Beta
সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪
Beta
সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪

কলাম

সমঝদাররা কেন আবার তিশ্যানকে মনে করছে

সেই ব্যাগ হাতে গোয়েন্দা চার্লস হিল, একপাশে সেই ছবি।

২০০২ সালে লন্ডনের রিচমন্ড এলাকার একটি বাসস্ট্যান্ডে ফেলে যাওয়া বড় প্লাস্টিকের শপিং ব্যাগ থেকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড-এর অবসরে যাওয়া প্রবীণ অনুসন্ধানী গোয়েন্দা চার্লস হিল বের করলেন সাত বছর আগে উইল্টশায়ারের লঙ্গলিট এস্টেট থেকে চুরি হওয়া ফ্রেম খোয়ানো তিশ্যানের আঁকা সেই ছবিটি— ‘দ্য রেস্ট অন দ্য ফ্লাইট ইন্টু ইজিপ্ট’।

পেইন্টিংটি পাওয়ার পর মনে করা হয়েছিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যদি প্রমাণিত হয় এটি  ‘ফেইক’ নয়, খাঁটি তিশ্যান তা হলে নিলামের ডাকে পাঁচ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত দাম উঠতে পারে।

চার্লস হিল একটা ‘ফেইক’ পেইন্টিং-এর পেছনে সাত বছর শ্রম দেবেন এটাও হবার নয়। লঙ্গলিট এস্টেট একটি ঘোষণা দিয়েছিল, পেইন্টিং উদ্ধারকারীকে একলক্ষ পাউন্ড স্টার্লিং পুরস্কার দেওয়া হবে। ব্যাগ খুলে সযত্নে যখন বের করলেন, দেখা গেল ফ্রেমটা  নেই, তবে ‘দ্য রেস্ট অন দ্য ফ্লাইট ইন্টু ইজিপ্ট’ পেইন্টিং-এর তেমন কোনও ক্ষতি হয়নি। লঙ্গলিটের কিউরেটর ছবি দেখে বললেন, এটাই। তারপরও পরীক্ষার জন্য গবেষণাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। নিশ্চয়ন করা হলো, এটা তিশ্যানের ‘দ্য রেস্ট অন দ্য ফ্লাইট ইন্টু ইজিপ্ট’ না হয়ে পারে না। সেই ছবির ডাক হতে যাচ্ছে, পাঁচ নয় বত্রিশ মিলিয়ন ডলারের বেশি ডাক উঠবে বলে চিত্র-বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

১৯৯৪ সালে চার্লস হিল এডভার্ড মুঙ্খের বিখ্যাত ‘দ্য স্ক্রিম’ উদ্ধার করে সেলেব্রিটি  গোয়েন্দা হয়ে উঠেছিলেন। তিশ্যানের এই ছবিটি আগেও একবার চুরি হয়েছিল। ১৮০৯ সালে ভিয়েনার ভেলভার্দে প্রাসাদ থেকে নেপোলিয়নের সৈন্যরা এই ছবিটি লুন্ঠন করেছিল।

জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে মেরি ও জোসেফ শিশু জিসাসকে নিয়ে মিশরে পালিয়ে যাচ্ছেন, বাইবেলের এই বিবরণটি কারাভাজ্জিও, তিশ্যানসহ রেনেসাঁ যুগের এবং তারও আগে অনেক শিল্পী ক্যানভাসে, কাঠের প্যানেলে তুলে এনেছেন। ১৫০৮ সালে তিশ্যান যখন আঁকেন তার বয়স তখন ১৮ কিংবা ২০ বছর। ক্লান্ত পরিবার গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছে, আড়াল করে রাখা হয়েছে শিশু জিসাসকে।

জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে মেরি ও জোসেফ শিশু জিসাসকে নিয়ে মিশরে পালিয়ে যাচ্ছেন, বাইবেলের এই বিবরণটি কারাভাজ্জিও, তিশ্যানসহ রেনেসাঁ যুগের এবং তারও আগে অনেক শিল্পী ক্যানভাসে, কাঠের প্যানেলে তুলে এনেছেন। ১৫০৮ সালে তিশ্যান যখন আঁকেন তার বয়স তখন ১৮ কিংবা ২০ বছর। ক্লান্ত পরিবার গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছে, আড়াল করে রাখা হয়েছে শিশু জিসাসকে।

‘দ্য রেস্ট অন দ্য ফ্লাইট ইন্টু ইজিপ্ট’ ১৫০৮।

রঙের জাদুকর তিশ্যানের হাতে স্লিপিং ভেনাস কিংবা ভেনাস অব উরবিনোসহ শত অনিন্দসুন্দর নারী আঁকা হয়েছে। তাঁর রঙের জাদু নিয়ে চিত্রসমঝদারগণ অনেক প্রশংসা করলেও তিনি বলছেন: ‘‘উজ্জ্বল রঙ নয় ভালো ড্রইং-ই সুন্দর ফিগার তৈরি করে।”

তিশ্যান নামে প্রসিদ্ধ ইতালীয় চিত্রকর তিজিয়ানো ভেসেল্লিও (১৪৯০-১৫৭৬)

রঙ নিয়ে তাঁর অনেক কথা: (ক) ভালো পেইন্টারের মাত্র তিনটি রঙ প্রয়োজন— কালো, সাদা এবং লাল। (খ) সব পেইন্টারেরই রঙ লাগাবার মেধা থাকে না, আসলে সমস্যার মুখোমুখি হলে অনেক পেইন্টার হতাশ হয়ে পড়েন। চাপ সৃষ্টি করে, প্রয়োজনীয় মেধার ঘাটতি থাকা শিল্পী কেবল ছবির ফর্ম নষ্ট করতে পারেন।

পোট্রেট, ল্যান্ডস্কেপ, পুরাণ ও ধর্মীয় বিষয়ের ছবি আঁকায় তাঁর অবস্থান এতোটাই উঁচুতে ছিল যে তার সমকালীন কেউ কেউ দান্তের প্যারাদিসো-র শেষ পঙক্তিটি তার উপর প্রয়োগ করেন: ক্ষুদ্র তারার দেশে একটি সূর্য। দ্য সান এমিডস্ট স্মল স্টার্স।

তিশ্যানের আঁকা ‘ফ্লোরা’


তিশ্যানের কয়েকটি সেরা ছবি
অ্যাসাম্পশন অব দ্য ভার্জিন, বাক্কাস অ্যান্ড অ্যারিয়ান, ডায়ানা অ্যান্ড অ্যাকটিয়ন, ভেনাস অব উরবিনো, সেক্রেড অ্যান্ড প্রোফেন লাভ, ভেনাস অ্যান্ড এডোনিস, ডায়ানা অ্যান্ড ক্যালিস্তো, দ্য রেইপ অব ইউরোপ, স্লিপিং ভেনাস, পোর্ট্রটে অব পোপ পল থ্রি, মার্টিয়ারডোম অব স্টেইন্ট লরেন্স, অ্যানানসিয়েশন, দ্য ফিস্ট অব দ্য গড, স্যালোম, সেল্ফ পোর্ট্রেট, দ্য জিপসি ম্যাডোনা।

ইউরোপে যার পরিচিতি তিশ্যান, তাঁর পেইন্টব্রাশ সম্পর্কে বলা হয় তিশ্যানের হাতে যখন ব্রাশ তা আপনাতেই অনুভূতিপ্রবণ হয়ে উঠে। তিনি মনে করেন শিল্পীকে তার অবজেষ্ট-এর নির্যাস অবশ্যই পেতে হবে। শিল্পী যা আঁকছেন তাতে বস্তুর চরিত্র ও আবেগের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে।

পরিণত শিল্পী তিশ্যান যখন বলেন ‘আমি মনে করি পেইন্টিং সম্পর্কে কিছু শিখতে শুরু করেছি’ তখন বুঝিয়ে দেন শেখার দিগন্ত অনিঃশেষ এবং একই সাথে অনেক শিল্পীর আত্মম্ভরিতাকে ধুলায় মিশিয়ে দেন। ষোড়শ শতকের ভেনেশিয়ান স্কুলের প্রধান শিল্পী ইতালীয় রেনেসাঁর অন্যতম অবদানকারী তিজিয়ানো ভেসেল্লি (কিংবা ভেসেল্লিও)। ইউরোপে যার পরিচিতি তিশ্যান, তাঁর পেইন্টব্রাশ সম্পর্কে বলা হয় তিশ্যানের হাতে যখন ব্রাশ তা আপনাতেই অনুভূতিপ্রবণ হয়ে উঠে। তিনি মনে করেন শিল্পীকে তার অবজেষ্ট-এর নির্যাস অবশ্যই পেতে হবে। শিল্পী যা আঁকছেন তাতে বস্তুর চরিত্র ও আবেগের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে।

তিশ্যানের ‘ভেনাস অব উরবিনো’

তিশ্যানের নারী
নারীর সৌন্দর্য ও আবেগ এবং পরিপূর্ণ শরীর সম্পর্কে তিশ্যানের চেয়ে ভালো ধারণা আর কে দেবেন। তাঁর হাতে আঁকা ক’টি অবিস্মরণীয় নারী চিত্র ‘ওমেন উইথ অ্যা মিরর’, ‘দ্য ভেনাস অব উরবিনো’, ‘ডায়ানা অ্যান্ড ক্যালিস্তো’ ও ‘রেইপ অব ইউরোপ’, ‘বাক্কাস অ্যান্ড অ্যাকটেয়ন’, ‘লাভিনিয়া’, ‘ভেনাস উইথ অ্যান অর্গানিস্ট অ্যান্ড অ্যা ডগ’, ‘ভেনাস উইথ অ্যান অর্গানিস্ট অ্যান্ড কিউপিড’, ‘দ্য ভার্জিন অ্যান্ড চাইল্ড’, ‘দ্য স্লিপিং ভেনাস’, ‘স্যাক্রেড অ্যান্ড প্রোফেন লাভ’, ‘ভেনাস অ্যানডিওমেন’, ‘ফ্লোরা’, ‘দ্য মেডোনা অব দ্য র‌্যাবিট’, ‘দ্য অ্যালদোব্রেনদিনি মেডোনা’, ‘ড্যান্স উইথ অ্যা নার্স’, ‘তারকুইন অ্যান্ড লুক্রেশিয়া’, ‘পার্থেউস অ্যান্ড অ্যান্ড্রোমিডা’, ‘দ্য ডেথ অব অ্যাকটিয়ন’, ও ‘দ্যা পেনটিনেন্ট ম্যাগদেলান’।

তিশ্যানের ‘খ্রাইস্ট ক্যারিইং দ্য ক্রস’

তিশ্যান কেমন করে আঁকতেন
তার সমসাময়িক একজন শিল্পীর বর্ণনা: তালতাল রঙ ব্যবহার করতেন…যাই আঁকতেন তার একটা ভিত তৈরি করে নিতেন প্রথমে, তার উপর আঁকতে আরম্ভ করতেন। আমি নিজে তাঁকে দেখেছি, রঙে তুলি ডুবিয়ে দৃঢ় হাতে টান দিতেন। কখনও কখনও এক পোঁচ বিশুদ্ধ মৃত্তিকা লাল রঙ, যেন একটা হাফ-টোন, অন্য কোনও সময় সাদা শিসার মতো একটা তুলির টান দিতেন, তারপর উচ্চকিত আলোর জন্ম দিতেন এব এই আঙ্গিক রীতি অনুসরণ করে তুলির চার টানে একটা চমৎকার ফিগারের আভাস দিতেন। (কবীর চৌধুরীর অনুবাদ) তিশ্যান প্রায় ষাট বছর শিল্পকলার ভেনেশিয়ান ধারার অবিসংবাদিত প্রধান নেতা ছিলেন ।


ইতালীয় চিত্রকর তিজিয়ানো ভেসেল্লিও তিশ্যানের জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাক্রম
১৪৯০ : জন্ম  ভেনিসে, কারও মতে ১৪৮৮ সালে।
১৫০৭ : শিল্পী জিওর্জিয়নের সহযোগী হিসেবে ফ্রেসকো অঙ্কন শুরু।
১৫১১ : পাদুয়ার কার্মেলাইট চার্চে ফ্রেসকো অঙ্কন।
১৪২২ : ভেনিস প্রত্যাবর্তন।
১৫১৩ : সম্মানজনক ব্রোকারস প্যাটেন্ট লাভ, সরকারি কাজের তত্ত্বাবধায়ক।
১৫১৬ : সিনেটের পেনশন লাভ (জিওভান্নি বেলিনির পর)।
১৫৩১ : দ্য ডেথ অব সেইন্ট পিটার অঙ্কিত।
১৫২৩ : বাক্কাস অ্যান্ড অ্যারিয়ান।
১৫২৫ : মিসট্রেস ও তাঁর দু’সন্তানের জননী সিসিলিয়াকে বিয়ে।
১৫৩০ : সিসিলিয়ার মৃত্যু, তাঁর অপর কন্যা লাভিনিয়ার মাকে বিয়ে।
১৫৬০ : সন্তান জন্মদানের সময় লাভিনিয়ার মৃত্যু।
১৫৬২ : দ্য রেইপ অব ইউরোপ অঙ্কন সম্পন্ন।
১৫৬৫ : প্যানিটেন্ট ম্যাগদেলেন অঙ্কন।
১৫৭৫ : সেইন্ট সেবাস্টিয়ান। ১৫৭৬ : ২৭ আগস্ট ভেনিসে প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু।

তিশ্যানের ‘অ্যাজাম্পশন অব দ্য ভার্জিন’-এর ক্লোজআপ।

ওভিদের সাহিত্য ও পুরাণের রূপায়ণ
পরিণত বয়সে তিনি ওভিদের রচনা ধরে শুরু করলেন তাঁর ‘পয়েজি’ সিরিজ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে: ‘ভেনাস অ্যান্ড এডোনিস’, ‘ডায়ানা’, ‘ডায়ানা অ্যান্ড অ্যাকটেয়ন’, ‘ডায়ানা অ্যান্ড ক্যালিস্তো’, ‘পার্সেউস অ্যান্ড অ্যান্ড্রেমিডা’, ‘দ্য রেইপ অব ইউরোপ’; অসমাপ্ত রয়ে যায় ‘দ্য ডেথ অব অ্যাকটেয়ন’। তিশ্যানের কমবেশি ১০০ ছবির কোনও হদিস নেই।

‘দ্য রেস্ট অন দ্য ফ্লাইট ইন্টু ইজিপ্ট’ দ্বিতীয় দফায় চুরি হওয়া আর তা আবার ফিরে পাওয়া চিত্রসমঝদার দুনিয়াকে তিশ্যানকে আবার মনে করিয়ে দিল।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক।
ইমেইল: momen98765@gmail.com

আন্দালিব রাশদী। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার
ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত