রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রমের সঙ্গে ইউক্রেনের গ্যাস ট্রানজিট পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান নাফতোগ্যাসের পাঁচ বছরের চুক্তির মেয়াদ ফুরিয়েছে। ফলে ইউক্রেনকে ট্রানজিট হিসাবে ব্যবহার করে ইউরোপে আর গ্যাস রপ্তানি করতে পারবে না রাশিয়া।
১ জানুয়ারি চুক্তিটির মেয়াদ শেষের পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তাদের ভূমি ব্যবহার করে রাশিয়াকে আর ব্যবসায়িক সুবিধা দিতে রাজি নন।
তেমনটাই সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তিনি; বলেছেন, “আমাদের রক্তের ওপর দিয়ে রাশিয়াকে আর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার কামাতে দেব না।”
এর জন্য প্রস্তুত হতে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) এক বছর সময় দিয়েছেন বলেও দাবি করেছেন জেলেনস্কি।
গ্যাসের জন্য ইউরোপের অনেক দেশই রাশিয়ার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। ১৯৯১ সাল থেকে ইউক্রেনের মাধ্যমে রাশিয়ার গ্যাস পাচ্ছে ইউরোপের দেশগুলো। তাছাড়া ইউক্রেনের ওপর দিয়ে যে গ্যাস ইউরোপে যায়, তার দামও তুলনামূলক কম। ফলে এই ট্রানজিটের সঙ্গে সঙ্গে অল্প দামে ইউরোপের গ্যাস পাওয়ার সুযোগও বন্ধ হতে যাচ্ছে।
কিন্তু কম দামে জ্বালানির জন্য রাশিয়ার গ্যাসের ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল ইউরোপ কি আসলেই রাশিয়ার গ্যাস ছাড়া চলার জন্য প্রস্তুত হতে পেরেছে? অন্যদিকে, ইউরোপের মত বড় বাজার হারিয়ে রাশিয়ার অর্থনীতিই বা কেমন ক্ষতির মুখে পড়বে?
ইউরোপীয় কমিশন অবশ্য বলছে, তারা প্রস্তুত। মহাদেশের গ্যাস ব্যবস্থা ‘সহনশীল ও নমনীয়’ পর্যায়ে রয়েছে জানিয়ে তাদের দাবি, ইউক্রেনের মাধ্যমে গ্যাস ট্রানজিট বন্ধ হলেও তা সামাল দিতে ইউরোপ এখন যথেষ্ট সক্ষম।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সস্তায় রাশিয়ার গ্যাস না পেলে ইউরোপের ওপর তার কৌশলগত ও প্রতীকী প্রভাব হবে ব্যাপক। যদিও ইইউ বলছে, যথাযথ পরিকল্পনা ও বিকল্প সরবরাহের কারণে এই প্রভাব সীমিত পর্যায়েই থাকবে।
জোগান বিবেচনায় নিলে ইইউ রাশিয়ার গ্যাসের উপর নির্ভরতা অনেকটাই কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। এক্ষেত্রে কাতার ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি এবং নরওয়ে থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাসের জোগান তাদের জন্য ভালো বিকল্প হয়ে উঠেছে, যদিও এর জন্য তুলনামূলকভাবে বেশি অর্থ গুনতে হচ্ছে তাদের।
গত ডিসেম্বরে ইউরোপীয় কমিশন এমন পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছে, যা ইউক্রেন হয়ে আসা রাশিয়ার গ্যাসের পুরোপুরি বিকল্প হয়ে উঠতে সক্ষম হবে বলে তারা মনে করছেন।
ইইউর জরুরি পরিকল্পনা অনুযায়ী, ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে গ্রিস, তুরস্ক ও রোমানিয়া থেকে ট্রান্স-বলকান রুটের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ করা হবে, যখন নরওয়ের গ্যাস পোল্যান্ডের মাধ্যমে পাইপলাইনে আসবে। এর পাশাপাশি জার্মানির মাধ্যমে মধ্য ইউরোপের দেশগুলোতে আরও গ্যাস সরবরাহ করা হবে।
ইউক্রেন হয়ে ইউরোপের যে দেশগুলো রাশিয়ার গ্যাস নেয়, তাদের অন্যতম অস্ট্রিয়া। দেশটির জ্বালানি নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইতোমধ্যে দাবি করেছে, তাদের সরবরাহে ঘাটতির কোনও শঙ্কা আপাতত নেই, কারণ তারা বিভিন্ন উৎস থেকে সরবরাহ নিশ্চিত করেছে এবং মজুত বাড়িয়েছে।
তবে রাশিয়াকে গ্যাস রপ্তানির জন্য আর ট্রানজিট না দেওয়া বিষয়ে ইউক্রেনের সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যেই স্লোভাকিয়ার জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ ইউক্রেন থেকে মূলত স্লোভাকিয়া হয়েই ইউরোপের দেশ অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও ইতালিতে যায় রাশিয়ার গ্যাস। এর জন্য ট্রানজিট ফি-ও পায় স্লোভাকিয়া। ফলে ইউক্রেন ট্রানজিট না দিলে স্লোভাকিয়ার আয়ের একটি পথও বন্ধ হয়ে যাবে।
এমন পরিস্থিতিতে গত শুক্রবার স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকো ইউক্রেনে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেন।
জবাবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি অভিযোগ করেছেন, স্লোভাকিয়া ‘যুদ্ধের অর্থ জোগাতে এবং ইউক্রেনকে দুর্বল করতে’ পুতিনকে সাহায্য করছেন।
তিনি বলেন, “ফিকো স্লোভাকিয়াকে ইউক্রেনীয়দের কষ্ট আরও বাড়ানোর জন্য রাশিয়ার প্রচেষ্টার মধ্যে টেনে নিচ্ছেন।”
স্লোভাকিয়া ইউক্রেনে বিদ্যুৎ রপ্তানি বন্ধ করলে সেক্ষেত্রে পোল্যান্ড বিদ্যুৎ দিয়ে কিয়েভকে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে। ইউক্রেনের জন্য পোল্যান্ডের এই সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে, কারণ রাশিয়ার নিয়মিত হামলায় তাদের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অবস্থা এখন খুবই খারাপ।
রাশিয়া-ইউক্রেন ট্রানজিট চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় ইইউর অংশ না হলেও ইউরোপের দেশ মলদোভাও বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। দেশটির একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চলে রাশিয়ার গ্যাসে, যা দেশটির বেশিরভাগ বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করে।
অবশ্য মলদোভার জ্বালানিমন্ত্রী কনস্তান্তিন বোরোসান বলেছেন, সরকার দেশটিতে স্থিতিশীল বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে নাগরিকদের জ্বালানি খরচে মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।
মলদোভার জ্বালানি খাতে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ৬০ দিনের জরুরি অবস্থা চলছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট মাইয়া সান্দু অভিযোগ করেছেন, ২০২৫ সালের সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাশিয়া তার দেশকে ‘ব্ল্যাকমেইল’ করছে।
এদিকে, ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি বন্ধ হলে নিঃসন্দেহে রাশিয়া একটি বড় বাজার হারাবে, যদিও দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলছেন, এর কারণে ইউরোপের দেশগুলোই বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে।
রাশিয়া ২০২২ সালে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অনেক দেশই তাদের গ্যাস আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিয়েছে। তবে ইইউর পূর্বাঞ্চলীয় কিছু দেশ এখনও রাশিয়ার গ্যাসের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। এই দেশগুলোতে গ্যাস রপ্তানি করে রাশিয়া বছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন ইউরো (৫.২ বিলিয়ন ডলার বা ৪.২ বিলিয়ন পাউন্ড) আয় করে।
২০২৩ সালে ইইউর গ্যাস আমদানির ১০ শতাংশেরও কম রাশিয়ার গ্যাস থেকে এসেছে, যেখানে ২০২১ সালে এটি ছিল ৪০ শতাংশ। তবে স্লোভাকিয়া ও অস্ট্রিয়াসহ ইইউভুক্ত বেশ কয়েকটি দেশ এখনও রাশিয়া থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে গ্যাস আমদানি করছে।
এসব দেশে রাশিয়ার গ্যাস রপ্তানি বন্ধ হলে তাদের রপ্তানি বাণিজ্যেও তার ধাক্কা লাগবে। এক্ষেত্রে বিকল্প কোনও পরিকল্পনার কথা এখনও রাশিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়নি।
অবশ্য ইউক্রেন ট্রানজিট বন্ধ করে দিলেও রাশিয়া হাঙ্গেরি, তুরস্ক ও সার্বিয়ায় গ্যাস সরবরাহ করতে পারবে। কারণ কৃষ্ণ সাগর হয়ে ‘তুর্কস্ট্রিম’ পাইপলাইনের মাধ্যমে এসব দেশে গ্যাস যাবে।