Beta
সোমবার, ৬ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
সোমবার, ৬ জানুয়ারি, ২০২৫

ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ের মগবাজারের কাজ নিয়ে অনিশ্চয়তা

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার।
[publishpress_authors_box]

থাইল্যান্ডের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ইতালিয়ান-থাইয়ের হাতে থাকা ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের শেয়ার চীনের দুই প্রতিষ্ঠান সিএসআই ও সিনোহাইড্রোয় হস্তান্তরের ওপর দুই সপ্তাহের স্থিতাবস্থা জারি করেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এ কারণে সাময়িকভাবে বন্ধ থাকবে ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ। 

দেশের প্রথম এই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে। আর এ নির্মাণকাজে বেসরকারি অংশীদার ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেড (এফডিইই)।

এফডিইইতে ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিক ইতালিয়ান থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেড। অবশিষ্ট ৪৯ শতাংশের মধ্যে চাইনা শ্যানডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কোঅপারেশন গ্রুপ লিমিটেডের (সিএসআই) ৩৪ শতাংশ ও সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেডের রয়েছে ১৫ শতাংশ।   

বর্তমানে এফডিইইর মালিকানা নিয়ে ইতালিয়ান-থাইয়ের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছে দুই চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ঠিকাদারদের এ বিরোধে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ ধীর হয়ে পড়েছিল।

বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ ৮ বিচারপতি আপিল বেঞ্চ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শেয়ার হস্তান্তরের বিষয়ে স্টেটাস কুও বা স্থিতাবস্থা জারি করেছে। আর নির্দেশ দিয়েছে, এ বিষয়ে আগামী ৩০ মের মধ্যে লিভ টু আপিল দায়ের করতে।

এতে এখন এক্সপ্রেসওয়েটির নির্মাণকাজ সাময়িকভাবে বন্ধ থাকছে।

প্রধান বিচারপতি বলেন, “আমাদের কাছে দেশের স্বার্থই সব থেকে বড়। ব্যক্তি বা ব্যাংক নয়। আমরা হাইকোর্টের রায় দেখেই আদেশ দেব।”

আদালতে ইতালিয়ান-থাইয়ের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এম আমিন উদ্দিন (অ্যাটর্নি জেনারেল), শেখ মোহাম্মদ মোরসেদ (অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল), ব্যারিস্টার ইমতিয়াজ ফারুক, ব্যারিস্টার ইমতিয়াজ মইনুল।

চীনের কোম্পানি দুটির পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী, আর চীনের এক্সিম ব্যাংকের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার মোস্তাফিজুর রহমান খান।

চীনের কোম্পানির আইনজীবী ব্যারিস্টার মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী বলেন, হাইকোর্টের আদেশ পাওয়া সাপেক্ষে দুই সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। দুই সপ্তাহ পর সিপি (লিভ টু আপিল) হিসেবে মামলাটি আপিলের তালিকায় আসবে পরবর্তী শুনানির জন্য।

এ সময় পর্যন্ত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলবে না কি বন্ধ থাকবে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেহেতু ব্যাংক বলে দিয়েছে তারা অর্থ দেবে না, কাজেই এখন তো কাজ বন্ধ রয়েছে।

ব্যাংকটির পক্ষে ব্যারিস্টার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “আর্বিট্রেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত যদি এই স্টেটাস কুয়ো (স্থিতাবস্থা) বহাল থাকে, তাহলে এই ঋণের শর্ত অনুসারে আরও যে ৩৯০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার কথা, সেটা ব্যাংক করবে না। এরফলে প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকবে। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মগবাজারের পরের কাজ অনিশ্চিয়তার মধ্যে পড়বে। এছাড়া বাংলাদেশে বর্তমানের ডলারের যে অবস্থা তার মধ্যে এই ডলার আসলে দেশের জন্যই ভালো হতো।”

দ্বন্দ্ব যেভাবে শুরু

ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের দক্ষিণে কাওলা, কুড়িল, বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক (কুতুবখালী) রুটে নির্মাণ হচ্ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।

প্রকল্পটিতে বিনিয়োগকারী হিসেবে এগিয়ে এলে ইতালিয়ান-থাইয়ের সঙ্গে ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি চুক্তি হয়। তখন প্রকল্পের মেয়াদ ছিল তিন বছর। এরপর ২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর সংশোধিত চুক্তি হয়। এ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা।

প্রকল্পের চুক্তি অনুযায়ী নির্মাণ ব্যয়ের ৭৩ শতাংশের জোগান দেবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। আর ২৭ শতাংশ, ২ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা ব্যয় করবে বাংলাদেশ সরকার।     

শুরু থেকেই প্রকল্পের অর্থের সংস্থান করতে ব্যর্থ হয় প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৯ সালে চায়না এক্সিম ব্যাংক ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়নার (আইসিবিসি) কাছ থেকে ৮৬১ মিলিয়ন ডলার ঋণ জোগাড় করে ইতালিয়ান-থাই। বিনিময়ে চীনের দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানির ৪৯ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটি। ওই দুটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে সিএসআই ও সিনোহাইড্রো করপোরেশন, যাদের হাতে রয়েছে এফডিইইর ৩৪ ও ১৫ শতাংশ শেয়ার।    

এরপর দফায় দফায় সময় বাড়িয়ে ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিক নির্মাণকাজ শুরু হয়। চলতি বছরের ৩০ মার্চ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল।

কিন্তু ব্যাংকঋণের সুদ পরিশোধে ইতালিয়ান-থাইয়ের ব্যর্থতার কারণে ব্যাংক তার ঋণ আটকে দেয়। আর শর্ত অনুসারে ইতালিয়ান-থাইকে চীনের প্রতিষ্ঠান দুটির শেয়ার হস্তান্তর করতে বলে। ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুরে সালিশী মামলা করে ইতালিয়ান-থাই।

উচ্চ আদালতে যেভাবে এল

সিঙ্গাপুরে সালিশী মামলা চলমান থাকায় অবস্থায় সালিশ আইন ২০০১ আইনের ৭ক অনুসারে শেয়ার হস্তান্তরের উপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করে ইতালিয়ান-থাই। এ আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি খিজির আহমেদ চৌধুরীর একক হাইকোর্ট বেঞ্চ নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

পরে হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে চীনের দুই কোম্পানি আপিলে যায়। আপিল বিভাগ অন মেরিটে নিষ্পত্তি করতে হাইকোর্টকে নির্দেশ দেয়। পরবর্তী সময়ে হাইকোর্ট ফের শুনানি করে ইতালিয়ান-থাইয়ের আবেদন খারিজ করে রায় দেয়।

এরপর এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করে ইতালিয়ান-থাই, যার শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগ দুই সপ্তাহের স্টেটাস কুয়ো জারি করে ৩০ মে পরবর্তী তারিখ ঠিক করে দিল।

আইনজীবী যা বললেন

চীনের কোম্পানির আইনজীবী মেহেদী হাছান চৌধুরী বলেন, “২০১৩ সালে ইতালিয়ান ডেভেলপমেন্ট কোম্পানিকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করার জন্য বাংলাদেশ সরকার কার্যাদেশ দেয়। কিন্তু তারা কাজ শুরু করতে ব্যর্থ হলে দুই চীনা কোম্পানির সঙ্গে মিলে একটি কোম্পানি (এফডিইই) করে।

“ওই তিনটা কোম্পানি মিলে প্রকল্পের জন্য ঋণ নেয়। সেখানে শর্ত ছিল, অংশীদারদের কেউ জানুয়ারি বা জুনে ঋণের সুদ দিতে ব্যর্থ হলে সুদের ওই অংশটা বাকি দুই গ্যারান্টারকে দিতে হবে এবং সুদ দিতে ব্যর্থ কোম্পানির শেয়ার বাকিদের কাছে চলে যাবে। বাংলাদেশ সরকারও তাতে অনুমোদন দেয়।”

এই আইনজীবী বলেন, “২০২৩ সালে ইতালিয়ান-থাই ঋণের সুদ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়। সে কারণে ঋণদাতা চীনা ব্যাংক ২০২৪ সালের ২৩ জানুয়ারি ইতালিয়ান-থাইকে চিঠি দিলে তারা আরবিট্রেশানে যায়।

“ওই আরবিট্রেশনের প্রেক্ষিতে তারা হাইকোর্ট ডিভিশনে মামলা করে, যাতে শেয়ার হস্তান্তর স্থগিত হয়। হাইকোর্ট মামলাটি চলার যোগ্য না বলে রুল খারিজ করে দেয়। তখন তারা আপিল বিভাগে আসে।”

নির্মাণকাজে অনিশ্চয়তা

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। র‌্যাম্পসহ এর দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। পুরো কাজ শেষ হলে মোট ৩১টি র‌্যাম্প দিয়ে এক্সপ্রেসওয়েতে যানবাহন ওঠানামার সুযোগ হবে।

২০১৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার দূরত্ব অংশ উদ্বোধন করা হয়। পরদিন ৩ সেপ্টেম্বর এই অংশে যানবাহন চলাচল শুরু হয়।

গত ২০ মার্চ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) গেট-সংলগ্ন র‍্যাম্প যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়।

প্রথম ধাপে ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ের বিমানবন্দর-বনানী অংশের অগ্রগতি ৯৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। দ্বিতীয় ধাপ বনানী-মগবাজার অংশের অগ্রগতি ৭৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

শেষ ধাপ মগবাজার-কুতুবখালী অংশের অগ্রগতি ১২ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। গত এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পটির সার্বিক অগ্রগতি ৭৪ দশমিক ২৩ শতাংশ।

কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মগবাজার-কুতুবখালী অংশের অগ্রগতি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হলো।  

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত