Beta
শনিবার, ৪ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
শনিবার, ৪ জানুয়ারি, ২০২৫

অবিস্মরণীয় ২০২৪

৩৬ জুলাইয়ের আন্দোলন

অনিক রায়

‘শেখ হাসিনা পালায় না’- এক বছর আগের এই ভিডিও ৫ আগস্ট ফিরে এসেছিল সোশাল মিডিয়ায় ওয়ালে ওয়ালে। ২০২৩ সালের ১ অগাস্ট এক অনুষ্ঠানে এই বক্তব্য দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। এক বছরের মাথায় পাল্টে গেল দৃশ্যপট; ৩৬ দিনের আন্দোলনে দেশে ছাড়তে হলো ১৬ বছরের শাসক শেখ হাসিনাকে। তারপর থেকে ভারতেই রয়েছেন তিনি।

গত ১ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা যখন রাজপথে নেমেছিল, তখন বাংলাদেশে কে ভাবতে পেরেছিল মাত্র ৩৬ দিনে নতুন এক ইতিহাস তৈরি হতে যাচ্ছে।

রক্ত, মৃত্যু, ধ্বংসের মধ্যে পতন ঘটল শেখ হাসিনার সরকারের। ভিন্ন ধরনের এক সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে দায়িত্ব নিলেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

৩৬ দিনের আন্দোলনে ৮৫৮ জন নিহত এবং সাড়ে ১১ হাজার আহত ব্যক্তির প্রথম ধাপের খসড়া তালিকা এরই মধ্যে প্রকাশ করেছে ‘গণঅভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিশেষ সেল’। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাথমিক হিসাবে নিহতের সংখ্যা ১৫৮১, আহত ৩১ হাজারের বেশি।

গণআন্দোলনে পতনের পর এই প্রথম কোনও রাষ্ট্রনেতাকে পালাতে দেখল বাংলাদেশ। ক্ষমতার দম্ভই তার কাল হলো। একটানা ১৫ বছর দেশ শাসন করছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। কঠোর হাতে বিরোধী দলকে দমন করে তকমা পেয়েছিলেন ‘আয়রন লেডি’; আর চলে যাওয়ার সময় জনতার স্লোগান শুনতে হলো- ‘এক, দুই, তিন চার-শেখ হাসিনা স্বৈরাচার’।

শুরুটা হয়েছিল গত ৫ জুন হাইকোর্টের এক রায়ে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ফিরিয়ে আনার রায় থেকে। এরপর কোটা সংস্কারের দাবিতে জুলাইয়ে আন্দোলন শুরু হলেও মাসের মাঝামাঝিতে এসে তা ভিন্ন মাত্রা পায়। কীভাবে উত্তাল হয়ে উঠেছিল জুলাইয়ের দিনগুলো।

অভ্যুত্থানের বিজয় উল্লাস; সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে জুলাই মাসে শুরু হয়েছিল শিক্ষার্থীদের যে আন্দোলন, আওয়ামী লীগ সরকারের দমন অভিযানে রক্তাক্ত পথ পেরিয়ে তা রূপ নেয় অভ্যুত্থানে। তাতে ৫ আগস্ট পতন ঘটে শেখ হাসিনার। উল্লাসে ফেটে পড়ে গোটা দেশ; জনতার ঢল উঠে পড়ে গণভবনের ছাদে মোবাইল টাওয়ারেও। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
কোটা সংস্কারের দাবিতে ১ জুলাই প্রথম কর্মসূচি নিয়ে নেমেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ করেছিল তারা। কে ভেবেছিল, ৩৬ দিনের মধ্যে তা অভ্যুত্থানে রূপ নেবে? ছবি : সকাল সন্ধ্যা
জুলাইয়ে মাঝামাঝি থেকে আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ; এরপর নির্বিচারে গুলি চলে। তাতে হাজার আন্দোলনকারী নিহত হয়। এই পুরো ঘটনায় পুলিশ ছিল জনরোষের মধ্যে। অভ্যুত্থানের পর পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব পাওয়া বাহারুল ইসলাম সম্প্রতি বলেছেন, পুলিশকে লাঠিয়াল বাহিনী হিসাবে ব্যবহার করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
কোটা সংস্কারের আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালিয়ে আলোচিত ছিল ছাত্রলীগ। আওয়ামী লীগের এই সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা ধারাল অস্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা পড়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ ছিল জুলাই আন্দোলনের সময় আলোচিত ঘটনা। এনিয়ে উচ্চ আদালতও ক্ষোভ জানায় পরে। আন্দোলনের মধ্যে ঢাকার আকােশ হেলিকপ্টারে ওড়াওড়ি ছড়িয়েছিল আতঙ্ক। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগে আন্দোলন দমনে ছিল কঠোর ভূমিকায়। তাতে মৃত্যুর মিছিলে প্রতিদিনই যোগ হচ্ছিল নতুন নতুন নাম। সেই ঘটনাগুলোতে গণহত্যার অভিযোগে এখন বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এই কার্যালয় ছিল ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদের নিয়ন্ত্রণে। সেখানে ধরে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ তো আগে থেকেই ছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সেখানে আটকে রাখার ক্ষোভ আন্দোলনে দিয়েছিল নতুন মাত্রা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
আন্দোলনকারীদের ওপর প্রথম হামলা হয় গত ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রলীগের সেই হামলায় আহত হয় অনেকে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
প্রতিরোধের শক্তি; গত ৩১ জুলাই ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি দিয়ে শিক্ষার্থীরা সুপ্রিম কোর্টে গেলে কয়েকজনকে পুলিশ আটক করে। তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থী পুলিশের গাড়ির সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ান। সেই ছবি পেন্সিলে এঁকেছিলেন অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, তিনি এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রেরণার নাম আবু সাঈদ; রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীর পুলিশের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর ছবি ছড়িয়ে পড়েছিল সোশাল মিডিয়ায়; পরে তা গ্রাফিতিতেও স্থান পায়। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
কোটা সংস্কার আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠার পর সেনাবাহিনী নামিয়েছিল সরকার। তবে সেনাবাহিনী শেষে জনগণেকে রক্ষার পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিল। ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের বিজয় পর্বে শাহবাগে সেনাসদস্যরা পেয়ে জড়িয়ে ধরেছিল জনতা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’ গত বছরের নভেম্বরে উদ্বোধন করেছিলেন শেখ হাসিনা। অভ্যুত্থানে তার সরকারের পতনের পর ক্ষোভের আগুন গিয়ে পড়ে বঙ্গবন্ধুর ওপরও। সেই ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয় ৫ আগস্ট। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
টানা দেড় দশক দেশ শাসনের পর গত ৫ আগস্ট এভাবে পালিয়ে যেতে হয় শেখ হাসিনাকে। গণভবন থেকে তেজগাঁও বিমানবন্দরে যাওয়ার পর হেলিকপ্টারে তিনি পৌঁছান কুর্মিটোলায়। সেখান থেকে একটি পরিবহন বিমানে করে ভারতে যান তিনি। এখনও সেখানেই রয়েছেন তিনি।
অভ্যুত্থানের সময় ফ্রান্সে ছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস; কিন্তু তাকেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ৮ আগস্ট তিনি দেশে ফেরার পর তাকে অভ্যর্থনা জানাতে শাহজালাল বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়েছিলেন অভ্যুত্থানের নেতারা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

১৪ জুলাই

চীন সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা; এক সাংবাদিকের প্রশ্নে তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাদের এত ক্ষোভ কেন? (চাকরি) মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি পুতিরা পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি পুতিরা পাবে?”

সেই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় রাতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সেই বিক্ষোভ থেকে স্লোগান ওঠে- ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার-রাজাকার’।

১৫ জুলাই

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। দফায় দফায় সংঘর্ষ হয় ক্যাম্পাসে।

১৬ জুলাই

সারাদেশে আন্দোলনকারী ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক সংঘাত বাধে। এতে ঢাকায় দুজন, চট্টগ্রামে তিনজন এবং রংপুরে একজন নিহত হয়।

রংপুরে নিহত আবু সাঈদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ছিলেন। পুলিশের গুলির মুখে তার প্রতিরোধের ছবি এই আন্দোলনের প্রেরণা হয়ে ওঠে।

এদিন কোটা পুনর্বহাল করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের আবেদন করে সরকার।

১৭ জুলাই

সারাদেশে পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। সেই পরিস্থিতিতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন শেখ হাসিনা। সর্বোচ্চ আদালতের রায় না আসা পর্যন্ত সবাইকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান।

তাতে সাড়া না দিয়ে পরদিন ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

১৮ জুলাই

সারাদেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি চলাকালে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও সরকার সমর্থকদের সংঘর্ষ বাধে। নিহত হয় কমপক্ষে ৪১ জন।

ঢাকায় মেরুল বাড্ডায় একটি ভবনে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। পরে হেলিকপ্টারে করে তাদের উদ্ধার করা হয়।

রামপুরায় বিটিভি ভবন, বনানীতে সেতু ভবন, মহাখালীতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সারাদেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়।

সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশের পরিবর্তে ২০ শতাংশ কোটার প্রস্তাব করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে সরকার রাজি বলে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। যদিও আলোচনার প্রস্তাব নাকচের ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা।

সহিংসতায় মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত জানায় সরকার।

কোটা পুনর্বহাল করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের শুনানি এগিয়ে ২১ জুলাই করার সিদ্ধান্ত হয়।

১৯ জুলাই

সংঘর্ষ ব্যাপক আকারে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকাসহ বেশ কয়েকটি জেলা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। নিহত হয় অন্তত ৭৫ জন।

এদিন রাজধানীতে মেট্রোরেলের মিরপুর ১০ নম্বর ও কাজীপাড়া স্টেশন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা, মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ জনতা।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে সারাদেশে কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েন করে সরকার। গ্রেপ্তার হন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।

২০ জুলাই

কারফিউ ভেঙে এদিন ঢাকা, সাভার, গাজীপুর, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছাত্র-জনতা রাজপথে নামলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ওপর চড়াও হয়। সংঘাতে নিহত হয় কমপক্ষে ৩৩ জন।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতের সঙ্গে দেখা করে আটটি দাবি জানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক। এই সাক্ষাৎ নিয়ে সমন্বয়কদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়।

কারফিউ বহাল থাকায় ২১ ও ২২ জুলাই সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়।

২১ জুলাই

কড়া নিরাপত্তার মধ্যে আপিল বিভাগে শুনানির পর কোটা পুনর্বহাল নিয়ে হাইকোর্টের রায় বাতিল করা হয়।

৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা, ১ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা, ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের কোটা রেখে বাকি ৯৩ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের আদেশ দেয় আদালত। সরকার চাইলে কোটার হার পুনর্বিন্যাস করা যেতে পারে বলেও আদালতের পক্ষ থেকে বলা হয়।

কারফিউর মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় সংঘাতে অন্তত ১২ জন নিহত হয়।

২২ জুলাই

বিচ্ছিন্ন সংঘাত ঘটলেও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। সংঘাত শুরুর পর থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের খবর দেয় পুলিশ।

কমপ্লিট শাটডাউন ৪৮ ঘণ্টার জন্য স্থগিতের ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। চার দফা দাবি বাস্তবায়নে সরকারকে আলটিমেটাম দেয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।

সাধারণ ছুটির মেয়াদ ২৩ জুলাই পর্যন্ত বাড়ানোর ঘোষণা দেয় সরকার।

২৩ জুলাই

আপিল বিভাগের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংশোধন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

এতে বলা হয়, সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগে সব গ্রেডে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হবে ৯৩ শতাংশ। বাকি ৭ শতাংশ নিয়োগ হবে কোটার ভিত্তিতে।

কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সাধারণ মেধাতালিকা থেকে শূন্য পদ পূরণ করা হবে।

রাতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সীমিত আকারে চালু করা হয়। সাধারণ ছুটি না বাড়িয়ে ২৪ জুলাই থেকে সীমিত পরিসরে অফিস-আদালত খোলার সিদ্ধান্ত হয়।

ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদীতে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করা হয়।

২৪ জুলাই

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মামলার হয়রানিতে ফেলা হবে না বলে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

তবে চলমান আন্দোলন থেকে শিক্ষার্থীরা সরে আসছে না বলে জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।

২৫ জুলাই

মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ নম্বর স্টেশন পরিদর্শন শেষে সারাদেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনায় দেশবাসীর কাছে বিচার চান শেখ হাসিনা।

দেশ ধ্বংসের দলীয় এজেন্ডা আড়াল করতে বিএনপি-জামায়াত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়।

সহিংসতায় মৃত্যুর ঘটনার নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান জানায় জাতিসংঘ।

২৬ জুলাই

সংঘাত-সহিংসতায় দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানির বিচার দাবি করে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা। কারফিউ শিথিলের মধ্যে ঢাকায় গানের মিছিল হয়।

ধানমণ্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারকে তুলে নিয়ে ‍যায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

২৭ জুলাই

বাংলাদেশকে আবার ‘ভিক্ষুকের জাতিতে পরিণত করতেই’ কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা চালানো হয়েছে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সারাদেশে সহিংসতা ও হত্যার প্রতিবাদে ২৮ জুলাই গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখন কর্মসূচির ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

২৮ জুলাই

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ‘জামায়াত-শিবির ছদ্মবেশে অনুপ্রবেশ’ করেছে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট সহিংসতায় সারাদেশে কয়েকদিনে ১৪৭ জন নিহত হয়েছে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়কের একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়, যেখানে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়।

যদিও বাইরে থাকা সমন্বয়করা এই ভিডিও নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ‘জোর করে’ আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয় অভিযোগ করে নতুন কর্মসূচি দেন তারা।

২৯ জুলাই

গণগ্রেপ্তারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হয়রানি বন্ধসহ আটক শিক্ষার্থীদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একাংশ।

৩০ জুলাই

কোটা আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় নিহতদের স্মরণে রাষ্ট্রীয়ভাবে সারাদেশে শোক পালন করা হয়।

রাষ্ট্রীয় শোক প্রত্যাখ্যান করে ফেইসবুকে প্রোফাইল পিকচার লাল করে চোখে লাল কাপড় বেঁধে ছবি পোস্ট করার আহ্বান জানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ঢাকায় সাংস্কৃতিক কর্মীরা গানের মিছিল বের করে।

৩১ জুলাই

সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে শতাধিক মানুষ হত্যার ঘটনার বিচার দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ডাকা ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করে ছাত্র-জনতা ।

শিক্ষার্থীসহ দুই শতাধিক মানুষ হত্যার দায় নিয়ে সরকারের প্রতি পদত্যাগের আহ্বান জানান ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের (ইউল্যাব) অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান।

১ আগস্ট

ডিবি কার্যালয় থেকে মুক্তি পান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ ও নুসরাত তাবাসসুম।

সহিংসতায় নিহতদের স্মরণে পালিত হয় ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি।

‘সন্ত্রাসী দল’ হিসেবে জামায়াতকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

২ আগস্ট

ঢাকায় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত দ্রোহযাত্রায় সভাপতির বক্তব্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ সরকারকে অবিলম্বে পদত্যাগের আহ্বান জানান।

ডিবি হেফাজত থেকে মুক্তি পাওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক বলেন, ডিবি কার্যালয়ে হেফাজতে থাকাকালে স্বেচ্ছায় তারা আন্দোলন প্রত্যাহারের বার্তা দেননি। জোর করে তাদের দিয়ে মিথ্যা বিবৃতি দেওয়ানো হয়েছিল।

৯ দফা দাবিতে ৩ আগস্ট সারাদেশে বিক্ষোভ এবং ৪ আগস্ট থেকে অনির্দিষ্টকালের ‘সর্বাত্মক অসহযোগ’ আন্দোলনের ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

৩ আগস্ট

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তাদের জন্য গণভবনের দরজা খোলা।

তবে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে শহীদ মিনারের সমাবেশ থেকে সরকার পতনের ১ দফা দাবি তোলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের জনগণের আস্থার প্রতীক। জনগণের স্বার্থে এবং রাষ্ট্রের যেকোনো প্রয়োজনে সেনাবাহিনী সবসময় জনগণের পাশে আছে এবং থাকবে।

৪ আগস্ট

দেশব্যাপী সহিংসতায় শিক্ষার্থী, পুলিশ সদস্যসহ প্রায় একশজন নিহত হওয়ার খবর আসে।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়াসহ অবসরপ্রাপ্ত এক দল সেনা কর্মকর্তা। সেনাবাহিনীকে ছাউনীতে ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানায় তারা।

পূর্বঘোষিত ৬ আগস্টের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি একদিন এগিয়ে ৫ আগস্ট পালনের ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে ‘বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ রূপান্তরের রূপরেখা প্রস্তাব’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে দেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ৫ দফা প্রস্তাব তুলে ধরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।

সরকারের পক্ষ থেকে অনির্দিষ্টকাল কারফিউ জারি। যে কোনও নাশকতা কঠোর হাতে দমনের নির্দেশ শেখ হাসিনার। শিক্ষার্থীদের বাইরে বের হতে না দিতে অভিভাবকদের প্রতি সরকারের বার্তা।

৫ আগস্ট

ঢাকায় সকাল থেকে কঠোর অবস্থানে পুলিশ। যাত্রাবাড়ী, বাড্ডা ও উত্তরায় সংঘর্ষ। দুপুরের আগে সড়ক পুলিশশূন্য হয়ে পড়ে। এরপর বিভিন্ন দিক থেকে শাহবাগের দিকে মিছিল এগোতে থাকে বিনা বাধায়। দুপুরের পর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সংবাদ সম্মেলনে জানান, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এরমধ্যে খবর আসে বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতের রওনা হয়েছেন শেখ হাসিনা। তাদের আগরতলা হয়ে দিল্লি পৌঁছনোর খবর আসে ভারতের সংবাদমাধ্যমে।

ঢাকার রাজপথজুড়ে উল্লাস; গণভবন, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকে পড়ে জনতা। সরকারি এসব ভবন থেকে যে যা পায়, নিয়ে যায়।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু স্মতি জাদুঘরসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ। বিভিন্ন পুলিশ থানা ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ। বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপরও হামলা হয়।

৬ আগস্ট

সরকারহীন, পুলিশহীন দেশে অরাজকতা চলতে থাকে। বিভিন্ন স্থানে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ চলে। ডাকাত আতঙ্ক ছড়ায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়।

শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রস্তাব মেনে নেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সংসদ বিলুপ্ত করা হয়।

সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে কয়েকটি রদবদল হয়, চাকরিচ্যুত হন মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান।

৭ আগস্ট

পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ে রদবদল। চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে বাদ দিয়ে মো. ময়নুল ইসলামকে আইজিপি নিয়োগ। র‌্যাব ও ডিএমপি কমিশনারও পরিবর্তন।

অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন পদত্যাগ করেন। মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার নিয়োগ বাতিল করা হয়।

সাত বছর পর নয়া পল্টনে দলের সমাবেশে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে হাজির হন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এই সমাবেশে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন তারেক রহমান।

শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. ইউনূসের ৬ মাসের সাজা বাতিল করে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল। এদিন ফ্রান্স থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন ইউনূস।

সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান জানান, পরদিন রাত ৮টায় অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নিতে পারে।

৮ আগস্ট

দুপুরে ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে নামেন ড. ইউনূস। তাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। সাংবাদিকদের ইউনূস বলেন, “আমার প্রথম কাজ শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা।”

রাতে বঙ্গভবনে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসসহ ১৪ জন উপদেষ্টাকে শপথ পড়ান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। বাকি তিন উপদেষ্টা ঢাকায় না থাকায় তারা পরে শপথ নেন।

ছিলেন জেলের পথে, গেলেন মসনদে

নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিদেশে খ্যাতি কুড়ালেও বাংলাদেশে কিছু দিন আগেও তাকে দৌড়াতে হয়েছিল আদালতের বারান্দায় বারান্দায়। এই মামলাগুলো শেখ হাসিনার প্রতিহিংসাপরায়ণতার ফসল বলে অভিযোগ করে আসছিল তার সমর্থকরা। সেই সব মামলার শুনানির সময় এজলাসের কাঠগড়ায় তাকে দাঁড়াতে হয়েছিল অনেক বার। ‘লোহার খাঁচা’ ভেতরে রাখায় অপমান বোধের কথাও বলেছেন বার বার।

কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থান বদলে দিয়েছে সব, কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর ২৪ দিনের ব্যবধানে তিনি আসীন হন সরকার প্রধানের চেয়ারে। অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতারাই তাকে বিদেশ থেকে এনে এই আসনে বসান। ফলে ‘গরিবের ব্যাংকার’ হয়ে যান রাষ্ট্রের কর্ণধার।

রাষ্ট্র পরিচালনার খানিক অভিজ্ঞতা ছিল ড. ইউনূসের। ১৯৯৬ সালের বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। রাজনীতিতে নামতে গিয়েও পিছু হটেছিলেন ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার সময়। নাগরিক শক্তি নামে দল গঠন করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবে পরে উপলব্ধি হয়েছিল, রাজনীতি তার জন্য নয়; এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়।

এরপর আওয়ামী লীগের শাসনকাল দুঃসময় নিয়ে আসে ইউনূসের জন্য। গ্রামীণ ব্যাংকের কর্তৃত্ব হারাতে হয়, মামলার মুখে পড়তে হয়, সাজাও হয় একটিতে। সেই সঙ্গে তাকে কটাক্ষ করে শেখ হাসিনার বাক্যবাণও চলছিল।

গত ৮ আগস্ট সরকার প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার আগে ১৫ জুলাই অর্থপাচার প্রতিরোধ আইনে দুদকের করা এক মামলায় হাজিরা দিতে আদালতের ‘খাঁচায়’ যেতে হয়েছিল ড. ইউনূসকে। এনিয়ে সেদিনও ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন তিনি; বলেছিলেন, “লোহার খাঁচার তৈরি আসামির কাঠগড়া আদালত থেকে তুলে নেওয়া উচিৎ। এটা জাতির প্রতি একটা মস্ত অপমান। এ অপমান আমাদের সহ্য করা উচিৎ না।” ক্ষমতা গ্রহণের ৮ দিনের মাথায় গত ১৬ আগস্ট ঢাকার সিএমএম আদালতের এজলাস থেকে আসামিদের রাখার লোহার খাঁচা সরানো শুরু হয়। এরপর একে একে সরানো হয় আদালতের এসব লোহার খাঁচা।

একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তার বিরুদ্ধে করা মামলা থেকে খালাস ও অব্যাহতি পাওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য মামলা বাতিল হতে থাকে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণের একদিন আগে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলা থেকে খালাস তিনি। শপথ গ্রহণের তিন দিনের মাথায় গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের টাকা আত্মসাতের আরেক মামলায় খালাস তিনি। সম্প্রতি ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইনের আরও পাঁচ মামলার কার্যক্রম বাতিল করে হাই কোর্টের দেওয়া রায় বহাল রাখে আপিল বিভাগ।

কারাগারে যাওয়ার অবস্থা থেকে যে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেলেন সেই কথা ড. ইউনূস নিজেই বলেছেন। প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, “এটা একটা নতুন অভিজ্ঞতার মতো। আমি দুদিন আগে জেলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আদালতের দরজায় দরজায় ঘুরছিলাম। হঠাৎ করে জেলে না গিয়ে আমি বঙ্গভবনে গিয়ে শপথ গ্রহণ করলাম।”

যেসব মামলায় খালাস

গত ১ জানুয়ারি ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের চেয়ারম্যান শেখ মেরিনা সুলতানার আদালত শ্রম আইন লঙ্ঘনের একটি মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. ইউনুসসহ চারজনকে ছয় মাস করে কারাদণ্ড দিয়েছিল। ছয় মাসের কারাদণ্ড ছাড়াও আদালত ৩০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও ২৫ দিন কারাদণ্ড দেয়। পাশাপাশি আদালত তাদের এক মাসের মধ্যে শ্রম আইন ২০০৬ এর প্রাসঙ্গিক ধারাগুলো মেনে চলার নির্দেশ দেন। এ রায়ের পর জামিন চেয়ে আবেদন করলে শুনানি নিয়ে এক মাসের জামিন দেয়। পাশাপাশি ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন ড. ইউনূস।

২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে মামলাটি করেছিলেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগের শ্রম পরিদর্শক (সাধারণ) এস এম আরিফুজ্জামান। তাতে দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে গত ৭ আগস্ট ড. ইউনূসের করা আবেদনের শুনানি নিয়ে তাকে দণ্ড থেকে খালাস দেন শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল বিচারক এম এ আউয়াল।

এদিকে, গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে দুদকের করা মামলা থেকে ১১ আগস্ট খালাস পান তিনি। গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে করা মামলায় ড. ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে গত ১২ জুন অভিযোগ গঠন করেছিল আদালত।

অন্যদিকে গত ৮ ডিসেম্বর ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইনে দায়ের করা পাঁচ মামলার কার্যক্রম বাতিল করে হাই কোর্টের দেওয়া রায় বহাল রাখে আপিল বিভাগ। তার আগে গত ২৪ অক্টোবর শ্রম আইনে দায়ের করা এসব মামলায় ও মানহানির এক মামলার কার্যক্রম বাতিল করে রায় দেয় হাই কোর্ট।

ড. ইউনূসের নামে যখন শ্রম আদালতে আলাদা পাচঁটি মামলা হয়, তখন তিনি গ্রামীণ টেলিকমিউনিকেশন্সের চেয়ারম্যান ছিলেন। প্রস্তাবিত ট্রেড ইউনিয়ন ঘিরে কর্মীদের চাকরিচ্যুতির অভিযোগ তুলে ২০১৯ সালে এসব মামলা করা হয়। ড. ইউনূসের আবেদনে এ মামলাগুলোর কার্যক্রম কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে পৃথক রুল জারি করে হাই কোর্ট। রুলের ওপর শুনানি শেষে গেল বছরের ২৪ অক্টোবর হাই কোর্ট মামলাগুলোর কার্যক্রম বাতিল আদেশ দেয়।

গরিবের ব্যাংকার

বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের যাত্রা করে নোবেল জয়ের পর তা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়ে ‘গরিবের ব্যাংকার’ নামে খ্যাতি এখন ড. ইউনূসের। তার জন্ম ১৯৪০ সালে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার বাকুয়া গ্রামে; দুলা মিয়া সওদাগর ও সুফিয়া খাতুনের ঘরে। তার শিক্ষাজীবনের শুরু স্থানীয় ফকির মহাজন স্কুলে, পরে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল ও চট্টগ্রাম কলেজে পড়াশোনা করেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বয়েজ স্কাউটসে যোগ দেওয়ার পর ১৫ বছর বয়সেই যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ এশিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হয় তার।

১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন ইউনূস। ১৯৬০ সালে স্নাতক এবং ১৯৬১ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। কিছুদিন অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলাম ও রেহমান সোবহানের গবেষণা সহকারী হিসাবে কাজ করার পর ১৯৬১ সালে চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন। ১৯৬৫ সালে উচ্চতর পড়াশোনার জন্য চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৭১ সালে ভ্যান্ডারবিল্ট ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি নেন। সেখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন পড়িয়েছেনও।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় নাগরিক কমিটি প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত আদায়ে সক্রিয় ছিলেন ড. ইউনূস। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ফিরে এসে কিছুদিন পরিকল্পনা কমিশনে কাজ করেন। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৫ সালে অধ্যাপক হওয়ার পর ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন।

দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে ইউনূসের লড়াই শুরু হয় ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের সময়। তিনি বুঝতে পারেন স্বল্প পরিমাণে ঋণ দরিদ্র মানুষের জীবন মান উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। সেই সময়ে তিনি গবেষণার লক্ষ্যে গ্রামীণ অর্থনৈতিক প্রকল্প চালু করেন। ১৯৭৪ সালে ইউনুস তেভাগা খামার প্রতিষ্ঠা করেন, যা সরকার প্যাকেজ প্রোগ্রামের আওতায় অধিগ্রহণ করে।

এক সাক্ষাৎকারে ইউনূস বলেন, “১৯৭৬ সালে আমি ২৭ ডলার দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক শুরু করেছিলাম। আমার ইচ্ছা ছিল গরিবদের সাহায্য করা। এর জন্য দরকার ছিল গরিব এন্টারপ্রেনিউয়ারদের কোনও কোল্যাটারাল বা বন্ধক ছাড়া ছোট পরিমাণে লোন বা ঋণ দেওয়া, যেন তারা তাদের নিজস্ব বিজনেস বা ব্যবসা শুরু করতে পারেন। গ্রামীণ যে উৎসাহ সৃষ্টি করে, তাতে আমি সেটা সম্প্রসারণে উদ্যোগী হই। তাই আমি বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে গিয়ে বলি গরিবদের জন্য একটা ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় আমি বৈধ কর্তৃত্বের অনুমোদন চাই। সরকার রাজি হয়।”

এইচ এম এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় গ্রামীণ ব্যাংক; সরকারের অংশীদারত্বে প্রতিষ্ঠিত এই ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নেন ইউনূস। গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম তখন থেকে বিশ্বব্যাপী ইউনূসকে পরিচিত করে তোলে। দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখার উদ্যোগ ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়। গ্রামীণ ব্যাংক ও ইউনূস যৌথভাবে পায় এই পুরস্কার।

ড. ইউনূস ১৯৭৮ সাল থেকে এপর্যন্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিকসহ প্রায় ১৪৫টি পুরস্কার এবং বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৬২টি সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি অজর্ন করেন। এর মধ্যে তিনি দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মামনা পদক স্বাধীনতা পদক বা স্বাধীনতা পুরস্কার পান ১৯৮৭ সালে। ১৯৮৪ সালে এশিয়ার নোবেল বলে খ্যাত রামন ম্যাগসেসে পুরস্কার। ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘প্রেসিডেনশিয়াল মেডিল অব ফ্রিডম’ এ ভূষিত হন তিনি।

বাংলাদেশে শুধু পল্লী অঞ্চলে গ্রামীণ ব্যাংকের কাজ থাকলেও শহরাঞ্চলেও নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে তা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন ইউনূস, কিন্তু আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে তা পারেননি। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে ইউনূসের এই মডেল গ্রহণ করেছে। তিনি নিজেই বলেছেন, “যদিও বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংককে এখনও শহরের গরিবদের সাহায্য দিতে নিষিদ্ধ রাখা হয়েছে, আমি এখন বিশ্বজুড়ে অনুরূপ কিছু প্রজেক্ট চালু করেছি।”

২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠনের দুই বছর পর বয়সের কারণ দেখিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ইউনূসকে সরিয়ে দেয় সরকার। তার বিরুদ্ধে আদালতে গিয়েও বিফল হন ইউনূস। শুধু গ্রামীণ ব্যাংকই নয়, এর সহযোগী অন্য প্রতিষ্ঠানেও কর্তৃত্ব হারাতে হয় ইউনূসকে। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “সরকার আমাকে বাধ্য করেছে পদটি ছেড়ে দিতে। সরকার যুক্তি দেখিয়েছে, ১১ বছর আগেই আমার রিটায়ার করার বয়স পেরিয়ে গিয়েছিল। যে আইনের দ্বারা ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাতে রাজি হবার সময়ে আমাদের ম্যানেজিং ডিরেক্টর (যে পদে আমি আগে অধিষ্ঠিত ছিলাম) নিয়োগের কর্তৃত্ব দিয়েছিলাম সরকারকে। এটা ছিল আমার আরেকটি বড় ভুল।”

গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনকে বাংলাদেশের ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ হিসাবে দেখছেন ড. ইউনূস। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “তিনি (শেখ হাসিনা) যত দিন ক্ষমতায় ছিলেন, তত দিন আমাদের দেশ দখলকৃত ছিল। তিনি দখলদার শক্তি, একজন স্বৈরশাসক, জেনারেলের মতো আচরণ করছিলেন, সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। আজ বাংলাদেশের সব মানুষ নিজেদের স্বাধীন মনে করছে।”

খালেদা জিয়ার পুনরুত্থান

কোনও রাজনীতিকের পতনের মুখ থেকে ফেরাকে বলা হয় প্রত্যাবর্তন; কিন্তু খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, তা প্রত্যাবর্তনের চেয়ে বেশি কিছু।

দুর্নীতির মামলায় দণ্ড নিয়ে ছয় বছর আগে যেতে হয়েছিল কারাগারে, আওয়ামী লীগ সরকার চার বছর আগে মুক্তি দিয়ে বাড়িতে থাকার সুযোগ দিলেও রাজনীতিতে তার ফেরার সম্ভাবনা দেখাই যাচ্ছিল না। তারমধ্যে ৭৯ বছর বয়সে অসুস্থতা আর অস্ত্রোপচারের ধকল তার সুস্থ হয়ে ওঠা নিয়েও সংশয় তৈরি করে দিয়েছিল। তার জীবন সঙ্কটাপন্ন, আওয়ামী লীগ সরকার তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তার দলের নেতাদের মুখ থেকে এমন কথা এসেছে বহুবার।

কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট; ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের িদনই সাজা মওকুফ হয়ে যায় বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার। তার দুদিন পরই দলের জনসভায় ভিডিও বার্তা নিয়ে হাজির হন তিনি। এরপর দলীয় নেতা আর কূটনীতিকদের নিজের বাড়িতে সাক্ষাৎও দেন বিএনপি চেয়ারপারসন। ২১ নভেম্বর বাইরের কোনও অনুষ্ঠানেও দেখা যায় তাকে। সেদিন সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ অতিথি হিসাবে অভ্যর্থনা পান তিনি। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের এগিয়ে যাওয়া রাজনৈতিক অঙ্গনে তার গুরুত্ব ফুটিয়ে তোলে। দৃশ্যত রাজনীতিতে হারাতে বসা আসনে ফের অধিষ্ঠিত হলেন তিনি, যখন তার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ শেখ হাসিনা দেশছাড়া।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার আসা কাছাকাছি সময়ে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার পর গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে পা রাখেন খালেদা জিয়া। বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন শেখ হাসিনার সঙ্গে। সম্মিলিত আন্দোলনে ১৯৯০ সালে এইচ এম এরশাদের সামরিক শাসনের অবসান ঘটান তারা। এরপর ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফেরার পর প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। এরপর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে পুনরায় সরকার গঠন করেও বিরোধীদের আন্দোলনের কাছে টিকতে পারেননি। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার সরকার আসার পর নির্বাচনে ক্ষমতা হারায় বিএনপি। তবে ২০০১ সালে আবার নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া, সরকার গঠন করেন জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে। তবে ২০০৬ সালে বিএনপি সরকার বিদায় নেওয়ার পর বড় সঙ্কট তৈরি হয় বিএনপির জন্য। জরুরি অবস্থা জারির পর বিএনপির মতো আওয়ামী লীগের জন্যও সঙ্কট নেমে এসেছিল তখন। খালেদা জিয়ার পাশাপাশি শেখ হাসিনাও তখন গ্রেপ্তার হন। তবে বিএনপির জন্য বড় আঘাত ছিল খালেদা জিয়ার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানের গ্রেপ্তার হওয়া। দুজনই পরে জামিনে বেরিয়ে বিদেশে চলে যান। আরাফাত বিদেশে থাকা অবস্থায়ই মারা যান ২০১৫ সালে। তারেক এখনও সপরিবারে লন্ডনে, তবে সেখান থেকেই দল পরিচালনা করছেন তিনি।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে বিএনপির ওপর রাজনৈতিক চাপ তৈরি করা হয়। সেই কারণে ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি; ভোট ঠেকানোর ঘোষণা দিয়েও পারেনি তারা। এরমধ্যে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে চাপে পড়ে দলটি। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিএনপির জন্য বড় আঘাত হয়ে আসে দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়ার দণ্ডের রায়। ওই বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয় তাকে। তারপর আরেকটি মামলায় তার দণ্ডের রায় আসে। ঢাকার পুরনো কারাগারে খালেদা জিয়াকে নির্জনবাসে রেখেই ২০১৮ সালের ভোটে অংশ নিয়েছিল বিএনপি, কিন্তু শোচনীয় হারের পর ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তোলে বিএনপি।

ভঙ্গুর বিএনপি তারপর নানা সময়ে উঠতে চাইলেও কোণঠাসা অবস্থা থেকে বের হতে পারছিল না বিএনপি। এরপর এই বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের নির্বাচনও বর্জন করে বিএনপি। তবে বড় কোনও আন্দোলনের কর্মসূচি তারা না দেওয়ায় তাদের দলীয় সামর্থ্য নিয়ে কটাক্ষ করে যাচ্ছিল আওয়ামী লীগ।

এর আগে ২০২০ সালে কোভিড মহামারির পর ২০২০ সালের মার্চে আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদার দণ্ড স্থগিত করে তাকে শর্ত সাপেক্ষে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়। এরপর প্রতি ছয় মাস পরপর তার মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছিল। গুলশানের বাসা ফিরোজায় থাকলেও কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার সুযোগ তার ছিল না। চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশ পাঠাতে পরিবারের পক্ষ থেকে কয়েক দফায় আবেদন করা হলেও সরকার তা নাকচ করে দেয়। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে লিভার, কিডনি, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস ও হৃদরোগে ভুগছেন। সাময়িক মুক্তির পর তাকে কয়েক দফা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। লিভার সিরোসিসের জন্য অস্ত্রোপচারের টেবিলে যেতে হয় তাকে, হৃদযন্ত্রে পেসমেকারও বসাতে হয়।

খালেদা জিয়ার বাকি জীবনটি এভাবেই যাবে, এমন ধারণা যখন অনেকে পোষণ করছিলেন, তখনই কোটা সংস্কার আন্দোলন অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর বঙ্গভবন থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আসে; তাতে বলা হয়, তিন বাহিনী প্রধান, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের বৈঠকের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। বন্দি খালেদা জিয়াকে বিদেশ পাঠাতে বিএনপির দাবি থাকলেও এখনও তিনি যাননি। তবে জানুয়ারিতে তাকে বিদেশ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

শেখ হাসিনার পলায়ন

দেড় দশক টানা দেশ শাসন করে আসা শেখ হাসিনা সরকার থাকছে না, তা ৩ আগস্টও কেউ কি ভাবতে পেরেছিল? বিরোধী দলগুলোকে বাদ দিয়ে জানুয়ারিতে একচেটিয়া নির্বাচন করে ফেলার পর মনে হচ্ছিল, ক্ষমতায় পাকাপোক্তভাবেই টিকে গেছেন শেখ হাসিনা। কিন্তু সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের এক আন্দোলন বদলে দেয় সব কিছু। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেওয়ার পর গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হয় শেখ হাসিনাকে। অথচ ঠিক এক বছর আগেও তিনি বেশ দম্ভের সুরেই বলেছিলেন, “শেখ হাসিনা পালায় না।” পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগের যখন কঠিন সময়, তখন দলের হাল ধরতে দেশে ফিরেছিলেন শেখ হাসিনা। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে দিয়েছিলেন নেতৃত্ব, তাতে পতন ঘটেছিল এরশাদের স্বৈরশাসনের । আর চলে যাওয়ার সময় তাকে জনতার স্লোগান শুনতে হলো- ‘এক, দুই, তিন চার-শেখ হাসিনা স্বৈরাচার’। গণআন্দোলনে পতনের পর এই প্রথম কোনও রাষ্ট্রনেতাকে পালাতে দেখল বাংলাদেশ। ক্ষমতার দম্ভই তার এই পরিণতি ডেকে এনেছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছ থেকে মন্তব্য এসেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, “এরশাদের চেয়ে শেখ হাসিনা শত গুণ বেশি খারাপ হয়ে বিদায় নিয়েছেন। এরশাদ পালিয়ে যাননি, তিনি পালিয়ে গেছেন। তিনি পালিয়ে গেছেন, কিন্তু আওয়ামী লীগ দলটাকে ধ্বংস করে দিয়ে গেলেন। তার হিংসা, দম্ভ, অহংকার দলটাকে ধ্বংস করল।” এক ছেলে ও এক মেয়ের জননী শেখ হাসিনার জন্ম ১৯৪৭ সালে গোপালগঞ্জে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম সন্তান হিসাবে। বাবার সূত্রে ছাত্রজীবনেই রাজনীতিতে হাতে খড়ি শেখ হাসিনার। গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজ (এখনকার বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্রলীগের হয়ে ছাত্র সংসদেও নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে তার বিয়ে হয় এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে। এই পরমাণু বিজ্ঞানীর সঙ্গে তার সংসারে আসে দুই সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী জয় প্রধানমন্ত্রী মায়ের তথ্য প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টার পদে ছিলেন। মেয়ে সায়মা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালকের পদে আছেন। পঁচাত্তরে স্বামীর সঙ্গে বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা। তখন আর দেশে ফেরেননি তারা। শেখ হাসিনা ভারতে থাকলেও রেহানা চলে যান যুক্তরাজ্যে। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে প্রবাসে থেকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার কিছু দিন পর ১৯৮১ সালে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। জিয়া এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার পর বিএনপির সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা নিয়েছিলেন সেনাশাসক এইচ এম এরশাদ। তখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নামেন শেখ হাসিনা। একই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া, বিএনপির হাল ধরে। এর মধ্যে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিলে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। তার সেই সিদ্ধান্তকে অনেকে এরশাদের সঙ্গে আঁতাত হিসাবে দেখেছিল। সেই নির্বাচনে যায়নি বিএনপি। সেই সংসদ টেকেনি, পরে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গণআন্দোলন তীব্র হয়। তারই ধারবাহিকতায় ছাত্রনেতাদের সক্রিয়তায় তীব্র আন্দোলনে ১৯৯০ সালে ক্ষমতা ছাড়েন এরশাদ। ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে আওয়ামী লীগ বসে বিরোধী দলের আসনে, শেখ হাসিনা হন বিরোধীদলীয় নেতা। ১৯৯৬ সালে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পর ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ, প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। ২০০১ সালের নির্বাচনে আবার ক্ষমতা হারালে আবার বিরোধীদলীয় নেতার আসনে বসতে হয় তাকে। তখন ২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলায় প্রাণে রক্ষা পেলেও শ্রবণশক্তি হারান তিনি। ২০০৭ সালে নির্দলীয় সরকার নিয়ে সংকট তৈরি হলে সংঘাত-সহিংসতার মধ্যে জারি হয় জরুরি অবস্থা; সেনা নিয়ন্ত্রণে গঠিত হয় সরকার, গ্রেপ্তার হন শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া। তবে আন্দোলনের চাপে দুজনকেই মুক্তি দিতে বাধ্য হয় ফখরুদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দুই বছর পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ফের প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। এরপর তার শাসনই চলতে থাকে। এরমধ্যে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়, খালেদা জিয়াকে বন্দি করা হয়। বাতিল করা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। এরপর প্রহসনের নির্বাচন নিয়ে যেমন সমালোচনা ওঠে, তেমনি গুম-খুন, মানবাধিকার হরণ, বাক স্বাধীনতা খর্বের ঘটনাগুলো ক্ষোভ বাড়াতে থাকে মানুষের। তার শাসনকে কর্তৃত্ববাদী শাসন হিসাবেই দেখতে থাকে বিদেশি সংবাদমাধ্যম। নানা সমালোচনা অবকাঠামো উন্নয়ন দিয়ে আড়াল করতে চাইছিলেন শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, টানেল, মারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সামনে মেলে ধরছিেলন তিনি। কিন্তু বিরোধী দলকে কঠোর হাতে দমন করলেও কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের এক আন্দোলনই পতনের দিকে নিয়ে যায় পাঁচ বারের প্রধানমন্ত্রী, আট বারের সংসদ সদস্য শেখ হাসিনাকে। সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল গত জুলাই মাসে। শান্তিপূর্ণ এই আন্দোলনে আগুন জ্বলে ওঠে গত ১৪ জুলাই শেখ হাসিনার এক বক্তব্যে। তিনি বলেছিলেন, “মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের বাচ্চারা পাবে, রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?” এর পরপরই ক্রোধে ফেটে পড়ে শিক্ষার্থীরা। রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে বের হয় মিছিল, যার স্লোগান ছিল- ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার-রাজাকার/ কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার-স্বৈরাচার’। পরদিন গত ১৫ জুলাই ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালালে পরিস্থিতি সংঘাতের দিকে গড়ায়। এরপর কয়েকদিনে দেড় শতাধিক নিহত হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েন করে সরকার। তবে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে দিনকে দিন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ধরে নেওয়া হয়েছিল। তারা মুক্ত হওয়ার পর সরকারের পদত্যাগের দাবি তোলে। গত ৩ অগাস্ট শহীদ মিনারে বিশাল সমাবেশ করে তারা পরদিন েথকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। তা ঠেকাতে আওয়ামী লীগ মাঠে নামল ৪ অগাস্ট ব্যাপক সংঘাতে একদিনেই শতাধিক নিহত হয়। এই পরিস্থিতিতে ৫ আগস্ট সারাদেশ থেকে মানুষকে ঢাকায় আসার আহ্বান জানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সাবেক একদল সেনা কর্মকর্তাও আন্দোলনের সমর্থন জানায়। তারপরও ৪ অগাস্ট কঠোর হওয়ার বার্তা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা, কিন্তু পরদিন চিত্র পােল্ট যায়। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারিও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে গেলেও তারপর আট মাসও গেল না, ‘স্বৈরাচার’ তকমা নিয়ে দেশ ছাড়তে হয় তাকে। ৭৬ বছর বয়সী শেখ হাসিনা ক্ষমতা হারিয়ে এখনও ভারতেই রয়েছেন। গণহত্যার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে ফেরত পাঠাতে ভারত সরকারকে এরই মধ্যে চিঠি দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। নয়া দিল্লি সেই চিঠি গ্রহণ করলেও হ্যাঁ বা না কিছুই জানায়নি। তবে তাকে ফেরত আনা কঠিন হবে বলেই মনে করেন কূটনীতিকরা।

ঘটনাবহুল এক বছর

১. নামমাত্র ভোটে আবার শেখ হাসিনার সরকার

আওয়ামী লীগ আমলে গত দুটি নির্বাচন দেখার পর এবারে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন কেমন হবে, তা আঁচ করা যাচ্ছিল সহজেই। কিন্তু বছরের শুরুতেই ৭ জানুয়ারির এই নির্বাচন কিছুটা জমিয়ে দিয়েছিল স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। নামে স্বতন্ত্র হলেও তাদের প্রায় সবাই ছিল আওয়ামী লীগেরই নেতা। বিরোধী দলবিহীন এই নির্বাচন জমাতে আওয়ামী লীগই এই কৌশল নিয়েছিল। ৪০ শতাংশ ভোটারের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ আসন পেয়েছে ২২৪টি, জাতীয় পার্টি পেয়েছে ১১টি, আর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছে ৬২টি আসনে। বাংলাদেশে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এত আসনে জয় এর আগে কখনও দেখা যায়নি। ভোট নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকলেও আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “কে কী বলল, তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।”

ভোটের চার দিনের মাথায় নতুন সরকার গঠন করেন শেখ হাসিনা। এটা ছিল তার টানা চতুর্থ মেয়াদে এবং সব মিলিয়ে পঞ্চম মেয়াদের সরকার। ২৫ মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীকে নিয়ে বঙ্গভবনে ১১ জানুয়ারি শপথ নেন শেখ হাসিনা। দেড় দশক দেশ শাসন করে আসা তার এই সরকার টিকেছিল সাত মাস। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পতন ঘটে এই সরকারের। আসে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

২. আগুন : ট্রেনে, কাচ্চি ভাইয়ে, সচিবালয়ে

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুদিন আগে ৫ জানুয়ারি ঢাকার গোপীবাগে চলন্ত ট্রেনে আগুনের ঘটনা নাড়িয়ে দেয় সারাদেশের মানুষকে। জ্বলন্ত ট্রেনের জানালায় অগ্নিদগ্ধ মানুষের বাঁচার আকুতি দেখে সেদিন চোখের জল আটকে রাখতে পারেননি অনেকেই। আগুনে প্রাণ হারান চারজন। দুর্ঘটনা নয়, ট্রেনটিতে আগুন দেওয়া হয়েছিল বলে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল তখন। তবে তার কূল-কিনারা পরে আর হয়নি। 

এর পরের মাসেই ২৯ ফেব্রুয়ারি ঘটে আরেকটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। সেদিন রাত ১০টার দিকে ঢাকার বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁয় আগুন লাগার খবর জানতে পারে দেশবাসী। শুরুতে আগুনের ভয়াবহতা আঁচ করা না গেলেও শেষে সেটিই হয়ে ওঠে অনেক মানুষের মৃত্যুর কারণ। সেই রাতের আগুনে প্রাণ হারান সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, প্রবাসীসহ ৪৪ জন মানুষ। আহত হন আরও প্রায় অর্ধশত। ওই অগ্নিকাণ্ডের পর অনিরাপদ ভবনে থাকা রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ করতে অভিযানে নেমেছিল সরকার। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তা থেমে যায়।

বছরের শেষ লগ্নে ২৬ ডিসেম্বর ভোররাতে আগুন লাগে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সুরক্ষিত স্থানগুলোর একটি সচিবালয়ে। কমপ্লেক্সের ৭ নম্বর ভবনে লেগেছিল আগুন, সেখানে পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের দপ্তর রয়েছে। এই আগুনে কারও প্রাণহানি না ঘটলেও ১০ ঘণ্টার চেষ্টায় নেভানোর আগেই বিভিন্ন দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ অনেক নথি পুড়ে ছাই হয়ে য়ায়। এই আগুনটি পরিকল্পিতভাবে লাগানো হয় বলে দাবি করেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

৩. সোমালি জলদস্যুদের কবলে বাংলাদেশি জাহাজ

এক যুগ পর আবার সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে বাংলাদেশের জাহাজ। প্রায় ৩২ দিন জিম্মি থাকার পর মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান এমভি আব্দুল্লাহর ২৩ নাবিক। এর আগে ২০১০ সালে সোমালি দস্যুদের হাতে জিম্মি হয়েছিল কেএসআরএম গ্রুপের আরেক জাহাজ ‘জাহান মণি’। নাবিকসহ সেই জাহাজ ছাড়িয়ে আনতে ১০০ দিন লেগেছিল। এমভি আব্দুল্লাহও কেএসআরএম গ্রুপেরই জাহাজ। গত ১২ মার্চ মোজাম্বিকের বন্দর থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে এমভি আব্দুল্লাহ সংযুক্ত আরব আমিরাতের উদ্দেশে রওনা হয়ে সোমালিয়া উপকূল পাড়ি দেওয়ার সময় জলদস্যুদের কবলে পড়ে। এরপর নাবিকদের নিরাপদ এবং অক্ষত অবস্থায় ছাড়িয়ে নিতে জাহাজ মালিক কর্তৃপক্ষ দেন দরবার শুরু করে। দরকষাকষির পর ১৪ এপ্রিল নাবিকরা জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পায়। তার এক মাস পর ১৪ মে নাবিকসহ জাহাজটি বাংলাদেশে ফেরে।

৪. বাংলাদেশের এমপি কলকাতায় খুন

গত মে মাসে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার ভারতে খুন হয়েছেন বলে খবর এলে তোলপাড় শুরু হয় দুই দেশেই। ভারতের গোয়েন্দা খুনের খবর নিশ্চিত করলেও লাশের সন্ধান দিতে না পারায় তা নিয়েও চলে নানা জল্পনা-কল্পনা। আনার ঝিনাইদহ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন। গত ২২ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ জানায়, আনার গত ১২ মে কলকাতায় যাওয়ার পরদিনই নিউ টাউনের সঞ্জিবা গার্ডেন্সের একটি ফ্ল্যাটে খুন হন। এঘটনায় ২২ মে বিকালেই ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন তার বাবাকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগে মামলা করেন। সেই ঘটনার তদন্তে ভারতেও গিয়েছিলেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার হারুন-অর রশীদ। ৩০ মে সঞ্জিবা গার্ডেন্সের সেপটিক ট্যাংক থেকে মানুষের দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়। এরপর ডরিন কলকাতায় যাওয়ার পর ডিএনএ পরীক্ষা করে ডিসেম্বর মাসে নিশ্চিত হওয়া যায় যে সেই দেহাবশেষগুলো আনারেরই। আনারকে খুনের পর লাশ টুকরা টুকরা করে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে জানায় পুলিশ। কর্মকর্তারা বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল বাংলাদেশেরই আনারের এক পুরনো বন্ধু। তার নাম আখতারুজ্জামান শাহীন। সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও খুনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শাহীন ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছেন। আনার খুনের কারণ হিসাবে ‘স্বর্ণ চোরাচালান’ নিয়ে দ্বন্দ্বসহ বিভিন্ন বিষয়ে সামনে এলেও কোনও বিষয়ই এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি দুই দেশের পুলিশ।

৫. বেনজীরের আলাদীনের চেরাগ

গত বছরের প্রথমার্ধে অনেকটা সময় ধরে আলোচনায় ছিলেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ। গত ৩১ মে দৈনিক কালের কণ্ঠে ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর তার সম্পদ নিয়ে শুরু হয় আলোচনা। সেই প্রতিবেদনে সাবেক এই পুলিশ প্রধানের হাজার হাজার একর জমি, রিসোর্ট ও কোটি কোটি টাকার সম্পদের তথ্য জেনে চোখ কপালে ওঠে অনেকেরই। গোপালগঞ্জের সন্তান বেনজীর দুই বছর আইজিপির দায়িত্ব পালনের পর ২০২২ সালে অবসরে যান। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন আসার পর বেনজীরের অর্থ-বিত্তের খোঁজে নামে দুদক। তাতে তারসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের নামেও বিপুল সম্পত্তির খবর মেলে। এর মধ্যেই গত ২০ এপ্রিল ফেইসবুকে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় নিজের ও পরিবারের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির সব অভিযোগ অস্বীকার করেন বেনজীর। এর কয়েকদিন পর ৪ মে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে দেশ ছাড়েন তিনি। এরপর জুলাই অভ্যুত্থানে চাপা পড়ে যায় বেনজীরের দুর্নীতির আলোচনা।

৬. ছেলের ছাগলকাণ্ডে ফাঁসলেন মতিউর

গত কোরবানির ঈদ ঘিরে আলোচনায় ছিল সাদিক এগ্রোর ১৫ লাখ টাকার ছাগল। এত দামের পেছনে ব্যাখ্যা ছিল উন্নত জাত ও বংশ মর্যাদা। সেই ছাগল কিনতে গিয়ে ভাইরাল হন তরুণ মুশফিকুর রহমান ইফাত। সেই ছাগলের রশি ধরে টান পড়ে ইফাতের বাবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা মতিউর রহমানের। প্রথমে বাঁচার জন্য নিজের ছেলেকেও অস্বীকার করেন তিনি। কিন্তু পরে বের হয়ে আসে ইফাত তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান। ইফাতের বিলাসী জীবনযাপনের সূত্র ধরে মতিউরের বিপুল সম্পদ অর্জনের বিষয়টি বেরিয়ে আসে। এরপর একে একে মতিউর হারান এনবিআর সদস্য ও সোনালী ব্যাংকের পরিচালকের পদ। ১৫ লাখ টাকার ছাগল এবং কোটি টাকার ব্রাহমা গরু নিয়ে ব্যাপক প্রচারণায় ছিল সাদিক এগ্রো সেসময়। কিন্তু কোরবানি পর থেকেই শনির দশা শুরু হয় প্রতিষ্ঠানটির। সাদিক এগ্রোর দাবি করেছিল গরুগুলো শতভাগ ব্রাহমা। কিন্তু বাংলাদেশে শতভাগ ব্রাহমা আমদানি বন্ধ। তাহলে সাদিক এগ্রো কীভাবে পেল শতভাগ ব্রাহমা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে একে একে বের হয়ে আসে সাদিক এগ্রোর দুর্নীতি। বের হয়ে আসে, রাজেন্দ্রপুর খাল দখল করে গড়ে উঠেছে সাদিক এগ্রো ফার্মটি। তখন অবৈধ স্থাপনাটি উচ্ছেদ করে সিটি করপোরেশন।

৭. প্রশ্নে ফাঁসে কোটিপতি গাড়িচালক আবেদ আলী

পিএসসির বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে সংস্থাটির গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় গেল বছরের মাঝামাঝিতে আলোচনায় উঠে আসেন তিনি। গত ৭ জুলাই ‘বিসিএস প্রিলি–লিখিতসহ গুরুত্বপূর্ণ ৩০ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস’ শিরোনামে চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে প্রতিবেদনে দেখানো হয়, বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে আবেদ আলী কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। চালকের কাজ ছেড়ে নিজেকে শিল্পপতি পরিচয় দিচ্ছেন। কয়েকটি কনস্ট্রাকশন ফার্মের প্রধান তিনি। রাজধানীতে তার রয়েছে দুটি বহুতল ভবন, মাদারীপুরে আছে আরেকটি বাড়ি। কুয়াকাটায় তিনি থ্রি-স্টার হোটেলও খুলেছেন। এরপর আবেদ আলীকে নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় তুমুল আলোচনা শুরু হয়। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালী অনেকের সঙ্গে তার ছবিও হয় ভাইরাল। আবেদ আলীর দান-খয়রাতের নামা নমুনাও উঠে আসে সোশাল মিডিয়ায়। তার ছেলে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়ামের দামি গাড়ি আর দান-খয়রাতও আসে আলোচনায়। এরপর প্রশ্ন ফাঁসের একটি মামলায় আবেদ আলীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

৮. সরকার শূন্য দেশে পুলিশবিহীন কয়েকদিন

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ার পর তিন দিন সরকারশূন্য অবস্থায় ছিল বাংলাদেশ। এর মধ্যে জনরোষে পড়ে পুলিশ উধাও হয়ে গেলে জনগণের নিরাপত্তাহীনতা ওঠে চরমে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে এর আগে কখনোই এমন অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে হয়নি বাংলাদেশকে।

হাজারো প্রাণের বিনিময়ে আওয়ামী সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সেই সময় ফ্রান্সে চিকিৎসাধীন থাকায় সঙ্গে সঙ্গে দেশে ফিরতে পরেননি তিনি। এ কারণেই এমন সরকারশূন্য অবস্থায় পড়ে দেশ। ৮ আগস্ট তিনি দেশে ফেরার পর রাতেই তিনিসহ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা শপথ নেন, তাতে অবসান ঘটে সরকারশূন্য অবস্থার।

অন্যদিকে আওয়ামী সরকারের দমন অভিযানের কারণে পুলিশ ছিল আন্দোলনকারদের ক্ষোভের লক্ষ্যবস্তু। সেই কারণে ৫ আগস্ট একের পর এক থানা জ্বালিয়ে দেওয়ার পর গা ঢাকা দেয় পুলিশ সদস্যরা। সড়কে কর্মরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরাও নেই হয়ে যায়। এর মধ্যে গত ৬ আগস্ট কর্মবিরতির ঘোষণা আসে পুলিশের সদস্যদের বিভিন্ন সংগঠন থেকে। এরপর থেকেই কয়েকদিন আর কোনও পুলিশি পায়নি সাধারণ মানুষ। পুলিশ কর্মবিরতিতে থাকায় ছাত্র-জনতা মিলে বিভিন্ন সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে নামে; অনেকেই পাড়া-মহল্লার নিরাপত্তা রক্ষায়ও পাহারা দেন। ৮ আগস্ট পুলিশের নতুন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম ৯ আগস্ট সন্ধ্যার মধ্যে দেশের সব পুলিশ সদস্যকে কর্মস্থলে ফেরার নির্দেশনা দেন। এরপর পুলিশ সদস্যরা সেনাবাহিনীর সহায়তায় ধীরে ধীরে নিজের ভূমিকায় ফেরে।

৯. ভাংচুর-লুটপাট-আগুন 

দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে ৪ আগস্ট থেকেই আক্রমণের শিকার হতে শুরু করে থানাগুলো। আর ৫ আগস্ট দুপুরের পর যেন থানাগুলোতে মানুষের ক্ষোভ যেন উগরে পড়ে। সেদিন বিকালের পর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সারাদেশের প্রায় সাড়ে ৪০০ থানা। লুট করা হয় পুলিশের অস্ত্র, গুলিও। থানায় আগুন, হামলা, ভাঙচুর ও হত্যাসহ নানা সহিংসতার মধ্যে কর্মস্থল ছেড়ে চলে যায় পুলিশ সদস্যরা।

৫ আগস্ট দুপুরেই অভ্যুত্থানকারীরা গণভবন, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকে পড়ে অবাধে। এই সময় সরকারি এই প্রতিষ্ঠানগুলো তছনছ হয়ে যায়। বিভিন্ন জিনিস লুটপাটও চলে অবাধে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের কার্যালয় ও দলের নেতাকর্মীদের বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন স্থানে থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাংচুর কিংবা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। লুটপাট শেষে পুড়িয়ে দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটি। 

১০. উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা

হঠাৎ করেই বছরের আগস্টে মাসের শুরুতে শুরু হয় বন্যা, তবে মাসের মাঝামাঝিতে সে বন্যা তীব্র আকার ধারণ করে। শুরুতে অতিবৃষ্টি ও উজানের ঢলের কারণে মুহুরী নদীর আশেপাশের কিছু এলাকা তলিয়ে যায়। কিন্তু এক সপ্তাহ পর থেকে ফেনী-নোয়াখালীতে প্রবল বৃষ্টির সঙ্গে সীমান্ত সংলগ্ন ত্রিপুরাতেও ব্যাপক বৃষ্টি হওয়ায় দ্রুত পরিস্থিতির অবনতি হয়। ফেনী, কুমিল্লা, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর এমন বন্যার কবলে পড়ে, যা আগে কখনও দেখা যায়নি। বন্যার কারণে বিদ্যুৎহীন হয়ে যায় এসব এলাকা, একসময় বন্ধ হয়ে মোবাইল নেটওয়ার্ক। এই বন্যার কারণ ছিল অতিবৃষ্টি এবং ভারত থেকে আসা উজানের পানি। ভারত গোমতী নদীর ডাম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়ায় এই বন্যা দেখা দেয় বলে অভিযোগ ওঠে। ভারতবিরোধী প্রচারও এই সময়ে প্রবল হয়ে ওঠে। তবে ভারতের পক্ষ থেকে অভিযোগ অস্বীকার করে বলা হয়, অতি বৃষ্টিই এই বন্যার কারণ এবং তাতে ত্রিপুরাও বন্যাকবলিত হয়েছিল।

১১. মব জাস্টিস

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই আলোচনায় উঠে আসে একের পর এক মব জাস্টিসের ঘটনা। ক্ষমতাচ্যুত দলটির নেতা-কর্মীরাই হচ্ছিলেন আক্রান্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মাস ছিল সেপ্টেম্বর। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) দেওয়া এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু সেপ্টেম্বরে মাসেরই দেশে গণপিটুনির ৩৬ ঘটনায় অন্তত ২৮ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় ১৪ জন। একই মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় সারাদেশে নিহত হয় অন্তত ১৬ জন, আহত হয়েছেন অন্তত ৭০৬ জন। এর মধ্যে গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের অতিথিকক্ষে তোফাজ্জল হোসেন নামে একজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। চোর সন্দেহে শিক্ষার্থীরা তাকে পিটুনি দিলেও তোফাজ্জলের মৃত্যুর পর জানা যায় তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। তার আগে ৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহীর বিনোদপুর বাজার এলাকায় পিটিয়ে মারা হয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে। ১৯ সেপ্টেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটুনিতে নিহত হন শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লা নামে এক সাবেক ছাত্রলীগ নেতা। আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের অনেকেও গ্রেপ্তার হওয়ার পর আদালতে নেওয়ার সময় আক্রান্ত হন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রধানদের চাপের মুখে সরিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। পরে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়ার পর এসব ঘটনা কমে আসে।

১২. গুম থেকে ফেরা

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় গত ১৫ বছরে বহু মানুষকে গুম করার অভিযোগ ছিল। তুলে নেওয়া বহু ব্যক্তির খোঁজ বছরের পর বছর মেলেনি। সেই সরকারের পতনের পর কয়েকজন ফিরে আসেন পরিবারের কাছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের ছেলে সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবদুল্লাহিল আমান আযমী, যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর ছেলে আইনজীবী আহমেদ বিন কাশেম, পাহাড়িদের সংগঠন ইউপিডিএফের নেতা মাইকেল চাকমা। তাদের গুম করে ‘আয়না ঘরে’ বন্দি রাখা হয়েছিল বলে তারা জানান। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই সব আয়না ঘর বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। জাতিসংঘের গুমবিরোধী সনদে স্বাক্ষর করার পাশাপাশি গত দেড় দশকে গুমের ঘটনাগুলোর তদন্তে কমিশনও গঠন করা হয়। কমিশনের তদন্ত, ঘটনায় সম্পৃক্ত কর্মকর্তা ও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের বয়ানে উঠে এসেছে গুম ও নির্যাতনের নানা রোমহর্ষক বর্ণনা। কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত ১৫ বছরের এক হাজার ৬৭৬টি জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে কমিশন পর্যালোচনা করেছে ৭৫৮টি অভিযোগ। ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ১৩০টি গুমের ঘটনা ঘটেছে এবং ২০২৪ সালে এখন পর্যন্ত ২১টি অভিযোগ জমা পড়েছে।

১৩. ব্যাটারি রিকশা

এ বছরে অন্যতম আলোচিত ছিল ব্যাটারি রিকশা চালকদের আন্দোলন। অভ্যুত্থানের আগে এবং পরে দুই দফায় আন্দোলনে নামে চালকরা। ১৮ মে সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা, ভ্যানসহ এই ধরনের থ্রি হুইলার চলাচল বন্ধে বিআরটিএ বিজ্ঞপ্তি জারি করলে শুরু হয় প্রথম দফার আন্দোলন। পরদিন ঢাকায় অবরোধে নামে ব্যাটারি রিকশার চালকরা। তাতে অচল হয়ে পড়ে রাজধানীর সড়ক। বেশ কয়েকটি স্থানে পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। চালকদের আন্দোলনের পর ২০ মে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার। ২২টি মহাসড়ক ছাড়া অন্যান্য রাস্তায় চলার অনুমতি পায় অটোরিকশা।

এরপরের দ্বিতীয় দফার আন্দোলন হয় গণ অভ্যুত্থানের পর। গত ১৯ নভেম্বর বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি মাহমুদুর রাজীর হাই কোর্ট বেঞ্ এক আদেশে ঢাকা মহানগরে ব্যাটারি রিকশা চলাচল তিন দিনের মধ্যে বন্ধ করতে বলে। এই আদেশের ২৪ ঘণ্টা পর থেকে শুরু হয় আন্দোলন। পুনরায় রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করে চালকরা। আন্দোলনের চাপে ২৫ নভেম্বর ঢাকা মহানগর এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধে হাই কোর্টের দেওয়া আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। সেইদিনই ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধ বা বিধিনিষেধ আরোপে হাই কোর্টের দেওয়া আদেশের ওপর স্থিতাবস্থা দেয় আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। তাতে থামে আন্দোলন।  

১৪. মিয়ানমারে যুদ্ধের আঁচ বাংলাদেশে

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ফল হিসাবে ১৩ লাখের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থীর ভার বছরের পর বছর বহন করছে বাংলাদেশ। এরমধ্যে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে এই শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের কাজও শুরু করা যায়নি। এখন সেখানে নাজুক অবস্থায় কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকা জান্তা সরকার। একের পর এক এলাকা নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। এর মধ্যে বাংলাদেশ লাগোয়া রাখাইন প্রদেশ এখন বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মির কব্জায়। বছরের শুরু থেকে রাখাইনে যুদ্ধের কারণে মাঝে-মধ্যেই গোলা উড়ে আসছিল কক্সবাজারের টেকনাফে। তাতে হতাহতের ঘটনাও ঘটে। গোলাগুলির কারণে নাফ নদী দিয়ে সেন্ট মার্টিনে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিতে হয়। আবার মাছ ধরা নৌকা ও ট্রলারগুলোও নামতে পারছিল না নদীতে। বছরের শেষ দিকে এসে আরাকান আর্মি রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। নাফ নদীতে বাংলাদেশিদের বিচরণ ঝুঁকিপূর্ণই রয়ে গেছে। এর পাশাপাশি আরও রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আসার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত কয়েক মাসে ৮০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে বলে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসই জানিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে আরাকান আর্মির সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ স্থাপনের আলোচনাও উঠেছে। প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি–সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমান সেই ইঙ্গিত এরই মধ্যে দিয়েছেন। তবে তা কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে বিশ্লেষকদের।

১৫. দিল্লি দূরস্থ

আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনকালে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক ছিল অতি নিবিড়। এই সম্পর্কের মাত্রা নিয়ে কটাক্ষমূলক নানা মন্তব্যও করছিল সমালোচকরা। কিন্তু অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে গিয়েও ওঠার পর পাল্টে যায় সেই সম্পর্কে চলছে উল্টোরথ।

শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা দাবি জানিয়ে আসছিল। তারমধ্যে অগাস্টের বন্যার পর ভারতবিরোধী প্রচার জোরাল হয়ে ওঠে। তবে কূটনৈতিক সম্পর্ক নাজুক পর্যায়ে পৌঁছে নভেম্বরে হিন্দু ধর্মীয় নেতা চিন্ময় ব্রহ্মচারী গ্রেপ্তার হওয়ার পর। শেখ হাসিনা সরকারের পতনে পর থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনাগুলো নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছিল নয়া দিল্লি। সেই নির্যাতনের প্রতিবাদ জানিয়ে অক্টোবরে চট্টগ্রামে সমাবেশের উদ্যোগ নিয়ে প্রচারে আসেন ইসকনের সাবেক নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী। তখন রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। নভেম্বরের ২৫ তারিখে তাকে গ্রেপ্তার করা হলে কড়া প্রতিক্রিয়া আসে নয়া দিল্লি েথকে। এর মধ্যে দেশটিতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির পশ্চিমবঙ্গের নেতা বেশি সরব হয়ে ওঠেন। তারা বাংলাদেশ সীমান্তে অবরোধের হুমকি দেন। তারপর আগরতলায় এক বিক্ষোভ থেকে বাংলাদেশ মিশনে হামলা হলে কূটনৈতিক উত্তেজনা আরও বাড়ে। ঢাকায় ভারতের হাই কমিশনারকে তলব করে প্রতিবাদ জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিপরীতে বাংলাদেশেও বিভিন্ন সংগঠন ভারতীয় দূতাবাসমুখে মিছিল-বিক্ষোভ করে। টানাপড়েন চলতে থাকার মধ্যেই শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নয়া দিল্লিকে চিঠি দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্ত্রি ঢাকা সফর করে গেলেও সম্পর্কের দৃশ্যমান কোনও উন্নতি দেখা যায়নি। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় করায় উদ্যোগী হয় অন্তর্বর্তী সরকার। মিশর সফরকালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী েশহবাজ শরিফের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস, দেন সম্প্রীতির বার্তা। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে সরাসরি জাহাজ চলাচলও এই প্রথম শুরু হয়। নিজেদের বৈরী প্রতিবেশীর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বিনির্মাণও ভালো চোখে দেখছে না ভারত।

তখতচ্যুত হয়ে দেশছাড়া বাশার আল-আসাদ

কল্লোল কর্মকার

ইউক্রেইনে যুদ্ধ থামেনি, মধ্যপ্রাচ্যেও সংঘাতও চলছে, তার মধ্যে ইরান-ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলা উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলেছিল, ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়াও জুগিয়েছিল আলোচনার খোরাক। তবে বছরের শেষ দিকে এসে বিদ্রোহীদের হামলায় সিরিয়ার দুই ‍যুগের শাসক বাশার আল-আসাদের পতন সব ঘটনা ছাপিয়ে যায়।

চুয়ান্ন বছর ধরে সিরিয়া শাসন করে আসছিল আসাদের পরিবার। ওই সময়ে দেশটির শিশুদের এই শুনতে শুনতে বড় হতে হয়েছে- ‘দেওয়ালেরও কান আছে’। কারণ একটি ভুল শব্দের প্রয়োগ একজন মানুষকে স্রেফ গায়েব করে দিতে পারে। আসাদরা নিজের স্বার্থে একাধিক গোপন পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলেছিল। এগুলোর সম্মিলিত নাম ছিল ‘মুকাবারাত’। আর এই মুকাবারাত একটি পরিবার ও এক ব্যক্তির শাসন প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিল।

প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ ও তার প্রয়াত বাবা হাফেজ ছিলেন এমন শক্তি, যার উপস্থিতি ছিল সর্বত্র; বিলবোর্ড, পোস্টার, ভাস্কর্যের মাধ্যমে। এই পরিবারের দীর্ঘদিনের দমন-পীড়নের শেষ হলো মাত্র ১১ দিনের সশস্ত্র লড়াইয়ে। গত ৮ ডিসেম্বর বিদ্রোহীদের হাতে পতন হয় বাশার আল আসাদের। সপরিবারে তাকে পালাতে হয় রাশিয়ায়।

দামেস্কের যেদিন পতন হয়, সেদিন ছিল রবিবার। মূলত বহু কাঙ্ক্ষিত এই রবিবারটি আসতে সময় লেগেছে ১৪ বছরের বেশি সময়। ২০১১ সালের মার্চে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে আসাদ বাহিনী যেদিন হামলা চালায়, সেদিন থেকেই আসাদের পতনের গুনতি শুরু হয়ে যায়।

আসাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একাধিক বিদ্রোহী গোষ্ঠী মিলিত হয়ে যায়। অথচ এই গোষ্ঠীগুলোই বহুদিন ধরে সিরিয়ার সেনাবাহিনী ও তারা একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল। বলতে গেলে ২০১৮ সাল থেকে সিরিয়া কেবল নামেই একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র ছিল। এর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ ইদলিব ছিল হায়াত তাহরির আল শাম (এইচটিএস) নিয়ন্ত্রণে। সংগঠনটি আগে জাবাত আল নুসরা নামে পরিচিত ছিল। একই সঙ্গে এটি আল কায়েদার সিরীয় শাখা হিসাবেও কাজ করত।

সিরিয়ার তেলসমৃদ্ধ উত্তর-পূর্বাংশ প্রথমে আইএসআইএস, পরে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সের (এসডিএফ) নিয়ন্ত্রণে ছিল। আজাজ শহরকেন্দ্রিক উত্তর-পশ্চিমাংশ ছিল তুরস্ক সমর্থিত সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মির অধীনে। দক্ষিণাঞ্চলের কিছু অংশে জর্ডান প্রভাবিত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর আধিপত্য ছিল। বাকি অংশ ছিল আসাদের।

ইসরায়েল ও লেবাননের হিজবুল্লাহর মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয় গত ২৭ নভেম্বর। সেদিনই হঠাৎ করে ইদলিব থেকে এইচটিএস ও তার মিত্ররা সিরিয়ার দক্ষিণে হামলা চালায়। খুব দ্রুত শহরগুলোর পতন হতে থাকে। আসাদের সেনাবাহিনী সেই অর্থে কোনও প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি।

অবশ্য পারার কথাও না। কারণ সিরিয়া নামের রাষ্ট্রটি বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, শাসন ব্যবস্থায় দুর্নীতি ও ইসরায়েলি বিমান হামলায় সামরিক অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছিল।

গত ৮ ডিসেম্বর দামেস্ক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বন্ধ হওয়ার ঠিক আগে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ তার ব্যক্তিগত বিমানে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। যে প্রেসিডেন্ট কয়েকদিন আগেই সৌদি আরবে আরব লীগের বৈঠকে অংশ নিয়েছেন, তার পক্ষে এমন দেশত্যাগের ঘটনা ছিল বিস্ময়কর।

আসাদ জাতির উদ্দেশে কোনও ভাষণ দেননি বা তার পদত্যাগ সম্পর্কে কোনও কথাও বলেননি। তার প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ হাজী আল জালালি বিরোধী পক্ষের প্রতি হাত বাড়িয়ে দেন। একটি সংক্ষিপ্ত ও পূর্বে রেকর্ড করা বার্তায় তিনি জানান, তিনি দামেস্কে আছেন এবং পরিবর্তনের সঙ্গে সহায়তা করতে প্রস্তুত। তিনি নাগরিকদের সরকারি সম্পত্তি রক্ষার আহ্বান জানান।

দামেস্কে ক্ষমতা হস্তান্তরের দৃশ্য দেখতে শান্তিপূর্ণই ছিল। কিন্তু এর অনুভূতি ছিল আনন্দ ও ভয়ঙ্কর উভয়ই। মানুষ আসাদ পরিবারের পোস্টারগুলো ছিঁড়ে ফেলে উল্লাস করছিল। অন্যদিকে কান্নায় ভেঙে পড়া নাগরিকেরা একটি নির্জন বিমানবন্দরের দিকে দৌড়ে পালাচ্ছিলেন। সৈন্যরা তাদের চৌকিগুলো ত্যাগ করে। সামরিক পোশাক, সরঞ্জাম, এমনকি ট্যাংকও রাস্তায় ফেলে চলে যায়।

শেষ পর্যন্ত আসলে আসাদের ক্লান্ত সেনাবাহিনী লড়াই করার কোনও অনুপ্রেরণা পায়নি। ওই সরকারের জন্য মৃত্যুকে বরণ করে নিতে চায়নি। দামেস্কের এক বাসিন্দা বলছিলেন, সেদিন তিনি প্রচণ্ড গুলির শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। তবে তিনি নিশ্চিত ছিলেন না, গুলির শব্দ কি উৎসবের জন্য নাকি অন্য কিছুর।

আসাদের কারাগার থেকে মানুষ দৌড়ে বেরিয়ে আসছে, এমন অনেক ভিডিওতে সয়লাব হয়ে যায় সোশাল মিডিয়া। এসব কারাগার ছিল আসাদের শাসনের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতীক। আর সেই প্রতীক খুলে দেয় বিদ্রোহীরা।

দামেস্কের কাছাকাছি অবস্থিত সাদনায়া নামক স্থানে রেকর্ড করা একটি ভিডিও ক্লিপ প্রকাশ পায়। সেখানে দেখা যায়, কালাশনিকভ হাতে সাধারণ পোশাক পরিহিত এক ব্যক্তি একটি দরজা খুলে দিচ্ছেন। আর সেখান থেকে নারীরা বের হচ্ছিল। সেসময় একজন পুরুষকে বলতে শোনা যায়, “বেরিয়ে আসো, বেরিয়ে আসো। ভয়ের কিছু নেই।”

তখন ভেতর থেকে একজন নারী ওই পুরুষদের পরিচয় জানতে চান। উত্তরে একজন পুরুষ বলেন, “আমরা বিপ্লবী। সিরিয়া আমাদের। তুমি ভয় কেন পাচ্ছ? বাশার আল আসাদের পতন হয়েছে। সে চলে গেছে। সে সিরিয়া ছেড়ে চলে গেছে।” এসব কথা শুনে কয়েকজন নারী চিৎকার করে ওঠেন।

বিদ্রোহীরা এমন এক সময় আসাদের ওপর হামলা করে, যখন তার মিত্ররা অন্য সংঘাতের কারণে ব্যস্ত বা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। রাশিয়া ইউক্রেনের সঙ্গে, আর ইরান ও হিজবুল্লাহ ব্যস্ত ছিল ইসরায়েলের সঙ্গে। হামলার নেতৃত্ব দেন আবু মোহাম্মদ আল জুলানি। তিনিই কয়েক বছর আগে জাবাত আল নুসরা প্রতিষ্ঠা করেন। পরে এটি আল কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে হয়ে যায় এইচটিএস।

জুলানি তার নিজের ইমেজ তৈরি করেছেন একজন রাষ্ট্রনায়কের মতো। কারণ তার নেতৃত্বেই সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি, তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টির মতো বহু দল আসাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামে। এমন ঐক্য সিরিয়ায় বিরল।

জাবাত আল নুসরা (আল কায়েদার শাখা) আসাদ বাহিনী ও বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে অনেকদিন ধরেই লড়াই করছিল। দলটির হাতে বহু বিদ্রোহী পরাজিত হয়। পরে এইচটিএস হওয়া দলটি আসলে কট্টর রক্ষণশীলতা ও একটি প্রতিক্রিয়াশীল বিপ্লবের প্রতিনিধিত্ব করছিল। আর একে প্রত্যাখ্যান করেছিল প্রাক-গণতান্ত্রিক বিরোধীরা। এইচটিএস আসলে ‘বিদ্রোহী’ ছিল না। তারা ছিল সেই গোষ্ঠী যারা বিদ্রোহীদের পরাজিত করেছিল। সেই বিদ্রোহী যারা আসাদের বিরুদ্ধে প্রথম রাস্তায় নেমেছিল।

নভেম্বরে শেষে জুলানি সিরিয়ার অনেক ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে এমন বার্তা দেন যে, এইচটিএস ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও বহুত্ববাদ গ্রহণ করেছে। আগামীর দিনগুলো বলে দেবে এই বার্তার সত্যতা। যদিও এই বড়দিনে সিরিয়ার খ্রিস্টানদের বিক্ষোভ করতে হয়েছে ক্রিসমাস ট্রি পুড়িয়ে দেওয়ার কারণে।

জুলানি বলছেন যে, তিনি পরিবর্তিত হয়েছেন। তবে তার একজন সহযোদ্ধা এক সাংবাদিককে জানান, জুলানির ওই পরিবর্তনগুলো কেবল বাহ্যিক। ওই সহযোদ্ধা জাবাত আল নুসরার শীর্ষ পদে ছিলেন। জুলানি ঘনিষ্ঠ জাবাত আল নুসরার সাবেক এক আমির এক সাংবাদিককে সম্প্রতি বলেন, “মানুষটি (জুলানি) মোটেও পাল্টায়নি। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা, হত্যা করা আর দেশ পরিচালনার মধ্যে পার্থক্য আছে।” অন্য সালাফি জিহাদি গোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক রক্তপিপাসা জুলানির জানা।

সিরিয়ায় আসার আগে ২০১১ সালে জাবাত আল নুসরা গঠনের উদ্দেশ্যে তিনি আবু বকর আল বাগদাদির ইসলামিক স্টেটের সদস্য ছিলেন। সেখানে থেকে তিনি ভুলগুলো বুঝতে পেরেছিলেন। সাবেক ওই আমির আরও বলেন, “জুলানি এখন নিজেকে একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দেখছেন।”

নতুন সিরিয়ার সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক। আসাদবিরোধী বিরোধীদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ইতিহাস রক্তাক্ত। তবে সাবেক আমির আশাবাদী। তিনি আশা করেন, জুলানি এইচটিএস ভেঙে দিয়ে এটিকে এবং অন্য গোষ্ঠীগুলোকে নতুন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত করবেন।

আমির বলেন, “জুলানি প্রতি সিরিয়ানকে শাস্তি নিতে পারবেন না। তিনি উত্তরের গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রণে এনেছেন। এখন তার অধীনে ৪০ হাজার যোদ্ধা রয়েছে। সত্যি বলতে, ভয়ের জায়গা হলো দক্ষিণের গোষ্ঠীগুলো। কারণ ওই গোষ্ঠীগুলোর একাংশ ইসরায়েলের সমর্থন পায়।

“তবে তাদের যোদ্ধার সংখ্যা আড়াই হাজারের মতো। জুলানির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো কোনো স্থানীয় সামরিক শক্তি নেই।” জুলানি ব্যর্থ হলে সিরিয়ার অবস্থা লিবিয়ার মতো হতে পারে বলেও তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেন।

বিশেষত সিরিয়ার আলাবিত সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎই নতুন রাষ্ট্রের দিক-নির্দেশনা বোঝাতে পারে। আলাবিত অধ্যুষিত অধিকাংশ এলাকায় নিরস্ত্র মানুষ আসাদের মুর্তি ভাঙচুর করছে, এমন ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। আসাদ আলাবিত বিরোধীদেরও আটক করেছিল। দেখার বিষয় জুলানির বাহিনী শৃঙ্খলা ধরে রাখতে পারে কি না?

আলাবিতরা নতুন সিরিয়ায় নিজেদের অবস্থান নিয়ে আত্মবিশ্বাসী কি না, তা স্পষ্ট হবে সীমান্ত পুনরায় খুলে দেওয়া হলে। এতে নিকটবর্তী সীমান্ত দিয়ে, বিশেষ করে লেবাননে এক বিশাল জনগণের স্রোত দেখা দিতে পারে। লেবানন ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে এবং প্রায় ২০ লাখ সিরীয় শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। সম্প্রতি লক্ষাধিক সিরীয় শরণার্থী এবং অনেক লেবানিজ সিরিয়ায় ফিরে যাচ্ছিলেন হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান যুদ্ধ এড়াতে। তবে এখন, কিছু সম্প্রদায়ের জন্য এই গমনপথ উল্টো হতে পারে। যদিও প্রবাসে থাকা অনেক সিরীয় আনন্দের সঙ্গে ‘মুক্ত সিরিয়ায়’ ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন।

‘মুক্ত সিরিয়ার’ ভৌগোলিক অখণ্ডতা নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনও রয়ে গেছে। তুরস্ক দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়েছে এবং কার্যত উত্তরাঞ্চলের বেশ কিছু এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় নয়শ সৈন্য সিরিয়ায় অবস্থান করছে। তারা উত্তর-পূর্বে কুর্দি নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিচ্ছে। এদিকে আসাদের বিদায়ের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইসরায়েল দখলকৃত গোলান মালভূমির নিকটবর্তী সিরিয়ার কুনেইত্রা শহরে আক্রমণ চালায়।

আসাদের ও সিরিয়ার ইরানের নেতৃত্বাধীন প্রতিরোধ অক্ষ থেকে পিছু হটা ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। এই অক্ষটি সিরিয়া, লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইরাকের কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী, ইয়েমেনের হুতি ও ফিলিস্তিনের হামাস নিয়ে গঠিত ছিল। ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলে হামাসের আকস্মিক আক্রমণের পর এই অক্ষ গুরুতর ধাক্কা খায়। সিরিয়া ছিল হিজবুল্লাহর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ পথ। এটি এখন শত্রুদের দ্বারা পরিবেষ্টিত—ইসরায়েল এবং সেই সিরিয়ান বিরোধীরা, যারা আসাদের শাসনকে টিকিয়ে রাখতে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে লড়েছিল।

বর্তমানে অনেক সিরীয়র মধ্যে উচ্ছ্বাস ও নতুন সম্ভাবনার অনুভূতি প্রবল। রবিবার হাজারো মানুষ দেশের বিভিন্ন শহরে জড়ো হয়। আর প্রবাসে ছড়িয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ মানুষও উদযাপনে শামিল হয়।

জার্মানিতে অবস্থানরত এক সিরীয় শরণার্থী, যিনি একসময় রাজবন্দি ছিলেন, তিনি এক সাংবাদিককে বলেন, “আমাদের আনন্দ বিশাল, বিশাল, বিশাল!” এটি ছিল একটি আনন্দের দিন—একটি উগ্র জাতীয়তাবাদী জাতির জন্য, মুক্ত হওয়া বন্দিদের জন্য। তবে এটি ছিল বেদনা ও শোকের দিনও। কারণ সাম্প্রতিক নির্মম যুদ্ধ এবং আগের বহু দশকের ঘটনায় নিহত ও নিখোঁজ হওয়া লক্ষ লক্ষ মানুষের স্মৃতি তখনও জীবন্ত।

তথ্যসূত্র : নিউ ইয়র্কার।

বেরিয়ে এল ব্যাংক খাতের কঙ্কাল

শেখ শাফায়াত হোসেন

তারল্য সংকট নিয়ে বছর শুরু করেছিল ব্যাংক খাত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে সাত-আটটি ব্যাংকের নিয়মিত নগদ টাকা ধার করতে হচ্ছিল। তাছাড়া ডলার সংকট, রিজার্ভে ওঠা-নামার মধ্যে দিয়ে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো জয়লাভ করে আবারও সরকার গঠন করে।

এর পরপরই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষার্ধের মুদ্রানীতিতে বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল করতে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালু করে। জানুয়ারি একেবারে শেষ দিকে সংকটে থাকা পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যানে পদ ছাড়েন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত।

ফেব্রুয়ারিতে খেলাপি ঋণ কমানো ও দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার বিষয়ে বিশেষ কর্মপরিকল্পনা (রোডম্যাপ) ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ফলে ব্যাংকের সংখ্যা কমে গেলে কর্মীরা চাকরি হারাবে কি না, অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।

এর পরপরই কিছু ব্যাংক নিজে থেকে মার্জ করার ঘোষণা দেয়। এর মধ্যে মার্চ মাসে পদ্মা ব্যাংককে নিজেদের সঙ্গে মার্জ করার ঘোষণা দেয় এক্সিম ব্যাংক। এরপর একে একে বেশ কয়েকটি ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ দেখা যায়।

এসময় ডলারের বাজার গতিশীল করতে ’কারেন্সি সোয়াপ’ পদ্ধতি চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে অস্বস্তি কমে আসে।  

আগের বছরের শেষ দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স ইস্যু শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের শুরুতে ‘কড়ি’ ও ’নগদ’ ডিজিটাল ব্যাংকের কার্যক্রম এগিয়ে নিতে থাকে।  

বছরের মার্চে এসে গণমাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকের ‘লাল, হলুদ ও সবুজ’ তালিকা সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশের জের ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে সাংবাদিক প্রবেশ সীমিত করে আনা হয়।

মার্চ শেষে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকায় পৌছালে তা নিয়েও বেশ আলোচনা উঠতে থাকে। খেলাপি ঋণ ছিল বিতরণ করা মোট ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ।

এপ্রিলে ব্যাংক খাতের আলোচিত ছিল বান্দরবানের থানচি ও রুমায় কৃষি ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকে কুকি চিনের ব্যাংক লুটের ঘটনা।

সোনালী ব্যাংক থেকে ১৫ লাখ টাকা ও কৃষি ব্যাংক থেকে ২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা লুট করে নেয় সন্ত্রাসীরা। চলে যাওয়ার সময় সোনালী ব্যাংক রুমা শাখার ম্যানেজার নেজামউদ্দিনকে জিম্মি কিরে নিয়ে যায় তারা। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পর তাকে মুক্ত করে আনে র‍্যাব। এর ফলে ব্যাংক খাতের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দেয়।

এপ্রিলের শেষ দিকে নতুন করে ব্যাংক একীভূত করা থেকে সরে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ইউসিবির সঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগও তেমন আগায় না। এর মধ্যে শিকদার পরিবারের সব সদস্যই ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ থেকে বাদ পড়ে।   

বছরের মাঝামাঝি এসে ব্যাংক খাতের ঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক করতে সিক্স মানথস মুভিং এভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল- স্মার্ট পদ্ধতিতে আরও কিছুটা পরিবর্তন আনে। যা ১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়।

ওই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোটা আন্দোলন শুরু হলে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো ব্যাংকের লেনদেনও সীমিত হয়ে আসে। রক্তক্ষয়ী আন্দোলেনের মধ্যে দিয়ে ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তন হয়। এরপর ব্যাংক খাতে বড় ধরনের সংস্কারের উদ্যোগের আলোচনা শুরু হয়। তার সঙ্গে বেরিয়ে আসতে থাকে দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংক খাতের প্রকৃত চিত্র।  

অন্তরর্বীকালীন সরকার আসার পর গভর্নর হিসেবে আবদুর রউফ তালুকদারের স্থলাভিষিক্ত হন সাবেক আইএমএফ কর্মকর্তা আহসান এইচ মনসুর। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর ১১টি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পষর্দ ভেঙে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে ৭টির মালিকানার সঙ্গে যুক্ত ছিল বহুল আলোচিত এস আলম গ্রুপ।

সরকার পতনের পর শরিয়াহভিত্তিক বেশ কয়েকটি ব্যাংক থেকে ঋণের নামে বড় অঙ্কের টাকা বের করে নেওয়ার অভিযোগ উঠে। ১০-১২টি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে বসে আছে- কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের এমন বক্তব্যে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিতে শুরু করেন গ্রাহকরা। এতে ব্যাংকগুলো নগদ টাকার তীব্র সংকটে পড়ে। অনেক ব্যাংক গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে হিমশিম খায়।

প্রথমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্যারান্টি স্কিমের মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অন্য ব্যাংক থেকে টাকা ধার নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। তবে ব্যাংকগুলো আস্থা হারানোয় পর্যাপ্ত তহবিল পাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর দাবির মুখে ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ছাপিয়ে ঋণ দিতে চেষ্টা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বছর শেষ হয়ে এলেও দুর্বল হয়ে পড়া ব্যাংক বন্ধ করা হবে কি না, একীভূত হবে কি না, মালিকানা বদল হবে কি না, সে বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট বার্তা পায়নি ব্যাংক খাত। এর মধ্যে নিজেই দুর্বল হয়ে পড়ায় এক্সিম ব্যাংক পদ্মা ব্যাংক মার্জ করা থেকে পিছিয়ে আসে।

এই সময়ে ব্যাংক খাত সংস্কার ও পাচার করা অর্থ উদ্ধারে কমিটি গঠন করা হয়। ব্যাংক খাত সংস্কারে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অনিয়মে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর সম্পদের প্রকৃত অবস্থা জানতে এসব ব্যাংকে ফরেনসিক নিরীক্ষা করার জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান নিয়েগে বিশেষ নীতিমালাও করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

পাশাপাশি মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান নগদের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ব্যাংক খাতকে কৃষ্ণগহ্বরের সঙ্গে তুলনা করেছে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।

ডিসেম্বরের শুরুতে কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় অন্তবর্তী সরকারের কাছে। তাতে বলা হয়, দেশের ব্যাংক খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ এখন ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা, যে অর্থ দিয়ে ১৩টি মেট্রোরেল বা ২২টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত।

আরও বলা হয়, গত দেড় দশকে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে ব্যাংক খাতে, ফলে খাতটি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ব্যাংক খাতের দুর্নীতিবাজরা সবাই ছিলেন প্রভাশালী।

শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি আরও বলেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে রাষ্ট্রীয় সংস্থার সহায়তায় ব্যাংক দখল করা হয়েছে। শুধু একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতেই ৭টি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয়। বড় অঙ্কের অর্থ দেশের বাইরে পাচার করা হয়।

অর্থপাচারের অভিযোগের তীর সবচেয়ে বেশি এস আলমের দিকে। ব্রিটিশ সংবাদপত্র ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আহসান মনসুর বলেন, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার (ডিজিএফআই) সহায়তায় কয়েকটি ব্যাংক দখল করার পর এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তার সহযোগীরা ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে অন্তত ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ‘বের করে’ নিয়েছেন। তারা প্রতিদিনই নিজেদের নামে ঋণ অনুমোদন করেছেন। এসব ব্যাংক দখল করে আনুমানিক ২ লাখ কোটি টাকা (১ হাজার ৬৭০ কোটি ডলার) দেশ থেকে পাচার করা হয়েছে।

এস আলম গ্রুপ একাই ইসলামী ব্যাংকের দেওয়া মোট ঋণের প্রায় অর্ধেক বা ৭৩ হাজার কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংকের ঋণের ৬৪ শতাংশ বা ১৮ হাজার কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৬০ শতাংশ বা ৩৫ হাজার কোটি টাকা ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৯০ শতাংশ নিয়ে গেছে। একইভাবে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও ইউসিবি থেকেও গ্রুপটি ঋণ নেয়।

সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী (জাভেদ) ইউসিবি থেকে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান আইএফআইসি ব্যাংক থেকে, সিকদার পরিবার ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের অর্থ তুলে নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ছে। এর ফলে বাড়ছে খেলাপি ঋণ।

দেশের ব্যাংকগুলোতে গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকায় পৌছেছে। তিন মাসেই ব্যাংকব্যবস্থায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। ব্যাংক থেকে বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশই বর্তমানে খেলাপি হয়ে আছে।

একদিকে গ্রেপ্তারের মিছিল, অন্যদিকে মুক্তির হিড়িক

তাবারুল হক ও আরিফুল ইসলাম

বছরের আলোচিত অভ্যুত্থানের শুরুটা হয়েছিল আদালত থেকেই। এই অভ্যুত্থানে রাজনীতির পট বদলে দেওয়ার পর বিচারাঙ্গনের নেতৃত্বও যায় বদলে। এরপর একের পর এক মামলায় খালাস পেতে থাকে বিচারিক আদালতের রায়ে দণ্ডিতরা। অন্যদিকে গ্রেপ্তার হতে থাকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি-নেতারা।

বছরের শুরুতে আদালতপাড়ায় ছিল বিএনপি নেতাদের ভিড়। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন নাশকতার মামলায় দলটির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও জামিন শুনানি চলছিল। বছরের প্রথম পাঁচ মাস আদালতের চিত্র চিল তেমনই।

গত ৫ জুন সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাই কোর্ট। এ রায়কে কেন্দ্র করে ফুঁসে ওঠে শিক্ষার্থীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে গড়ে ওঠে আন্দোলন। সরকারের দমন-পীড়নে জুলাই মাসের মাঝামাঝিতে এসে সহিংস হয়ে ওঠে আন্দোলন।

তখন আন্দোলন দমনে ধর-পাকড় শুরু করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, নজরুল ইসলাম খান, রুহুল কবির রিজভী, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, জামায়াতে ইসলামীর নেতা মিয়া গোলাম পারওয়ার, আব্দুল্লাহ মো. তাহের, বিজেপি নেতা আন্দালিব রহমান পার্থ, গণঅধিকার পরিষদের নেতা নুরুল হক নুর, গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তির আহ্বায়ক আখতার হোসেনসহ কয়েক হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে আটক রাখা হয়। রিমান্ডে নেওয়া হয় দফায় দফায়।

তাতে আন্দোলন আরও তীব্র হওয়ার পর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিলে রাতারাতি পাল্টে যায় বিচারাঙ্গের দৃশ্যপটও। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেয়। এরপর থেকেই গুম, খুন, হত্যাচেষ্টাসহ নানা অভিযোগে গ্রেপ্তার হতে থাকে আওয়ামী লীগসহ এর মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা।
গত ১৩ আগস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করা হয় মোহাম্মদপুরের মুদি দোকানি আবু সায়েদকে হত্যার অভিযোগে। আসামি করা হয় শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ সাতজনকে। এরপর থেকে একের পর এক মামলা হয় পতিত সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ১৪ দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে চলে গ্রেপ্তারও।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর প্রথমেই গ্রেপ্তার হন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। গ্রেপ্তার হন সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক মন্ত্রী দীপু মনি, প্রতিমন্ত্রী আরিফ খান জয়।
এছাড়া ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাবেক মন্ত্রী টিপু মুনশি, শাহজাহান খান, শেখ হাসিনার উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী,  সাবেক সংসদ সদস্য হাজি মো. সেলিম, পুলিশের সাবেক আইজিপি শহীদুল হক, আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, আওয়ামী লীগ নেতা সাদেক খান, আবদুস সোবহান গোলাপসহ অনেকে। গ্রেপ্তার হওয়ার পর আদালতে নেওয়ার সময় আক্রান্তও হন কয়েকজন। 
অন্যদিকে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরপরই রাষ্ট্রপতির আদেশে মুক্তি পান বিএনপি চেয়ারপারসন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। এরপর উচ্চ আদালতের রায়েও তিনি খালাস পান দুর্নীতির দুই মামলা থেকে। তার ছেলে দলের ভারপ্রাপ্ত তারেক রহমানও বেশ কয়েকটি মামলা থেকে খালাস ও অব্যাহতি পান।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, রুহুল কবীর রিজভী, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, মো. হাফিজ ইব্রাহীম, তারেকের (এপিএস) মিয়া নুরুদ্দিন অপুকে বিভিন্ন মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এছাড়াও অব্যাহতি পান জামায়াত নেতা গোলাম পরওয়ার, গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হকসহ আরও অনেকে।
গত ৩ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়াকে মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ভুয়া জন্মদিন পালন, যুদ্ধাপরাধীদের মদদ দেওয়াসহ মানহানির পৃথক পাঁচ মামলা থেকে খালাস দেয় আদালত। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে মারা যাওয়া ৪২ জনকে হত্যার অভিযোগে খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে করা মামলা গত ২৪ অক্টোবর খারিজ করে দেয় আদালত।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে করা গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা থেকে গত ২৪ অক্টোবর ও বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি দুর্নীতি মামলা থেকে গত ২৭ নভেম্বর খালেদা জিয়া অব্যাহতি পান। গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা থেকে বিএনপি নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও অব্যাহতি পান। তবে অন্যান্য ১২ আসামি বিচারের মুখোমুখি হন। বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি মামলা থেকে খালেদা জিয়ার সাথে অব্যাহতি পান ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও আলতাফ হোসেন চৌধুরী। তবে চার আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।
জিয়াউর রহমানকে ‘জাতির পিতা’ ঘোষণা দেওয়ার অভিযোগে শাহবাগ থানায় দায়ের হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা থেকে তারেক রহমানকে ২২ সেপ্টেম্বর অব্যাহতি দেয় ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল। ১০ কোটি ৩১ লাখ টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগে করা মামলা থেকে ২৭ নভেম্বর তারেক রহমান অব্যাহতি পান। একই দিন কর ফাঁকির অভিযোগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) করা মামলা থেকেও খালাস পান তারেক রহমান।
দুর্নীতির মামলা থেকে খালাস পান মির্জা আব্বাস, খন্দকার মোশাররফ হোসেন। রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের সময় ভাংচুরের অভিযোগে বেশকিছু মামলা থেকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, রিজভীসহ অনেকে অব্যাহিত পেয়ে যান। সাবেক মন্ত্রী শাহজাহান খানের মিছিলে বোমা হামলার অভিযোগে মামলায় খালেদা জিয়াসহ ২৬ জনকে অব্যাহতির আদেশ দেয় ঢাকার আদালত।
গত ১ জানুয়ারি শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছিল শ্রম আদালত। তবে আপিল করার শর্তে ড. ইউনূসসহ আসামিদের ১ মাসের জামিন দেওয়া হয়। এরপর চলতি বছর দুদকের করা অর্থ আত্মসাৎ, মানিলন্ডারিং মামলায় বিচারের মুখোমুখি হন ড. ইউনূস।
তবে অন্তবর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ১১ আগস্ট দুদক মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করে। আদালত আবেদন মঞ্জুর করে মামলা প্রত্যাহারের আদেশ দেয়।

দেড় যুগ আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে গ্রেপ্তার সালাম পিন্টুর পাশাপাশি কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন বিতর্কিত ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুনসহ অনেকে। জঙ্গি নেতা হিসাবে দণ্ডিত মুফতি জসীমউদ্দীন রাহমানীও মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে আসেন।

বড় মামলার বড় আসামিরাও খালাস

বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলাটিতে বিচারিক আদালতের রায়ে দণ্ডিত সবাইকে খালাস দেয় হাই কোর্ট। গত ১ ডিসেম্বর দেওয়া এ রায়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলের প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, তৎকালীন উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ৪৯ আসামি খালাস পান। ২০ বছর আগে মামলাটি নতুন করে তদন্তের পক্ষেও মত দেয় আদালত।
আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে ১৪ আসামির সবার মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল বিচারিক আদালত। গত ১৮ ডিসেম্বর হাই কোর্টের রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ পাঁচ আসামি খালাস পান। এ মামলায় পলাতক উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়ার পাশাপাশি সাজা কমেছে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সাবেক পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার সাহাব উদ্দিন আহাম্মদ, সাবেক উপপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর লিয়াকত হোসেন, সাবেক মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান, হাফিজুর রহমান, দীন মোহাম্মদ ও হাজি আব্দুস সোবাহান।

অন্যদিকে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় গত ২৭ নভেম্বর হাই কোর্টের রায়ে খালাস পান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ৬ বছর আগে ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর খালেদা জিয়াসহ চার আসামিকে সাত বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দিয়ে রায় দিয়েছিল ঢাকার জজ আদালত। চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার রায়ের আগে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল খালেদা জিয়াকে। ওই বছরের ৩০ অক্টোবর হাই কোর্টে এ মামলার আপিল শুনানি শেষে সাজা বেড়ে হয় ১০ বছর। ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি হাই কোর্টের দেওয়া এ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পেলে দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করেন তিনি। এ মামলাটি এখন আপিল বিভাগে বিচারাধীন।

বাংলাদেশের ক্রিকেট নক্ষত্রের বিস্মরণীয় বছর

শিহাব উদ্দিন

২০২৪, স্মরণীয় একটি বছর হতে পারত সাকিব আল হাসানের জন্য। অথচ এই বছরটিই হয়ে উঠেছে বিস্মরণীয়। কারণ আর কিছু নয়, যে খেলা দিয়ে নিজেকে বিশ্বে পরিচিত করেছেন, সেই ক্রিকেট সরে যাচ্ছে দূরে। টেস্ট থেকে অবসর, দেশের মাটিতে খেলতে না পারা, দেশের বাইরেও অনিশ্চিত হয়ে ওঠা। ক্যারিয়ারের শেষ বেলায় তা ভাবনারও বাইরে ছিল সাকিবের।

দেশের ক্রিকেটের সেরা বছরের শুরুতে পা দিয়েছিলেন রাজনীতির মাঠে। সেরার মতোই ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন। সাকিবের সামনে খুলে গেল রাজনীতিতে সেরা হওয়ার দুয়ার। অথচ ভাগ্যের উপহাস! সাত মাসের মাথায় এখন দেশেই পা ফেলতে পারছেন না সাকিব।

গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাগুরা-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সাকিব। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে পৌনে ২ লাখ ভোট বেশি পেয়ে। সাংসদ হয়ে মাগুরাকে অন্য উচ্চতায় তুলতে চেয়েছিলেন যেমন ক্রিকেট বিশ্বে তুলেছেন বাংলাদেশকে।

সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি সাকিবের। সাংসদ পরিচয়ে খুব বেশি দিন দেখাও যায়নি তাকে। সাকিবের রাজনীতির নৌকা তীর ছাড়ার পর থেকেই উত্তাল ঢেউয়ের ঝাপটায় দুলে উঠেছে বারবার। প্রথম ধাক্কা ছিল চোখের সমস্যা।

নির্বাচনে জয়ের পরপরই বিপিএলের ব্যস্ততা আসে সাকিবের। রংপুর রাইডার্সের হয়ে মৌসুমটা খুব বাজে কেটেছিল। আসর শুরুর আগে চোখের চিকিৎসা করিয়ে আসেন ইংল্যান্ড থেকে। কিন্তু পুরোপুরি সেরে উঠেননি। মার্চে তাই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাত্র একটি টেস্ট খেলেছিলেন পুরো সিরিজে। কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে ফিরে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে একটি সেঞ্চুরি স্বস্তি দিয়েছিল সাকিবকে।

তবে সুখের বাতাস সাকিবের নৌকার পালে খুব বেশি সময় হাওয়া দেয়নি। ওই একটি ম্যাচের রান ছাড়া ব্যাটিংয়ে বাজে ফর্মেই ভুগছিলেন বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডার। এই পড়তি ফর্ম নিয়ে খেলতে যান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। সেখানে নিজের ও দলের ব্যাটিং ব্যর্থতায় একাদশে সাকিবের অপরহার্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

ক্যারিয়ারে অনেকবার সমালোচনার অতলে পড়ে গিয়ে দুর্দান্ত বেগে ফিরে এসেছেন সাকিব। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে সুপার লিগের ম্যাচ জিতিয়ে আরও একবার উদাহরণ হয়েছিলেন। বিশ্বকাপের পর তার আসল দুঃসময় শুরু।

আসর শেষে কানাডার গ্লোবাল টি-টোয়েন্টি লিগে খেলতে যান তিনি। ততদিনে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাল। ছাত্ররা মারা যাচ্ছেন কোটা সংস্কারের দাবি জানাতে গিয়ে। কিন্তু মাশরাফী-সাকিবদের ‘দর্শক’ ভূমিকায় প্রবল প্রশ্ন ওঠে।

এমন সময় কানাডায় এক প্রবাসী ছাত্রকে “আপনি দেশের জন্য কী করেছেন?” পাল্টা প্রশ্ন করে এবং সাধারণ ছাত্রদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার দিনে পরিবারের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল ছবি ফেইসবুকে পোস্ট করে পরিস্থিতি তাতিয়ে দেন সাকিব।

তরুণ সমাজ মুখ ফেরায় তার দিক থেকে। সময়ের ব্যবধানের কারণে কানাডার রাত বাংলাদেশের দিন। ৫ আগস্ট সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সঙ্গে তার সাংসদ পরিচয়টাও হারিয়েছেন।

এরপর সাকিবের নৌকা আর শান্ত দরিয়া পায়নি। যে সাকিবকে তরুণরা মাথায় তুলে রাখত, তারাই এই ক্রিকেটারের নামে অনির্বচনীয় স্লোগান দেয়। সেসব লিখে যায় মিরপুর স্টেডিয়ামের দেয়ালে। তার কিছু এখনও দৃশ্যমান মিরপুর স্টেডিয়ামের দেয়ালে।

সবচেয়ে বড় ধাক্কা ছিল হত্যা মামলায় আসামির তালিকায় সাকিবের নাম। আন্দোলনের সময় ঢাকায় মারা যাওয়া এক পোশাক শ্রমিকের হত্যার নির্দেশদাতার দোষ চাপানো হয় তার ওপরও।

ওই ঘটনার পর পাকিস্তান ও ভারতে দুটো সিরিজ ছিল বাংলাদেশের। দুটোতেই খেলেছেন। ভারতের কানপুরে টেস্টের প্রথমদিন ঘোষণা দেন মিরপুরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সাদা পোশাকে ইতি টানার। কিন্তু সাকিবের ইচ্ছা আর পূরণ হয়নি।

ছাত্রদের প্রবোল বিরোধিতায় দেশের মাটিতে খেলার সুযোগ শেষ হয়ে যায়। নিরাপত্তার স্বার্থে সাকিবকে দেশে না আসার পরামর্শ দেওয়া হয় সরকার থেকে। আমেরিকা থেকে দুবাই এসেও ফিরে যেতে বাধ্য হন তিনি। ৩৭ বছর পেরিয়ে আসা সাকিব কবে দেশের মাটিতে খেলবেন, তার নিশ্চয়তা এখনও মেলেনি।

উইন্ডিজ সিরিজে খেলার ইচ্ছা জানিয়ে কিছু শর্ত দিয়েছিলেন সাকিব। হত্যা মামলা থেকে নাম সরিয়ে নেওয়া, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া ও দেশে ফিরে আবার নিরাপদে দেশ ছাড়ার সুযোগ চেয়েছিলেন। কিন্তু বিসিবির পক্ষে এই নিশ্চয়তা দেওয়া অসম্ভব। তাই সাকিবের জন্যও দেশের বাতাসে শ্বাস নেওয়া আপাতত অসম্ভব হয়েই থাকছে।

আলোচিত সাকিব সমালোচিত হয়েছেন অনেক ঘটনাতেই। কিন্তু কখনই কোণঠাসা হননি। এক নির্বাচন তার জীবনের গতিপথ উল্টে দিয়েছে। যে নৌকায় পা রেখে তার নাবিক হওয়ার স্বপ্ন ছিল, সে নৌকা ডুবে এখন তীরহীন দরিয়ায় ভাসছেন সাকিব।

এ বছরের জুলাই যেমন ৩১ এ শেষ হয়নি। বাংলাদেশ ক্রিকেট নক্ষত্রের বিস্মরণীয় এই বছরও শেষ হওয়ার নয় যেন!

দ্রোহকালে অস্বস্তি সংস্কৃতির অঙ্গনে

রুদ্র হক

দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের হাওয়া বদলের বছর ২০২৪। বছরের শুরুতেই নির্বাচনকালীন রাজনৈতিক উত্তেজনা পেরিয়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গন যখন থিতু হতে যাচিছল, তখনই কোটাবিরোধী আন্দোলনে সরগরম হয়ে ওঠে সারাদেশ। সেই আন্দোলন ঘিরে সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর গড়ে ওঠে। আন্দোলন রূপ নেয় অভ্যুত্থানে, তাতে পতন ঘটে সরকার। অভ্যুত্থানের পরও এই অঙ্গনে স্থবিরতা কাটেনি।

গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের তারকা ও শিল্পীদের একটি বড় অংশই জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। এমপি হওয়ার দৌড়ে মিছিলে শামিল হন অনেকে, তা না পেলেও ‘নৌকা-নৌকা’ সরব করতে মাঠে ছিল বড় অংশ। তা নিয়ে শিল্পীদের কারও কারও মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও তা চাপা পড়েই ছিল। জুলাই আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে তা প্রকাশ্য রূপ নেয় হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ‘আলো আসবেই’র মাধ্যমে। সেখানে দেশের সুপরিচিত তারকাদের অনেকেই যুক্ত ছিলেন এবং সরকারবিরোধী ফেইসবুক স্ট্যাটাস ও আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের তারা চিহ্নিত করছিলেন। তা দেখে প্রতিবাদ জানান অন্যরা। এনিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বাহাস জলতে থাকে। অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর জনরোষের মধ্যে প্রযোজক সেলিম খান ও তার সন্তান চিত্রনায়ক শান্ত খানকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় চাঁদপুরে। গানবাংলা টেলিভিশনের কার্যালয়ও পোড়ে ক্ষোভের আগুনে। গ্রেপ্তার হন এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কৌশিক হোসেন তাপস।

অভ্যুত্থানের পর ১৫ আগস্ট অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিতে গিয়ে হেনস্থার শিকার হন। অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতি শিল্পকলায় কাজে যোগদান করতে গিয়ে হন লাঞ্ছিত। শিল্পকলার মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী পালিয়ে গেলেও গ্রেপ্তার হন অভিনেত্রী শমী কায়সার।

সংস্কৃতি অঙ্গনে বড় পরিবর্তন সূচিত হতে থাকে সংশ্লিষ্ট বড় বড় পদগুলোতে নানা পরিবর্তন ও কমিটি পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে। পুনর্গঠিত কমিটিগুলো স্থান পেতে থাকেন জুলাই আন্দোলনে সরব ও সক্রিয় নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলীরা। সেন্সরবোর্ড বদলে সার্টিফিকেশন বোর্ড। বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, নজরুল একাডেমি, বিটিভিসহ নানা প্রতিষ্ঠানে পুরনো কর্তাব্যক্তিদের বদলে নতুন নিয়োগ ঘটে। সংস্কৃতি উপদেষ্টা হয়ে আসেন নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।

অভ্যুত্থানের পর সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাটি ঘটান শিল্পকলা একাডেমির নতুন মহাপরিচালক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ। কিছু মানুষের প্রতিবাদের মুখে শিল্পকলার মঞ্চে ‘নিত্যপুরাণ’ নাটক চলার সময় প্রদর্শনী বন্ধ করে দেন তিনি। বরেণ্য অভিনেতা মামুনুর রশিদকে নাটকে অভিনয় থেকে বিরত থাকতে বলেও সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। এরপর বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের অনুষ্ঠানমালার শিরোনাম ‘বিজয়ের উৎসব’ এর বদলে ‘ডিসেম্বরের উৎসব’ করে সমালোচনার মুখে আবার তা বদলাতেও বাধ্য হন তিনি।

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ভারতবিরোধী অবস্থান প্রকট হওয়ায় ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ভারতীয় শিল্পী কাউকে অতিথি হিসাবে দেখা যায়নি এবার। রাহাত ফতেহ আলী খান ও আতিফ আসলামের মতো পাকিস্তানি শিল্পীদের কদর বাড়তে থাকে কনসার্ট আয়োজনে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা ফোক ফেস্ট ও বেঙ্গল ক্লাসিক মিউজিক ফেস্ট আয়োজন এর আশা জাগলেও তা অজানা কারণে থেমে যায়। বিএনপি আয়োজন করে ‘সবার আগে বাংলাদেশ’-শিরোনামে বিশাল এক সার্বজনীন কনসার্ট। শিল্পকলা একাডেমিও জুলাই গণভ্যুত্থানের চেতনা ছড়িয়ে দিতে ও সংস্কৃতি অঙ্গনকে চাঙা করতে সারাদেশে নানামুখী আয়োজনে অনুষ্ঠান আয়োজন করতে থাকে। দীর্ঘদিন পর কনসার্টে ফেরেন বিএনপি সমর্থিত শিল্পী হিসেবে পরিচিত বেবি নাজনীন, কনকচাঁপা ও আসিফ আকবর।

তবে অস্থিরতার কারণে চলচ্চিত্র নির্মাণ ও মুক্তিও স্থগিত হতে থাকে একের পর এক। সেই বিবেচনায় সিনেমা হল মালিকদের চূড়ান্ত ক্ষতির বছর ছিল ২০২৪। বছর শেষে বেশকিছু চলচ্চিত্র মুক্তি পেলেও তা ব্যবসায়িক সাফল্যের ছোঁয়া পায়নি। বছরের শুরুতে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম হিট ছবি ‘তুফান’ নিয়ে এলেও বছর শেষে ফ্লপ গেছে ঢাকাই ছবির কিংখ্যাত শাকিব খান অভিনীত ‘দরদ’। ওটিটি প্লাটফর্মও খুব একটা ছন্দ খুঁজে পায়নি এ বছর।

অভ্যুত্থানের আগে শিল্পীদের মধ্যে বিভেদের যে পর্দা তৈরি হয়েছে, তা কাটেনি এখনও। এর মধ্যে অভ্যুত্থানের চাওয়া আর পাওয়ার হিসাব মেলাতে গিয়ে হতাশার সুরও ফুটে উঠছে বারও কারও কণ্ঠে। সব মিলিয়ে সংস্কৃতিক অঙ্গনে অস্বস্তি রয়েই গেছে।

বছরের শুরুতে ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। বিরোধী দলবিহীন এই নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের আগ্রহ কেমন ছিল, তা তুলে ধরে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের কামুচান শাহ উচ্চ বিদ্যালয়ের এই ছবি। ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তবে টিকেছিলেন সাত মাস। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
সাকিব আল আল হাসান; দেশসেরা এই ক্রিকেটার রাজনীতিতে নেমে সংসদ সদস্য হওয়ার পর গত ১০ জানুয়ারি নিয়েছিলেন শপথ। তবে অভ্যুত্থানের পর তার এমপি পদের অবসান ঘটে সাত মাসেই। এখন দেশের মাটিতে খেলাটাও তার অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
সাদিক এগ্রোর আলোচিত সেই ছাগল। গত জুন মাসে কোরবানির ঈদের সময় ১৫ লাখ টাকায় ছাগলটি কেনার ঘোষণা দিয়ে ভাইরাল হয়েছিলেন মুশফিকুর রহমান ইফাত নামে এক তরুণ। তাতে ইফাতের বাবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা মতিউর রহমানের সম্পদ নিয়ে ওঠে আলোচনা। এই ছাগলের জন্য তার চাকরিও খোয়াতে হয়। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
বছরের দ্বিতীয় মাস ফেব্রুয়ারির ২৯ তারিখ রাতে আগুন লাগে বেইলি রোডের বহুতল বাণিজ্যিক ভবন গ্রিন কোজি কটেজে। সেখানে ছিল কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁ। সেই আগুনে প্রাণ হারান সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, প্রবাসীসহ ৪৪ জন। ওই অগ্নিকাণ্ডের পর অনিরাপদ ভবনে থাকা রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ করতে অভিযানে নেমেছিল সরকার। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তা থেমে যায়। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
গণভবনে গত ৩ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে এটাই তার শেষ ছবি, যা পিআইডি সরবরাহ করেছিল। ৪ আগস্ট তিনি আরেকটি অনুষ্ঠানে অংশ নিলেও তার ছবি পিআইডি থেকে আসেনি। তার একদিন পরই অভ্যুত্থানে দেশ ছাড়তে হয় তাকে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দুর্নীতির মামলায় দণ্ড থেকে খালাস পান খালেদা জিয়া। ৭ ডিসেম্বর ভিডিও বার্তা দিয়ে নয়া পল্টনের জনসভায় যোগ দেন তিনি।
ব্যাটারি রিকশা বন্ধ করায় এই বছর দুই দফায় আন্দোলনে নেমেছিল চালকরা। গত ১৯ নভেম্বর হাই কোর্ট ঢাকায় ব্যাটারি রিকশা নিষিদ্ধ করলে বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করে তারা। ২১ নভেম্বর তাদের বিক্ষোভের সময় অ্যাম্বুলেন্সও পড়েছিল আটকা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের আঁচ টের পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকেও। রাখাইনে জান্তা সরকারের বাহিনী আর বিদ্রোহী আরাকান আর্মির গোলাগুলি গোটা বছরজুড়ে থেকে থেকে আতঙ্ক ছড়ায় টেকনাফে। ওপারে বিস্ফোরণের প্রকট শব্দ গত অক্টোবরে ফাটল ধরায় টেকনাফ সীমান্তের এই বাড়িতে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
ঢাকায় কলেজে কলেজে মারামারির ঘটনা এবার হয়ে উঠেছিল আলোচিত। ‘মেগা মানডে’ ঘোষণা করে ২৫ নভেম্বর ডেমরার মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা চালিয়ে তছনছ করে কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা। আগের দিন সুপার সানডে ঘোষণা করে হামলা হয়েছিল কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
বছরের শেষ দিকে এসে আগুন লাগে দেশের জনপ্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে। ৭ নম্বর ভবনে আগুন লাগে ২৬ ডিসেম্বর ভোররাতে। সেখানে পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের দপ্তর। এই আগুন লাগানো হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে উপদেষ্টাদের মধ্য থেকেই। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

প্রচ্ছদ : মোতাসিম বিল্লাহ পিন্টু