Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

ঘুমধুম দিয়ে রেল সংযোগ অবাস্তব পরিকল্পনা : ওয়াহিদউদ্দিন

বান্দরবানের ঘুমধুম সীমান্ত।
বান্দরবানের ঘুমধুম সীমান্ত।
[publishpress_authors_box]

বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, চীন, মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোর মধ্যে একটি সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ট্রান্স এশিয়ার নেটওয়ার্কের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ যেখানে যুক্ত হয় ২০০৭ সালে।

কথা ছিল, চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার ও রামু থেকে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ঘুমধুম পর্যন্ত যাবে বাংলাদেশ রেলওয়ের লাইন। এরপর ওপারে মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্ত হবে এই নেটওয়ার্ক। কিন্তু মিয়ানমারের ঘুমধুম সীমান্তবর্তী অঞ্চলটি পাহাড়ি হওয়ায় রেললাইন প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়। ফলে কক্সবাজার পর্যন্তই রেললাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন সরকার।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলছেন, ট্রান্স এশিয়ান রেল যোগাযোগের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হলেও এর উদ্দেশ্য ছিল অবাস্তব।

কারণ হিসেবে তিনি ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের পাহাড়ি অঞ্চলের কথা বলেন।

তার ভাষ্যে, “মিয়ানমারের বাংলাদেশ সীমান্তের অংশের পুরোটাই পাহাড়ে ঘেরা। এই পাহাড় ভেদ করে মিয়ানমারের মূল অংশের সঙ্গে রেল যোগাযোগ অবাস্তব স্বপ্ন।”

এমন পরিস্থিতিতে ‘দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পটির রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৯ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ বাদ দিয়ে প্রকল্পটি শেষ করার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার।

এতে প্রকল্পটির ব্যয় ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা কমছে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা কমিশনের এক কর্মকর্তা।

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন প্রকল্পটা যখন শুরু করা হয়েছিল, তখন বলা হয়েছিল এই রেললাইন দিয়ে ঘুমধুম হয়ে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে।

“অথচ তখন আমি একবার রেঙ্গুন গেলাম। তখন ওখানকার হাইকমিশনার আমাকে বলেছিলেন, এটা তো অবাস্তব কথা। এই রেল লাইন ঘুমধুম পর্যন্তই যাবে। কারণ এরপরে মিয়ানমারে বাকি অংশে যেতে হলে তো পর্বত পড়বে। ওটার ভেতর দিয়ে যাওয়া তো…”

এসময় মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে উপদেষ্টা বলেন, “রাখাইন অঞ্চলে কি এখনও সরাসরি রেঙ্গুন থেকে আসতে পারে? হয় সমুদ্র দিয়ে এসে আক্রমণ করে অথবা বিমান দিয়ে আসে। স্থল পথে তো ওই জায়গা দিয়ে যাওয়াই যায় না।

“এরকম অনেক প্রকল্প আছে যেগুলো যে উদ্দেশ্য করার কথা বলা হয়েছিল, শুরুতেই বোঝা গিয়েছিল যে ওটা হবে না। এটা আগেই বোঝা উচিৎ ছিল।”

২০১২ সালে প্রকল্পটি প্রথম অনুমোদন দেওয়ার সময় রেল বিভাগ থেকে জানানো হয়েছিল, রামু-ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনাটি ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে রুট-১-এর অংশ।

ওই পরিকল্পনা অনুযায়ী, ট্রান্স এশিয়ান রুট-১ ভারতের গেদে থেকে দর্শনা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। এরপর ঈশ্বরদী-বঙ্গবন্ধু সেতু-জয়দেবপুর হয়ে যাবে টঙ্গী পর্যন্ত। সেখান থেকে আখাউড়া-চট্টগ্রাম ও দোহাজারী-রামু হয়ে ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমারে প্রবেশ করবে।

প্রকল্পটির মাধ্যমে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজারের ঝিলংজা পর্যন্ত ১০১ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করে গত বছরের ১১ নভেম্বর উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই রেললাইন দিয়েই এখন কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকার সঙ্গে রেল যোগাযোগ সচল রয়েছে।

তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতেই সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে, রামু-ঘুমধুম অংশ আপাতত বাস্তবায়ন করা হবে না। এতে প্রকল্পের ব্যয় এক হাজার কোটি টাকার মতো কমতে পারে বলে সে সময় ইঙ্গিত দিয়েছিলেন রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

সেসময় বাংলাদেশ রেলওয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক কামরুল আহসান জানিয়েছিলেন, মূলত মিয়ানমারের অনাগ্রহের কারণেই রামু থেকে ঘুমধুম পথের নির্মাণকাজ স্থগিত করতে হচ্ছে। আরও দু’তিন বছর আগেই এ সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।

ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার শুরু থেকেই যাচাই-বাছাই করে প্রকল্প হাতে নেওয়ার ওপর জোর দিয়েছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে ওয়াহিউদ্দিন মাহমদু প্রথম দিনই কর্মসংস্থান বান্ধব নয় এবং কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প যাচাই-বাছাই করে বাদ দেওয়ার ঘোষণা দেন।

এরই মধ্যে আলোচনায় আসে রামু থেকে ঘুমধুম রেললাইন প্রকল্প।

পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের একজন কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রকল্পটি কক্সবাজার পর্যন্ত রেখেই শেষ করে দিতে সরকারের নির্দেশনা পাওয়া গেছে।

“শিগগির পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় তুলে কাটছাঁট করে শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। এর মাধ্যমে প্রকল্পটি থেকে ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা কমিয়ে ১১ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হবে।”

শুরুতে প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে জানতে প্রকল্পটির পরিচালক মো. সুবক্তগীনের মোবাইলে কয়েকবার টেলিফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।

প্রকল্পের ইতিহাস

২০১০ সালে তৎকালীন মহাজোট সরকারের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন হওয়ার সময় চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার ও রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।

তখন প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল মাত্র ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। কিন্তু পরবর্তীকালে কাজ শুরু করতে গিয়ে প্রকল্পটি পরিবেশ ও বনাঞ্চলের জীবজন্তু রক্ষায় অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ রেলওয়ে।

এরপর প্রকল্পটিতে অর্থায়নে এসে নতুন করে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। ওই সমীক্ষা অনুযায়ী চুনতি এবং চকরিয়ার বনাঞ্চলের বিশেষ করে হাতি চলাচলের সুবিধা রেখে রেলপথ নির্মাণের একটি নকশায় প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ১০ গুণ বাড়িয়ে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।

এর মধ্যে ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা উন্নয়ন সহযোগী এডিবির ঋণ এবং বাকি ৪ হাজার ৯১৯ কোটি টাকা সংস্থান হয় সরকারি তহবিল থেকে।

২০১৬ সালে তৎকালীন সরকার এই ব্যয় বাড়িয়ে প্রথমবারের মতো সংশোধন করে একনেক সভায় তুলে অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর প্রকল্পটিকে সরকার ফার্স্ট ট্র্যাক বা অগ্রাধিকার প্রকল্প ঘোষণা করে চূড়ান্ত কাজ শুরু করে ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুনে শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়।

কিন্তু কোভিড-১৯ এলে আবারও আঘাত আসে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজের গতিতে। এরপর তৎকালীন সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আবারও এক বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্য দেওয়া হয়। এরপর শতভাগ কাজ শেষ করতে আরও এক বছর বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে  প্রস্তাবিত দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে প্রকল্পটি থেকে রামু-ঘুমধুম অংশ বাদ দিয়ে নির্মাণ ব্যয় ১১ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকায় নামিয়ে প্রকল্পটি শেষ করা পরিকল্পনা করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত