জীবন থেকে তিনি নিয়েছেন বড় শিক্ষা। পদে পদে বাধা আর প্রতারণা ওঁত পেতে থাকে। সেগুলো মোকাবিলা করে কীভাবে সামনে এগিয়ে যেতে হয়, কৈশোরেই শিখে নিয়েছেন তাওহীদ হৃদয়। ক্রিকেট পথ তৈরি করার শুরুতেই হয়েছিলেন প্রতারণার শিকার। ভুয়া একাডেমিকে ভর্তি হয়ে গচ্চা দিয়েছিলেন বেশ কিছু টাকা-পয়সা।
ক্রিকেট জীবন বলুন বা ব্যক্তিগত জীবন, তখনই বুঝে গিয়েছিলেন এখানে টিকে থাকতে গেলে লড়াই করতে হবে। হৃদয় সেই লড়াইয়ের অস্ত্র এতটা মজবুত করেছেন যে, এখন বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে লড়াকু সৈনিকদের একজন তিনি।
দৃঢ় মানসিকতা আর চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞায় বোলারদের চোখে চোখ রেখে অবলীলায় শট খেলতে পারেন। অনায়াসে সীমানাছাড়া করতে পারেন বল। ছক্কা মারার দুর্বলতা নিয়ে প্রায়ই সমালোচনার মুখে পড়েন বাংলাদেশের ব্যাটাররা। তবে হৃদয়ের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠার জায়গা সত্যি আছে কি? এতদিন প্রশ্ন থাকলেও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচের পর আর থাকার কথা নয়। টানা ৩ ছক্কায় আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের ঝলক দেখিয়ে নামের মতোই হৃদয় জিতে নিয়েছেন তিনি।
কেন ৩ ছক্কার এত গুরুত্ব
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয় দিয়ে বিশ্বকাপ মিশন শুরু করেছে বাংলাদেশ। লক্ষ্য খুব বড় ছিল না, ১২৫ রানের। কিন্তু এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বোলারদের যে দাপট চলছে, সেটি ডালাসের গ্র্যান্ড প্রেইরি স্টেডিয়ামেও বহাল থাকল। সঙ্গে বাংলাদেশের টপ অর্ডারের ব্যর্থতার গল্প তো চলমান আছেই। ফলে রান তোলার গতি কমে যায় বাংলাদেশের। হৃদয়ের ওই টানা ৩ ছক্কার মাহাত্ম্য এখানেই।
লঙ্কান বোলারদের মানসিকতাও কিছু সময়ের জন্য ভেঙে দিয়েছিল হৃদয়ের ব্যাটের তাণ্ডব। সমান্তরালে বাংলাদেশ ক্যাম্পে ফিরে আসে উচ্ছলিত আত্মবিশ্বাস। স্কোরবোর্ডে ১১ ওভারে ৭৩ রান ৩ বলের ব্যবধানে বেড়ে দাঁড়ায় ৯১-তে। জয় থেকে মাত্র ৩৪ রান দূরে। হৃদয়ের ওই ঝলক পরের বলে শেষ হয়েছে, পরে আরও উইকেট হারিয়েছে, তবে তার ৩ বলে নেওয়া ওই ১৮ রানের কারণেই হয়তো ৬ বল আগে জয় নিশ্চিত করতে পেরেছে বাংলাদেশ।
কীভাবে এলো ৩ ছক্কা
নিজের তৃতীয় ওভারে বোলিংয়ে এসেছিলেন ভানিন্দু হাসারাঙ্গা। শ্রীলঙ্কান অধিনায়কের প্রথম বলে স্লগ সুইপ করে মিডউইকেটের ওপর দিয়ে ছক্কা মারেন হৃদয়। দ্বিতীয় বলে আরও বড় ছয়। এবার ডিপ স্কয়ার লেগের ওপর দিয়ে। তৃতীয় বলে কভারের ওপর দিয়ে ছক্কা। টানা ৩ বলে ৩ ছক্কা হাঁকিয়ে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ‘আসল’ রূপ ফেরান হৃদয়।
বোলার হাসারাঙ্গার কথা টানলে হৃদয় মেরেছেন আসলে টানা ৪ ছক্কা! কারণ শ্রীলঙ্কান লেগ স্পিনারের আগের ওভারের শেষ বলটাও সীমানার ওপার উড়িয়ে মেরেছিলেন তিনি। নতুন ওভারের প্রথম ৩ বলেও ৩ ছক্কা। সব মিলিয়ে ৪ ছক্কা ও ১ চারে ২০ বলে ৪০ রানের ইনিংস খেলে ম্যাচের পার্থক্য গড়ে দিয়েছেন হৃদয়।
প্রশংসায় ভাসছেন হৃদয়
বোলাররা যে ম্যাচে ছড়ি ঘুরিয়েছে, সেখানে এমন আগ্রাসী ব্যাটিং। নিশ্চিতভাবেই প্রশংসার দাবিদার হৃদয়। বাংলাদেশের ম্যাচ জয়ের পর সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবাল যেমন বলেছেন, “যেভাবে বাংলাদেশ রান তাড়া করেছে তা দেখে আমি সত্যিই আনন্দিত। সাধারণত ১২৫-১৩০ স্কোরের রান তাড়াগুলো খুব ট্রিকি হয়। এমন ম্যাচে শুরুর তিন ব্যাটারের একজনকে হাফসেঞ্চুরি ইনিংস খেলতে হয়। তখন কাজটা সহজ হয়। বাংলাদেশ সে জায়গাটায় ভুল করেছে। তবে হৃদয়কে ধন্যবাদ দিতে হবে।”
কেন ধন্যবাদ দিচ্ছেন, সেটির ব্যাখ্যা দিয়েছেন পরের কথায়, “ও (হৃদয়) ওই চাপের সময়টায় যেভাবে ব্যাট করল, ওর ওই ক্যামিওটা বাংলাদেশের রান তাড়ায় দারুণ সহযোগিতা করেছে।”
নাজমুল হোসেন শান্তর কাছে হৃদয়ের ইনিংসটি ‘সাহসী’। হাসারাঙ্গার ওভারটি নিয়েই কথা বলেছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক, “হৃদয় আজ (৮ জুন) তার অন্যতম সাহসী ইনিংসটি খেলেছে। ব্যাটিং ইনিংসে ওই ওভারটি (হাসারাঙ্গার) যেভাবে সে মোকাবিলা করেছে তা আমাদের রান তাড়ায় দারুণ ভূমিকা রেখেছে।”
শুধু সতীর্থ নয়, বাইরে থেকেও প্রশংসা কুড়াচ্ছেন হৃদয়। জনপ্রিয় ভারতীয় ধারাভাষ্যকার হার্শা ভোগলে এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেলে লিখেছেন, “তাওহীদ হৃদয় সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছি এবং সেগুলো মোটেও অতিরঞ্জিত নয়। তাকে একজন বিশেষ খেলোয়াড়ই মনে হচ্ছে।”
পরিশেষে
‘বিশেষ’ খেলোয়াড়ই বটে। অন্তত সীমিত ওভারের ক্রিকেটে প্রতিনিয়ত নিজেকে উঁচু থেকে আরও উঁচুতে নিয়ে যাচ্ছেন। আধুনিক টি-টোয়েন্টিতে যে ক্যারিশমা দরকার, হৃদয়ের ব্যাটিং স্টাইলে সবকিছুর উপস্থিতি স্পষ্ট। টানা ৩ ছক্কা তো সেটিই বলছে!