এক সময় দেশের ফুটবলে ভরা যৌবন ছিল। তখন খেলা হতো সারা দেশে, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা ফুটবলাররা ঢাকার মাঠ মাতিয়ে হয়ে উঠতেন জাতীয় তারকা। এই পরম্পরায় চিড় ধরেছে ঝিমিয়ে পড়া জেলা ফুটবলের কারণে। এর মধ্যে আবার বিশেষ কিছু জায়গা বা অঞ্চল ছিল খুবই ফুটবল উর্বরা, তাদের ফুটবলার ছাড়া জাতীয় দলও কল্পনা করা যেতো না। ফুটবলের সেই আঁতুড়ঘরগুলোর ছন্নছাড়া রূপ ধরা পড়েছে সকাল সন্ধ্যার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক বদিউজ্জামান মিলনের তদন্তে। তৃতীয় কিস্তি চট্টগ্রামের ফুটবল নিয়ে
স্কুল ছুটির পর আরাফাত হোসেন পৌঁছে যায় ডায়নামিক ফুটবল একাডেমিতে। ষোলশহর আবদুল হামিদ সওদাগর উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রের চোখে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন। চট্টগ্রাম থেকে এসে একদিন ঢাকার মাঠে ফুটবল খেলবে।
কিশোর এই ফুটবলার এরই মধ্যে স্থানীয় টুর্নামেন্টে দারুণ পারফরম্যান্সের সুবাদে নজর কেড়েছে কোচদের। ২০২৩ সালে চট্টগ্রামের অনূর্ধ্ব-১৩ ফুটবল টুর্নামেন্টে হয়েছে সেরা খেলোয়াড়। আরাফাতের মতো অনেক কিশোর প্রতিদিন চট্টগ্রামের বিভিন্ন ফুটবল একাডেমিতে অনুশীলন করছে। একাডেমি বাড়ছে হু হু করে, কিন্তু সেই হারে বন্দরনগরী থেকে উঠে আসছে না ফুটবলার। অন্তত ঢাকায় বা জাতীয় দলের জার্সিতে দেখা যাচ্ছে না তাদের।
ঐতিহ্য-হারা চট্টগ্রামের ফুটবল
বাংলাদেশের ফুটবলে একটা সময় দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করেছেন চট্টগ্রামের ফুটবলাররা। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের ১৯৭৮ সাল থেকে যেটার শুরু। পরবর্তীতে ফুটবলার আসার জোয়ার চলমান ছিল নব্বইয়ের দশকের শেষেও।
চট্টগ্রাম থেকে উঠে এসেছেন আশীষ ভদ্র, দিলীপ বড়ুয়া, সুনীল কৃষ্ণ, ইউসুফ বলী, সুভাষ বড়ুয়া, ইকবাল খান, এফ আই কামাল (ফখরুল ইসলাম), সত্যজিৎ দাস রুপু, মাহবুব হোসেন রক্সি, শাহাজ উদ্দিন টিপু, মাসুদ পারভেজ কায়সার, আরমান আজিজের মতো তারকা ফুটবলার।
সর্বশেষ জাতীয় দলে খেলেছেন চট্টগ্রামের মামুনুল ইসলাম, শহীদুল আলম সোহেল, সাখাওয়াত হোসেন রনি, নাসির উদ্দিন চৌধুরীরা। এই সংখ্যাটা এখন শূন্যের কোটায়।
একটা সময় ঢাকায়ও বেশ দাপট ছিল চট্টগ্রামের ফুটবলারদের। আশি থেকে নব্বইয়ের দশকে চট্টগ্রামের ফুটবলাররা সাধারণত ঢাকায় খেলতেন আবাহনী, ভিক্টোরিয়া, ধানমন্ডি, আজাদ স্পোর্টিং, ইস্ট এন্ড ক্লাব, ওয়াপদা, রহমতগঞ্জে। অবশ্য মোহামেডান ও বিজেএমসিতেও কয়েকজন খেলেছেন। এসব ক্লাবে এখন আগের মতো পদচারণা নেই চট্টগ্রামের খেলোয়াড়দের।
নেই ঐতিহ্যবাহী ক্লাবগুলোও
২০০৭ সালে প্রথম পেশাদার লিগে চমৎকার খেললেও পরে তাদের এই ধারা আর অব্যাহত থাকেনি। দেশের শীর্ষ লিগ থেকে নামার পরও টিকে ছিল স্থানীয় প্রিমিয়ার লিগে। তবে ক্ষয় রোগ ধরেছিল। শেষমেষ এই রোগে ২০১০ সালের পর থেকে এই মোহামেডানকে আর দেখাই যায়নি চট্টগ্রামের ফুটবলে। এখনও সদরঘাটে মোহামেডানের সাইনবোর্ড লাগানো ভবনটি আছে জীর্ণশীর্ণ হয়ে। আগের সেই কোলাহল নেই, ক্রীড়া তৎপরতাও নেই এই ভবনে। অবশ্য প্রিমিয়ারের নীচের লিগে মোহামেডান ব্লুজ নামে একটি দল খেলছে।
মোহামেডানের দুর্দশার বিপরীতে চট্টগ্রাম আবাহনী এখনও নিজেদের ফুটবল ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। তারা দেশের শীর্ষ লিগে খেলছে এবারও তবে দাপুটে অবস্থান নেই। দলটি পেশাদার লিগ থেকে অবনমিত না হয়ে এখনও যে খেলে যাচ্ছে-এটাই আবাহনী কর্তাদের সন্তুষ্টির জায়গা। তারা দেশের প্রিমিয়ার লিগ খেলার পাশাপাশি চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার লিগে খেললে স্থানীয় ফুটবল আরও আকর্ষণীয় হয়। এটা আবাহনী কর্তাদের বারবার বলেও চট্টগ্রামে খেলাতে পারছে না স্থানীয় জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন।
ঢাকার পর চট্টগ্রাম লিগই ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। আবাহনী-মোহামেডানের লড়াইও উত্তাপ ছড়াতো পুরো জেলায়। চট্টগ্রাম মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ শাহাবুদ্দিন শামীম পুরনো দিনের স্মৃতিচারণা করে বলেন, “ঢাকার মতো চট্টগ্রামেও আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ মানেই প্রচন্ড উত্তেজনা ও জমজমাট লড়াই। পতেঙ্গা থেকে রাঙ্গুনিয়া, রাউজান সর্বত্র ক্লাবের পতাকা উড়তো। স্টেডিয়ামে বাস ভর্তি করে দর্শক আসতো। নব্বইয়ের দশকে আবাহনী-মোহামেডানের এক মেয়র কাপ ফাইনালে গ্যালারিতে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। মাঠের বাইরেও ঠিক সম পরিমণ দর্শক ছিল। মোহামেডান ১-০ গোলে এগিয়ে থাকা অবস্থায় বৃষ্টির কারণে ম্যাচ পরিত্যাক্ত হয়েছিল। দুই দলকে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করলে স্টেডিয়ামে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল মোহামেডান সমর্থকরা।”
আশি ও নব্বইয়ের দশকে ঢাকার তারকারা গিয়ে খেলতেন চট্টগ্রাম মোহামেডান ও আবাহনীতে। বাদল রায়, মোনেম মুন্না, কায়সার হামিদ, আশীষ ভদ্র, রুম্মন বিন ওয়ালী সাব্বির, শেখ মোহাম্মদ আসলাম, এফ এ আই কামাল, আলফাজ আহমেদ, আমিনুল হক, আরিফ খান জয়সহ অনেকে খেলেছেন চট্টগ্রামে।
এছাড়া সি কাস্টমস, ল্যান্ড কাস্টমস, নওজোয়ান ক্লাব, পোর্ট ক্লাব, বিসিআইসি, সিটি করপোরেশন ক্লাব, বন্দর ক্লাব- সি কাস্টমস দলগুলো অংশ নিত স্থানীয় লিগে। কিন্তু এখন এসব ক্লাব নেই চট্টগ্রাম লিগে। চট্টগ্রাম জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (ডিএফএ) সভাপতি এসএম শহীদুল ইসলাম এজন্য দুষছেন কর্তৃপক্ষকে, “ বিসিআইসি, সিটি করপোরেশন, বন্দর ক্লাবের মতো এমন সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে একেক সময় একেক জন আসেন। এদের অনেকে ক্রীড়ামোদী নন। খেলাধুলা ভালোবাসেন না। এ কারণে ফুটবলের দল গড়তে তত আগ্রহী হন না। আর এভাবেই দিনে দিনে চট্টগ্রামের ফুটবল ধ্বংস যাচ্ছে।”
নিয়মিত লিগের পরও…
জেলা ফুটবলের চারটা লিগের মধ্যে আছে প্রিমিয়ার লিগ, প্রথম বিভাগ লিগ, দ্বিতীয় বিভাগ ও তৃতীয় বিভাগ। তৃতীয় বিভাগে দলের সংখ্যা বিশ ছাড়িয়ে গেলেও ওপরের বাকি তিন লিগে খেলে ১০টি করে দল । এগুলোতে চট্টগ্রামের ফুটবলার খেলোনোর বাধ্যবাধকতাও আছে। প্রিমিয়ারে বিভিন্নভাবে চট্টগ্রামের ফুটবলার খেলানোর বিধিনিষেধ থাকলেও সেটা আগামী মৌসুম থেকে তুলে দেওয়ার কথা ভাবছে জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। তাদের যুক্তি, প্রিমিয়ার লিগ দিয়ে খেলোয়াড় তৈরি করা যায় না, এটা খেলোয়াড়ের মান প্রদর্শনীর চূড়ান্ত জায়গা। প্রিমিয়ার লিগ হলো দেশি-বিদেশী ভাল ফুটবলারদের নিয়ে চট্টগ্রামের ফুটবলকে আকর্ষণীয় মোড়কে উপস্থাপনের জায়গা।
এর নীচের লিগগুলোতেই খেলোয়াড় তৈরি হয়। তাই প্রথম বিভাগে তারা ৫ জন চট্টগ্রামের ফুটবলার খেলানোর বাধ্যবাধকতা জারি রেখেছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগেও আছে সেই কড়াকড়ি যেন স্থানীয় উঠতি ফুটবলাররা ভালোভাবে খেলার সুযোগ পায়। এত আয়োজনের পরও অবিশ্বাস্যভাবে চট্টগ্রাম থেকে খেলোয়াড় উঠে আসছে না!
তাহলে কী ভাল সংগঠকের আকাল !
ভাল খেলোয়াড় তৈরির পেছনে থাকেন ভাল সংগঠকরা। আশীষ ভদ্রের মতো তারকার জন্ম হয়েছে তারকা ক্রিকেটার তামিম ইকবালের বাবা ইকবাল খানের হাতে। তার হাতেই চট্টগ্রামে তৈরি হয়েছিল কেকেআরসি।
ফুটবল কোচ নজরুল ইসলাম লেদু বলেন, “যারা ইকবাল খানের কাছে অনুশীলন করতেন, দুপুরের খাবারে ইকবাল খান তাদের সবাইকে রাজসিক খাবার দিতেন– তার বাবার ‘খাজা হোটেলে’। আশীষ ভদ্র ইকবাল খানের অধীনে তৈরি হওয়া সব চাইতে বড় ফুটবলার। বর্তমানে ইকবাল খানদের মতো সংগঠক খুঁজে পাওয়া যাবে না চট্টগ্রামে। এজন্য সেই মানের ফুটবলারও উঠে আসছে না।”
চট্টগ্রাম ডিএফএর সভাপতি এসএম শহীদুল ইসলাম আক্ষেপের সুরে বলেন, “আগের মতো সংগঠক আর আসবে না। সংগঠকদের সবারই ক্লাবের প্রতি আত্মনিবেদন ছিল অনেক। যেমন আবদুর শুক্কুর চৌধুরী। তিনি রাইজিং স্টার ক্লাবের সংগঠক ছিলেন। আমরা তার হাত ধরেই ফুটবলার হয়েছিলাম।”
তারা ছিলেন ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর সংগঠক। ওরকম ক্রীড়ামুখী ও আন্তরিক সংগঠক এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না চট্টগ্রামে।
এখনকার সংগঠকরা নিজের স্বার্থ চিন্তা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। জাতীয় দলের গোলরক্ষক শহীদুল আলম সোহেল মনে করেন, “চট্টগ্রামের সংগঠকদের মধ্যে কাউন্সিলর তৈরির প্রতিযোগিতা হয়। কারণ যত বেশি কাউন্সিলরের পদ তৈরি হবে তত বেশি টাকা আয় করা যাবে। তাই যেনতেন ভাবে একটি দল মাঠে নামিয়ে দিলেই হলো। কে খেলল বা খেলল না সেদিকে কারও মাথা ব্যথা নেই।”
আসলে সর্ষের মধ্যেই ভূত
চট্টগ্রামে নিয়মিত লিগ হয়। একটা-দুটো নয়, চার-চারটা লিগ হয়। বেশ কিছু একাডেমিও আছে। এরপরও ফুটবলার উঠে না আসার ব্যাপারটা বড় রহস্যময়। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে চট্টগ্রামের লিগে যারা খেলেন তাদের বেশিরভাগই চট্টগ্রামের বাইরের ফুটবলার। আর শহরের সব একাডেমি হলো টাকা আয়ের মেশিন। এদিকে বাফুফে ইতিমধ্যে ১৯টি একাডেমিকে পাঁচ তারকা রেটিং দিয়েছে। কী বুঝে দিয়েছে বা কীসের বিনিময়ে দিয়েছে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার আরমান আজিজ মনে করেন, “এসব কিশোর একাডেমিতে ফুটবলারদের অনুশীলন হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু তাদের পর্যাপ্ত বিশ্রাম বা রিকভারির সময় দেওয়া হচ্ছে না। একটা দল গোছানোর সুযোগ দেওয়া হয় না। সবার মানসিকতা একটাই, তাড়াতাড়ি শুরু করে তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। তাছাড়া কোচের মান নিয়েও আমার মনে প্রশ্ন আছে।”
এত লিগের পরও ফুটবলার উঠে না আসার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে চট্টগ্রাম আবাহনীর সাবেক অধিনায়ক ও ক্রীড়া সাংবাদিক দেবাশীষ বড়ুয়া দেবু বলেছেন, “এই যে লিগের গল্প সেখানে তো চট্টগ্রামের ফুটবলার খুব কম। চট্টগ্রামের বাইরের ফুটবলাররাই খেলে চট্টগ্রামের লিগগুলোতে। আগে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা পটিয়া, আনোয়ারা, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া থেকে খেলোয়াড় আসতো। ওসব উপজেলায় এখন ফুটবল হয় না। চট্টগ্রামের ফুটবলার সংখ্যা ভয়ংকরভাবে কমেছে।”
তাই খেলা, লিগ হওয়ার পরও স্থানীয় ফুটবলের কোনও উন্নতি নেই। অন্যান্য জেলার ফুটবলাররা চট্টগ্রামে খেলে যায়।
শেষ কথা
চট্টগ্রাম অন্যান্য জেলার চেয়ে একদম আলাদা। এখানে ডিএফএ খেলা চালায়, নিয়মিত লিগ হয় কিন্তু এই লিগে খেলে অন্যান্য জেলার ফুটবলাররা। স্থানীয় উপজেলাগুলোয় ফুটবল-চর্চা কমে যাওয়ায় ফুটবলারের আকাল পড়েছে চট্টগ্রামে।