বলিউড স্টার মানেই সারাজীবন পাদপ্রদীপের নিচে থেকেই জীবন শেষ করবেন তা নয়। এই ইন্ডাস্ট্রির অনেক তারকাকেই বরণ করে নিতে হয় দারিদ্র আর নিদারুণ ট্র্যাজেডি। দর্শক হৃদয় জয় করেও কেউ কেউ আবার হয়ে পড়েন বিস্মৃত এবং একাকী।
মীনা কুমারি
নাম তার মাহাজাবিন বানু। অভিনয় করতেন মীনা কুমারি নামে। তাকে সবাই চিনতো বলিউডের ট্র্যাজেডি কুইন হিসেবে। শেষদিকে এতোটাই অসুস্থ হয়ে পড়েন যে চাইলেও অভিনয়ে নিয়মিত হতে পারেননি। দুঃখের বিষয় হলো, তার মৃত্যু হয় মাত্র ৩৮ বছর বয়সে!
দাম্পত্য জটিলতার কারণে ভুগছিলেন অনিদ্রা রোগে। ঘুমের ওষুধ এড়াতে ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছিলেন স্বল্প মাত্রায় ব্র্যান্ডি খেতে। কিন্তু ১৯৬৪ সালে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটার পর তাই কিনা বুমেরাং হয়ে এলো। হয়ে পড়লেন মদ্যপ। তার জেরেই কিনা ১৯৬৮ সালে ধরা পড়লো লিভার সিরোসিস।
‘পাকিজা’ মুক্তির মাত্র তিন সপ্তাহ পর মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সেন্ট এলিজাবেথ নার্সিং হোমে। অসুস্থ হবার দুদিন পরেই চলে গেলেন কোমায়। আর কোমা থেকে না ফেরার দেশে।
কথিত আছে, মৃত্যুর সময় তার নাকি হাসপাতালে বিল দেওয়ার মতো অর্থও ছিলনা।
পারভিন ববি
পারভিন মোহাম্মদ আলী খানজি ববি বলিউডে পরিচিতি পান পারভিন ববি নামে। ছিলেন বলিউডের সেরা নায়িকাদের একজন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮২, এই সময়ে অভিনয় করেছেন ‘অমর আকবর অ্যান্থনি’, ‘সুহাগ’, ‘কালা পাত্থার’ এবং ‘শান’ এর মতো সিনেমায়।
কিন্তু ১৯৮৩ সালে হুট করেই বলিউড ইন্ডাস্ট্রি থেকে একেবারে ‘অদৃশ্য’ হয়ে গেলেন। কেউই জানতো না কোথায় আছেন এই গ্ল্যামারাস অভিনেত্রী। এ সময় কানাঘুষা চলতে থাকে- মাফিয়াদের হস্তক্ষেপেই নাকি তার অভিনয় ক্যারিয়ারের ইতি ঘটেছে।
সিনেমা থেকে এই হঠাৎ স্বেচ্ছা নির্বাসনে গিয়ে বাবি ব্যস্ত হয়ে পড়েন সঙ্গীত, পিয়ানো, পেইন্টিং, স্থাপত্যকলা এবং মানবাধিকার নিয়ে। একাকি থাকতেন মুম্বাইয়ের এক ফ্ল্যাটে। বেশ স্বচ্ছলতার মধ্যেই কাটাতেন জীবন। ধারণা করা হয়, কিছুটা অপ্রকৃতস্থ’ও হয়ে পড়েছিলেন এই অভিনেত্রী।
তবে বলিউডের এই অভিনেত্রীর জীবনাবসান ঘটে খুব করুণভাবে। ফ্ল্যাটের দরজায় তিনদিনের পত্রিকা পড়ে থাকতে দেখে অ্যাপার্টমেন্ট কর্তৃপক্ষ খবর দেয় স্থানীয় পুলিশকে। পুলিশ এসে পারভিন ববির মৃতদেহ আবিষ্কার করে।
পরে ময়নাতদন্তে জানা যায়, তার বাম পা ছিল গ্যাংগ্রিন আক্রান্ত। ডায়াবেটিস রোগী হওয়ায় গ্যাংগ্রিন মারাত্মক আকার নেয়। পুলিশ ধারণা করে, ৭২ ঘণ্টারও বেশি সময় তার মৃতদেহ ফ্ল্যাটেই পড়ে ছিল। টানা ৩ দিন না খেয়েই ছিলেন এই অভিনেত্রী। সব রকম গুজব উড়িয়ে দিয়ে পুলিশ স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, মাত্রাতিরিক্ত ডায়াবেটিস, অনাহার এবং গ্যাংগ্রিনের কারণেই তার মৃত্যু ঘটে।
সীতারাম পাঞ্চাল
সীতারাম পাঞ্চাল পরিচিত ছিলেন ‘স্লাম ডগ মিলিয়নিয়ার’, ‘পিপলি লাইভ’, ‘দ্য লিজেন্ড অব ভাগাত সিং’ এবং ‘জলি এল এল বি’র মতো বলিউড ফিল্মে অভিনয়ের জন্য।
কিডনিজনিত সমস্যা এবং ফুসুফুসে ক্যান্সারে মারা যান এই অভিনেতা। অর্থকষ্ট এমন জায়গায় পৌঁছায় যে চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে পারছিলেন না। হরিয়ানা সরকার তার চিকিৎসার জন্য ৫ লাখ রুপি দান করেছিল। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। মাত্র ৫৪ বছর বয়সে মৃত্য ঘটে এই বলিউড অভিনেতার।
একে হাঙ্গাল
একে হাঙ্গাল বা আভতার কিষাণ হাঙ্গালের বলিউড অভিষেক হয় ৫২ বছর বয়সে। ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী। জন্মেছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের শিয়ালকোটে। যা বর্তমানে পাকিস্তানের অংশ।
বলিউড ফিল্মে অভিনয় করা হাঙ্গালের বলিউড ক্যারিয়ার ছিল পাঁচ যুগের। বার্ধক্যজনিত নানান সংকটে ভুগতে থাকা হাঙ্গালের চিকিৎসা ব্যয় বহন করা খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল। তার ছেলে বিজয় ছিলেন বলিউডের একজন ক্যামেরাম্যান এবং ফটোগ্রাফার। ২০০৭ সালে হাঙ্গাল যখন বেশ অসুস্থ তখন বিজয়েরই বয়স ৭৫। বেকার বিজয় বাবার চিকিৎসা ব্যয় সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছিলেন। পরে ২০১২ সালে ৯৮ বছর বয়সে একে হাঙ্গালের মৃত্যু ঘটে।
ভারত ভূষণ
ভারত ভূষণকে বলা হয় হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম সেরা অভিনেতা। বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি আজও স্মরণীয়। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত করেছিলেন অভিনয়। কথিত আছে জুয়ায় হেরে নিজের বাড়ি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন।
তবে অন্য একটি উৎস থেকে জানা যায়, অর্থ সংকট থেকে বাঁচতেই এই বাড়ি তিনি বিক্রি করেন আরেক বলিউড তারকা রাজেন্দ্র কুমারের কাছে। এই বাড়ি পরে হাত ঘুরে বিক্রি হয় আরেক তারকা রাজেশ খান্নার কাছে।
মৃত্যুর পূর্বে কিছুদিন সিনেমা প্রযোজক হিসেবে টাকা লগ্নি করেছিলেন। কিন্তু তার প্রযোজিত বেশিরভাগ ছবিই ফ্লপ হয়। ১৯৯২ সালে মৃত্যুর আগে আর্থিক সংকট কিছুটা কাটলেও আগের সে জৌলুশ আর কখনই ফিরে আসেনা তার।
ভিমি
বলিউড অভিনেত্রী ভিমি আলোচনায় আসেন ‘হামরাজ’ এ অভিনয় করে। এতে তিনি সুনীল দত্তের বিপরীতে অভিনয় করেন। সময়টা ১৯৬৭।
হামরাজ হিট হলেও, নিজের জায়গা পাকা করতে ভিমিকে হাঁটতে হয় আরও কিছুদূর।
শশী কাপুরের বিপরীতে কাজ করেন ‘পতঙ্গ’ সিনেমায়। ১৯৬৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘আব্রু’ সিনেমায় কাজ করেন প্রধান চরিত্রে। অভিনয় করেন পাঞ্জাবী সিনেমায়’ও।
মাত্র ৩৪ বছর বয়সে এই অভিনেত্রী মৃত্যুকে বরণ করে নেন। অতিরিক্ত মদ্যপান আর এলোমেলো জীবন তাকে দিন দিন অসুস্থতার দিকে ঠেলে দিচ্ছিল।
১৯৭৭ সালে মুম্বাইয়ের নবনীতা হাসপাতালের এক সাধারণ ওয়ার্ডে মৃত্যু ঘটে এই অভিনেত্রীর। মৃত্যুর সময় এতোটাই নিঃসঙ্গ ছিলেন যে, তার মৃতদেহ নিতে আসার কোন লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে একটি ঠেলা গাড়িতে করে তার লাশ শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়।
অচলা সচদেব
অচলা সচদেব বলিউড ইন্ডস্ট্রিতে বিখ্যাত ছিলেন মা এবং দাদী চরিত্রে অভিনয়ের জন্য। বলিউডের সুপার ডুপার হিট ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’ তে কাজলের দাদী চরিত্রে অভিনয় করে তিনি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
ব্রিটিশ ভারতে তিনি কাজ করেছেন অল ইন্ডিয়া রেডিও, লাহোরে। দেশভাগের পর দিল্লীতে। হিন্দি সিনেমায় তার অভিষেক ঘটে ১৯৩৮ সালে।
১৩০ এর বেশি সিনেমায় কাজ করা এই অভিনেত্রীর শেষ জীবনগুলো কেঁটেছে নিদারুণ কষ্টে। জানা যায়, এক দুর্ঘটনার পর তিনি চলাফেরার ক্ষমতা হারান। পরিবারের সদস্যরা হাসপাতালে তাকে দেখতে আসতেন কালেভদ্রে। পরিবারের পক্ষ থেকে তার দেখাশোনার জন্যও কেউ ছিলেন না হাসপাতালে। পরে হাসপাতালে একাকী তার মৃত্যু ঘটে।