যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী সমাবেশে গুলি চালানো হয়েছে। এতে কানে গুলি লাগলেও প্রাণে বেঁচে গেছেন ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্প। পরে সিক্রেট সার্ভিস সদস্যদের গুলিতে হামলাকারী নিহত হয়েছে।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শনিবার পেনসিলভেনিয়ায় নির্বাচনী সমাবেশে বক্তব্য দেওয়ার সময় ট্রাম্পকে লক্ষ্য করে গুলি চালানোর ঘটনা ঘটে।
সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া হামলার একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, ট্রাম্প মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দেওয়ার মধ্যেই হঠাৎ গুলির শব্দ হয়। সঙ্গে সঙ্গে কানে হাত দিয়ে নিচে বসে পড়েন ট্রাম্প। এরপর নিরাপত্তারক্ষীরা দ্রুত তাকে ঘিরে ফেলেন। কিছুক্ষণ পর ট্রাম্প উঠে দাঁড়ান। সে সময় ট্রাম্পের ডান কান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। রক্ত লেগেছিল তার মুখেও।
মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় স্লোগান দিতে শুরু করেন ট্রাম্প। ডান হাতের মুঠি শক্ত করে উপরের দিকে ছুড়ে দিয়ে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘ফাইট, ফাইট, ফাইট।’
এ ঘটনায় ট্রাম্পের সমাবেশে আসা এক ব্যক্তি নিহত এবং দুজন গুরুতর আহত হয়েছেন।
‘কান ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে গুলি’
হামলার ঘটনায় ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নিজের সোশাল মিডিয়া ট্রুথ সোশালে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, “আমাকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়েছিল। গুলি আমার কান ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে। গুলিতে ডান কানের উপরের দিকের চামড়া চিড়ে গেছে।”
ট্রাম্প লিখেছেন, “হঠাৎ আমি অদ্ভুত শব্দ শুনি, সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারি অঘটন ঘটেছে। আর তখনই অনুভব করি গুলি আমার কান ফুটো করে দিয়েছে। অনেক রক্ত পড়তে থাকে, আমি তখন বুঝতে পারি কী ঘটেছে।
“এটা অবিশ্বাস্য যে আমাদের দেশে এ রকম একটি ঘটনা ঘটেছে। হামলাকারী সম্পর্কে এখনও কিছু জানা যায়নি। হামলাকারী নিহত হয়েছেন।”
দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ায় ট্রাম্প তার পোস্টে সিক্রেট সার্ভিস ও অন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকেও ধন্যবাদ জানান। সেই সঙ্গে এ ঘটনায় নিহত তার সমর্থকের পরিবারের প্রতিও সমবেদনা জানান ট্রাম্প।
পোস্টের শেষে ট্রাম্প লিখেছেন, ‘ঈশ্বর আমেরিকার মঙ্গল করুক!’
প্রত্যক্ষদর্শীরা যা জানিয়েছেন
ঘটনাস্থলে থাকা এক প্রত্যক্ষদর্শী বিবিসিকে বলেন, সমাবেশে লোকজনের ভিড়ের বাইরে দাঁড়িয়ে তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য শুনছিলেন। ওই সময় পাশের একটি ভবনের ছাদে এক ব্যক্তিকে অস্ত্র হাতে দেখতে পান তিনি।
গ্রেইগ নামের ওই ব্যক্তি বলেন, “আমি লক্ষ্য করি যে আমাদের পাশের ভবনের ছাদে একজন অস্ত্র হাতে অগ্রসর হচ্ছে। সে আমাদের থেকে ৫০ ফুট দূরে ছিল। তার কাছে একটি রাইফেল ছিল, আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম– এটি একটি রাইফেল ছিল।
“আমি ভাবছিলাম ট্রাম্প কেন এখনও বক্তব্য দিয়েই যাচ্ছেন। তাকে কেন স্টেজ থেকে নামানো হচ্ছে না। তার দিকে তাঁকিয়ে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। এর কিছুক্ষণ পর পরপর পাঁচটি গুলির শব্দ হয়।”
তবে ঘটনাস্থলে থাকা জেন ও থেরেসা নামে আরও দুই প্রত্যক্ষদর্শী ছয় থেকে আটটি গুলির শব্দ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন বিবিসিকে।
থেরেসা বলেন, “আমি প্রথমে একটি শব্দ শুনলাম, একটু পরে আবার দুটি শব্দ হলো। তখন আমি বুঝতে পারি যে এগুলো গুলি।”
যেভাবে থামানো হয় হামলাকারীকে
হামলার সময় সমাবেশস্থলের পরিস্থিতি কেমন ছিল, তা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম ফক্স নিউজ।
বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে সংবাদমাধ্যমটি বলছে, গুলির শব্দ পেয়েই মঞ্চে বসে পড়েন ট্রাম্প। তখন সিক্রেট সার্ভিসের এজেন্টরা ট্রাম্পকে রক্ষা করতে ছুটে যান। মানব ঢাল হয়ে তাকে ঘিরে রাখেন।
ট্রাম্পের নির্বাচনী সমাবেশে উপস্থিত এক ব্যক্তির ধারণ করা ভিডিওতে দেখা গেছে, মঞ্চে উঠে বক্তৃতা শুরু করেছেন ট্রাম্প। এর কয়েক সেকেন্ড পরই কাউকে চিৎকার করে বলতে শোনা যায়, “তার কাছে বন্দুক আছে!” অন্য একজন একই স্বরে বলে ওঠেন, “সে ছাদে!”
আশপাশ থেকে চিৎকার শুনে সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বুঝতে পারেন, কোনও এক ব্যক্তির কাছে বন্দুক আছে। তখনও গুলি ছোড়া হয়নি।
এরপরই ভেসে আসে পরপর কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ। শব্দ পেয়েই মাথা নিচু করেন সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা।
সে সময় তাদের মধ্যে একজন অন্যদের পরামর্শ দেন, যে ভবনের ছাদে বন্দুকধারী রয়েছে, তার কাছে না যেতে।
এর কয়েক সেকেন্ড পর দেখা যায়, বন্দুকধারীকে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। তার প্রাণহীন দেহ একজন দেখেছেন বলে দাবি করেন।
ওই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, “তিনি মারা গেছেন। তারা তার মাথায় গুলি করেছে।”
সিএনএনের তোলা ছবিতে দেখা গেছে, সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন সমাবেশে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, সেসময় তার ঠিক পেছনে একটি ভবনের ছাদে ছিলেন সিক্রেট সার্ভিসের স্নাইপাররা। তাদের গুলিতে হামলাকারীর মৃত্যু হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে।
হামলাকারীকে থামানো গেছে নিশ্চিত হওয়ার পরই সিক্রেট সার্ভিসের এজেন্টরা ট্রাম্পকে নিয়ে মঞ্চ ত্যাগ করেন এবং তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
ভালো আছেন ট্রাম্প
হামলার শিকার হওয়ার দ্রুতই ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে নেন সিক্রেট সার্ভিসের সদস্যরা। পরে তাকে দ্রুত নেওয়া হয় স্থানীয় বাটলার মেমোরিয়াল হাসপাতালে।
ট্রাম্পের একজন মুখপাত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে সিএনএন জানিয়েছে, সাবেক প্রেসিডেন্ট এখন ভালোই রয়েছেন। তিনি নিউ জার্সিতে নিজের বাড়িতে ফিরেছেন।
পেনসিলভেনিয়া থেকে উড়োজাহাজে করে নিউ জার্সির নিউয়ার্ক বিমানন্দরে নামেন ট্রাম্প। একটি ভিডিওতে ট্রাম্পকে স্বাভাবিকভাবে হেঁটেই উড়োজাহাজ থেকে নামতে দেখা গেছে।
পেনসিলভেনিয়ার গভর্নর জোশ স্যাপিরো জানিয়েছেন, শনিবার রাতে গুলির ঘটনার পরপরই বাটলার ছাড়েন ট্রাম্প। রবিবার সকালে তিনি নিউ জার্সিতে পৌঁছেও গেছেন।
ট্রাম্প ভালো আছেন বলে তার সহকর্মীদের কাছ থেকে জেনেছেন বলেও জানান স্যাপিরো।
হত্যার উদ্দেশ্যেই হামলা
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর হামলার ঘটনাটিকে হত্যাচেষ্টা হিসেবেই দেখছে দেশটির কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)।
ট্রাম্পের ওপর গুলি চালানোর পর এক প্রেস কনফারেন্সের এফবিআই কর্মকর্তা কেভিন রোজেক এ কথা জানান।
তিনি বলেন, “আজ সন্ধ্যায় সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর হামলার ঘটনাটিকে আমরা তাকে হত্যার চেষ্টা হিসেবেই দেখছি।”
এফআইবি সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করছে বলেও এ সময় জানান সংস্থাটির কর্মকর্তা কেভিন।
হামলাকারী সম্পর্কে যা জানা গেল
সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর হামলার পর এক বিবৃতিতে এফবিআই জানায়, ট্রাম্পের ওপর গুলি চালানো ব্যক্তির নাম টমাস ম্যাথিউ ক্রুকস। ২০ বছর বয়সী এই তরুণের বাড়ি পেনসিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যের বেথেল পার্ক এলাকায়।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “হামলার ঘটনায় তদন্ত চলছে। কারও কাছে এ ঘটনা সম্পর্কিত কোনও তথ্য কিংবা ছবি বা ভিডিও থাকলে তারা এগুলো দিয়ে তদন্ত কার্যক্রমে সহায়তা করার আহ্বান জানানো হচ্ছে।”
তবে তরুণ টমাস ম্যাথিউ ক্রুকস কেন ট্রাম্পকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন সে বিষয় এফবিআইয়ের বিবৃতিতে কিছু জানানো হয়নি।
বাইডেনসহ বিশ্বনেতাদের নিন্দা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। ট্রাম্পের ওপর হামলার পর এক বিবৃতিতে ডেমোক্র্যাট পার্টির প্রার্থী বাইডেন বলেন, “এ ধরনের সহিংসতার কোনও জায়গা আমেরিকায় নেই। এটা জঘন্য, জঘন্য। এ হামলায় কে বা কারা জড়িত তার সব তথ্য খুঁজে বের করা হবে। এর নিন্দা জানাতেও এক জাতি হিসেবে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।”
নিন্দা জানানোর পাশাপাশি টেলিফোনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলে তার খোঁজখবর নেওয়ার কথাও জানিয়েছেন বাইডেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানও ট্রাম্পের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাজ্য, কানাডা, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ভারত, নিউজিল্যান্ড, থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রনেতারা।
তারা ট্রাম্পের প্রতি সমবেদনা জানানোর পাশাপাশি যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।