এক বছরের ব্যবধানে দেশে নতুন পাঁচটি ক্যান্সারের ধরন শনাক্ত হয়েছে। গত বছরও যেখানে ৩২ ধরনের ক্যান্সারের কথা বলা হচ্ছিল, সাম্প্রতিক এক গবেষণায় তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮টিতে।
বিশ্বজুড়ে ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশেও প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন।
বিশ্বের সব দেশেই ক্যান্সার আক্রান্তদের সমন্বিত চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সে ব্যবস্থা নেই। যদিও বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, তাদের প্রত্যেকেরই ক্যান্সারের পাশাপাশি অন্যান্য শারীরিক সমস্যাও দেখা দিচ্ছে। কিন্তু সমন্বিতভাবে চিকিৎসার কোনও সুযোগ এখনও দেশে গড়ে ওঠেনি।
এতদিন দেশে মোট কত রোগী ক্যান্সারে আক্রান্ত তার কোনও সঠিক পরিসংখ্যান ছিল না। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় একটি জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছে। যেখানে দেখা গেছে, প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ১০৬ জন ক্যান্সারে আক্রান্ত। দেশে মোট মৃত্যুর ১২ শতাংশই হচ্ছে এই রোগটিতে।
এ গবেষণার প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. খালেকুজ্জামান বলেন, “বাংলাদেশে জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার রেজিস্ট্রি বা নিবন্ধন (পিবিসিআর) না থাকায় প্রতিবেশী দেশগুলোর তথ্য ব্যবহার করে ক্যান্সারের পরিস্থিতি অনুমান করতে হতো। যার কারণে ক্যান্সারের সঠিক পরিস্থিতি আসলে কেমন, তা নির্ধারণে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ক্যান্সারের পরিস্থিতি নির্ণয় করা জরুরি হয়ে পড়েছিল বলেই কিশোরগঞ্জের দুই লাখ মানুষের ওপর বছরব্যাপী এই গবেষণা পরিচালিত হয়।”
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি যে ক্যান্সারগুলোয় আক্রান্ত হন সেগুলো হলো স্তন, ঠোঁট ও মুখগহ্বরের, পাকস্থলি ও স্বরযন্ত্র এবং জরায়ুমুখ ক্যান্সার।
ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ফুসফুস ক্যান্সারে, পুরুষরাও এই ক্যান্সারে বেশি মারা গেছেন। অন্যদিকে নারীদের মধ্যে স্তন ও জরায়ু ক্যান্সারে মৃত্যুর হার বেশি।
মৃতদের মধ্যে অনেকই ছিলেন যারা বিভিন্ন ধরনের জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত। তাদের মধ্যে ১৭ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপ, ১১ শতাংশের ডায়াবেটিস, ছয় শতাংশের হৃদরোগ এবং তিন শতাংশের কিডনি রোগ ছিল। দুই শতাংশ ক্যানসার রোগীর স্ট্রোকের ইতিহাসও পাওয়া গেচে। এছাড়া প্রায় ৭৬ শতাংশ পুরুষ ক্যান্সার রোগীর ধূমপানের ইতিহাস আছে।
ক্যান্সার রোগের বিশেষজ্ঞরা সবসময়ই বলেন, এই রোগে একক চিকিৎসা নয়, বরং এর চিকিৎসা হতে হবে সংমিশ্রিত, সমন্বিত। যাকে বলা হয় কমবাইন্ড চিকিৎসা। কিন্তু বাংলাদেশে কম্বাইনড চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। ফলে যাদের সামর্থ্য আছে তারা দেশের বাইরে গিয়ে সমন্বিত চিকিৎসা নিচ্ছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপেও এর সত্যতা মেলে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সবশেষ গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে ১২টি অসুখের চিকিৎসায় বিদেশ যাওয়ার হার বেশি। অসুখগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ক্যান্সার, ২১ শতাংশ ক্যান্সার রোগী বিদেশে চিকিৎসা নিদে যান। এরপর রয়েছে হৃদরোগী, ১৮ শতাংশ। কিডনি রোগীর বিদেশ যাওয়ার হার ১৪ দশমিক পাঁচ শতাংশ।
দীর্ঘদিন ক্যান্সার নিয়ে কাজ করা চিকিৎসক হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলেন, ক্যান্সার চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত সমন্বিত পদ্ধতির পাশাপাশি জাতীয় ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিও নেই।
“অথচ এখন দেশে যে পরিমাণ রোগী, তার জন্য দরকার একটি জাতীয় ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ কৌশল। যার অধীনে থাকবে ক্যান্সার কর্মকাণ্ড ও কর্মসূচির বিস্তারিত পরিকল্পনা। সেই সঙ্গে আস্থা রেখে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া যায়, সেই আস্থার জায়গাতেও সংকট তীব্র ভীষণ।”
সঠিকভাবে ক্যান্সার শনাক্ত, স্ক্রিনিং সিস্টেম এবং চিকিৎ প্রোটোকল অবশ্যই থাকতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সবকিছুকে এক ছাতার নিচে আনতে হবে।”
একমাত্র জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালেই সরকারিভাবে পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সারের চিকিৎসা পাওয়া যায় জানিয়ে হাসপাতালটির সাবেক এই চিকিৎসক বলেন, “এর বাইরে আরও প্রায় ২০টি সরকারি হাসপাতালে ক্যান্সারের চিকিৎসা পাওয়া গেলেও তা পূর্ণাঙ্গ নয়।”
ক্যান্সারের চিকিৎসা দলগতভাবে হলেই তাকে আদর্শ বা মডেল চিকিৎসা ব্যবস্থা বলা যায়। আর নিয়ম অনুযায়ী, এই দলে থাকবেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, সার্জন, অনকোলজিস্টসহ অন্যরা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালযের হেমাটোলজি বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ডা. গুলজার হোসেন বলেন, “ক্যান্সারের চিকিৎসা অনেকদূর এগোলেও দেশে এখনও কোনও বৃহৎ অবকাঠামো গড়ে তোলা যায়নি না বিপুল জনগোষ্ঠীকে সেবা দিতে সক্ষম।”
রোগ নির্ণয়ের সব ধরনের সেবা না থাকাও এর অন্যতম কারণ হিসেবে জানিয়ে তিনি বলেন, “এক ছাদের নিচে সব সেবাকে আনতে না পারা বড় সংকট। আমাদের দক্ষ জনবলের ঘাটতিও রয়েছে। পর্যাপ্ত রেডিওথেরাপি মেশিন না থাকা, থাকলেও বেশিরভাগ সময় তা অচল থাকা এখনও আমাদের ক্যান্সার চিকিৎসাকে কিছুটা ব্যাকফুটে রেখেছে।”
ক্যান্সারের জন্য সমন্বিত কোনও চিকিৎসা ব্যবস্থা কেন গড়ে ওঠেনি জানতে চাইলে গুলজার হোসেন বলেন, “সুষ্ঠু ও সুদুরপ্রসারি পরিকল্পনার অভাব, দক্ষ জনবল এবং জনশক্তির অভাবসহ বিভিন্ন বিভাগের নিজেদের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের ঘাটতি এবং একে অন্যের প্রতি সহযোগিতার মনোভাব গড়ে না ওঠাই এর কারণ।”
জাতীয় ক্যান্সার কন্ট্রোল কাউন্সিলের বৈঠক হয়েছে মাত্র একটি
দেশে জাতীয় ক্যান্সার কন্ট্রোল কাউন্সিল এক দশকের বেশি সময় ধরে অকেজো। ক্যান্সারসংক্রান্ত পরিকল্পনাসহ সবকিছু এই কাউন্সিলের মাধ্যমে হওয়ার কথা থাকলেও গত ১২ বছরে তারা মাত্র একটি বৈঠক করতে পেরেছে। এই কাউন্সিলের কাজ ছিল ক্যান্সারবিষয়ক যেকোনো প্রকল্প ও পরিকল্পনা একনেকে পাঠানো।
কাউন্সিলের সভাপতি হিসেবে আগে ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এবং কমিটির মেম্বার সেক্রেটারি হিসেবে পদাধিকারবলে থাকেন জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক।
দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কাউন্সিলে কোনও কাজই হয়নি।
কাউন্সিলকে নিষ্ক্রিয় উল্লেখ করে হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলেন, “এটা সচল কবে হবে সেটাও অজানা “
অন্যদিকে পদাধিকার বলে পদ থাকলে জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতালের পরিচালকরা বলছেন, তারা এ কাউন্সিল সম্পর্কে কিছুই জানেন না।
বর্তমান ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জাহাঙ্গীর কবির জানালেন, তিনি দুই মাস হলো এ পদে যোগ দিয়েছেন, কিন্তু কাউন্সিল সম্পর্কে কিছুই জানেন না।
সাবেক পরিচালক ডা. নিজামুল হকের সঙ্গে। তিনিও কাউন্সিলের কাজ সম্পর্কে অবহিত নন।
তিনি বলেন, “এ নামে কোনও কাউন্সিল রয়েছে, সেটাইতো আমার জানা নেই!”