যে অভিযোগে ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজে জেরবার, সেই যৌন নিপীড়নের অভিযোগের মুখে থাকা ব্যক্তিদের নিয়ে নিজের নতুন প্রশাসন সাজাচ্ছেন তিনি।
ভোটে জিতে চার বছর বাদে পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিতে যাওয়া ট্রাম্পের মনোনীত ব্যক্তিদের নিয়ে এখনই বিতর্ক ছড়াচ্ছে, এর মধ্যে দুশ্চরিত্র ব্যক্তিদের নামও উঠে আসছে আলোচনায়।
পর্ন তারকার সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লুকাতে ঘুষ দেওয়ায় দোষি সাব্যস্ত ট্রাম্প এখন পর্যন্ত তার পরবর্তী প্রশাননের জন্য যে ক’টি নাম ঘোষণা করেছেন, তার মধ্যে পরবর্তী প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ এবং পরবর্তী অ্যাটর্নি জেনারেল ম্যাট গেটজের বিরুদ্ধে রয়েছে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ।
এই তথ্য জানিয়ে ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারীদের প্রতি ট্রাম্পের নিজের অবমাননাকর আচরণের ইতিহাসের প্রতিফলেই ঘটেছে এই ব্যক্তিদের মনোনীত করার মাধ্যমে।
কংগ্রেসে রিপাবলিকান পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও যৌন নিপীড়নের অভিযোগ থাকায় হেগসেথ ও গেটজের মনোনয়ন সেনেটে অনুমোদন নাও পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেননা নিজ দলের প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সেনেটের বাধা হয়ে দাঁড়ানোর নজির যুক্তরাষ্ট্রে ভুরি ভুরি রয়েছে।
অভিজ্ঞতা না থাকায় এবং চরম দৃষ্টিভঙ্গির কারণে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসাবে সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও টিভি উপস্থাপক পিট হেগসেথের মনোনয়ন নিয়ে প্রথম থেকেই অনিশ্চয়তা ছিল।
এখন সামনে এল যৌন নিপীড়নের অভিযোগ। ক্যালিফোর্নিয়া পুলিশ ২০১৭ সালে তার বিরুদ্ধে একটি যৌন নিপীড়নের অভিযোগের তদন্ত করে বলে জানা গেছে।
তদন্তের পর তার বিরুদ্ধে কোনও মামলা হয়নি। তবে ট্রাম্পের নবনিযুক্ত চিফ অব স্টাফ সুসি ওয়াইলস বিষয়টি জানার পর তা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন এবং মনোনয়নের পরদিনই বুধবার সন্ধ্যায় হেগসেথকে ফোন করে কথা বলেন।
পিট হেগসেথের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগটি প্রথম প্রকাশ্যে আনে ভ্যানিটি ফেয়ার। পত্রিকাটি জানিয়েছে, ট্রাম্পের নিজের আইনজীবীরাও হেগসেথের সঙ্গে কথা বলেছেন।
৪৪ বছর বয়সী পিট হেগসেথ রক্ষণশীল টিভি চ্যানেল ফক্স নিউজের উপস্থাপক এবং একজন লেখক। তার আগে তিনি ন্যাশনাল গার্ড ও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন। হেগসেথ সেনাবাহিনীতে সরাসরি যুদ্ধে নারীদের অংশগ্রহণের বিরোধী ছিলেন।
হেগসেথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারসহ সেনাবাহিনীতে ব্যাপক রদবদলেরও পরামর্শ দেন। এনিয়ে তিনি একটি বইও লেখেন চলতি বছরের শুরুর দিকে— ‘দ্য ওয়ার অন ওয়ারিয়র্স : বিহাইন্ড দ্য বিট্রেয়াল অব দ্য মেন হু কিপ ইউ ফ্রি’।
বইটিতে তিনি পরামর্শ দেন, “যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্টকে জাতিকে রক্ষা করতে এবং শত্রুদের পরাস্ত করতে প্রস্তুত করার জন্য পেন্টাগনের সিনিয়র নেতৃত্বে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। অনেক সামরিক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করতে হবে।”
গত মঙ্গলবার হেগসেথের মনোনয়নের পরপরই খবর আসে ট্রাম্পের ট্রানজিশন টিম বরখাস্ত করার জন্য সামরিক কর্মকর্তাদের একটি তালিকা তৈরিতে হাত দিয়েছে। ওই তালিকায় জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ বা প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর প্রধানদের নামও রয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদে ট্রাম্প মনোনীত রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়রের বিরুদ্ধেও যৌন নিপীড়নের অভিযোগ রয়েছে। তার সন্তানদের সাবেক এক বেবিসিটার দাবি করেছেন, ১৯৯৮ সালে কেনেডি তাকে তার বাড়িতে আটকে রেখেছিলেন।
ভ্যানিটি ফেয়ারের প্রতিবেদন অনুসারে কেনেডি ওই অভিযোগের জবাব দিয়েছিলেন এই বলে যে, “আমি কোনও গির্জার ছেলে নই।”
অ্যাটর্নি জেনারেল পদের জন্য মনোনীত ফ্লোরিডার কংগ্রেসম্যান ম্যাট গেটজ নারী পাচারের অভিযোগে দুই বছরের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্তের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কের অভিযোগও রয়েছে। তবে তার বিরুদ্ধেও পরে আর মামলা হয়নি।
রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাটিক সেনেটররা শুক্রবার গেটজের আচরণ সম্পর্কে প্রতিনিধি পরিষদের নৈতিক কমিটির একটি প্রতিবেদন দেখার জন্য চাপ দেন। অভিযোগ ছাড়াই ফৌজদারি তদন্ত শেষ হওয়া সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছিল।
বুধবার ট্রাম্প তার মনোনয়ন ঘোষণার পরপরই হাউস থেকে পদত্যাগ করে গেটজ প্রতিবেদনটির প্রকাশ আটকে দেন। প্রতিবেদনটি শুক্রবার প্রকাশ করার কথা ছিল। গেটজের ভয় ছিল, প্রতিবেদনটির বিষয়বস্তু তার ভাবমূর্তির জন্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিকর হতে পারে।
প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার মাইক জনসনও বলেছেন, তিনি ‘দৃঢ়ভাবে অনুরোধ করবেন’ যাতে প্রতিবেদনটি প্রকাশ না করা হয়।
কিন্তু প্রতিবেদনটি এরপরও তার মনোনয়নকে ঝুঁকিতে ফেলে দিতে পারে। সেনেটের বিচার বিভাগীয় কমিটির সদস্য এবং টেক্সাসের রিপাবলিকান সেনেটর জন কর্নিনসহ আইনসভার জ্যেষ্ঠ সদস্যরা বলেছেন, সেনেটে তার নিয়োগ নিশ্চিতকরণ শুনানিতে ব্যবহারের জন্য প্রতিবেদনটি সংরক্ষণ করা হবে।
যৌন অসদাচরণ, অথবা অবৈধ ড্রাগ ব্যবহারে জড়িত থাকা, প্রতিনিধি পরিষদে অনুপযুক্ত ছবি ও ভিডিও শেয়ার, রাষ্ট্রীয় শনাক্তকরণ রেকর্ডের অপব্যবহার, নির্বাচনী প্রচারের তহবিল ব্যক্তিগত কাজে খরচ এবং ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে ২০২১ সালে গেটজের বিরুদ্ধে ওই তদন্ত শুরু হয়।
ট্রাম্প তাকে নিয়োগ দিয়েছেন মূলত বিচার বিভাগে পাইকারি শুদ্ধি অভিযান চালানোর জন্য, যাতে তার বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলোও সহজেই বাতিল করা যায়।
ট্রাম্পের মনোনীতদের যৌন আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তার নিজের অতীতেরও প্রতিধ্বনি করে।
ট্রাম্পকে গত বছর লেখক ই জিন ক্যারলকে যৌন নিপীড়নের দায়ে ৮৩ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দেয় আদালত। ক্যারল অভিযোগ করেছিলেন, ট্রাম্প তাকে ১৯৯৬ সালে ধর্ষণ করেছিলেন, যা ট্রাম্প অস্বীকার করেন।
২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে অ্যাকসেস হলিউডের একটি অডিও প্রকাশের জেরে ট্রাম্প প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে প্রায় ছিটকে পড়ছিলেন। অডিওটিতে ট্রাম্পকে তার সেলিব্রিটি স্ট্যাটাস ব্যবহার করে নারীদের যৌনাঙ্গে অনুমতি ছাড়াই স্পর্শ করার জন্য গর্ব করতে শোনা যায়।
তথ্যসূত্র : দ্য গার্ডিয়ান