তীরে এমন একটি জায়গা ছিল যেখান থেকে আজমত সারসেনবায়েভ লোনা, নীল-সবুজ কাস্পিয়ান সাগরে ঝাঁপ দিতেন। মাত্র এক দশক পরে সে জায়গাটি এখন দিগন্তে বিস্তৃত পাথুরে মাঠের মতো দেখায়।
কাজাখস্তানের উপকূলীয় শহর আকতাউ থেকেও পানি অনেক দ্রুত নেমে গেছে, যেখানে ইকো-অ্যাক্টিভিস্ট বা পরিবেশবাদী কর্মী আজমত তার সারা জীবন কাটিয়েছেন।
“এটা দেখা খুবই বেদনাদায়ক,” বললেন তিনি।
তার এক হাজার মাইলেরও বেশি দক্ষিণে ইরানের রাশত শহরের বাসিন্দা খাশায়ার জাভানমার্দিও শঙ্কিত। এখানকার সাগরও দূষণে দমবন্ধ হয়ে আছে।
পেশায় আলোকচিত্রী জাভানমার্দি বলেন, “আমি আর সাঁতার কাটতে পারি না। পানি বদলে গেছে।”
তিনি কাস্পিয়ানের দক্ষিণ উপকূলে ভ্রমণ করেন এবং এর ধ্বংসের ছবি তোলেন।
এই দুজন মানুষই তারা যে সাগরের পাড়ে বড় হয়েছেন, তার সঙ্গে নিজেদের নিবিড় সংযুক্তি অনুভব করেন। দুজনই এখন সেই জলরাশির ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কিত।
কাস্পিয়ান সাগর পৃথিবীর বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ জলরাশি এবং বৃহত্তম হ্রদ। আকারে এটি বাংলাদেশের দেড় গুণ। এর চারপাশের উপকূলরেখার দৈর্ঘ্য ৪ হাজার মাইলেরও বেশি এবং পাঁচটি দেশের সীমান্ত ছুঁয়েছে— কাজাখস্তান, ইরান, আজারবাইজান, রাশিয়া ও তুর্কমেনিস্তান।
এই দেশগুলো মাছ ধরা, কৃষিকাজ, পর্যটন এবং পানীয় জলের পাশাপাশি এর লোভনীয় তেল ও গ্যাসের মজুদের জন্য এটির উপর নির্ভর করে। কাস্পিয়ান এই শুষ্ক অঞ্চলের জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং মধ্য এশিয়ায় বৃষ্টিপাত ও আর্দ্রতার উৎসও।
কিন্তু এটি নিজেই এখন সমস্যায় পড়েছে।
বাঁধ নির্মাণ, অতিরিক্ত সম্পদ আহরণ, দূষণ এবং জলবায়ু সংকট এর ধ্বংস ত্বরান্বিত করছে। কিছু বিশেষজ্ঞের আশঙ্কা, কাস্পিয়ান সাগরকে ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’র দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, যা আর পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে না।
জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ালেও কাস্পিয়ানের মতো স্থলবেষ্টিত হ্রদের ওপর তার প্রভাব পড়ছে না। হ্রদটি নদী থেকে প্রবাহিত পানি এবং বৃষ্টিপাত ও বাষ্পীভবনের চক্রের মাধ্যমে ভারসাম্য বজায় রাখে। কিন্তু পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ভারসাম্য পরিবর্তিত হচ্ছে, যার ফলে এটি সঙ্কুচিত হয়ে আসছে।
ভবিষ্যতে কী হতে পারে, তা দেখার জন্য বেশিদূর তাকানোর দরকার নেই। কাজাখস্তান ও উজবেকিস্তানের কাছাকাছি অবস্থিত আরল সাগরটি একসময় বিশ্বের বৃহত্তম হ্রদগুলোর একটি ছিল। কিন্তু মানব ক্রিয়াকলাপ এবং ক্রমবর্ধমান জলবায়ু সংকটে সেটি প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছে।
হাজার হাজার বছর ধরে তাপমাত্রা ওঠানামা এবং বরফের চাদর এগিয়ে আসা এবং পিছিয়ে যাওয়ার কারণে কাস্পিয়ান সাগর অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে। তবে গত কয়েক দশকে এই পতন ত্বরান্বিত হচ্ছে।
এর পেছনে মানব ক্রিয়াকলাপ বড় একটি ভূমিকা রাখছে। চারপাশের দেশগুলো এতে অনেক জলাধার এবং বাঁধ তৈরি করেছে। কাস্পিয়ানে ১৩০টি নদী দিয়ে পানি এসে জমা হয়। তবে প্রায় ৮০ শতাংশ পানিই আসে মাত্র একটি নদী থেকে— ভলগা। এটি ইউরোপের দীর্ঘতম নদী, যা মধ্য ও দক্ষিণ রাশিয়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়।
তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য এশিয়া ও ককেশীয় স্টাডিজ বিশেষজ্ঞ ভ্যালি কালেজি বলেন, কাস্পিয়ান সাগরে প্রবেশ করা পানির প্রবাহ কমাতে রাশিয়া ৪০টি বাঁধ নির্মাণ করেছে, যার মধ্যে আরও ১৮টির কাজ চলছে।
কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন একটি ক্রমবর্ধমান তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, বাষ্পীভবনের হার বৃদ্ধি করছে এবং বৃষ্টিপাতকে আরো অনিয়মিত করে তুলেছে।
জার্মানির ব্রেমেন ইউনিভার্সিটির আর্থ সিস্টেম মডেলার ম্যাথিয়াস প্রাঞ্জ বলেছেন, কাস্পিয়ান সাগরের পানির স্তর ১৯৯০-র দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে কমা শুরু হয়। ২০০৫ সালে এসে যার গতি বেড়েছে। গত ৩০ বছরে প্রায় ৫ ফুট পানি কমেছে।
প্রাঞ্জ সিএনএনকে বলেন, পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাস্পিয়ানের পানির স্তর আরও ‘ব্যাপকভাবে কমতে’ শুরু করে। তার গবেষণা বলছে, এই শতকের শেষ নাগাদ ৮ থেকে ১৮ মিটার (২৬ থেকে ৫৯ ফুট) পানি কমতে পারে। বিশ্ব কত দ্রুত জীবাশ্ম জ্বালানী দূষণ কমাতে পারে বিষয়টি তার উপরও নির্ভর করছে।
অন্য একটি সমীক্ষা বলছে, ২১০০ সালের মধ্যে ৩০ মিটার (৯৮ ফুট) পর্যন্ত পানি কমতে পারে।
রিডিং ইউনিভার্সিটির প্যালিওক্লাইমাটোলজির অধ্যাপক এবং গবেষণার সহ-লেখক জয় সিঙ্গারেয়ার বলেছেন, এমনকি বিশ্ব তাপমাত্রা আশানুরূপভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও কাস্পিয়ান সাগরের অগভীর উত্তর অংশ, যার বেশিরভাগ কাজাখস্তানের আশেপাশে, সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যাবে।
কাস্পিয়ান সাগরতীরের দেশগুলোর জন্য এটি একটি বড় সংকট। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের কালেজি বলেছেন, আকতাউয়ের মতো অগভীর বন্দর শহরগুলোতে জাহাজ ভেড়ানো কঠিন হয়ে যাবে। এতে মাছ ধরার জায়গাগুলো সঙ্কুচিত হবে, পর্যটন হ্রাস পাবে এবং জাহাজ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বও তৈরি হতে পারে। সিংগারেয়ার বলেন, হ্রদের সম্পদ কমানোর প্রতিযোগিতায় থাকা পাঁচটি দেশ ‘আরো বেশি পানি আহরণের প্রতিযোগিতায়’ লিপ্ত হতে পারে। এটি তেল ও গ্যাসের মজুদ নিয়ে নতুন দ্বন্দ্বও সৃষ্টি করতে পারে, যদি পানি কমে যাওয়ায় উপকূলরেখা বাড়ায়, দেশগুলো নতুন করে আরও এলাকার ওপর নিজেদের অধিকার দাবি করে।
কাস্পিয়ান সাগরের অনন্য বন্যপ্রাণীদের জন্যও পরিস্থিতি ইতিমধ্যেই বিপর্যয়কর। এটি বিপন্ন প্রাণী স্টার্জন সহ শত শত প্রজাতির আবাসস্থল, বিশ্বের ৯০ শতাংশ ক্যাভিয়ারের উৎস।
ওয়েসলিং সিএনএনকে বলেন, “সাগরটি অন্তত ২০ লাখ বছর ধরে ভূমিবেষ্টিত। মহাসমুদ্র থেকে এই চরম বিচ্ছিন্নতার ফলে এতে ‘খুব অদ্ভুত ককলসের মতো উদ্ভট প্রাণীর আবির্ভাব’ ঘটেছে।
তিনি বলেন, কিন্তু পানি কমে যাওয়ায় সাগরে অক্সিজেনের মাত্রাও কমে যাচ্ছে। এতে লাখ লাখ বছর ধরে বিবর্তনের মাধ্যমে আবির্ভূত অবশিষ্ট প্রাণীরাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। এটি একটি বিশাল সংকট, যা প্রায় কেউই জানে না।
এটি কাস্পিয়ান সিলের জন্যও একটি সংকট— সিল একটি বিপন্ন সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী, যা পৃথিবীতে আর কোথাও পাওয়া যায় না। দূষণ এবং অতিরিক্ত মাছ ধরার কারণে অগভীর উত্তর-পূর্ব কাস্পিয়ান সাগরে তাদের প্রজনন স্থানগুলো স্থানান্তরিত এবং অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
কাজাখস্তানের ইনস্টিটিউট অফ হাইড্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইকোলজির একজন গবেষক অ্যাসেল বাইমুকানোভা বলেছেন, আকাশ থেকে করা জরিপে সীলগুলোর সংখ্যায় বিশাল কমতি দেখা যায়।
২০০৯ সালে উত্তর-পূর্ব কাস্পিয়ান সাগরের দুরনেভ দ্বীপপুঞ্জে বিজ্ঞানীরা সিলদের একটি প্রজনন সাইটে ২৫ হাজারটি সিল গনণা করেছিলেন। বাইমুকানোভা বলেন, “কিন্তু ২০২০ সালের বসন্তের মধ্যে সেখানে একটি সিলও দেখা যায়নি।”
এই সংকটের কয়েকটি সহজ সমাধান আছে। কাস্পিয়ান সাগর এমন একটি অঞ্চলে অবস্থিত যেখানে প্রচুর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা রয়েছে। এর তীরবর্তী পাঁচটি দেশের প্রত্যেকে বিভিন্ন উপায়ে এর পতন অনুভব করবে।
কালেজি বলেন, এর জন্য শুধু কোনও একটি দেশকে দোষারোপ করা যায় না। তবে তারা যদি সম্মিলিত পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয় তাহলে আরাল সাগরের বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি হতে পারে। কারণ কাস্পিয়ান তার প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক চক্রে ফিরে আসবে এর কোনও নিশ্চয়তা নেই।
কাস্পিয়ানের ভাগ্য নিয়ে এই উদ্বেগ এমন সময়ে বাড়ছে যখন এই অঞ্চলের উপর বিশ্বের সার্বক্ষণিক নজর রয়েছে।
আগামি মাসে বিশ্ব নেতারা আজারবাইজানের উপকূলীয় রাজধানী শহর বাকুতে কপ-২৯ তথা জাতিসংঘের বার্ষিক জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনে জড়ো হবে। সম্মেলনে তারা কাস্পিয়ান সাগরের এই অংশজুড়ে তেল ও গ্যাস উত্তোলনের স্থানগুলো জলবায়ু মোকাবেলায় কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে তা নিয়েও আলোচনা করবেন।
আগস্টে দেশটির প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ বলেছিলেন, কাস্পিয়ান সাগরের পতন ‘বিপর্যয়কর’ এবং একটি পরিবেশগত বিপর্যয় হয়ে উঠছে। তবে একই সময়ে দেশটি জীবাশ্ম জ্বালানির নিজস্ব উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে, যা এই পরিবেশ বিপর্যয়ের বড় কারণ।
এদিকে, কাজাখস্তানের সারসেনবায়েভ ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা সুন্দর ও চিত্তাকর্ষক ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে কাস্পিয়ানের দুর্দশার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছেন।
যদি জলবায়ু সংকট এবং পানির অতিরিক্ত উত্তোলন নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকে, তবে তার আশঙ্কা, “কাস্পিয়ান সাগর আরাল সাগরের মতো ভাগ্যের মুখোমুখি হতে পারে।”
ইরানে জাভানমার্দিও কাস্পিয়ান উপকূলরেখার ছবি তুলে চলেছেন। দূষিত পানি, সঙ্কুচিত উপকূল এবং সাগরের শুকিয়ে যাওয়ার ছবি তুলছেন তিনি। সেইসঙ্গে এর বিদ্যমান সৌন্দর্য্য এবং সাগরের সঙ্গে মানুষের সংযোগও তুলে ধরছেন।
সাগরটির অদৃশ্য হয়ে যাওয়া সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে চাইছেন তিনি। জাভানমার্দি বলেন, “এটি বিশ্বের বৃহত্তম হ্রদ। বিশ্বের সব মানুষের এটিকে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে বিবেচনায় নেওয়া উচিৎ।”
তথসূত্র : সিএনএন