রুশ বিপ্লবের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমেরিকান সাংবাদিক জন রিড তার বিখ্যাত বইটির নাম দিয়েছিলেন ‘টেন ডেজ দ্যাট শুক দ্য ওয়ার্ল্ড’। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য দশ দিন আসলে অনেক বেশি। তারা মাত্র এক সপ্তাহেই বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছেন।
ট্রাম্প-পুতিনের বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেওয়ার এ পদক্ষেপ শুরু হয় গত ১২ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ট্রাম্প ও পুতিন ফোনে কথা বলেন এবং পারস্পরিক সম্পর্ক পুনরায় শুরু করার প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে ইউরোপ ও আমেরিকার মধ্যে মতবিরোধ আরও স্পষ্ট হয়।
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের প্রয়াস হিসেবে সৌদি আরবে হয় রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের বৈঠক। ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার অভিযানের পর এটিই দুই দেশের মধ্যে প্রথম উচ্চপর্যায়ের সরাসরি আলোচনা।
এই এক সপ্তাহে বিশ্ব রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন এসেছে। ঐতিহ্যবাহী মিত্রতা নড়বড়ে হয়েছে। ইউরোপ ও ইউক্রেন দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। আর ইউরোপের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
সবচেয়ে বড় বিষয়, এতে রাশিয়া তার কাঙ্ক্ষিত অবস্থানে পৌঁছেছে। বিশ্ব রাজনীতির শীর্ষ পর্যায়ে, কোনও ছাড় না দিয়েই।
রাশিয়ার সংবাদপত্রগুলোর বুধবারের মূল শিরোনাম ছিল রিয়াদে আলোচনার টেবিলে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
ক্রেমলিন চায় তার জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দেখুক, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার পশ্চিমাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
রুশ গণমাধ্যম যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ হওয়ার সম্ভাবনাকে স্বাগত জানাচ্ছে। আর ইউরোপের নেতারাও কিয়েভকে কটাক্ষ করছে।
রাশিয়ার সরকার ঘেঁষা ট্যাবলয়েড মস্কোভস্কি কোমসোমোলেতস লিখেছে, “ট্রাম্প জানেন, রাশিয়াকে কিছু ছাড় দিতে হবে। কারণ তিনি এমন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করছেন যারা ইউক্রেনে জয়ী অবস্থানে আছে। তিনি অবশ্যই ছাড় দেবেন। তবে তা আমেরিকার ক্ষতি করে নয়, বরং ইউরোপ ও ইউক্রেনের ক্ষতি করে।”
একই লেখায় ইউরোপের সমালোচনা করে বলা হয়েছে, “এতদিন ইউরোপ নিজেকে সভ্য বিশ্বের অংশ ও এক ধরনের স্বর্গরাজ্য বলে ভেবেছে। কিন্তু তারা খেয়ালই করেনি যে তারা নিজেদের অবস্থান হারিয়েছে। আর এখন তাদের সেই পুরনো বন্ধু, যিনি আটলান্টিকের ওপারে আছেন, সেটাই তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।”
রুশ মিডিয়াগুলো এমন উচ্ছ্বসিতভাবে লিখলেও মস্কোর রাস্তায় এমন উচ্ছ্বাসের লক্ষণ দেখা যায়নি।
রাশিয়ার মানুষ এখন শুধু পর্যবেক্ষণ ও অপেক্ষা করছে। তারা দেখতে চায়, ট্রাম্প সত্যিই রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র হবেন কি না; ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারবেন কি না।
মস্কোর বাসিন্দা নাদেঝদা বলেন, “ট্রাম্প একজন ব্যবসায়ী। তার একমাত্র আগ্রহ অর্থ উপার্জন করা। আমি মনে করি না পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন হবে। পরিবর্তন আনতে অনেক কিছু করতে হবে।”
আরেক বাসিন্দা গিওর্গি বলেন, “হয়তো সৌদি আরবে হওয়া আলোচনাগুলো কিছুটা সাহায্য করবে। শত্রুতা বন্ধ করার এখনই সময়।”
রাশিয়ার আরেক নাগরিক ইরিনা বলেন, “ট্রাম্প সক্রিয়। উদ্যমী। কিন্তু তিনি আসলে কিছু করবেন তো? আমরা স্বপ্ন দেখি, এই আলোচনা শান্তি আনবে। এটি প্রথম পদক্ষেপ। হয়তো এটি আমাদের অর্থনীতিতেও সহায়তা করবে। এখানে খাবার ও অন্য পণ্যের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। এর একটি কারণ বিশেষ সামরিক অভিযান (ইউক্রেন যুদ্ধ) এবং সামগ্রিক আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি।”
এমন বাস্তবতার মধ্যেই পুতিন ও ট্রাম্প ফোনে কথা বলেছেন। তাদের প্রতিনিধি দল সৌদি আরবে সাক্ষাৎ করেছে। শিগগিরই প্রেসিডেন্ট সম্মেলনের সম্ভাবনাও রয়েছে।
ট্রাম্প ও পুতিন কী আলাপ করতে পারেন, তা কয়েক দিন আগেই মস্কোভস্কি কোমসোমোলেতস পত্রিকা এক কল্পিত সংলাপ লিখেছিল। তাদের কল্পিত সংলাপ ছিল এমন-
“ট্রাম্প পুতিনকে ফোন করলেন।”
“ভ্লাদিমির! তোমার দেশ দারুণ, আমার দেশও দারুণ। চল, আমরা বিশ্বকে ভাগ করে নেই!”
“আমি তো আগেই বলেছি! চল, তাহলে শুরু করি!…”
এই কথোপকথন কি শুধুই মস্কোভস্কি কোমসোমোলেতস পত্রিকার কল্পনা? সময়ই তা বলে দেবে।
তথ্যসূত্র : বিবিসি