দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক- রেমিটেন্সে একদিনে দুই রেকর্ড হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত ডিসেম্বর মাসে ২৬৩ কোটি ৮৯ লাখ (২.৬৪ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে।
একক মাসের হিসাবে এই অঙ্ক অতীতের যেকোনো মাসের চেয়ে বেশি। এর আগে ২০২০ সালের জুলাই মাসে সর্বোচ্চ ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ (২.৬ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছিল।
এ নিয়ে টানা পাঁচ মাস ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স দেশে আসল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এমনটা দেখা যায়নি।
অন্যদিকে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে বিদায়ী ২০২৪ সালে ২ হাজার ৬৮৮ কোটি ৮৬ লাখ (২৬.৮৯ বিলিয়ন) রেমিটেন্স দেশে এসেছে, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ২৩ শতাংশ বেশি।
বছরের হিসাবে এর আগে সর্বোচ্চ রেমিটেন্স এসেছিল ২০২২ সালে, ২২ দশমিক শূন্য সাত (২২.০৭ বিলিয়ন) ডলার।
আর এই রেমিটেন্সের উপর ভর করে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ বেড়েই চলেছে। বুধবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল প্রায় ২১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংক বুধবার রেমিটেন্স প্রবাহের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ষষ্ট মাস ডিসেম্বরের ব্যাংকিং চ্যানেলে ২৬৪ কোটি (২.৬৪ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে।
বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২০ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৩১ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৮ কোটি ৫১ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে যা এক হাজার ২১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
এর আগে ২০২০ সালের জুলাই মাসে সর্বোচ্চ ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ (২.৬ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্সেএসেছল। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এসেছিল গত জুন মাসে, ২৫৩ কোটি ৮৬ লাখ (২.৫৪ বিলিয়ন) ডলার।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আসে ১৯৯ কোটি ১২ লাখ (১.৯৯ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স। এ হিসাবে ২০২৩ সালেল ডিসেম্বরের চেয়ে বিদায়ী বছরের ডিসেম্বরে ৩২ দশমিক ৫১ শতাংশ বেশি রেমিটেন্স দেশে এসেছে।
চলতি অর্থবছরের পঞ্চম মাস নভেম্বরে ২১৯ কোটি ৯৫ লাখ (২ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে, যা ছিল গত বছরের নভেম্বরের চেয়ে ১৪ শতাংশ বেশি।
চতুর্থ মাস অক্টোবরে এসেছিল ২৩৯ কোটি ৫১ লাখ (২.৩৯ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে; প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২১ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি।
তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে এসেছিল ২৪০ কোটি ৪৮ লাখ (২.৪০ বিলিয়ন) ডলার। দ্বিতীয় মাস আগস্টে আসে ২২২ কোটি ৪১ লাখ (২.২২ বিলিয়ন) ডলার। প্রথম মাস জুলাইয়ে এসেছিল ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ (১.৯১ বিলিয়ন)।
অর্থবছরের ছয় মাসের (প্রথমার্থ, জুলাই-ডিসেম্বর) হিসাবে এক হাজার ৩৭৭ কোটি ৭১ লাখ (১৩.৭৭ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ১ হাজার ৮০ কোটি (১০.৮০ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছিল।
বছরের হিসাবে দেখা যায়, ২০২০ সালের ২১ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। ২০২১ সালের আসে ২২ দশমিক শূন্য সাত বিলিয়ন ডলার।
২০২২ সালের আসে ২১ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালের এসেছিল ২১ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার।
রেমিট্যান্স শুধু প্রবাসী আয় নয়, তা অর্থের একটি আন্তর্জাতিক প্রবাহও। কোনও কোম্পানি তার অন্য দেশের শাখায় অর্থ পাঠালে কিংবা কোনও ব্যক্তি অন্য দেশে বিনিয়োগ করার জন্য অর্থ পাঠালে সেটাও রেমিটেন্স। এছাড়া কোনও সংস্থা বা ব্যক্তি অন্য দেশের কোনও সংস্থা বা ব্যক্তিকে দান করার জন্য অর্থ পাঠালে সেটাও রেমিটেন্স হিসাবে ধরা হয়ে থাকে।
রেমিটেন্সের এই উল্লম্ফনে সন্তোষ প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মোটা দাগে বলা যায়, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সই আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে। এটা আমাদের অর্থনীতির জন্য খুবই ভালো। এতেই প্রমাণিত হয় যে,এখন হুন্ডি কমেছে; টাকা পাচার হচ্ছে না।
“এতে অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরছে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। সেজন্য সরকার ও কেন্দ্রিীয় ব্যাংককে পদক্ষেপ নিতে হবে।”
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা, মৃত্যু, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ, মামলা, গ্রেপ্তার ও প্রবাসীদের উৎকণ্ঠার প্রেক্ষাপটে জুলাই মাসে রেমিটেন্স কমেছিল বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
ওই সময় আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার জন্য সরকারকে দায়ী করে দেশে রেমিটেন্স না পাঠাতে সোশাল মিডিয়ায় কেউ কেউ প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
১৯ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংকিং কার্যক্রম চলে মাত্র এক দিন। শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনের মধ্যে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিয়ন্ত্রণে ১৯ জুলাই রাত থেকে কারফিউ জারি করে বিদায়ী সরকার। এরপর ২৩ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংক বন্ধ ছিল।
ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় ব্যাংকের অনলাইন লেনদেনও বন্ধ ছিল। কয়েক দিন লেনদেন বন্ধের পর ২৪ জুলাই ব্যাংক চালু হয়। ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ১৯ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই বৈধ পথে তথা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে কোনো প্রবাসী আয় আসেনি।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর রেমিটেন্স প্রবাহে আরও ধীরগতি লক্ষ্য করা যায়। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূনের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হয় অন্তর্বর্তী সরকারের; রেমিটেন্স প্রবাহেও গতি ফেরে।
দেশে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি মুদ্রার সংকট চলছে। কোভিড মহামারীর সময়ে আমদানি তলানিতে নামায় একপর্যায়ে দেশে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানি খরচ অনেক বেড়ে যায়। একই সাথে প্রবাসী আয় ও রপ্তানিতে যথেষ্ট প্রবৃদ্ধি না হওয়ায় রিজার্ভ দ্রুত কমতে থাকে।
সংকট কাটাতে ও রিজার্ভ বাড়াতে প্রবাসী আয়সহ বিদেশ থেকে অর্থ আনতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত কয়েক মাসে এসব পদক্ষেপের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রবাসী আয়ে।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) চেয়ে ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি।
রিজার্ভ ২১.৫০ বিলিয়ন ডলার
এদিকে রেমিটেন্স বাড়ায় বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ বেড়েই চলেছে। বুধবার দিন শেষে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার।
গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংক যে ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। গ্রস হিসাবে ছিল ২৪ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার।
এর আগে চলতি বছর ৩০ জুন রিজার্ভ বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। এরপর থেকে হিসাব করলে বুধবারের রিজার্ভের অঙ্কই সর্বোচ্চ।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের উল্লম্ফন এবং ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ৬০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তার ঋণ যোগ হওয়ায় রিজার্ভ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “গত কয়েক মাস ধরে রেমিটেন্স বাড়ছে। চলতি ডিসেম্বর মাসের ২৮ দিনেই প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার এসেছে। রপ্তানি আয়ও ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। এই দুই সূচকের উপর ভর করে রিজার্ভ বাড়ছিল। এডিবির ৬০ কোটি ডলার যোগ হওয়ায় তা ২১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।”
“খুব শিগগিরই বিশ্বব্যাংকের বাজেট সহায়তার ৫০ কোটি ডলার যোগ হবে। তখন রিজার্ভ আরও বাড়বে।”
তবে সেই স্বস্তি বেশি দিন থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। তখন রিজার্ভ আবার কমে আসবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, রমজান মাসকে সামনে রেখে বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা বেশি পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলেছেন। সে কারণে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসের আকুর আমদানি বিল সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের চেয়ে বেশি হবে।
এক বছর আগে গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। গ্রস হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার।
আমদানি ব্যয় কমায় এবং রেমিটেন্স বাড়ায় ২০২১ সালের আগস্টে বাড়তে বাড়তে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গ্রস হিসাবে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
গত বছরের ১২ জুলাই থেকে আইএমএফের কথা মতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সেখানে গ্রস হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম-৬ পদ্ধতি অনুসরণ করেও তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। এর আগে কেবল গ্রস হিসাবের তথ্যই প্রকাশ করা হতো।
এখন বিপিএম-৬ ও গ্রস হিসাবের পাশাপাশি রিজার্ভের নিট বা প্রকৃত হিসাবও করে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে সেটি প্রকাশ করা হয় না। কেবল আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থাকে জানিয়ে দেওয়া হয়।
নিট রিজার্ভ হচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রার মোট সঞ্চিতি থেকে সব ধরনের দায়দেনা বাদ দেওয়ার পর যা থাকে সেটা। বাংলাদেশের পেক্ষাপটে গ্রস হিসাবের রিজার্ভের চেয়ে নিট রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলারের মতো কম থাকে। আর বিপিএম-৬ হিসাবের চেয়ে কম থাকে ৫ বিলিয়ন ডলারের মতো।
সে হিসাবে বাংলাদেশের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৬ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। এতে দেখা যাচ্ছে, ডিসেম্বর শেষে ১৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার নিট বা প্রকৃত রিজার্ভ থাকার যে শর্ত আইএমএফ দিয়েছে, তার চেয়েও বেশি আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভকে তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ হিসেবে উল্লেখ করে।
সবশেষ গত অক্টোবর মাসের আমদানির তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, ওই মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৬ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে।
সে হিসাবে ২১ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে তিন মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুদ থাকতে হয়।