আশায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেন। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকে সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ বলা হয়ে থাকে। কিন্তু সুদ বেশি হওয়ার পরও সঞ্চয়পত্র কেনা কমিয়ে দিয়েছেন মানুষ।

কেন মানুষ সঞ্চয়পত্র কেনা কমিয়ে দিয়েছেন- এ প্রশ্নে অর্থনীতিবিদ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ খুবই কষ্টে আছে। শীত মৌসুমে বাজারে শাক-সবজির দাম কমায় জানুয়ারিতে কিছুটা কমলেও বেশ কিছু দিন ধরে দুই অঙ্কের (১০ শতাংশ) উপরে অবস্থান করছে।

“পরিবারের খরচ মেটাতেই পারছে না। মানুষের হাতে কোনও সঞ্চয় থাকে না; অনেকের ধার-কর্জ করে সংসার চালাতে হয়। সংসারই চলছে না, সঞ্চয়পত্র কিনবে কীভাবে।”

তিনি বলেন, “সুদের হার হ্রাস ও নানা ধরনের কড়াকড়ি আরোপের কারণে মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে। সে কারণেই নিট বিক্রি নেগেটিভ হয়েছে।”

এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আরও বলেন, “ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। মানুষ যা আয় করছে, তা নিয়ে সংসারই চলছে না। সঞ্চয় করবে কীভাবে; সঞ্চয়পত্র কিনবে কীভাবে?”

একই ধরনের কথা বলেছেন আরেক অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক জায়েদ বখত।

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “এখনও যেকোনো স্কিমের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি। কোনও ঝামেলাও নেই। অনলাইন করায় প্রতি মাসের মুনাফা অটোমেটিক গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে চলে আসে। মেয়াদপূর্তির পর আসলও চলে অ্যাকাউন্টে।

“তারপরও মানুষ আগের মতো সঞ্চয়পত্র কিনছে না; কিনছে না বললে ভুল হবে। কিনতে পারছে না। কেননা, বাজারে সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে। বেড়েছে সন্তানদের শিক্ষা খরচ; চিকিৎসার ব্যয় বেড়েছে। সব কিছু মিলিয়ে সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে।”

“অনেকে মেয়াদপূর্তির আগেই সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে সংসারের খরচ মেটাচ্ছেন। সঞ্চয় করবে কীভাবে?”

সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমায় সরকারের একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে মন্তব্য করে জায়েদ বখত বলেন, “এতে সরকারের ভবিষৎ ঋণের বোঝা কমবে।”

অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক এখন মূল্যস্ফীতির। সরকারি হিসাবে নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে এক অঙ্কের ঘরে (সিঙ্গেল ডিজিট) ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে নেমে এসেছে। চার মাস পর এই সূচক সিঙ্গেল ডিজিটে নামল।

গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের শেষ মাস জুনে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে তা বেড়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে ওঠে। আগস্টে তা কিছুটা কমে হয় ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। পরের মাস সেপ্টেম্বরে তা আরও কমে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে নেমে আসে।

এরপর থেকে এই সূচক ১০ শতাংশের উপরেই অবস্থান করছিল; নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে নেমে এসেছে।

তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনও দুই অঙ্কের ঘরে (ডাবল ডিজিট) রয়েছে। জানুয়ারিতে এই হার ছিল ১০ দশমিক ৭২ শতাংশ। খাদ্য বহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ।

শীত মৌসুমে বাজারে শাক-সবজি, ডিম, পেঁয়াজসহ অন্য সব পণ্যের দাম কমায় জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি কমেছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কর্মকর্তারা।

সঞ্চয়কারীদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করতে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার গত মাস জানুয়ারিতে বাড়িয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের আওতায় পরিচালিত সঞ্চয় কর্মসূচিগুলোর (স্কিম) মুনাফার হার বেড়ে ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয় ৭৮ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকার। তার বিপরীতে গ্রাহকেরা সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়েছেন (আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ) ৯৯ হাজার ৯৭২ কোটি টাকার।

অর্থাৎ নিট বিক্রি ২১ হাজার ১২৪ কোটি টাকা কমেছে। তার মানে সরকার গত অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ঋণ এক টাকাও পায়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকারের নেওয়া ঋণের পুঞ্জীভূত পরিমাণ ২০২৪ সালের জুন শেষে ছিল ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে তা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকায়।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত