ভয়-ভীতি, শঙ্কা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেও বাঙালি হিন্দুরা দুর্গাপূজা করে। কারণ দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দুর সবচেয়ে বড় উৎসব। এই উৎসবকে অনেকে রামায়ণে বর্ণিত দুর্গা পূজার রূপ বলে মনে করেন। মা দুর্গার অকালবোধন এবং এর রামায়াণযোগ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক।
অযোধ্যাপতি রাম ছিলেন ভগবান বিষ্ণুর সপ্তম অবতার। ১৪ বছর বনবাসকালে তাঁর স্ত্রী সীতাকে দৈত্যরাজ রাবণ অপহরণ করেন। রাবণের কবল থেকে সীতাকে মুক্ত করার জন্য রাম দৈত্য রাজাকে বধ করার সিদ্ধান্ত নেন। ভগবান রামচন্দ্র রাবণের প্রাণনাশে সাফল্য অর্জনের জন্য দেবী দুর্গার কৃপা কামনা করেন ও সেজন্য তিনি আদ্যাশক্তি দেবী দুর্গার আরাধনা করেন। ঐতিহ্যগতভাবে দেবী দুর্গা বসন্ত ঋতুতে পূজিত হতেন। কিন্তু যুদ্ধের কারণে রাম শরৎ ঋতুতে দেবীর আশীর্বাদের জন্য প্রার্থনা করেন। যদিও শরৎকাল দেবদেবীদের ঘুমের সময় বলেই জ্ঞাত। কারণ, এসময় দিন ছোট ও রাত বড় হয় এবং রাত সাধারণত রাক্ষস জাতির পরিচায়ক বলে গণ্য করা হয়।
প্রথা অনুযায়ী দেবী দুর্গার অষ্টমীবিহিত সন্ধিপূজায় ১০৮টি নীল পদ্মের প্রয়োজন হয়, কিন্তু অনেক চেষ্টার পরেও রাম শুধুমাত্র ১০৭ টি পদ্মের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন। এসময় নিরুপায় হয়ে তিনি ১০৮তম পদ্ম স্বরূপ তাঁর নিজের চোখ উপড়ে নিতে উদ্যত হন। কথিত আছে যে, পতিতপাবন রামের চোখকে নীল পদ্মের সঙ্গে তুলনা করা হতো বলে তাঁর অপর নাম ছিল ‘পদ্মলোচন’।
মা দুর্গা এই প্রস্তাব পেয়ে রামের একনিষ্ঠতা দেখে খুশি হয়ে স্বয়ং ভগবান রামের সামনে আবির্ভূতা হন এবং দৈত্যরাজ রাবণকে যুদ্ধে পরাজিত করার জন্য রামচন্দ্রকে আশীর্বাদ করেন। মা দুর্গার এই অসময়ে আবাহন বাংলায় ‘অকালবোধন’ হিসাবে পরিচিত হয়। তারপর থেকেই শরৎকালে দেবী দুর্গার পূজা প্রচলিত হয়।
শরৎকালীন দুর্গাপূজা শারদোৎসব নামে পরিচিত হয় যা বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে বৃহদাকারে পালিত হয়। বসন্তকালীন দুর্গাপূজা বাসন্তী পূজা নামে পরিচিত যা ঐতিহ্যগতভাবে মূল দুর্গাপূজা হলেও শারদীয় দুর্গাপূজা উদযাপনের উন্মাদনায় তা প্রায় হারিয়ে গেছে।
যাহোক, আর্যরীতির সঙ্গে বাঙালির সৃজনশীলতা যুক্ত হয়ে দুর্গোৎসব বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। আমরা বর্তমানে যেমন পয়লা বৈশাখকে নববর্ষ হিসেবে পালন করি, শরৎ ঋতুর আরম্ভকে আর্যরা তেমনি নববর্ষ হিসেবে গণ্য করতেন। আর্যদের হিসাব অনুযায়ী আশ্বিন মাসের শুক্ল নবমীতে বর্ষা ঋতু পূর্ণ হয়। দশমীতে শরৎ আরম্ভ। আর্যদের নববর্ষ আর বাঙালির দুর্গাপূজা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। নববর্ষে প্রবেশের আগে সবাই প্রত্যাশা করে নতুন বছরটি সুখে যাবে, সুখে কাটবে, অভীষ্ট সিদ্ধ হবে, মনস্কামনা পূর্ণ হবে। দুর্গাপূজা করা হয় এ কারণে যে, মা দুর্গার কৃপা হলে নববর্ষে আমাদের বিজয় হবে। এ কারণে দশমীর নাম বিজয়া দশমী হয়েছে। এ বিষয়ে একটু বিস্তারিত আলোকপাত করা যাক।
দুর্গা কে? তিনি এক দেবী। দেবী কে? এক শক্তি। শক্তি কী? কর্ম বা কাজ করার ক্ষমতা। আমরা যে কথা বলি, কথা একটা কাজ। দেখি, শুনি, বুঝি এগুলোও কাজ। শক্তি ছাড়া কাজ হয় না। এ শক্তি-কথন শক্তি, শ্রবণ শক্তি, দৃষ্টি শক্তি, বোধ শক্তি। এ শক্তির নাম সরস্বতী।
একটি আমগাছের কথা চিন্তা করা যাক। গাছটি আগে ছিল না, নতুন জন্মেছে। এক শক্তি গাছটির জন্ম দিয়েছে। সে শক্তি এক দেব। সে দেবের নাম ব্রহ্মা। গাছটি এতকাল বেঁচে আছে, বেড়েছে। যে শক্তি এ গাছটিকে এতকাল বাঁচিয়ে রেখেছেন, বাড়িয়েছেন, তার নাম বিষ্ণু। একদিন গাছটির ডালপালা-ফুল-ফল থাকবে না, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একাকার হয়ে যাবে, আমগাছ বলে আর চিনতে পারা যাবে না। তখন গাছটির লয় হয়ে যাবে। যে শক্তি এ লয় ঘটাবেন, তিনি মহেশ্বর।
উল্লেখ্য, সনাতন হিন্দুধর্ম মতে, ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির, কার্য-কারণের তত্ত্বগত ব্যাখ্যায় ঈশ্বরের ট্রিনিটি বা ত্রয়ী অবস্থাকে গ্রহণ করা হয়েছিল। তিনি যখন সৃষ্টি করেন তখন তিনি ব্রহ্মা (সৃষ্টিকর্তা), যখন সৃষ্টি বজায় রাখেন তখন তিনি বিষ্ণু (পালনকর্তা), যখন নতুন সৃষ্টির মানসে জগৎ ধ্বংস করেন ঈশ্বর তখন মহেশ্বর (প্রলয়কর্তা)। বিশ্বেশ্বরের এই সৃষ্টি, পালন ও প্রলয়কার্যে যে এনার্জি (শক্তি) বা কনসাসনেস (চেতনা) অন্তঃসলিলার মতো বিশ্বজগতের সর্বত্র নিয়ত প্রবাহমান তাকে সনাতনধর্ম প্রকৃতি হিসাবে ব্যাখ্যা করেছে।
শক্তির আসলে কোনও রূপ নেই। লিঙ্গভেদ নেই। কাজের দ্বারা শক্তির পরিচয়। কর্মই তার রূপ। আমরা ভাষা ও ভাবের অনুরোধে কোনও শক্তিকে দেব, কোনও শক্তিকে দেবী বলি; কিন্তু বস্তুত এ ভেদ নেই। কর্ম দ্বারাই দেব-দেবীর পরিচয়। কর্ম দেখেই প্রতিমা কল্পনা। তাহলে প্রশ্ন আসে, তবু কেন এত দেব-দেবী? এ প্রশ্নটিরও মীমাংসা হওয়া দরকার।
প্রকৃতিতে আমরা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন দেখি। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা এভাবে ছয় ঋতুর পরিবর্তন হচ্ছে। শক্তি ছাড়া এ পরিবর্তন হতে পারে না। সে শক্তি এক দেব। নাম আদিত্য; কিন্তু শীত ঋতুর আদিত্য গ্রীষ্ম আনতে পারে না, গ্রীষ্ম ঋতুর আদিত্য শীত আনতে পারে না।
এটা অনেকটা সরকারি দপ্তরের মতো। যদি ডাক বিভাগের প্রধানকে বলা হয় আমাদের গ্রামে একটি স্কুল বানিয়ে দিন, তিনি বলবেন— সে আমার কাজ নয়। যদি শিক্ষা বিভাগের দেবতাকে গ্রামে একটি নলকূপ বসানোর জন্য বলি, তিনি বলবেন— সে আমার কাজ নয়। সরস্বতীর কাছে ধন চাইলে পাওয়া যাবে না। লক্ষ্মীর উপাসনা করে বিদ্যা চাইলে তিনিও স্রেফ না বলে দেবেন। তাহলে আমরা কী করব? যিনি পারবেন তার পূজা করব, উপাসনা করব। যিনি যাবতীয় শক্তির সম্মিলন, যিনি সব দেব-দেবীর মিলিত রূপ, তিনি বিশ্বশক্তি। ঋগবেদে এর নাম অগ্নি। আমরা বলি শক্তি।
অগ্নির এক প্রসিদ্ধ নাম— জাতবেদ, যা কিছু জন্মেছে তিনি তার সব জানেন, কারণ বিনাশক্তিতে কিছুই জন্মাতে পারে না। তার আরেক নাম ‘বিশ্ববিদ’, যিনি সমস্ত জানেন, কারণ যা কিছু আছে, যা কিছু ঘটছে সবই শক্তির কর্ম। পুরাণে অগ্নির নাম ‘তেজ’। আমরা যাকে শক্তি বলছি তিনি তেজঃ।
দুর্গা অগ্নির মতো, বিশ্বশক্তি। বিশ্ব শব্দের অর্থ সমস্ত। অনেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো (আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় নয় কিন্তু), যেখানে সমস্ত বিদ্যা সম্মিলিত হয়েছে, সমলগ্ন কিংবা সংযুক্ত নয়, একেবারে সম্মিলিত একীভূত। দুর্গা বিশ্বশক্তি। তিনি প্রসন্ন বা খুশি হলে আমাদের সব ইচ্ছাই পূর্ণ করতে পারেন।
হিন্দুধর্মে দেবী দুর্গা পরমা প্রকৃতি ও সৃষ্টির আদি কারণ। হিন্দু পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে তিনি শিবের স্ত্রী পার্বতী, কার্তিক ও গণেশের জননী, এবং কালীর অন্যরূপ।
দুর্গা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় শক্তির সম্মিলন। এ প্রসঙ্গে মার্কণ্ডেয় পুরাণে এক উপাখ্যান আছে। একবার দেবাসুরে (দেব বনাম অসুর) তুমুল মারামারি বেধেছিল। অসুররা পরাক্রান্ত, তারা নানা আকার ধারণ করতে পারত। এক অসুর বুনো মোষের আকার ধরে দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এক এক দেবতা যুদ্ধ করতে যান। পরাজিত হয়ে ফিরে আসেন। ইন্দ্র গেলেন, পরাজিত হয়ে ফিরে এলেন। বরুণ গেলেন, তারও ওই দশা। যিনি যান তিনিই পরাজিত হন। দেবতারা ব্রহ্মাকে সঙ্গে নিয়ে বিষ্ণু ও মহেশ্বরের কাছে গিয়ে তাদের দুর্দশা বর্ণনা করলেন। বিষ্ণু ও মহেশ্বর ভয়ানক ক্রুদ্ধ হলেন। তাদের সব তেজ বাইরে বেরিয়ে এলো। প্রত্যেক দেবতার তেজ বের হয়ে মিলিত হলো। এক বিশাল তেজরাজি একত্রিত হলো। সেই সম্মিলিত তেজ থেকে এক নারী আবির্ভূত হলেন। তার নাম চণ্ডী বা দুর্গা। তিনি সহজেই মহিষাসুরকে বধ করলেন।
আমরা যে দুর্গার পূজা করি, তিনি যে এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সম্মিলিত শক্তি, তা স্মরণ করার জন্য মহিষমর্দিনী রূপ কল্পিত হয়েছে। দুর্গার দশ হাত দেখেই বোঝা যায় যে, দুর্গা সম্মিলিত শক্তি। দশ হাতে দশ আয়ুধ। আয়ুধ মানে যুদ্ধাস্ত্র। এ আয়ুধ দেখলেই বোঝা যায় তিনি সকল দেবতার সম্মিলন। এক হাতে চক্র বা বিষ্ণুর আয়ুধ। অতএব তিনি বিষ্ণুশক্তি। এক হাতে শূল যা মহেশ্বরের আয়ুধ। অতএব দুর্গা মহেশ্বরী। এক হাতে নাগপাশ, নাগপাশ বরুণের আয়ুধ, অতএব দুর্গা বরুণানী— বরুণের শক্তি ইত্যাদি।
মার্কণ্ডেয় পুরাণের আরেক আখ্যানে বলা হয়েছে, দুর্গা শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামে দুই অসুরকে বধ করেছিলেন। অসুর দুটি নিহত হলে দেবতারা তার স্তব করেছিলেন। এই স্তবে বলা হয়েছে— ‘‘যা দেবী সর্বভূতেষু সৃষ্টি রূপেন সংস্থিতা/নমস্তস্যৈ, নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।”
অর্থাৎ তিনি যাবতীয় পঞ্চভৌতিক পদার্থে সৃষ্টিরূপে বিরাজমান, তাকে বারবার নমস্কার। তিনি শক্তিরূপে, সৃষ্টিরূপে, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, ক্ষমা, দয়া-মায়ার আধার, তিনি বিশ্ব মা, দুর্গা। তিনি চৈতন্য। তিনিই বিশ্বরূপ। এভাবে অনুপ্রাণিত হয়েই বঙ্কিমচন্দ্র ‘বন্দে মাতরম’ রচনা করেছিলেন।
বিশ্বশক্তির আধার যিনি, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে যার প্রকাশ তাকে আমরা পূজা করব কী দিয়ে? শক্তির পূজা মোটেও সহজ কাজ নয়। শক্তি তিন প্রকার: শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক। ভক্তিই তার পূজা, তার প্রিয় কর্ম করাও তার পূজা। আমরা তাকে মাতৃরূপে দেখতে ভালোবাসি। তার পূজাই সার্থক যিনি বিশ্বজননীকে সত্যি সত্যি মা মনে করেন, মায়ের প্রিয় কাজ করেন, তার আজ্ঞা পালন করে সুখী হন। যিনি এ মাকে আনন্দময়ীরূপে দেখতে পান, তিনি ধন্য। তার জন্ম সার্থক। দুর্গা তাই নিতান্তই বাঙালির দেবী।
দেবী দুর্গাকে বুঝতে হলে ভাবপ্রবণ বাঙালির নিজস্ব সংসার বেষ্টন ও অন্দরমহলকে অনুভব করতে হবে। পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বাঙালির দুর্গোৎসব’ নিবন্ধে বলেছেন— ‘‘শক্তিসাধনা ভাবের ও ভক্তিসাধনা রসের ও প্রেমের নহে। আদ্যশক্তিকে মা বলিয়া, মেয়ে বলিয়া এমন বিকাশ কোনো জাতির কোনো সাহিত্যে হয়নি। বাঙালি যেমন গালভরা, বুকপোড়া মা নামে ডাকিয়া তাকে, আবক্ষ, তৃণস্তম্ভ পর্যন্ত সকলকে মা বলিয়া মাধুরীমন্ডিত করিয়া লয়; এমন মাতৃভাবের অভিব্যক্তি আর কোনো জাতি করিতে পারে নাই। মায়ের ঘর-সংসার পাতাইয়া, মায়ের ছেলে হইয়া কেমন করিয়া থাকিতে হয়, তা বাঙালিই শিখিয়াছিল, বাঙালিই পারিয়াছিল। যে মায়ের স্নেহ পায় নাই, কন্যাকে আদর করে নাই, সে বাঙালির দুর্গোৎসব কেমন করে বুঝিবে। বাঙলার মায়ের স্নেহ বোঝা চাই, প্রাণে প্রাণে অনুভব করা চাই, বাঙালির গৃহের কুমারী কন্যার আদর-সোহাগ বোঝা চাই, যত্ন-আবদার জানা চাই, তবে ইষ্ট দেবতার ওপর সেই ভাব আরোপের মহিমা বুঝিতে পারিবে।’’
আজকের ঘোর বস্তুগত যুগে এত ভাবময় কথা, এতটা ভাবালুতা বুঝি কিছুটা অলীক মনে হয়; কিন্তু দুর্গাপূজার মূল অনুভবে ও আচরণে খানিকটা ভাবাতিরেক রয়েছে নিশ্চিত। দুর্গাপূজা পালনে বাঙালি হিন্দুর আড়ম্বর দেখে তা সহজেই বোঝা যায়।
লেখক: লেখক ও কলামিস্ট।
ইমেইল: [email protected]