মধ্য আমেরিকার দেশ পানামায় কৃত্রিমভাবে নির্মিত পানামা খাল বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জলপথ। ৮২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খাল আটলান্টিক মহাসাগরকে প্রশান্ত মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। এই খাল নিয়ে সম্প্রতি তর্কযুদ্ধে জড়িয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও পানামার প্রেসিডেন্ট হোসে রাউল মুলিনো।
তর্কযুদ্ধের শুরুটা অবশ্য করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পই। তিনি মনে করছেন, প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের বোকামি ছিল। পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ যদি ধরে রাখা হতো, তাহলে সেখানে চলাচলের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজগুলোকে এখন অতিরিক্ত শুল্ক দিতে হতো না।
এক প্রতিবেদনে টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ট্রাম্প তার পূর্বসূরির সমালোচনা করেই ক্ষান্ত হননি। খালটিকে ‘গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদ’ অভিহিত করে একে পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে নেওয়ার মনোবাসনাও ব্যক্ত করেছেন।
কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ খালটির ব্যবস্থাপনা নিয়ে পানামা সরকারের সমালোচনা করে ট্রাম্প দাবি করেছেন, মধ্য আমেরিকার দেশটির কর্মকর্তারা যেন তার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে ব্যবস্থা নেন।
স্বভাবতই পানামা খাল নিয়ে ট্রাম্পের অবস্থানকে ভালোভাবে নেননি পানামার প্রেসিডেন্ট হোসে রাউল মুলিনো। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ব্যবহার করে ট্রাম্পকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, খালের প্রতি বর্গমিটারের মালিক পানামার জনগণ এবং এই মালিকানা তাদের হাতেই থাকবে, অন্য কারও হাতে যাবে না।
ট্রাম্প কী বলেছেন
গত ৫ নভেম্বর নির্বাচনে জয়ের পর রবিবার যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় প্রথম এক সমাবেশে বক্তব্য দেন ট্রাম্প। ৭৫ মিনিট দীর্ঘ সেই বক্তব্যের একপর্যায়ে পানামার রক্ষণশীল প্রেসিডেন্ট মুলিনোর সমালোচনা করেন তিনি।
ট্রাম্প বলেন, মুলিনো সরকার পানামা খালে চলাচলকারী জাহাজ থেকে যে শুল্ক আদায় করছে, তা ‘হাস্যকার’; এর কোনও মানে হয় না।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০ জানুয়ারি শপথ নিয়ে হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তন করতে যাচ্ছেন রিপাবলিকান নেতা ট্রাম্প। দ্বিতীয় মেয়াদে পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ প্রায় ৫০ বছর পর আবার যুক্তরাষ্ট্রের হাতে ফিরিয়ে আনতে চাইছেন তিনি।
সেই অভিপ্রায়ের কথা জানিয়ে সমাবেশে পানামার সরকারকে হুমকি দিয়ে ট্রাম্প বলেন, “পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র একসময় মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছিল। পানামা সরকার যদি তা ভুলে যায়, তাহলে খালটি যাতে যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত ও প্রশ্নাতীতভাবে ফিরে পায়, আমরা সে দাবিই তুলব।”
মুলিনোর জবাব কী
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরে জাহাজ চলাচল সহজ করতে পানামা খাল নির্মাণ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তারাই খালটি নিয়ন্ত্রণ করত। ১৯৭৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার একটি চুক্তির মাধ্যমে ওই জলপথ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পানামাকে দিয়ে দেন।
খালটির নিয়ন্ত্রণ এখন যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিতে নারাজ পানামার প্রেসিডেন্ট মুলিনো। খালের নিয়ন্ত্রণ ঘিরে ট্রাম্পের দাবি প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেছেন, এ ধরনের দাবি জানানোর অর্থ পানামার সার্বভৌমত্বকে অসম্মান করা।
যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী মিত্র হিসেবে পরিচিত মুলিনো। তবে কৌশলগত জলপথ পানামা খাল নিয়ে কোনও ধরনের আপসের জায়গায় যে তিনি নেই, তা তার বক্তব্যে স্পষ্ট।
ট্রাম্পের নাম উল্লেখ না করে এক্সে দেওয়া পোস্টে মুলিনো বলেন, খালে চলাচলকারী জাহাজ থেকে অতিরিক্ত শুল্ক নেওয়ার যে অভিযোগ উঠেছে, তাতে পানামা সরকারের কোনও হাত নেই, কারণ এই শুল্ক নির্ধারণ করেন বিশেষজ্ঞরা। পরিচালন খরচ ও সরবরাহ-চাহিদার ওপর ভিত্তি করে এই শুল্ক নির্ধারিত হয়ে থাকে।
তিনি জানান, পানামা খালে জাহাজ চলাচল আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এসব বর্ধিত জাহাজ যাতে সহজে চলাচল করতে পারে, এজন্য খালকে আরও প্রসারিত করতে কয়েক বছর ধরে কাজ করছে তার সরকার। এই প্রকল্পের অর্থ শুল্ক সমন্বয়ের মাধ্যমে জোগান দেওয়া হবে।
পানামার প্রেসিডেন্ট মুলিনো হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, বিভিন্ন ইস্যুতে পানামার জনগণের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে। কিন্তু পানামা খাল ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে তারা এক পতাকার নিচে ঐক্যবদ্ধ।
ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া
পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রেসিডেন্ট মুলিনোর কড়া জবাব ট্রাম্পের কানে পৌঁছাতে দেরি হয়নি। প্রতিক্রিয়ায় নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশালে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, “আচ্ছা, বিষয়টি আমরা দেখব!”
ওই পোস্টের পাশেই তিনি সেঁটে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা পোঁতা পানামা খালের ছবি, যার শিরোনাম, ‘যুক্তরাষ্ট্র খালে স্বাগতম!’